খেলাধুলার অকাল মৃত্যুতে আসামী কি ইন্টারনেট-ই ? : তন্ময় সিংহ রায়।

0
8708

খেলাধুলা হল শরীর ও মন গঠনের অন্যতম উৎস। মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের এক অপরিহার্য দলিল বলা যেতে পারে।
বছর পঁচিশ কি তিরিশ হবে,
প্রকৃতির বুকে বৈচিত্রময় খেলাধুলা’র দুরারোগ্য ক্যান্সার তখনও পড়েনি ধরা!
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রাত’টা জেগে ওঠার কিছু পরপরই একদল ছেলে তড়িঘড়ি করে নেমে পরলো মাঠে ফুটবল নিয়ে।
বাব্লু, দিনেশ, ধীমান, রাজু, পাপাই, সুভাষ আরো কত কে!
পালানুযায়ী আজ রাজুও কাঁচা ছোলা এনে সুসম্পন্ন করেছে তার দায়িত্ববোধের পরিচয়।
মাঠের একপাশে প্রায় ঘর্মাক্ত সুজিত তাঁর বোনের লাফান দড়িটায় একটানা সাতাত্তর’টায় তখনও গতিশীল।
রীতা, রাখি ও সীমা, তিন বান্ধবী’র বন্ধুত্বের বন্ধন’টা বেশ ভালোই শক্ত, তা অনেকেই জানে বৈকি!
ঠিক করলো, আধ-ভাঙা ফেদারেই আজ শীতের সকাল’টা কোনোরকমে চালিয়ে দেবে তিনজন।
আগামীকাল প্রত্যেকেই একটা করে নিয়ে আসবে নতুন ফেদার।
ব্যাডমিন্টন’টা রাখি’র একটু বেশিই প্রিয়!
দামি র‍্যাকেটও বাবার কাছ থেকে সে জন্মদিনে পেয়েছে উপহার হিসাবে!
অতঃপর মাঠের পাশের একটা প্রায় বাগান গোছের ছোটো সবুজ ভুখন্ডে তাঁরা মন রাখলো ব্যাডমিন্টনে।
সদ্যজাত দিন’টা মুক্ত বাতাস ও স্নিগ্ধতায় ভরা তার অবর্ণনীয় সৌন্দর্য নিয়ে যেন দুহাত বাড়িয়ে ডাকছিল এদেরকেই, খেলার একান্ত সাথি হবে বলে।
দুমদাম পড়ে, প্রাণখোলা চিৎকার ও আনন্দ উন্মাদনার মধ্যে দিয়ে দৌড়-ঝাঁপে সম্পূর্ণ হল তাঁদের খেলা।
ফলাফল, পাপাই’রা হেরেছে আজ তিন গোলে!
এরপর স্কুলে’র পালা।
সিংহভাগের মন হয়ে উঠলো উদাস!
কোনোরকমে স্কুলের কর্তব্য পালন করে, বাড়িতে এসেই খেয়ে না খেয়ে হাফ্ প্যান্টে উর্ধ্বশ্বাসের এক দৌড়, ধীমানের সম্পূর্ণ শরীরটাকে পৌঁছে দিল পাশের বাব্লুদের পাড়ার কাঁচের গুলি খেলার আড্ডায়। পকেটে করে খান পঁচিশ গুলি সে নিয়েও এসেছে বটে।
আগের দিন-ই দশটা জিতেছে সে।
পাশের মাঠেই বড় দাদারা খেলছে ভলি বল।
মাঝে মধ্যেই মনের ইচ্ছে’টার হাতছানি দিয়ে যায় তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার অণুপ্রেরণা।
আর একটু বড় হলেই সে পারবে ভলিবল ছুঁতে।
সুভাষ আর দিনেশকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা।
ও ওরা তো নিতাইদের বাড়ির পিছনে লাট্টু খেলবে সকালেই বলেছিল।
কাঁচের গুলি খেলতে খেলতেই হঠাৎ ধীমানের খারাপ হওয়া মনটা’র প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখে-মুখে!
সূর্য’টা যদি বুঝতো তাঁর মনের কষ্ট’টা ঠিক কোথায়? তো হত না এতটা নির্দয়!

খেলাধুলার যে ভিটামিনে একসময় বিপুল পুষ্টি গ্রহণ করতো অধিকাংশ বিশেষত টিনেজারদের দেহ ও মন, সে পুষ্টিই আজ আই. সি. ইউ তে!
আজ আর আগের মতন ফুটবল খেলে বেশিরভাগই নষ্ট করেনা সময়, হয়তো বা এ প্রজন্মকে এর উপকারিতা অনুভব করতে হয় বই পড়ে!
ইচ্ছে জাগলেও সাথিহীনতায় তা পরিণত হয়না বাস্তবে! অতৃপ্ত বাসনাটা ছটফট করে ভিতরেই!
কাঁচের গুলিগুলো আজ ডাইনোসরের অজানা দেশে!
সেই স্কিপিং, হাডুডু, কানামাছি, লুকোচুরি আজ সাথিহীনতার যন্ত্রণা’র অনলে দগ্ধে মুমুর্ষুপ্রায়!
সেই দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠটা’র দুঃখী জীবন চলছে আগাছা, তৃণ ও তৃণভোজীদের নিয়েই! মাঠটার বুকও আছে, কিন্তু সে বুকে মৃত্যু হয়েছে শুধু আজ চিৎকার ও দৌড়-ঝাঁপের!
সদ্যজাত দিন’টাও আজ বড়ই নিঃসঙ্গ ও অসহায়!

ইন্টারনেটের যুগে আমরা অভিভাবকরাই ভালোবাসা ও স্নেহ, মায়া-মমতার বন্ধনে আটকা পড়ে, অবচেতন মনে স্মার্ট ফোনে নেশাগ্রস্ত করে নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে চরম ক্ষতি করছি আমাদের টিনেজারদের! ভালোবেসে ছেলে-মেয়েদের আমরাই উপহার দিচ্ছি ও দিয়ে চলেছি ‘বিকিরণ’, যার ভবিষ্যত পরিণাম, ‘হার্ট অ্যাটাক’, ‘ব্রেইনের নিউরনের ক্ষতি, কোষ দুর্বল এমনকি ক্যান্সার’, ‘স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা’, ‘কিডনি’র সমস্যা’ ইত্যাদি।
খেলাধুলার উপকারিতা বোধকরি আমরাও চলছি ভুলতে/না ভুলেও আমরা হয়ে পড়েছি চুড়ান্ত অসচেতন!
আমাদের ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি আমাদেরকেও উচিৎ যথাসম্ভব খেলাধুলা করা।

শৈশব ও কৈশোর বঞ্চিত হচ্ছে বন্ধুত্বের মেলামেশার মধুর বন্ধন থেকে! ক্রমশঃ তারা হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার এও এক উল্লেখযোগ্য কারণ বলাই যুক্তিসংগত।
আমাদের উচিৎ খেলাধুলার উপকারিতা যেমনঃ- খেলাধুলা আমাদের,
(১) হৃদপিন্ডের সুস্থতা দান (২) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ। (৩) উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করা, (৪) কোলেস্টেরল লেভেলকে ঠিক রাখা,(৫) রক্তের সঞ্চালনকে ঠিক রাখা, (৬) রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে বৃদ্ধি।
(৭) মাংসপেশি ও হাড় গঠনে সহায়তা।
(৮) মনকে আনন্দ দান, (৯) শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা প্রদান ও দক্ষতা বৃদ্ধি প্রভৃতি সম্পর্কে বিশেষত টিনেজারদের বোঝানো, সাথে নিজেদেরকেও।
আমাদের উচিৎ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের মুহুর্তে বিশেষত টিনেজারদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন থেকে যথাসাধ্য দুরে রাখা ও খেলাধুলার সুষ্ঠ পরিবেশ গড়ে তুলে তাদের আগ্রহী করে তোলা।
আমাদের সচেতনতাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দেবে অধিক সুষ্ঠ, সবল, সতেজ, রোগ ও আত্মকেন্দ্রিকতাবিহীন একটা সুন্দর জীবন ও সর্বোপরি সমাজ।।