মহান শূন্যতার গভীরে আত্মসমর্পিত এক নিরীহ লাজুক কবি যাঁকে আমরা তৈমুর খান নামে চিনি । যাঁর আকীকায় নামকরণ করা হয়েছিল তৈমুর আলি খান । ইতিমধ্যে তিনি সারা বাংলা জুড়ে খ্যাতি লাভ করেছেন । বাংলা কবিতার জগতে তিনি একজন শক্তিমান কবি । কবিতা ও কবিকে নিয়ে নানা আলোচনা – সমালোচনার স্রোত একইভাবে বয়ে চলেছে আজও ।
কে কবি আর কে কবি নয় । কোনটা কবিতা কোনটা নয় । কবিতা আসলে কী ! কী তার মাধুর্য ! সে তর্ক থাক । কবি তৈমুর খান কীভাবে দেখেছন , তাঁর বিশ্বস্ত চোখ দুটির দৃষ্টি নির্মল অনুভূতিকে স্পর্শ করেছে,স্পর্শ তর্জমায় যে শব্দ ও শব্দমালায় পাঠককে স্তব্ধ করে ,শিহরন ও মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছেন ,আমরা সেই বিষয়ে আলোকপাত করব । দেখব কবি কীভাবে কবিতায় শূন্যতার অন্ধকারের ভিতর আলোক কণার জন্ম দিয়েছেন তাঁর কলমের শিল্প কারিকুরিতে ।
যে আন্তসারশূন্যতা থেকে কবি তৈমুরের কবিতার জন্ম তা হয়তো বাংলার কবিতা রসিকজনের অনেকে জানেন ।হয়তো জানেন শিশু কবির প্রাতরাশ প্রসঙ্গে । বিস্ময়ের সীমা থাকে না যখন দেখি , শিশু কবি ,অথবা কিশোর কবি সকালে ঘুম থেকে উঠে একমুঠো মুড়ি অথবা একটি লেরু না পেয়ে বাবা-মায়ের চোখের জলে প্রাতরাশ সেরে নেন ।
অভাবের চিরন্তন মহান দৃশ্য ও তার শূন্যতার বেদনাবোধগুলির সাথে জোতদার বাড়ির গোয়াল পরিষ্কার করা থেকে যেকাজগুলি মাহিন্দাররা করে থাকে , সাথে গাল-মন্দ, নির্যাতন উপরি পাওনা জুটত নিয়মিত কবির মন ও শরীরে । অসহায়তার নির্মম শিকার কবি মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন তাঁর ঈশ্বর কবিতার কাছে । প্রশ্ন তোলেন , কোথায় পা রাখব ?
নির্বাকের পরামর্শে কথা কই
হাঁটতে গিয়ে দেখি পা নেই
নির্যাতনের অন্ধকার , অভাবের অন্ধকার তাঁর কাছে আশীর্বাদের ফুল হয়ে ঝরে পড়ে ।
কতরকমের যে অন্ধকার আছে পৃথিবীতে
সব যেন সাদা কাগজের পৃষ্ঠায় অক্ষর হয়ে গেছে ।
তাঁর নিজের সত্য উপলব্ধির অক্ষরগুলি আমাদেরকে এক নতুন ভাবনার বোধে পৌঁছে দেয় ।
তৈমুর খান বীরভূম জেলার পানিসাইল নামে এক সবুজে ঘেরা গ্রামে জন্মেছিলেন ১৯৬৮’র ২৮ জানুয়ারি । তাঁর বাবা জিকির খান , মা নওরাতুন বিবি । অভাবের সংসার হলেও লেখা-পড়া শিখতেই হবে এমন একটা জেদ ছিল বাল্যকাল থেকেই ।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ে বি-এ অনার্স ও পরে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম-এ এবং পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন ২০০১ সালে । চরম আর্থিক সংকট মাথায় নিয়ে তাঁর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটাই ছিল আরও বিস্ময়ের । চারপাশে জড়িয়ে ধরেছে অভাব ।হ্যাঁ ভাতের অভাবই ! পেটের ক্ষুধার কাতরতা তাঁকে শিখিয়েছে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয় ।
শূন্যতার গভীর অন্ধকার তাঁর প্রর্থনা শুনেছে। তাঁকে দিয়েছে এক অমূল্য সম্পদ । তাঁর হাতে নেচে উঠেছে সেই সম্পদ । যার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলা জুড়ে । তিনি অ-ভাবকে ভাবে ধরেছেন শব্দের ফুল দিয়ে আর তিনি হা-হাকারের কবি হয়ে উঠেছেন—
রাত বাড়লে চাঁদে ডুবে যাই । এখনো অতীত
হইনি । তবু দ্যাখো অতীতের চরাচর জেগে
আছে চাঁদের উঠোনে । অই জল ।
শব্দেরা আসে যায় । কখনো ফুল হয়ে , কখনো নারী হয়ে , কখনো এই চরাচরে বসন্ত হয়ে । কবি জীবন সঙ্গিনী চান । তখন ২০০৫ । দর্শন শাস্ত্রে এম এ পাশ করা সাবিনা ইয়াসমিন তাঁর সাথে জুটি বাঁধেন । নানা অনুভবের জন্ম ও প্রকাশ ঘটে—
রাস্তার মেয়েটি একবারও গর্জে ওঠে না
তার মনিবন্ধে আশ্চর্য চাঁদ উঠেছে
উরুর ফাঁকে টলটলে রোদ
বুক দেখা যাচ্ছে না , বুকের ওপর রং-বেরঙের শালুক-পদ্ম
এইসব স্বপ্নেরা আসে বিক্ষোভহীন, অভিযোগহীন, একেবারে হৃদয়ের সহজাত । সারাদিনের পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যা আসে । ক্ষুধার আগুন জ্বলে । দারিদ্র টপকে যাবার অনেক পথ । বাঁকাটেরা সোজা সরল , কিন্তু কবি চান একটি মসৃণ পথ । তাই দিনমজুরের কাজ ছেড়ে তিনি মুম্বাই চলে যান কাজের সন্ধানে । সেখানেও শরীরক্ষয়ের পরিশ্রম । ফিরে আসেন কবি ।কিন্তু যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ কই ? তখনও সেই কবিতা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় । হাহাকার থেকে শান্তি এনে দেয় —
খা শূন্য , আমাকে খা
আছি বা নেই
দুই দিকে তোর হাঁ
ঘুম ভাঙল এখানেই
জলের ওপর উবুড় হয় ছায়া
ওপর দিকে পা …………….
……………….
ও মেঘ, ও চাঁদের সাদা, এ শূন্যতায় ঘুরছি একা
বাতাস খেয়ে
খা শূন্য , আমাকে তুই আমার স্বপ্ন অস্ফুট সব গোপনতা
নির্বোধ অন্তক্রিয়াশীল শূন্যতার কাছে এই তাঁর প্রর্থনা । সেই প্রর্থনায় নিবেদনের ফুল ভিন্ন , ভিন্ন তার সুগন্ধ , পাঠক তার ঘ্রাণে মুগ্ধ । তারপর তাঁর অক্ষরে অক্ষরে , শব্দে শব্দে , বাক্যে বাক্যে আলোর বিকিরণ , আলোময় চেতনার প্রকাশ ……..
সরল চাঁদের অক্ষরে কে লেখে জ্যোৎস্নার নাম
আলপনা , তুই আলো জ্বেলে পড়িস এখনো ?
প্রিয় পাঠক , শব্দ কতটা ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পারে তৈমুরের কবিতায় তা বোঝা যায় । তাঁকে চিনে নিতে পারি আমরা । কারণ তিনি জীবনের কবিতা লেখেন । অথচ তাঁর জীবন নেই । নেই রাজ্যের বাসিন্দা তিনি । অভাব অভাব আর অভাব । ছাত্র পড়িয়ে পেট চলে না । চাকরি অনিশ্চিত । …………….. জীবন বলতে
কিছুই নেই , হা হা হিম নিশুতি রাত খায় চাঁদ
সমুদ্রে একাকী নেমে গেল ঢেউ,দুয়ারে কেউ
নিরর্থক দাঁড়ায় , বন্ধ ঘরে তার ছায়ার মরীচিকা
রক্ত ক্ষরণের পবিত্র শূন্যতায় নত হয়ে থাকেন কবি কবিতার খাতায় । ছবি আঁকেন, মানুষের ছবি , সমাজের ছবি , প্রেমের ছবি , ভালোবাসার ছবি , বিরহ যন্ত্রণার ছবি আর সময়ের কাছে অপেক্ষার হাত পাতেন—
কেবল দাঁড়িয়ে আছি , অপেক্ষা এখন আমারই নাম
কোনো অন্তরাল নেই,ছদ্ম পরিভাষা নেই
দু’বাহুই ডাল-পালা,গাছের শেকড় হয়ে
বিঁধছে হৃদয় ।
একটি ক্ষীণ আলোকবেণু বেজে উঠল । মুচকি হেসে জানান দিল আলোর ফুলকি । সময় প্রর্থনা মঞ্জুর করল ১৯৯৮ এ । নলহাটি হীরালাল ভকত মহাবিদ্যালয়ে অংশকালীন শিক্ষকতার ডাক পেলেন কবি । বত্রিশ বছরের লড়াই শেষে কিছুটা শান্ত হল অভাব । তারপর আর ও চার বছর পর ২০০২ এ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকাপাকি একটা চাকরির ব্যবস্থা হল ।
কবি শ্বাস নিলেন প্রাণ ভরে । বেকার জীবনে তিনি অধ্যাপক নোজফুল হকের সাথে একটি পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন । আর ততদিনে তাঁর একটি কাব্য গ্রন্থ দৌড় প্রকাশনী প্রকাশ করে ফেলেছেন । তখন ১৯৯৪ সাল । সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ “কোথায় পা রাখি ”।
সংসারের অভাব হয়তো ঘুচল , কিন্তু মনের অভাব ঘুচলা না । কয়েক বছরেই চাকরি জীবন বন্দিশালা বলে মনে হল । তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন । সেখানেও তিনি জীবনহীনতায় ভুগতে থাকেন । এ জীবন যেন তার জীবন নয় । কেমন কষ্টে তিনি আছেন জানালেন নিজেই তাঁর একমাত্র বন্ধু কবিতার কাছে —
তবু এখানে জীবন নেই
মরীচিকা ছেয়ে আছে সব
পিপাসা বেড়েই যাচ্ছে
শুকনো কান্নার ভেতর
কৃত্রিম বিলাস
স্বপ্নের ভেতর কাঁপা কাঁপা
জ্বর । চাপা অশান্তির
রোগশয্যা পাতা
আমিষ জীবনের ক্রূর হাসি
জীবনের যাত্রাপথে সময় এক বড় শিক্ষক । যাপনের বাঁধাধরা নিয়মের মাঝে শিখিয়ে দেয় সেখান থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে হয় । মুক্তি পাওয়া মানে তো কবিতার ঘরবাড়ি বানানো । সেই সময়ই তৈমুরকে চিনিয়ে দেয় অনিশ্চিত যাপনচিত্রের নির্মম বোধগুলির অনুভূতি ও বিশ্বাসের দরোজা । ভিতরে ভিতরে আলোর বিকিরণ ঘটে , অক্ষরেরা নেচে ওঠে । কবিতার কাছে কবি নিজেকে নিবেদন করেন । বাস্তবের ছবিগুলি কবিতায় শিল্প হয়ে ফুটে ওঠে —
এখন শুধু নিজের উনান,ছোট্ট ভাতের হাঁড়ি
আর সকালবেলার বাজার করার থলে
আমাকে জাগায় এসে
জলতোলা বালতি স্নান সেরে নিতে বলে
একটু দেরি হলে কলমটি চ্যাঁচাবে
সাদা খাতা স্ত্রীর মতো
যত পার শব্দ বীর্য ঢালো ।
তৈমুরের গোটা জীবনটাই কবিতা । তাঁর জীবন ভাঙনের রক্তপাত,বিচিত্র সামাজিক দৃশ্যপট , অনিবার্য নিয়মতান্ত্রিকতার পীড়ন , বৈষম্য সবই তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে নিজে নিজেই উঠে এসেছে কবিতার শরীর জুড়ে । কবিরও জীবন ছুঁয়ে থাকা দৈনন্দিন যেমন , ঘর , উঠান , উনান , বাইরে কলের জল এ সবের তাপ – যন্ত্রণার বন্দি জীবন থেকে সরে এসে নিজের ভিতরে প্রবেশ করেন । তারপর শূন্য বাতাস তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কবিতার উদ্যানে ।
রাতের চাঁদের গান , জ্যোৎস্না স্বরলিপি
পুরুষ কিছুটা গায় , কিছুটা নারী
প্রিয় পাঠক কবিতাটি গোটাটা পড়ে নেবেন একবার ,তৈমুর খানকে জানতে,জানা যাবে কিছুটা ; পিপাসা বেড়ে গেলে তাঁর কবিতার প্লাবনে ঝাঁপ দিন। কবিতার স্রোত তরঙ্গে যে মাধুর্যের বসতি সেখানে পৌঁছে যাবেন । মধুচন্দ্রিমার মতো উপলব্ধি আপনাকে পুলকিত করবে —
“মাছরা নতুন জানালায় আসে
আর জলশব্দ রেখে যায়
আমরা তখন শুধু ভেজার অসুখে
উষ্ণ হই
চারিদিকে জলশব্দ ছড়িয়ে পড়ে
রাতের বিছানায় পাহারা দেয় রাত
দাড়ি,কমাহীন জীবনকে মনে হয়
জলের পরাগ —”
কবি জীবন লিপিকার হয়ে ওঠেন এক অমোঘ আত্মচেতনায় । চেতনার গভীরতম বিন্দুরেখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে অক্ষরের গেরস্থালি । তিনি দেখতে পান জীবনলিপির সূত্র—
সব বালুচর ঘুমের কিরণ মেখে জেগে থাকে
চাঁদের উপকূলে
মিথ্যেরাও এখানে সুস্পষ্ট সব
হ্রদ থেকে উঠে আসে স্নানের মেয়ে
অর্ধেক শরীর তামা , পিতলের মতো মনে হবে
হয়তো এমনই ফলক তার চিরদিন যৌবনের শব
বিজ্ঞাপন হয়ে ফেরে ।
আমরা পড়তে পড়তে চিনে ফেলি নৈশসভ্যতার সত্যিকারের বঞ্চনা ও পীড়নের ছবি । তারপর ?
“ তারপর আরও দূরে হেঁটে আসি
অনেক জ্যোৎস্না ছিল, কেবলই সমুদ্র
কেবলই উদ্দাম প্রাণের উপমা
কালস্রোত মুছে যেতে যেতে তোমার
নীরব বেলা পড়ে যায়
স্পষ্ট অক্ষরের পাশে মানব মিছিল
অমোঘ অবশ্যম্ভাবী কোলাহল
এগিয়ে আসে আগুনের মতো
প্রতিটি প্রাণকণা পৃথিবীর দ্বীপময় জেগে ওঠে
এত বিবর্ণ আকাশ কেন আজ ?
কোনো ফুলেই ভাষা নেই ।
শুধু একা চাঁদ ক্ষুধিত মানুষের হাতে
শুয়ে আছে
বাতাসে এখন কোথাও উড়ে যাচ্ছে ছাই
মেঘে মেঘে ভাসে , ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নজরুল !
কবি তৈমুর তাঁর নিজস্ব ভাষায় কবিতা লেখেন । তাঁর স্বর অন্যকোনো স্বরের সাথে মেলে না । তাঁর ভাষা সাধারণের মুখের ভাষা । যে ভাষায় দুঃখ বেদনা , হাসি-আনন্দ মরমে মরমে ধ্বনি কাতর করে তোলে । তাই কবি কখনো কখনো দশমীর চাঁদকেও জীবনের সাথে মিলিয়ে দিতে পারেন ।
“জন্মের স্টেশন থেকে সব ট্রেন মৃত্যুর দিকে ছাড়ে”
জীবনের সুখ যন্ত্রণার ক্লান্তি কখনো কখনো কবিকে নৈঃশব্দ্যের ভিতর ঠেলে দেয় । চারপাশে তখন মহাশূন্য । শূন্যতাই তো কবির আশ্রয় স্থল । শূন্যতার অন্ধকারই তাঁকে বেঁচে থাকার পথগুলি দেখিয়ে দেয় । কবি খুঁজে পান কবিতার সুন্দর রূপ—
এই বেঁচে থাকার মানে খুঁজতে খুঁজতে
সারাদিন শ্রমিক হয়ে যাই
সমাজের মৃতদেহ থেকে পোকা ও পঙ্কিল
বেছে বেছে তুলে আনি কিছুটা সময়
যে ঘর বানাই , যে নারীর কাছে সঙ্গম প্রর্থনা করি
নিরাপদ বিশ্বাসের সন্তান কামনায়
সেখানেও ঢুকে যায় শয়তান ঈশ্বর !
কবি তৈমুর খান আবংলা সাহিত্যের কাব্যধারার একটি নির্মল স্রোত । যার বিচরণভূমি স্বাধীন । ইচ্ছেমতো জনপদ গড়ে ও ভাঙে । তাই তিনি স্বতন্ত্র । তিনি সৌখিন কবি নন । সময় বিনোদনের কবি নন । অবসর যাপনেরও না । যাপনযন্ত্রণার ভিতর যুগযন্ত্রণার ছবি তাঁর কবিতার সম্পদ । তাঁর মহান পংক্তিগুলি তাঁকে এই সময়ে একজন শক্তিমান কবি হিসাবে চিহ্নিত করেছে । বিপর্যয়, নির্যাতন হতাশার শূন্যতায় মহান অন্ধকারের ভিতর তাঁর কবিতাগুলি পবিত্র আলোকশিখা ।
যা দৃশ্যকল্প, উপমা, চিত্রকল্প ও শব্দ প্রতীকের ব্যবহার বাক্যের ভাব তরঙ্গের অনুরণন সৃষ্টি হয়েছে । মানব মনের আবেগ,অনুভূতি,দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন কবিতাগুলির অভিব্যক্তির মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে । দৃশ্যের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ প্রকৃতি রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি মূল্যবোধ দর্শন সবটাই তাঁর কবিতার ফসল হয়ে উঠেছে । তৈমুরের সাদামাটা জীবন ,সৎ সহজ সরল উচ্চারণে তির্যক, বিদ্রুপ দিয়ে গাঁথা কবিতার শব্দ কাঁর জীবন যাপনের মতো সহজ, সরল এবং সাহসী —
নিজেকে নিঃশব্দের কাছে রাখি
তবুও প্রপাত আসে উন্মাদ শিখরে
তবুও প্রলাপ বয়ে যায় জনান্তিকে
হিংস্র সাম্রাজ্য জুড়ে নিঃস্ব জাগরণ
কোথাও ঘুমের দরোজা নেই
তবু সারারাত নিঃসঙ্গ যাতায়াত করে ………
কবির কথা কবি নিজেই বলেছেন ।
কবি-বৃক্ষ এবং উত্তরাধিকার প্রেমবীজ প্রবন্ধে নিজেকে দৃঢ প্রত্যয়ে ব্যক্ত করেছেন । তাঁর বলার ধরনটাও প্রশংসার দাবি রাখে । তিনি যখন গদ্যকার তখন পাঠকদের এক ভিন্ন প্রাপ্তির দরোজা খুলে যায় । আমরা খুঁজে পাই কবির ভঁড়ার ঘরের চাবি ।
তাঁর কয়েকটি লাইন……”কবিতা মনের সত্য উপলব্ধি । সে আনন্দ হোক বেদনা হোক, সেখান হতেই শব্দ গ্রন্থনায় অনুভবে সঞ্চারিত হয় । এই আছি অথবা নেই, এই থাকা না থাকার থেকেই যাবতীয় দৃশ্যমান , অদৃশ্যমান ,কল্পনা অকল্পনা , চেতন অচেতন, দিন অন্ধকার সমস্তই ঘুরপাক খেতে থাকে । এই অনুভূতির প্রকাশ ঘটে কবিতায় ।”
কবির গদ্য ও ছোট গল্পের কথা এখানে বলা গেল না । অন্যত্র সুযোগ পেলে বলার চেষ্টা করব । তবে তাঁর গদ্যশৈলী ও চমৎকার । তাঁর ছোটগল্প গ্রন্থ “জীবনের অংশ” দারুণভাবে মুগ্ধ করে । “জারজ” উপন্যাসটিও বর্তমান সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ।
কবির কাব্যগ্রন্থ :
১) কোথায় পা রাখি ১৯৯৪ দৌড় প্রকাশনী ২)বৃষ্টিতরু ১৯৯৯ দৌড় প্র ৩) খা শূন্য আমাকে খা ২০০৩ কাঞ্চিদেশ প্রশনী ৪) আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা ২০০৪ কাঞ্চিদেশ ৫)বিষাদের লেখা কবিতা ২০০৪ কপোতক্ষ প্রকাশনী ৬) একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ ২০০৭ তবু অভিমান প্রকাশনী ৮) তরঙ্গের লীলায় দেখি মাধুর্যের বসতি ২০০৮ বর্ধমান খবর প্রকাশনী , ৯)জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর ২০০৮ তরুণাস্থি প্রকাশন ১০) প্রত্নচরিত ২০১১ দৌড় প্রকাশনী ১১) এই ভোর দগ্ধ জানালায় ২০১০ সহযাত্রী প্রকাশন ১২) বৃত্তের ভেতরে জল ২০১৭ নিজস্ব ১৩) জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা ২০১৭ বার্ণিক প্রকাশনী ১৪) নির্বচিত কবিতা ২০১৭ আবিষ্কার প্রকাশনী ১৫) স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি ২০১৮ স্রোত প্রকাশনী ১৬) উন্মাদ বিকেলের জংশন ২০১৮ প্রিয় শিল্প প্রকাশন ১৭) নির্ঘুমের হ্রস্বধ্বনি ২০১৮ স্রোত প্রকাশন ১৮) ইচ্ছেরা সব সহ মরণে যায় ২০১৮তাবিক প্রকাশন ১৯) আত্মসমাহিত পিরামিড ২০১৮ বোধ প্রকাশন ২০) স্বয়ংক্রিয় বিষাদের পর ২০১৮ স্রোত প্রকাশনী ২১) আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা ২০১৯ বইতরণী
গদ্য গ্রন্থ
১) কবির ভাঁড়ারের চাবি ২০১৮ বার্ণিক ২) মুক্তির দশক নব্ব ই এর কবি ও কবিতা ২০০৯ সহযাত্রী ৩) আত্ম সংগ্রহ ২০০৯ দে পাবলিকেশন ৪ ) আত্মক্ষরণ ২০১৬ আবিষ্কার ৫) জারজ উপন্যাস ২০১৯ বার্ণিক ৬) জীবনের অংশ ২০১৯ আবিষ্কার ।