২০ এপ্রিল মধ্যরাতে যখন এই লেখা পোস্ট করছি তখন দেশের করোনা চিত্রটি ঠিক এরকম–
আক্রান্ত ১৬১০০
মৃত্যু ৫১২
গোটা বিশ্বে করোনা আক্রান্ত সংখ্যা পঁচিশ লক্ষ ছুঁতে চলেছে।
মৃত্যু এক লক্ষ ষাট হাজার।
শুধু ইউরোপেই মৃত এক লক্ষ।
আমেরিকায় প্রায় ৪০ হাজার।
এই ঝড় কালই কমে যাবে, পরশু পৃথিবী আবার নিজের ছন্দে ফিরবে, এমন কোনও খবর নেই।
শুধু বলা যেতে পারে, যতক্ষণ না পর্যন্ত মারণ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে ততক্ষণ দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
সামাজিক দূরত্বই আপাতত বাঁচার পথ। যিনি বাড়িতে থাকবেন, তিনি বেঁচে যাবেন।
তদুপরি এই সময় বিশ্বের করোনা সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করে ১৩০ কোটির দেশ ভারত যদি মনে করে ভাল জায়গায় আছি, তাহলে মূর্খের স্বর্গে বাস করা হবে।
ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকিয়ে ভারত সরকার অথবা কোনও অঙ্গ রাজ্যের সরকার স্বস্তি অনুভব করলে ঐতিহাসিক ভুল হবে।
করোনা যেভাবে উন্নত বিশ্বকে গ্রাস করেছে, সেই গ্রাফ যদি সমীক্ষা করা হয়, তাহলে বোঝা যাবে, সংক্রমণ যারাই হালকাভাবে নিয়েছে, তারাই ডুবেছে।
আজ থেকে দেশে অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় চালু হতে চলেছে। খুলছে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা অফিস। নানা সেক্টরেও কাজ শুরু হবে। একশো দিনের কাজ করার ক্ষেত্রেও ছাড় ঘোষণা হয়েছে। উৎপাদন শিল্পে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। খুলছে চটকল।
মূলত যে সব এলাকায় করোনার প্রভাব নেই, সেই সব এলাকা চিহ্নিত করে ছাড় দেওয়া হলেও অফিস খুললে মানুষকে রাস্তায় বেরতে হবে।এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তা ভাবার অবকাশ আছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৪ এপ্রিল প্রথম পর্ব মেটার পর ৩ মে পর্যন্ত লকডাউনের সময়সীমা বাড়িয়েছিলেন।
সমস্যা হলেও দেশের মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এমনকী, ফের যদি সীমা বর্ধিত হয়, তা–ও মানার প্রস্তুতি রয়েছে সর্বত্রই।
কিন্তু যদি এভাবে সব খুলে যায়, তাহলে সর্বনাশ হতে পারে।
করোনা ভারতে দ্বিতীয় স্টেজে না তৃতীয় স্টেজে সেটা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। যদিও প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যু।
যেভাবে নতুন নতুন এলাকা থেকে খবর আসছে, তাতে মনে করা হচ্ছে গোষ্ঠী সংক্রমণ কিছু কিছু এলাকায় দানা বাধছে। এখন বিদেশযোগ অথবা ভিন রাজ্যযোগের খবর নেই।
মহল্লায় ছড়াচ্ছে। এটাই সবচেয় ভয়ের সময়।
এখন দূরত্ব বাড়ানোর সময়।
তাহলে ৩ মে–র আগে এত ছাড় কেন?
ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে লকডাউন একটি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা।
প্রায় এক মাস সব কিছু স্তব্ধ রেখে আমরা সুফল পেয়েছি।
২৫ মার্চ থেকে যদি দেশ স্তব্ধ না হত, তাহলে পাড়ায় পাড়ায় কান্নার রোল পড়ে যেত। যেহেতু সেই ছবিটা দেখতে পাচ্ছি না, তাই কি হালকাভাবে নিতে শুরু করেছি?
শেষ মূহর্তে তীরে এসে তরী ডুববে না তো?
ভাবতে হবে।
এদিকে কেরল মডেল নিয়ে খুব আলোচনা।
মজার কথা হল, বিশ্বকে বিপদের ফেলেছিল যারা, চিনের ইউহান প্রদেশই পথ দেখাচ্ছে।
তারা এবার করোনামুক্তির পথে।
এক চিত্র ভারতে।
কেরল রাজ্যে প্রথম করোনা ধরা পরে।
সেই কেরল এবার করোনামুক্ত হতে চলেছে।
নতুন করে আক্রান্ত কমছে।
এই রকম চললে খুব শীঘ্রই কেরলের মানুষ গর্ব করে বলতে পারবে তারা করেনাকে হারাতে পেরেছে।
সেই পথে গোয়াও।
কেরলের এই সাফল্যের মূল কারণ, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে তারা করোনার চেনকে কেটে দিতে পেরেছে।
বাম গণতান্ত্রিক সরকার রক্ষমতায়। অনেকেই বলছেন, সব কৃতিত্ব কমিউনিস্ট সরকারের।
নিশ্চয়ই।
এত বড় কাজ যারা করতে পারে, তাদের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
পাশাপাশি যদি কেউ এও বলেন,
চিনেও তো কমিউনিস্টরা ক্ষমতায়।
তাহলে গোটা মানব জাতির সংকট দেখা দেওয়ার দায় সেই দেশের কমিউনিস্টদেরই ওপর বর্তায়। ভালো নিলে খারাপটাও নিতে হবে কমরেড।
এই যুক্তি ফেলে দেওয়া যাবে না।
কিন্তু বাস্তবিকই কেরল এই কাজটা করতে পেরেছে নিজেদের জাতির রক্তের জোরেই।
যে রাজ্যের ৯৬.১১ শতাংশ মানুষ সাক্ষর, মহিলাদের হার ৯২.০৭ শতাংশ,
তারা সমাজিক সঙ্কটে নেতৃত্ব দেবেন না তো কারা দেবে।
চেতনা আছে বলেই বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে কেরলবাসী।
শুধু সামাজিক দূরত্ব নয়, দ্রুত টেস্ট, চিকিৎসা সমস্ত হয়েছে কঠোর অনুশাসনে।
আমি মনে করি, যদি ইউডিএফ সরকারও ক্ষমতায় থাকত, একই ফল হত।
আমাদের রাজ্যে এত কিছুর পর প্রতিদিন বাজার করা, ব্যঙ্কে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। ভিড় করে মসজিদে নামাজ পরতেই হবে অনেককে।
তারা বুঝছেনই না, যত ভিড় তত করোনা।
সরকারের ঘারে বন্দুক রেখে আমরা পালায়। নিজেরা দায়িত্ব পালন করিনা।
কেন কেরল পেরেছে শুনবেন?
২৬.৫৬ শতাংশ মুসলমান গত এক মাস মসজিদে ভিড় করেননি।
১৮.৩৮ শতাংশ খ্রিস্টান চার্চে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন।
জাগ্রত পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে নেই বাকি ৫৪ শতাংশ হিন্দুর ভিড়।
একটা জাতির সব ধর্মের মানুষ লড়াইয়ে শামিল।
ভাবা যায়।
তাই ‘কেরল’ ‘কেরল’ করলে হবে না। নিজেদের আগে নিজেদের ভাল করে দেখি।
সাড়ে তিন কোটির জনসংখ্যার কেরলের সঙ্গে, সাড়ে দশ কোটি মানুষের বাংলার অমিলগুলোই বেশি।অনেক সমস্যা আমাদের।
তবু, সবাই তাকাব কেরলের দিকেই।
সারা পৃথিবী তাকাচ্ছে।
বিবিসি কেরলের সাফল্য নিয়ে বিরাট স্টোরি করেছে।
মার্কিন চ্যানেলগুলো খোঁজ করছে, কোন পথে আরব সাগরতীরের অপূর্ব সুন্দর রাজ্যটির করোনাজয়।
বারো বছর পর পর কুরুঞ্জি ফুল ফোটে মুন্নারের পাহাড়তলে।
সেটা যেমন রহস্য, তেমনই রহস্য একের পর এক বিপর্যয় কী করে রুখে দেয় পিটি উষার দেশ।
গত বছর বন্যায় ভেসে গিয়েছিল রাজ্যটি। ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগেনি।
গ্রীষ্মের দাবদাহ জ্বালা মুছিয়ে বর্ষা আসে এই কেরলের মাটিতে প্রথম।
তারপর ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ায়।
করোনা মুক্তিতেও তারা প্রথম।
এবারও মুক্তির বৃষ্টির হয়ে পথ দেখাক
বাকি দেশকে।
কিংশুক প্রামাণিক
20 এপ্রিল 2020y