উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রীটের বিগত যৌবনা সেই বাড়িটা, যার আয়তন বিশাল, কিন্তু রূপ ফেরানোর আয়োজন বিশেষ করা হয় না। পলেস্তারা বিশেষ প্রয়োজনে কোনমতে গায়ে চাপানো হয়, রঙের তাগিদ অনুভব হয় না, রুপোর অভাবের দোহাই দিয়ে। উঠোনের একধারে টাইম কল। টালার জল যখন সাপ্লাই হয়, পাশের চৌবাচ্চায় পাইপ লাগিয়ে দিতে ভুলে গেলে জল অবিরাম গড়িয়ে গিয়ে উঠোনে একরাশ শ্যাওলা পড়ে এবং এটা প্রায়ই ঘটে। উঠোনে নারকেল মালা ঘষতে ঘষতে বড়ো গিন্নির মুখে গালাগালির তোড়। দোতলার বারান্দা থেকে তীব্র ভাষায় প্রতিরোধ। বারোয়ারি কাজে কার আর উৎসাহ হয় ? অথচ যতদূর জানি, বারোয়ারি শব্দের ব্যুৎপত্তি গত অর্থ বারোজন ইয়ার অর্থাৎ বন্ধুদের আড্ডা। আজকাল সার্বজনীন অর্থেও বারোয়ারি কথাটার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এবাড়ির লোকেদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক। কেউ কারো বন্ধু নয়| তবে হয়তো সকলের ফান্ডে সংসার চলে বলে এই বাড়ির অবস্থা – ব্যবস্থাকে সার্বজনীন বলা যায়। সুকিয়া স্ট্রীটের এই বাড়ির ফটকে একটুকরো পাথরে লেখা, সরকার বাড়ি। রোদ- বৃষ্টিতে ঝাপসা, তবুও পড়া যায়। কিন্তু পাড়ার বাসিন্দারা কেউ সরকার বাড়ি বলে না।সসেটা এ বাড়ির গিন্নিদের ক্রেডিট। সরকার বাড়ি সম্পর্কে আড়ালে মুচকি হেসে বলে সার্কাস বাড়ি। বলবে না কেন, কত রকমের ট্রাপিজের খেলা চলে এখানে! যে যার স্বার্থ সিদ্ধি পলিশড ওয়েতে করে যাচ্ছে। দড়ির দোলনে কসরত দেখাচ্ছে সরটা খাবে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে। গতরটি নাড়াতে আপত্তি। অথচ তারা হাঁড়ি আলাদা করতে নারাজ, হাঁড়ি ঠেলতেও নারাজ। সেজ গিন্নি একটু ব্যতিক্রম। তবুও বড়ো গিন্নির ঘাড়ে সংসারের পুরো জোয়াল। বড়ো গিন্নির ক্লান্তি আসে। বিক্ষোভ বাড়ে। অগ্নুৎপাতও হয়। কিন্তু রুপো, রূপ আর বিদ্যের গুমোর চুপ করে থাকে না। ফলে যার যা নিজস্ব যুক্তি, তার ভিত্তিতে ঝগড়া হয়। সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত কাজের ভাগ নিয়ে, নিজের ছেলে মেয়ের ভাগের দুধ বেশি পরিমাণে তড়িৎ গতিতে নিজস্ব ঘরে পাচার করা নিয়ে , স্বামীর খাওয়ার সময় বড়ো মাছটা পরিবেশন করে বলা, ” এই যাঃ বুঝতে পারলাম না, তোমার পাতে বড়ো পেটিটা পড়ে গেল, বলা নিয়ে। ” বুবাই তো আবার বড়ো পেটির পিস ছাড়া খেতে পারে না।” বুবাই এ বাড়ির বড়ো গিন্নির শিব রাত্রির সলতে, তার ওপর ডাক্তার।” হাসপাতালে কত রোগী, কতো খাটুনি, কতো জটিল রোগ নিয়ে মাথা ঘামানোর জটিলতা।” মুখে আওড়ায় বটে মেজ জা, তবে কাজটুকু সারে পোলাইট পদ্ধতিতে। তাতেও এ বাড়িতে ঝগড়া হয় অসভ্যের মতো। মেজো জা বলে, “মাঝে মাঝে হাতায় সুবিধা মত ভালো মাছ যদি ডুবন্ত ঝোল থেকে উঠে পড়ে, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করার কি আছে? “প্রশ্ন ওঠে না বড়ো জায়ের আর চুপ করে থাকার। মেজো দেওরের খাওয়া হয়ে গেলে টিপ্পনি,
” রোজ হাতায় ওঠে পেটি লাফ দিয়ে.” ধূমধাড়াক্কা। এটাও ট্রাপিজের খেলা। খাওয়ার মতো সংবেদনশীল কারণে চেঁচামেচি অমানবিক। আর যৌথ সংসারে অমানবিকতা মানায় না। সেটা জানা থাকলেও মানা যায় না। যদিও মানা হয় কোন কোন সময়, তবুও বিকল্প হিসেবে অন্য কোন অজুহাতে ঝড় উঠতেই পারে। বিষম বাহুদের সংসার যে। হয়তো বড়ো গিন্নি মেজাজ খোয়ালো ছেলের পেটিটা মেজো দেওরের পাতান্তর হওয়ার কারণে, ” এই ক্ষেন্তি, তোকে বলেছিলাম না, এঁচোড় কুটতে।” ” কি করব বড়ো বৌদি, আসা মাত্তর সেজো বৌদি বলল, আজ সোমবার, মনে আছে তো ক্ষেন্তি, মঙ্গলবার মোচা খেতে নেই। চটপট কুটে দে। তোর সেজো দাদাবাবু নিজের হাতে এনেছে সাধ করে. বড়ো বৌ পৃথুলা দেহ নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে হাঁক মারে। গলার স্বর উদারায় নয়, তারায়, ” বলিহারি যাই তোর সেজ বৌ, কি আক্কেল তোর, এঁচোড়ের এক জায়গায় পচন ধরেছে, চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি রে!” মেজ বৌকে যা বলা যায় না, বড়ো লোকের বেটি বলে, সেজ বৌকে তা অনায়াসে বলা যায়। ডাক্তারের মতো নোবেল প্রফেশনের অজুহাতে মাছের বড়ো পেটির ব্যবস্থা যা হয়েছে বড়ো গিন্নির ছেলের, সেটা হাতছাড়া হতে বসেছে বড়ো লোকের জামাই মেজ দেওরের জন্যে, মেজ জায়ের কূটনৈতিক চালে, তাতে যে লক্ষ্য কে বাদ দিয়ে উপলক্ষ্য নিয়ে বড়ো গিন্নির গলার সার্কাস খেলা উদারায় নয়, মুদারায় নয়, একেবারে তারায় চড়বে.. সেটা তো বলাই বাহুল্য। আর সেজ জা চুপটি করে থেকেছে, তা’ও তো নয়। তার বাপের রুপো না থাক, নিজের রূপের গুমোর ষোল আনা ছেড়ে আঠারো আনা। সেও গুরুজন বলে রেয়াৎ করে না। এক কথা, দু কথা, চার কথা। সেজ দেওর দাড়ি কামাচ্ছিল। দু-গাল পরিষ্কার, ঠোঁটের কাছে আর চিবুকে ফেনা। অসমাপ্ত ক্ষৌর কাজ। মেজাজ বিগড়েছে। অফিসে পরশু কাল লেট হয়েছে। আজ লেট হলে ক্যাজুয়েল লীভ থেকে একদিনের কোটা বাদ।” কি হচ্ছে কি ভোরের বেলা থেকে কাকচিল বসতে দেবে না এ বাড়িতে? বড়ো গিন্নি বলে,” ভোর তুমি কখন দেখলে সেজ ঠাকুর পো! বেলা দশটা নাগাদ ওঠো। প্রাতকৃত্য সারো, তারপর ভাতের থালাখান কাছে টেনে সদ্ব্যবহার করে বাসস্ট্যান্ডে দৌড় মারো। বলি, আফিসে কিছু বলে না রোজ লেট রোজ লেট। সেজ ঠাকুর পো মুহূর্তে তীর বেঁধা পাখি। বিদ্যুৎ গতিতে সঠিক ঠিকানায় গামছা কাঁধে। রূপসী বৌ ছাড়বে কেন, কলঘরের বাইরে থেকে আক্ষেপ করে, বাবা কার হাতে সম্প্রদান করেছে আমাকে,… ভীতু কাপুরুষ, ভ্যাবাগঙ্গারাম, কেলানে কার্তিক.. আরো কতসব বিশেষণ। কলঘরের কলে জল তখন পড়ছে ফুলফোর্সে। এ বাড়ির সেজ ছেলে জানে কলঘরের পর্ব চুকলে পোশাক পরতে আর ভাতের থালা ফাঁক করতে তার লাগবে মিনিট পনেরো সময়। খাওয়ার পরিবেশনের সময় সেজ বৌয়ের কেঁদে ফোলানো লাল চোখ তাকে কষ্ট দেবে, কিন্তু বাক্য যন্ত্রণা থেকে আপাতত রেহাই। রাতে ফিরে যা হবার, তা তখন দেখা যাবে। বড়ো বৌদির সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেল তো বাঁচোয়া। বাঁচোয়া বড়ো আর সেজো বৌয়ের সম্পর্কটা মিঠে-কড়া। এই মনের কথা, এই মনোমালিন্য। এ বাড়ির সেজো ছেলে দরজা খুলে রাস্তায় পা দেয়। পেছনে স্বস্তি- বচন.. দুর্গা দুর্গা। ঘাড় না ঘুরিয়ে বোঝে বড়ো বৌদি।
সেদিন হেঁশেলে এঁচোড় মোচা দুটোই রান্না হয়। তোলা থাকে ঠান্ডা মেশিনে পরের দিনের জন্য। এই ঠান্ডা মেশিনটা বড়ো গিন্নির ছেলে কিনে এনেছিল, যখন সে হাউস স্টাফ ছিল। এ বাড়ির মান্ধাতা আমলের উঁচু সিলিং এর তলায় দুশো তিরিশ লিটারের ফ্রিজটা লিলিপুট,বিশাল পুরোনো ফার্নিচারের তুলনায় বেমানান। তবু লম্বমান জানলা গলে গলি পেরিয়ে যখন একটু বেলা হলে সূর্যের আলো ফ্রিজটার গায়ে পড়ে, তখন বড়ো গিন্নি যেখানেই থাকুক, ছুটে এসে ফ্রিজটার গায়ে হাত বোলায়। তার খোকার প্রতি স্নেহে বুকটা উথাল-পাথালি করে। মনে পড়ে ফ্রিজটার আসার আগের দিনটা। সেদিন খোকার ডে ডিউটি ছিল হসপিটালে। সে তুলনায় একটু দেরি করে ফিরেছিল। মাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ছাতে সন্ধ্যা বেলায়।” মা একটা ফ্রিজ কিনে ফেললাম।” ” সে কি রে কেন? এই তো সবে আয় হচ্ছে। এর মধ্যে এত বিলাসিতা করিস না বাবা।” হ্যাঁ আমার এ গল্প বহুদিন আগের। আজ সেই বাড়িটাও নেই। বাসিন্দারা অনেকেই স্বর্গীয় বা স্বর্গীয়া। যারা বেঁচে আছে, পরবর্তী শাখা বা প্রশাখার সাথে অন্য জায়গায় শিকড় চালিয়েছে। তাই ফ্রিজ তখন নিত্য প্রয়োজনীয় কোন কমোডিটি নয়। বিলাসিতা বই কি। বড়ো গিন্নির খোকা বলেছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাদের আর আমাদের খ্যাঁটোনের ব্যবস্থা করার জন্য রিলে রেসে নাম লেখাতে হবে না। ধীরে সুস্থে রান্না করো। ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে গরম করলেই চলবে। বাবা না হয় এখানে থাকেনা। বাদকুল্লা থেকে মাসে একবার বাড়ি আসে। মেজ কাকুর অফিসে দায়িত্ব অনেকখানি। আগে বেরোতে হয়। ছোটো কাকুকে কল্যাণীতে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে হয়। তোমার হাঁফ ধরে যায়। মেজকাকীমা তো শুধু মেজকাকুর খাওয়ার সময় পরিবেশন করা ছাড়া রান্নাঘরের দিক মাড়ায় না। ছোটো কাকীমা কলেজ থেকে ফেরে যখন তোমার আর সেজকাকিমার রান্না পর্ব সকালের মতো শেষ। আবার সন্ধ্যা থেকে রাতের রান্না শুরু। ছোটো কাকীমার চা করা আর সান্ধ্যকালীন জলখাবারের দায়িত্ব পালন। কখনো খাতা দেখা, কখনো কোশ্চেন পেপার তৈরি থাকে। ক্লাসে পড়ানোর জন্যে নিজেকে রোজ তৈরি করতে সমস্যা হয় সময় নিয়ে। তুমি ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফোটো মা। তার অনেকটাই জের গিয়ে পড়ে মেজ কাকীমার ওপর। তাই ফ্রিজ আনাটা দরকার, খুব দরকার ছিল মা। ” বড়ো গিন্নি সেদিন
ছেলের তার প্রতি দরদের জন্য আপ্লুত হয়েছিল। আঁচলে চোখ কচলে ছেলের চিবুকে হাত দিয়ে বলেছিল,” দীর্ঘজীবি হও বাবা। ” আকাশের চাঁদ তারারা হেসেছিল সেদিন।
এই ভাবে সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িটায় সূর্য ওঠে, ডোবে। সন্ধ্যার আঁচল ধরে রাত আসে। কালো চাদর মুড়ি দেয়া রাত মুখের ঢাকনা খোলে। ভোরের আলোর পথ দিয়ে আরেকটা দিন আসে। এই বাড়ির গিন্নিরা যে যার মতো থেকে যায়। দিন, মাস, বছর তাদের কোন পরিবর্তন ঘটায় না। এ বাড়ির বড়ো কর্তা রিটায়ার্ড হয়ে সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে থিতু হয়। কিন্তু সে তো সদাশিব মানুষ। আর বহুদিন একলা থেকে সংসারের রাজনীতি বোঝার সাধ্য নেই। আর সাধ্য যখন নেই, তখন চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর বড়ো গিন্নির ছেলে আড়ালে মায়ের সাপোর্টার। কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র। কাকীমারা গুরুজন। তাই তাদের কাজের সমালোচনা করা তার মতে শোভন নয়। তাই এ সংসারে অশান্তি বৃদ্ধি পায় দিনের পর দিন.কখনো মেজ সেজ আর ছোটো তরফের ছেলে মেয়ে দের নিয়ে মনোমালিন্য তুঙ্গে ওঠে মায়েদের মধ্যে। ছেলে মেয়েরা কিন্তু বিন্দাস। নিজেরা খেলা করে, খুনসুটি করে, কিন্তু ঝগড়া কদাপি নয়। যত আব্দার বড়ো গিন্নির ছেলের কাছে। কেউ তার কোলে উঠে বসে, বুড়ো আঙুল চুষে বলে এটা এনো. কেউ হাত ধরে টান মারে.. ওটা দেবে., কেউ কোমর জড়িয়ে বলে, কবে আনবে? মেজ গিন্নি বলে মেজ কর্তাকে, ” বাবার দেয়া বাড়িতে চলো চলে যাই।” মেজ কর্তা ঘুম গলায় সত্যি কথা বলে ফেলে, নিজের অগোচরে, ” সংসারে কিছু কাজে হাত লাগাতে তো পার, রাতদিন শুয়ে বসে না থেকে। মেজ গিন্নির কাঁদুনে গলা,” এ কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে! আমি বাপের বাড়িতে আদরে মানুষ। কি কথা দিয়েছিলে আমার বাবাকে, মনে নেই? তুলোয় শুইয়ে রাখবো আপনার মেয়েকে। তার বদলে
তুলো- ধোনা করো তোমরা। মেজো কর্তা খেটে খুটে ক্লান্ত। নাকের গর্জনের
ফ্রি- কোয়েন্সি বেড়ে যায়। মেজ গিন্নির কান্নার আওয়াজ বেশ কিছু বাড়িতে শোনা যায়।
ছোট কর্তার ঘরে আরেকটা দৃশ্য। ছোট কর্তা বলে, বড়ো বৌদি জ্বর নিয়ে রান্না করেছে, সেজ বৌদির কাছে শুনলাম। আজ অন্তত রান্নাটা সেরে নিতে। খাতা দেখার দোহাই দিয়ে কতদিন নাটক- নভেলে মুখ গুঁজে বসে থাকবে। নিষ্পৃহ মুখে ছোট গিন্নির নির্বিচারে জবাব, ” কলম আর খুন্তীর বিরোধ জানো না বুঝি? কারখানার শ্রমিক বুদ্ধিজীবীর মর্ম বুঝবে কি? ছোটকর্তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। চুলের মুঠি ধরে ছোট গিন্নির মাথা দেয়ালে ঠুকে দেয়,” নিকুচি তোর বুদ্ধিজীবীর. ” ছোট বৌয়ের চিল চিৎকার.. ছোটোলোক, অসভ্য জানোয়ার.. পাড়া-প্রতিবেশীরা নির্জন রাতে
সার্কাস দেখে. এই ভাবে সার্কাস বাড়ি নিয়ে অন্য বাড়ির অন্দর মহলে, বার বাড়ির উঠোনে, পাড়ার রোয়াকে রোয়াকে আলোচনা – সমালোচনা, মশকরা সব হয়।
সেদিন বিকেলে ঘটনাটি ঘটে। বড়ো গিন্নির ডাক্তার খোকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে গাড়ি চাপা পড়েছে। প্রাণটা আছে এখনো, কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বলা যায় না। সার্কাস বাড়ি আজ নিশ্চুপ। নিশ্চুপ তো হবেই, ঘরে বিরাট তালা। সময়টা দুপুর – বিকেলের মাঝখানে। ক্ষেন্তি এসে ফিরে যাবে.. এ কথা মনে করার মানসিকতা নেই সার্কাস বাড়ির সদস্যদের. বড়ো গিন্নি বোবা। মেজ গিন্নি বলছে, ” বড় দিদি শাড়ি পাল্টাবে না? ” বড়ো গিন্নি কোন জবাব দেয় না। মেজো গিন্নি অন্য সময় হলে বিরূদ্ধ কিছু বলতো, আজ বলে না। গায়ে হাত দিয়ে বলে, ” তোমার মেজ দেওরকে খবর দিয়েছি। মেডিক্যাল কলেজের সামনে চলে যাবে। ছোটো গিন্নি আলমারি খুলে কিছু টাকা বটুয়ায় ভরে। সেজ গিন্নি আফসোস করে, অন্যদিন খেতে দেরি হয় বড়দির। সকলকে খাইয়ে আরেক দফা স্নান সেরে গোপালের সেবা করে তবে খাবে। হা গোপাল আজ কি করলে, বড়দির সেবা নিলে, আর তার কোল খালি করতে যাওয়ার খবর পাঠালে! ভক্তি ছেদ্দা যে উঠে যায় ঠাকুর। মেজ গিন্নি বড়ো গিন্নিকে দুগ্রাস ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করে। মানসিক নিথর বড়ো গিন্নি ঠোঁট চিপে রাখে। বড়ো কর্তাকে নিয়ে ওরা এগোয় ট্যাক্সির দিকে। বড়ো কর্তার হাত ছোট গিন্নির হাতে। বড়ো গিন্নির হাত মেজো গিন্নির হাতে ধরা। এই সময়ে ওদের সাপোর্টের প্রয়োজন. আশেপাশের জানলা খুলে যায়, ” এ আবার কি নতুন সার্কাস!” সার্কাস পার্টির সদস্যরা কি হয়েছে, জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। জানার তাগিদ অনুভব করলে নিজেরা পরে জেনে নেবে। ওদের এখন যৌথ মন খারাপ, একত্রিত উদ্বিগ্নতা। ছোটকর্তা ট্যাক্সি ডাকে। আজ তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছেলেমেয়ে গুলোকে মামার বাড়িতে চালান করা হয়েছে।
বড়ো গিন্নির খোকার ব্রেন ইনজুরি। ওষুধ – ইনজেকশন, স্যালাইন, অক্সিজেন চলছে। ওর ব্লাড গ্রুপটা বেয়াড়া, ও নেগেটিভ।সব্লাড ব্যাঙ্কে অমিল। লাগবেও কয়েক বোতল। মেজো বলে আমি ও নেগেটিভ, ছোট এগিয়ে আসে, আমারও। ডাক্তার নিশ্চিন্ত। বেঁচে গেল বড়ো গিন্নির খোকা। বংশের শিব রাত্রির সলতে যদিও নয়, তবে সকলের বড়ো আদরের।
এতোটা টান এই সার্কাস সংসারের পরস্পরের প্রতি, আগে বোঝা যায় নি। বিপদ বুঝিয়েছে, পরস্পরের সম্পর্কের অটুট বুনন কত প্রয়োজন। এই বুনন কখন ঠাস বুনোট হয়ে ওঠে, জীবন তা বুঝিয়ে দেয়। সেই শুরু, এরপর সার্কাস বাড়িতে আনন্দের রোশনাই। মেজো সেজো আর ছোট গিন্নির ছেলে আর মেয়েরা বড়ো হয়েছে, স্কুল কলেজ পার হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ে হয়েছে। বড়ো গিন্নির খোকা এখন বৌ নিয়ে বিদেশে। ছেলে হয়েছে তার। মা- বাবাকে খোকা বিদেশে নিজের কাছে নিয়ে গেছে। অন্য কর্তা- গিন্নিরা ছেলে বা মেয়ের কাছে। সুকিয়া স্ট্রীটের সার্কাস বাড়িটা ভাঙ্গার আওয়াজ আসছে। এ পাড়ার পুরোনো পাড়া-প্রতিবেশীদের বুকে মুষলের আওয়াজ, স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে সার্কাস বাড়ি।