আত্নপ্রেম ও রবীন্দ্রনাথ : সৌগত রাণা কবিয়াল।

0
857

“ভালোবাসা” একটি বিস্ফোরক শব্দ ! মানুষের মননে এই শব্দের রঙ বহুমাত্রিক, তার মধ্যে বাঙালিদের কাছে তাদের প্রাণের রবি ঠাকুর একটি অতি উজ্বলতম রঙ !
সবসময়কার আধুনিক বাঙালিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন একজন মুগ্ধ করা মানুষ, যার কাছ থেকে ধার নিয়ে জীবনের প্রতিটি সময়ের অনুভুতিগুলোকে অবলীলায় শব্দে বেধে দেয়া যায় ! মানবীর প্রেমে একজন জন্ম প্রেমিক হিসেবে কবি গুরুকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে বেশ মুখরোচক তৃপ্তি ! কিন্তু, প্রকৃতির প্রতি কবিগুরুর একটা অদ্ভুত টান বরাবরই ছিলো, বিশেষ করে রাত্রিকালীন প্রকৃতির প্রতি ! আমার জীবনে আমি রাতের প্রেমে পড়েছি রবি ঠাকুরের ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’, এই গানটা শুনে শুনে !
সেক্যুলার বাঙ্গালী সবসময় কটমটে তথ্যনির্ভর রবীন্দ্র বিশ্লেষণে সুখ খোঁজে,
কিন্তু আপন মননে রবি ঠাকুরের চরিত্র আলোচনায় বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে না কখনো !
আচ্ছা, যে মানুষটা তার জীবনের প্রতিটি যন্ত্রণায় হাত পা ছুড়ে কাঁদার পরিবর্তে আপনমনে একেকটি নতুন সৃষ্টি নিয়ে মাততেন, যার কাছে আপন মনের ঘর ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মন্দির, সেই মানুষটাকে কঠিন কঠিন শব্দে আটকে দেয়াটা বোকামো নয় কি ?
ভালোবাসা যে কতোটা বহুমাত্রিক সুখ, সেটা হয়তো বাঙালির ঘরে কবিগুরু জন্ম না নিলে তথাকথিত ধুতি উঁচু করে চলা শিক্ষিত বাঙালিদের জানার সুযোগ হয়ে উঠতো না কখনোই ! সৃষ্টিতে সুখী হয়ে বাঁচতে জানা বাংলা সাহিত্যের এই শ্রেষ্ঠ অবতার ‘রবীন্দ্রনাথ’ তার বহু লেখায় স্বকীয়তায় ভরসা রাখার অনুরোধ করেছেন তার প্রিয়জনদের প্রতি ! কবিগুরু হয়তো জানতেন, “আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নাই, যদি সে নতুনের গান গায়” ! তাই কবিগুরু হয়তো কখনোই চাইতেন না যে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টির ধারাবাহিকতা নষ্ট হোক ! তার হাতেই সেই শব্দ খেলা করে সুরের ছলে,
“তুমি কেমন করে গান করো হে গুনি, আমি অবাক হয়ে শুনি..”!
অনেক প্রাপ্তির ভীড়েও একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হয়ে একাকী রাত্রি যাপন ছিলো তার প্রিয়তম সময় !

বিনম্র স্রষ্টা কখনো জোয়ারে গা ভাসায় না ! এ কথাটা কবিগুরু প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করতেন বলেই হয়তো বলেছিলেন,
“যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে, তবে একলা চলো রে..”!
নতুনের জন্য উনার প্রেম বরাবরই পিতার মতো স্নেহময় ছিলো, আর তাই আজ শত বছর পার করেও বাংলা সাহিত্যে কবিগুরু একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য অবতার হয়ে বেঁচে আছেন মানুষের জীবনের প্রতিটি সময়ের অনুভুতিতে !
আমার মনে হয়, যে ভালোবাসার বহুমাত্রিক রুপ উনি শিখিয়েছেন বাঙালিদের, তার মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিলো ‘আত্নপ্রেম’ ! আর এই আপনারে ভালোবাসায় কেবল সুখের খেলা থাকে ! কারন, যে নিজেকে ভালোবাসতে জানে না সে কি করে অপরকে ভালোবাসবে ? আর একজন শিল্পীর শ্রেষ্ঠ শিল্প তখনই প্রকাশ পায় যখন সে আপন মনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে যে সে ব্যতিক্রম এবং নতুনের সৃষ্টিই তার কাংখিত সুখ !

এই কালিকলমের জগতে নির্বোধের জন্য অনুকরণ, আর বোধের জন্য অনুসরণ !
কবিগুরু আপন বোধের আলোয় পথ দেখিয়ে সাহিত্যের মন্দিরে সৃষ্টির রাজা হয়ে বেঁচে আছেন ! পৃথিবীর বাকি সকল রাজার মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একজন যোগ্য উত্তরাধিকারের জন্য নবীনের স্তুতি গেয়েছিলেন !

” আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি তোমাদের ঘরে ?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে ।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।”

এবার প্রজন্মের সময় এসেছে নতুনের সৃষ্টিতে মত্ত হয়ে রাজার ঋণ শোধের… !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here