বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারটা যে নোবেল, এটা বলার জন্য কোনও মানুষকে সাহিত্যকর্মী হওয়ার প্রয়োজন নেই। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে গোটা পৃথিবীতেই লেখক বা কবিকে উৎসাহিত এবং সম্মান দেওয়ার জন্য অসংখ্য পুরস্কার প্রচলিত। কিন্তু একজন রাজার সমস্ত অলংকারের মধ্যে আমাদের সবথেকে বেশি নজর কাড়ে যেমন তাঁর মুকুট, সাহিত্যের অসংখ্য পুরস্কারের মধ্যেও নোবেলের মতো একটা পুরস্কার সাহিত্যসেবীকে রাজার আসনেই বসিয়ে দেয়। শেষ একশো বছরে বাঙালি সাহিত্যিকের কপালে জুটেছে একটি মাত্র নোবেল। প্রাপকের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। নোবেল এবং পশ্চিমের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের পূর্বদিকের লোকেদের সন্দেহের চোখ এবং ভ্রু কোঁচকানোর অভ্যাসটাও মজ্জাগত। তবে নোবেল : বছর = ১ : ১০০ অনুপাতটাও হজম না হওয়ারই মতো। পূর্বদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ আর পশ্চিম থেকে সেনক্যুইজ, বার্নাড শ, পিরানদালো, থমাস মান, ইয়েটস, সলোকভ্, ল্যাগেরলফ, হেস, কামু, লাক্সনেস, জেনাসেন থেকে ট্রান্সট্রোমার, পর্যন্ত নামগুলো নিলে পূর্ব ও পশ্চিমের নোবেল প্রাপকদের অনুপাতও এক শোচনীয় মানে দাঁড়াবে। পার্ল বাককে আমি তাঁর মূল কর্মসূত্রে পশ্চিমীদের দলেই ফেলব।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশোতম বছর পার করে রবীন্দ্রনাথ কেন নোবেল পেয়েছিলেন তা বিচার করার জন্য এ কলম নয়। এটা ধ্রুব সত্যি যে, রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে ভারতীয় তথা বাংলাসাহিত্যে এমন অনেকেই উঠে এসেছেন
পরের পৃষ্ঠায়………….২
(২)
যাঁরা নোবেল প্রাপকের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে পারেন বা পারতেন। তারাশঙ্কর, মাণিক, বিভূতিভূষণ বা জীবনানন্দ – প্রত্যেকেই নোবেলজয়ীর তালিকায় স্বচ্ছন্দে ঢুকে পড়তে পারতেন। আরও অনেক নাম এই মুহূর্তে মাথায় কিলবিল করে উঠছে। কিন্তু এতগুলো বছরে নোবেল পাওয়ার এই যে ভাঁটা তা কি আমাদের এক চরম, অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় না!
তাহলে যে দাঁড়াচ্ছে রবীন্দ্রনাথের পর রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ। তাহলে কি আমাদের সাহিত্যের যাত্রাপথ একই বৃত্তপথে আবৃত্ত হতে থাকবে! রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী বলে কিছু নেই! কেন এ ব্যাপারে পশ্চিম বার বার আমাদের টেক্কা দিয়ে যাবে। গোটা পুরস্কার ব্যাবস্থাটার মধ্যেই আজকাল নানা রকম সন্দেহের মেঘ উঁকি দেয়। কিন্তু এটাই কি শেষ কথা হবে, না কি প্রাপ্তিযোগ নেই বলে আঙুর ফল টক? ঘাঁটিয়ে দেখলে আরও অনেক কারণ ভেসে উঠবে না তো।
ভারতবর্ষ, বিশেষত বাংলা প্রদেশের জল হাওয়া এবং সাংস্কৃতিক বাতাবরণ লেখক বা কবি সৃষ্টির পক্ষে বেশ একটা পুষ্টিকর এবং উপযোগী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তবে এটাও সত্যি যে একই পরিবারের সমস্ত ছেলেমেয়ে একইরকম সুযোগ-সুবিধা পেয়েও জীবন ও জীবিকায় সার্থক নাও হতে পারে। বাংলা সাহিত্যে বর্তমানে হাজার হাজার লেখক ও কবি সৃষ্টি হচ্ছে। বই ছাপা হচ্ছে তার থেকেও বেশি গুণে। এর মধ্যে অবশ্য এমন অনেক বই আছে যা ছাপা না হলে বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের খুব ক্ষতি হত না। তাহলে লেখক এবং লেখা-দুয়েরই যোগান আছে। এমনকি কিছু কিছু লেখাকে সাংঘাতিক প্রতিশ্রুতিমানও মনে হয়। তাহলে সে সমস্ত লেখা বিশ্বপাঠকের দোড়গোড়ায় পৌঁছচ্ছে না কেন! বিশ্বপাঠকের মন জয়ে রবীন্দ্রনাথ বা তিন বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তী উত্তর আধুনিক লেখকদের কোন স্তরকে ছুঁতে হবে।
পরের পৃষ্ঠায়………….৩
(৩)
এখানে কারও কারও মনে হতে পারে যে লেখকের নিজস্ব জগৎ-এর স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা হচ্ছে বোধহয়। কিন্তু নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের এ সম্পর্কে মতটি ছিল ভিন্ন। ‘বিশ্বসাহিত্যে’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে কী লিখলেন তিনি, একবার দেখে নেওয়া যাক, – “যেখানে সাহিত্যেরচনায় লেখক উপলক্ষমাত্র না হইয়াছে সেখানে তার লেখা নষ্ট হইয়া গেছে। যেখানে লেখক নিজের ভাবনায় সমগ্র মানুষের ভাব অনুভব করিয়াছে, নিজের লেখায় সমগ্র মানুষের বেদনা প্রকাশ করিয়াছে, সেইখানেই তাহার লেখা সাহিত্যে জায়গা পাইয়াছে। তবে সাহিত্যকে এইভাবে দেখিতে হইবে যে, বিশ্বমানব রাজমিস্ত্রী হইয়া এই মন্দিরটি গড়িয়া তুলিতেছে; লেখকেরা না না দেশ না না কাল হইতে আসিয়া তাহার মজুরের কাজ করিতেছে। সমস্ত ইমারতের প্ল্যানটা কী তাহা আমাদের কারও সামনে নাই বটে, কিন্তু যেটুকু ভুল হয় সেটুকু বার বার ভাঙা পড়ে; প্রত্যেক মজুরকে তাহার নিজের খাপ খাওয়াইয়া, সেই অদৃশ্য প্ল্যানের সঙ্গে মিলাইয়া যাইতে হয়, ইহাতেই তাহার ক্ষমতা প্রকাশ পায় এবং এইজন্যই তাহাকে সাধারণ মজুরের মতো কেহ সামান্য বেতন দেয় না। তাহাকে ওস্তাদের মতো সম্মান করিয়া থাকে।”
সারমর্ম যা দাঁড়াল, তা হল, রবীন্দ্রনাথ নিজেও স্বীকার করছেন, ব্যক্তিগুণ সাহিত্যের গুণ হতে পারে, কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের পাঠকের কাছে পৌঁছতে হলে সেই উপাদানে বিশ্ববোধের উপাদান থাকা চাই। এখন বিশ্ববোধ দু’টি নিয়ামকের ভিত্তিতে একজন লেখকের মধ্যে গড়ে ওঠে – তাঁর বলার ভাষা এবং জীবনের দর্শন। যুগভিত্তিক জীবনাদর্শন সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি লেখকের সত্যিই জুড়ি নেই। নিজের সময় থেকে এগিয়ে যাওয়া সময়কে চোখে আঙুল দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে দেখাচ্ছেন আজকের যুগের বেশ কিছু লেখক-লেখিকা, যদিও লেখনীর এই ব্যাকরণও আমাদের শিখিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথই। জীবনের শেষ লগ্নে লেখা, ‘ল্যাবরেটরি’ বা ‘বদনাম’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পড়ে থাকল ভাষা। ভাষার ক্ষেত্র
পরের পৃষ্ঠায়………….৪
(৪)
প্রস্তুতির সব দায় লেখক বা কবির নয়। গীতাঞ্জলীর বহু কবিতা ইয়েটস যে দৃষ্টিকোণ থেকে অনুবাদ করেছিলেন, তাতে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন এবং বিশ্ববোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির বা মাষ্টারপিস গুলির বিশ্বপাঠকদের নিরিখে অনুবাদ হচ্ছে তো?
বর্তমান যুগ বিশ্ববাণিজ্যের। প্রকাশনা জগৎও জড়িয়ে পড়েছে এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে। পাঠকের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছানোর জন্য বিশ্বপ্রকাশনাও বাণিজ্যিক নিত্য-নতুন কৌশল খুঁজে চলেছে। কোনও অবস্থাতেই প্রকাশক এই গুরুদায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না। আজকের পৃথিবী যে-ভাবে ফেসবুক, ট্যুইটার বা ওয়েবসাইট নির্ভর হয়ে পড়ছে, প্রকাশনা জগৎও নিজেকে সেই গন্ডীর বাইরে রাখতে পারে না। প্রকাশনা জগৎ-এও চাই বিশ্বায়নের ধামাকা বিস্ফোরণ। এটা বোঝার সময় উপস্থিত যে, আমরা এখন কোনও নির্দিষ্ট স্থান বা দেশের আওতাভুক্ত নই, আমরা একটা গোটা গ্লোবের বাসিন্দা। বলা বাহুল্য, বিশ্বসাহিত্যের এই অমূল্য পুরস্কারের সঙ্গে বই বিক্রির সম্পর্ক কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই ছিল। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রজীবন কথার’ ৭৫ নং অধ্যায়ে সরাসরি জানাচ্ছেন যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবির বই বিক্রির পরিমাণ সবদিক থেকেই বেড়ে গিয়েছিল। লেখকের বই বিক্রি বাড়লে তাতে প্রকাশকের লাভ নেই, আশা করি একথাটা কোনও প্রকাশক অস্বীকার করবেন না।
নিঃসন্দেহে ভারতীয় তথা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বাঙালির গর্ব, আরাধ্য এবং শ্রদ্ধেয়। কিন্তু বিগত একশো বছরে বাঙালির সাহিত্যে বিশ্ববিজয় ভবিষ্যৎ-এ শুধু রবীন্দ্রথেই থেমে থাকবে, এটা কি বাঙালির সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চায় কাম্য? রবীন্দ্রনাথ নিজেও কি জীবনের একই বৃত্তে আবদ্ধ থাকতে চাইতেন! আমাদের জীবনে নতুন প্রাণের পদধ্বনি ও জয়ধ্বনির মধ্যেই সম্ভবত লুকিয়ে থাকবে একটি জাতির এগিয়ে চলার
পরের পৃষ্ঠায়………….৫
(৫)
ইতিহাস। মৃত্যুর শেষ পর্বে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি গান নতুনের সেই জয়ধ্বনিই গায় – “…… হে নূতন/দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ……/ব্যক্ত হোক জীবনের জয়/ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়। …..”
নতুন শোনাক তার বিশ্বজয়ের জয়ধ্বনি। আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাহিত্যপ্রেমীরা প্রস্তুত সাহিত্যে আরও একটি নোবেলের জন্য।
___________________