(সেটে সবাই রেডি ‘পথের পাঁচালী’ শ্যুটিংয়ের জন্য। সহ পরিচালক এসে তাঁর কাছে স্ক্রিপ্ট চাইলে তিনি আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘আলাদা করে স্ক্রিপ্টের কী দরকার? আমি যা বলবো ওরা তাই করবে ও বলবে।’ এ কথা শুনে সেটের সবার চক্ষু তো চড়কগাছ! অতঃপর ইতিবাচক সম্মতি প্রকাশে, ছোট্ট চিরকুট টাইপের কাগজের টুকরোতে একটা করে দৃশ্য এঁকে দিলেন এবং কে ও কি কথা বলবে তাও লিখে দিলেন বসে। এই চিরকুটগুলোই ছিল ‘পথের পাঁচালী’র স্ক্রিপ্ট।
এসব বিষয়গুলোকে মাথায় এমনভাবে গেঁথে নিতেন তিনি যে তাঁর আর প্রয়োজন হত না কোনও কিছুরই।)
১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্ম হলেও তাঁর আদি পৈতৃক ভিটে ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া নামক একটি গ্রামে। সেখানেই জন্ম হয় তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায়ের।
৩ বছর বয়েসেই মারা যান মানিকের বাবা সুকুমার রায়। সেই থেকে নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেই বহু কষ্টে, মা সুপ্রভা দেবীর কাছে সযত্নে বেড়ে ওঠেন তিনি।
এরপর শিক্ষাজীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়া থেকে শুরু করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্পূর্ণ অধ্যয়নে ইতি টেনে ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায় এবং সেখানে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডিজে কিমারে জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে যোগ দেন মাত্র ৮০ টাকা বেতনের চাকরীতে।
যেহেতু চিত্রসজ্জা বা ভিজুয়াল ডিজাইন ছিল সত্যজিৎ রায়ের-এর একটি অতি পছন্দের বিষয়, তাই সেক্ষেত্রে কম বেতনকে সহজেই পেরেছিলেন মেনে নিতে।
নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ১৯৪৩ সালের দিকে সত্যজিৎ রায় জড়িয়ে পড়েন ডিকে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেস-এর সঙ্গে। ডিকে গুপ্ত তাঁকে অনুরোধ করেন সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা বইগুলোর প্রচ্ছদ আঁকার, পাশাপাশি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতাও দেওয়া হয় তাঁকে।
ওই প্রতিষ্ঠানে থেকেই অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন সত্যজিৎ রায় এবং পরবর্তীতে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হওয়ার দৌলতে, জিম করবেটের ‘ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন’ ও জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি বইয়ের প্রচ্ছদ নকশাগুলি তৈরি করেন তিনি নিজ হাতে।
১৯৪৭ সালে তিনি, চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও অন্যদের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি।’ সোসাইটির সদস্য হওয়ার সুবাদে তাঁর সুযোগও হয় অনেক বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার। এ সময় তিনি গভীর মনোযোগসহকারে দেখেন প্রচুর ছবি।
একসময় কলকাতায় সাক্ষাৎ হওয়া ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ার এবং বিশেষত, ভিত্তোরিও ডি সিকা দ্বারা পরিচালিত, ১৯৪৮ সালে নির্মিত একটি ইতালিয়ান ছবি ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে'(সাইকেল চোর)দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন তিনি।
একজন সু-চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে ওঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৫৫ সালে তিনি তৈরি করেন, অমর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে তৈরি প্রথম ছবিটি।
শুধু ছবি বলা ও তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিশ্লেষণ না করাটা বহন করে মুর্খামির পরিচয়।
এই বাংলা সিনেমাটি তৈরির ঠিক পিছনেই লুকিয়ে আছে এক করুণ সংগ্রাম ও দৃঢ়সংকল্পতার ইতিহাস!
সাধারণ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে পরিচালক হিসাবে তিনি শুরু করলেন মুভিটির শ্যুটিং।
কিছুটা কাজ এগোবার পর, টাকা-কড়ি গেল সব শেষ হয়ে, কি করবেন তখন?
কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে বাস্তবের কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিও যে মাথা নত করেছে বারংবার, ইতিহাসে তার উপযুক্ত প্রমাণ আছে ভুরিভুরি!
দুশ্চিন্তায় নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রীর গয়না বন্ধক এবং নিজের দামি-দামি বইপত্র বিক্রি করে পুনরায় শুরু করলেন শ্যুটিং।
কিন্তু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়লোনা সেখানেও! তাতেও সম্পূর্ণ হল না কাজ।
এদিকে নতুন পরিচালক, কে ঢালবে এর পেছনে অর্থ? রাজি নন কেউই।
অনেক কষ্টে এদিক-সেদিক করে আবার টাকা-পয়সা জোগাড় করে শেষমেশ সম্পূর্ণ করা গেল সিনেমাটি।
আর এই সিনেমাই অর্জন করে ফেলে, আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির শিরোপা!
তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, প্রথম পর্যায়ে একেবারে নতুন পরিচালক হিসাবে কলকাতার দর্শকরা এই মুভিটিকে গ্রহণ করেননি ভালোভাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের গঠন ও সাথে পণ্ডিত রবিশংকরের অসাধারণ সংগীতের সমন্বয়ে তৈরি এই মুভি অবশেষে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে শুরু করে ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্ব জুড়ে!
মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে এই ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্রটি যার মধ্যে ১৯৫৬ সালের ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভাল’-এ পাওয়া সর্বোচ্চ সম্মান হিসাবে ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ (Best Human Documentary)পুরস্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আর এভাবেই বিশ্বচলচ্চিত্রের বিস্তৃত আকাশে নক্ষত্ররূপে আবির্ভাব ঘটে এক কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের।
চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভাবের শুরুতেই তিনি প্রায় শেষ করে ফেললেন তাঁর বুদ্ধাঙ্কের প্রমাণ দেওয়া!
এরপর একে একে ১৯৫৯ সালে, ‘অপুর সংসার’, ১৯৬৩ সালে ‘মহানগর’, ১৯৬৪-তে ‘চারুলতা’, ১৯৭৪ সালে ‘সোনার কেল্লা’ ও ১৯৮০-তে ‘হীরক রাজার দেশে’ প্রভৃতি অবিস্মরণীয় সৃষ্টিতে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে একেবারে পাকাপাকিভাবে নিয়ে পৌঁছালেন বিশ্বদরবারে!
শুধু একজন উচ্চ মাত্রার চলচ্চিত্র পরিচালকের ভূমিকায় তিনি থেমে ছিলেন না, লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার হিসাবেও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। সিনেমার প্রতিটি ক্ষেত্রে নিপুণ শৈল্পিক দক্ষতার সাথে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ!
মনকে বুঝে শিশুদের মনগ্রাহী গল্প উপহার দেওয়াটা অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন!
তোপসে ,জটায়ু, ফেলুদা, মুকুল, গুপি গাইন-বাঘা বাইন কিংবা ‘হীরক রাজার দেশে’-এর মাস্টারমশাই, এই সমস্ত চরিত্র ও তার বর্ণনা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয় যে সত্যজিৎ রায় কত বড় মাপের একজন মনস্তাত্ত্বিক(বিশেষত শিশু)ছিলেন।
চলচ্চিত্র নির্মাণের ভীত ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ, যেন পুরোটাই বেমালুম মুখস্থ ছিল তাঁর।
একেই বোধ হয় বলে হেরিডিটি।
যে সরল শিশুটি বড় হয়েছে সহজ, সাদা-মাটা এ সমস্ত সিনেমা দেখে, প্রাপ্ত ও বৃদ্ধ বয়সে সেই ছবিই ছুঁয়ে গেছে সেইসব বাঙালির, নীতি, সমাজ কিংবা রাজনৈতিক বোধগুলোকে।
তাঁর গহিন সমাজবোধেরও বাস্তব প্রতিফলন যেন ঘটেছিল এই সমস্ত বাংলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।
অনেকেই এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করেন যে,
আর্থার কোনান ডয়েল সৃষ্ট সু-বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ‘শার্লক হোমস’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা।’
বলিউডের অতি উচ্চ মাত্রার অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের সাথে তিনি কাজও করেছেন ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামক একটি সিনেমায় যেখানে, অমিতাভ বচ্চনকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন একজন ভাষ্যকার হিসাবে।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক স্বনামধন্য অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে একসঙ্গে মোট ১৪টি সিনেমায় কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়। তাদের এই জুটি বিখ্যাত হয়ে আছে সিনেমা ইতিহাসে।
তিনি প্রথম রঙীন বাংলা ছবি করেন
১৯৬২ সালে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা।’
ব্যস্ততম কর্মজীবনে তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে বিখ্যাত হল ১৯৯২ সালে পাওয়া ‘অস্কার’ (একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার)যা তিনি অর্জন করেন সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে। এছাড়াও ৩২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যার মধ্যে ৬ টিই ছিল সেরা পরিচালকের এছাড়াও ১টি গোল্ডেন লায়ন, ২টি সিলভার বিয়ার লাভ করেন তিনি।
কমেডি কিং চার্লি চ্যাপলিনের পর দ্বিতীয় ফিল্ম ব্যক্তিত্ব হিসাবে সত্যজিৎ রায়কে সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করেন ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।’
১৯৮৫ সালে তিনি পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে।’
এছাড়াও ফরাসি সরকার থেকে ১৯৮৭ সালে সেদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘লেজিওঁ দ’নর’ প্রদান করা হয় সত্যজিৎ রায়কে।
তিনি ছাড়াও এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অমিতাভ বচ্চন।
তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিনি অর্জন করেন ‘পদ্মভূষণ’ পুরষ্কার ও দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারত রত্ন’ সম্মান অর্জন করেন ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে।
সর্বশেষ ২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় ১৩ তম স্থান উঠে এসেছিল বিশ্ববন্দিত অনন্য প্রতিভার অধিকারী একটি ব্যক্তির নাম, সত্যজিৎ রায়।
দূর্ভাগ্যবশতঃ জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় ১৯৯২ সালের ২৩ শে এপ্রিল বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তথা সমগ্র বিশ্বের আকাশে ঘটে যায় এক সু-উজ্জ্বল নক্ষত্র পতনের মতন মর্মান্তিক ঘটনা!
আপামর বিশেষত বাঙালী হৃদয়ের মণিকোঠা আ-মৃত্যু উদ্ভাসিত থাকবে এ কোহিনুরের তেজোদীপ্ত আলোকছটায়!!