দুপুরের পর থেকে শুধু গুন্ডামি ,বদমাইশি করে সারাটা দিন কাটায় শুভ।সকাল সকাল স্কুল করে সেই যে দুপুরে ফেরে ব্যস ,শুরু হয় হুটোপাটি,দৌড় ঝাঁপ। বাপরে বাপ, তাও একা একাই,সঙ্গে কেউ থাকলে কি না হতো!
১:১৫ তে স্কুল বাসটা ফেরার অপেক্ষা,নেমেই এক ছুটে,আনতে যাওয়া কাজের দিদি রুনুকে ব্যাগ টা ধরিয়েই শুভ’র বাড়ি মুখো দৌড় শুরু হয়। প্রথমে এসেই খাঁচার খরগোশ গুলোর দিকে উঁকি ঝুঁকি,বক বক।ওদিকে “কইরে ভাই আয়রে,নে শরবত নে রে,কৈ রে ভাই ,চান টা কর”এসব বলে বলে হয়রান হয়ে এক প্রকার ক্লান্ত হয়ে পড়ে রুনু।
বছর ষোলোর এই দেহাতি মেয়েটা কে মিতালী সত্যিই খুব ভাগ্য করে পেয়েছে বলতে হবে। তখন মিতালীরা ভাড়া থাকতো ওই রেল কলোনির দিকে।খুব ছোট যখন শুভ, সেই সবে দুই বছরে পা দিয়েছে,মিতালী স্কুলের চাকরিটা পায়। স্বামী অনির্বান ভীষণ সাপোর্ট করেছিল সেই সব দিন গুলোতে।মিতালী দিনের পর দিন একটা বিশ্বস্ত কাজের মেয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে কত জনকে যে বলতো।ভাগ্যিস অনির্বাণের অফিস টা শহরের মধ্যেই ছিল,তাই বাঁচোয়া।অনির্বান অনেক বার চেষ্টা করেছে তার মা,বাবাকে এখানে আনতে,কিন্তু ওনারা গ্রাম ছেড়ে এই ঘুপচি ভাড়া বাড়িতে কিছুতেই আসবেন না! শেষে ওরা জায়গা কিনে বাড়ি পর্যন্ত করলো,কিন্তু মাঝ খান থেকে অনির্বাণের আচমকা ট্রান্সফার যেন সব ওলট পালট করে ফেলল ওদের একটু একটু করে গোছানো সংসারকে। সবে সাড়ে তিন বছরের কোলের বাচ্ছা নিয়ে সে এক বিশ্রী চিন্তার দিন। সেই সময় আচমকা,মহাসমুদ্রে ভাসমান টালমাটাল অবস্থায় মুক্তির দূত হিসাবে রুনুর আবির্ভাব।স্কুলের এক কলিগ ঠিকানা,ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বললে এক মুহূর্ত আর দেরি করে নি দুটোতে।সেই থেকে রুনু এক প্রকার সংসারের হালটা বকলমে ধরে রেখেছে এটা মিতালী,অনির্বান দুজনেই খুব ভালো করে জানে।
মিতালীও একদম নিজের ছোট বোনের মতো তোয়াজ করে রাখতো রুনু কে।আর যাই হোক মা,বাবা,ভাই বোন সব ছেড়ে কটা টাকার জন্য এতদূর এসে তার কোলের শুভ কে এত যত্নে কে আর রাখবে।
“কৈ রে ভাই এলিরে, আয় আয় জলদি জল গরম হয়ে গেছে”একবার হাঁক দিলো রুনু।শুভ জানে এক্ষুনি মায়ের ফোন আসবে স্কুলের টিফিন হলেই।তাই সেও বাধ্য হয়ে রুনুর কাছে স্নান করে খেতে বসে গেল।মিতালী ফোনেই প্রতিদিন নির্দেশ দিয়ে দেয় রুনু কে, ছেলেকে,এরপর কি করবে,আজ কি ফল খাবে এই সব। রুনুও অক্ষরে অক্ষরে সব বাধ্য ছাত্রীর মতো মেনে চলে নিজেও ভাইয়ের সাথে একটু ঘুমিয়ে নেয়।
যে মেয়েটা এই ক বছর আগে এসেছিল,একদম হাড় কঙ্কাল বের হওয়া ক্ষুধার্ত অবয়ব নিয়ে,এখন সে একদম তেল চক চকে। শরীরেও এসেছে যৌবনের ঝিলিক।অনির্বানের সেই কোন সুদূর, হিলি সীমান্তে পোস্টিং হওয়ায় পনের দিন পর পর একবার করে আসে।তাও একদিনের জন্য বাড়ি ফিরেই আবার ফেরার তাগিদ,এত্ত হয়রানি,তবুও চলছে চলুক যতদিন যায়। এদিকে নতুন এত বড়ো বাড়ি,মিতালী পই পই করে বলে রেখেছে রুনু কে ,একদম মেন গেট কেউ হাঁকলেও খুলবি না,বলা তো যায়না,যা দিন কাল!
এই ভাবেই বেশ ভারসাম্য রেখে চলছিল,কি যে নজর লাগলো!কথায় আছে না,বেশি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে নেই ।ব্যস,সেদিন সন্ধ্যায় পাবলিক বুথের একটা নম্বর থেকে ফোন এসে তাল কেটে দিলো সব ! রুনুর ভাই ভীষণ রকমের অসুস্থ,অগত্যা রুনুর বাবা কাল ভোরে রুনুকে নিতে আসছে। রবিবার এক মাত্র ছুটির দিন কোথায় তিনজনে, হই হই করে কাটিয়ে কাল সকাল থেকে আপন কাজে ব্যস্ত হবে,গেল তাল কেটে। অনির্বানের অফিসে অডিট চলছে,ওকে অফিস যেতেই হবে। স্রেফ একটা দিনই কি করে যে চলে রুনু ছাড়া, সেই বিপর্যয়টা চোখের সামনে মিতালী,অনির্বাণদের মনের মধ্যে দুঃচিন্তার ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিচ্ছিল। শেষমেষ মিতালী, স্কুলের কলিগকে ফোন করে দিন পাঁচেক মেডিকেল নেবার সিদ্ধান্ত নিল,যদি এর মধ্যে ফিরে যায় রুনু এই ভাবনায়। কিন্তু কোথায় কি,রুনু আজ চার দিন গেল,একটাও খবর দেয় নি।কাল মিতালীর ছুটিও শেষ হচ্ছে!
মিতালীর বাবা অনেক বার মেয়েকে বলেছেন,কি দরকার এখানে চলে আয়, একা ওতো বড়ো বাড়ীতে পড়ে থাকিস।কিন্তু ওখান থেকে শুভর আর নিজের স্কুল খুব দূর হয়ে যাবে,তাছাড়া অনির্বান শ্বশুর বাড়িতে ফিরতেও ইতস্তত করবে প্রতি সপ্তাহে এই ভাবনায় প্রতিবার এড়িয়ে গেছে,বাবার কথা রাখতে পারে নি।কিন্তু এই প্রতিকূলতায়,শুভর স্কুলে একটা দরখাস্ত দিয়ে আজই বিকালে রওনা দিলো মা,বেটাতে বাবার বাড়িতে।
আজ একা একাই ফিরছে মিতালী,শুভকে মা বাবার কাছে রেখে,মনে এক রাশ বিষণ্নতা নিয়ে।বাস যখনই দাঁড়াচ্ছে,রুনুর বয়সী মেয়ে দেখলেও মন টা হু হু করে উঠছে।একটা ফোন নম্বর ও নেই ,যে ফোন করে খবর নেবে রুনুর ভাই কেমন রইলো,কি যে করছে মেয়েটা ! যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিল সেটাতে বার কতক ফোন করেও কোনো লাভ হয় নি।
আজ পনের দিন হয়ে গেল। একাকী ভূতের মতো মিতালীর দিন কাটছে,ছেলেকে ছেড়ে,রুনু কে ছেড়ে।এই সপ্তাহে অনির্বানও আসতে পারে নি অডিটের চাপে।এতো ঝড় জল আজ সারাদিন যে,কাক ভেজা হয়ে মিতালী স্কুল থেকে ফিরলো। আজ শুভর কাছে যাবার পরিকল্পনা ছিলো,সে উপায়ও বন্ধ হয়ে গেল নিম্নচাপের চক্করে। ভিজে বিধস্ত হয়ে, হেঁচে কেশে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে হাতড়ে লাইট জ্বালাতে গিয়ে থমকালো। মনে পড়লো,ওহ ইনভার্টারের ব্যাটারিটা মিস্ত্রিকে দেখাতে হবে,চার্জ নিচ্ছে না কদিন ধরে! বাড়ি ফিরতেই রুনু ,পরম যত্নে,কি সুন্দর জল,শরবত,আদা দিয়ে চা বানিয়ে দিতো। যখন যেটা লাগতো,হাজির করে এমন অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে যে কিচ্ছু ইচ্ছা করে না আর বানাতে মিতালীর। তার ওপরে সে আবার একা,এই মন খারাপি বৃষ্টি বাদল সন্ধ্যায়।
সারারাত সে যে ,কি ঝমঝম বৃষ্টি।দরজা জানালা গুলো লাগিয়েও যেন মনে হচ্ছে হাওয়ার দাপটে ভেঙে যাবে। চার্জারের আলো ঘন্টা খানেক জ্বলার পর সেও নিভে যেতে মোম বাতিও হাওয়ায় বার কতক নিভলো।”দূর ,কে আর একার জন্য রান্না করে”এই ভাবনায় , একটু মুড়ি চানাচুর খেয়ে জলদি শুয়ে পড়লো মিতালী। সারারাত একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে যেন,ঘুমের মধ্যেই কত বার যে ,এত বড়ো বিছানায় শুভ কে হাতড়েছে আর রুনু রুনু বলে ডেকেছে তার ইয়ত্তা নেই!
তখন খুব ভোর,ঘড়িতে চারটে পঁচিশ। হটাৎ ঘুমটা ভেঙে যায় মিতালীর।জানলার পর্দা সরিয়ে কাঁচ দিয়ে বাইরের থমথমে আর সারা রাত বৃষ্টি ভেজা শহরটা একবার দেখেই আবার শুতে গেল।একটা কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল,আবার। কিন্তু এই সময় কে ডাকবে তাকে? বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই আবার দরজায় টোকা! “উহঃ কে রে বাবা”বলে আই হোলে চোখ রাখতেই ,আরে বাপরে এ যে, সুসংবাদ কাকভোরে! দেখে কি ,রুনু দরজার সামনে মাথা নিচু করে জবু থবু ভাবে দাঁড়িয়ে। দরজা খুলেই আনন্দে জড়িয়ে ধরে রুনুকে ,মিতালী । বাড়ির খবর নিতেই রুনু মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলো ঝর ঝর করে।কাঁদিস না রুনু,ভাই কেমন আছে বলতেই মুখ চাপা দিয়ে বাথরুমে চলে গেল সে।আরো কয়েক ঘন্টা বিছানায় গড়িয়ে মিতালী উঠে দেখে রুনু রান্না বান্না,কোটা বাটা সব শেষ করে জামাকাপড় ভেজাচ্ছে।
“এই রুনু ,তুই এতো রাতে কি করে এলি রে মা আমার?”মিতালীর কৌতূহলী প্রশ্নে বিশেষ কিছু হেলদোল হলো না রুনুর। এক মনে এতদিনের জমে থাকা কাজ সে সেরেই চলেছে। টিফিনে মুড়ি কলাই সেদ্ধ খেতে খেতে রুনুর কথা শুনে স্তম্ভিত হলো মিতালী! রুনু যেদিন পৌঁছায়,সেদিন রাতেই কিনা ওর ভাই মারা যায় ,জ্বর কমছিল না! সবে সাড়ে নটা বাজে,রান্না ঘরে ঢুকে দেখে সব রান্না কি সুন্দর পরিপাটি করে রেখে দিয়েছে!!এই রুনু যেন কোন জাদুবলে,এই কদিনে আরো চটপটে হয়ে ফিরেছে।
বেলা বাড়ায় বৃষ্টিটা থেমে হালকা রোদের ঝিলিক যেন রুনুর বাড়ি ফেরার সুখবর ইঙ্গিত করছে।গতকাল এই বৃষ্টি আবহাওয়া দেখে অনির্বান ডিরেক্ট শ্বশুরবাড়ি থেকে শুভ কে নিয়ে আজ ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসেই আবার কাল সোমবার ভোরে চলে যাওয়া।”চল রুনু শুবি চল” বলে মিতালী চলে গেলেও রুনু “নাগো বৌদি তুমি শোও,আমার ভালো লাগছে না বলে, চুপ করে বারান্দায় বসে রইলো।
“কৈ দেখি,দেখি শুভ,তোর গলার কাছে কি হয়েছে রে এটা”,হাত দিতেই ভয়ে-যন্ত্রণায় কেমন শিউরে উঠলো যেন। লাল টকটকে মতন একটা ক্ষত, বিষাক্ত পোকা কামড়ে দেবার মতো।ওষুধ লাগিয়ে সেটা ঠিক হলো তো আবার সেদিন ছুটির দিনে চান করাতে গিয়ে দেখে হাতের কব্জির পেছনে একই রকমের দাগ। সেদিন আর মাথা ঠিক রাখতে পারে নি মিতালী,”কেন ভাই কে ,যত্ন নিস না,মশারি টাঙ্গাস না তুই”বলে রুনুকে ডেকে বেশ কড়া করে বকা দিয়েছে।আর শুভ, মা কে চুপ করাচ্ছে,মা “প্লিজ তুমি আর বোকো না,দিদি খুব রেগে যায়,আমার ভয় করে”!
হঠাৎ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে গোটা ঘর দেখে খোলা,কোথাও নেই রুনু।ছাদে,নিচে তন্ন তন্ন খুঁজে,ডেকে হয়রান হয়ে অনির্বাণকে ফোন করতে সে জানালো ফিরছে আজ।একটা লেট ফাঁকা ট্রেনে এক সাংঘাতিক নাকি ঘটনা হয়েছে,বাড়ি ফিরে বলবে।সারারাত তিন জন অপেক্ষা করেও রুনু কিন্তু ফিরলো না! আগামীকাল ও ছুটি দেখে অনির্বাণ ঠিক করলো,ঠিকানা তো আছে যাই রুনুর গ্রামে একবার দেখে আসি!এই বয়সের একটা মেয়ে এইভাবে ঘর থেকে উধাও,অন্তত বাড়িতে খবর বা গেছে কিনা দেখে আসাও হবে।
ভোর বেলায় পাশের বাড়ির পোষা কুকুরটা চিৎকার করছিল কেমন অদ্ভুত একটা ভয়ে!সকালে উঠে সবাই শুনলো ,বীভৎস ভাবে গলার কাছটা কে যেন কুকুরটার খুবলে খেয়েছে।ওপরের বারান্দা থেকে এই মর্মান্তিক দৃশ্যটা দেখে মন টাই খারাপ হয়ে গেল অনির্বাণের।মিতালী,শুভ কে না নিয়েই সে বেরুলো বাইক নিয়ে রুনুর গ্রামে তার খোঁজে।
এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে আজ ,রান্না ঘরে খুট খাট শব্দ হচ্ছে দেখে মিতালী দৌড়ে গিয়ে দেখে,রুনু নিজের মনে রান্না করছে।কিন্তু একি ,রাতারাতি রুনুর এতো লম্বা চুল হলো কি করে,এলোকেশীর মতো এমন ভাবে মুখটা ঢাকা আছে চুলে। মিতালী কেমন যেন ভয়ে কিছু বলার আর সাহস না পেয়ে চুপ করে ফিরে এলো। পায়ে পায়ে ছাদে উঠে দেখে ,ওমা,একি-তার ডাইনিং রুমের দুর্গা মূর্তি,কৃষ্ণের ক্যালেন্ডারটা কি বিশ্রী ভাবে দুমড়ে পরে আছে, বৃষ্টি ভেজা জল থই থই ছাদে।
এদিকে ঠিকানা নিয়ে একের পর এক রাস্তার লোককে শুধিয়ে,রুনু দের শ্যামবাটি গ্রামে পৌঁছে তাজ্জব বনে গেছে অনির্বাণ! গ্রামের লোক জন বলে কি ,গতমাসে ওই বাড়ির তরতাজা ছেলেটা রোগে ভুগে মারা যাওয়ার পর দুঃখ, শোকে ওই বাড়ির তিন জনই অপঘাতে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়। এমনকি মেয়ে বাইরে থাকতো সেও কিনা মরে গেল,আটকাতে পারলো না মা বাবাকে এটাই ওদের আফসোস। শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারে নি অনির্বাণ! শুধু ভাবছে,তবে যে রুনু তার বাড়িতে কাল দুপুরেও ছিল! তার মাথা কাজ করছিল না তবুও,অনির্বাণ একজনের সাথে রুনু দের বাড়িতে ঢুকল। গোটা বাড়িটা মৃত্যুর আগে কেরোসিন ঢেলে ওরা পুড়িয়ে তবে নিজেরা মরে। কি অদ্ভুত চরম অসহায়তায় মানুষের ন্যূনতম জ্ঞান লোপ পায় ভেবে অবাক হলো।চারিদিকে এখনো যেন পোড়া গন্ধ! ওদের পায়ের শব্দে কালো কুচকুচে দুটো বেড়াল কেমন ভাবে থমকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। তখনও বাইরের তারে ঝুলছে গত বছর পুজোয় কিনে দেওয়া রুনুর জামাটা আধপোড়া হয়ে! একটা চাপা কষ্ট ,ভয় স্তম্ভিত করে দিচ্ছিল অনির্বাণকে।তখনই মিতালীর আশ্বস্ত গলায় ফোন এলো,”অনি তুমি কোথায়,চলে এসো,যাক বাবা রুনু ফিরেছে,সঙ্গে ওর মা বাবাও।”
কি করে যে অনির্বাণ ,মিতালী কে ফোনে বোঝাবে ,মৃত তিন ব্যক্তি কি ভাবে তার বাড়িতে পৌছালো,আর ওদের সামনে মিতালী,শুভ কতটাই বা সুরক্ষিত এসব প্রশ্নের ঢেউ নিয়েই বাইক স্টার্ট দিলো অনির্বাণ।তাঁর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সব কিছু ভেবে। অনির্বাণ আবার রিং ব্যাক করে মিতালীকে, সাবধান করতে যেতেই ওপাশ থেকে রুনুর গলা এলো,”দাদা বাবু তুমি কোঁথায়,জলদি এসো কত দিন দেখিনি”শুনে এক শিরশিরানি ধরে গেল শরীরে। গত কাল কোনো ট্রেন না পেয়ে এক বারো ঘন্টা লেটে আসা ফাঁকা জয়নগর প্যাসেঞ্জারে উঠে,ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছিলো অনির্বাণ। যখন ঘুম ভাঙলো ট্রেন এক অন্ধকার নিঝুম স্টেশনে দাঁড়িয়ে। জন মানব শূন্য ,আলো আঁধারী গোটা কামড়া ,আর দু চারটে চামচিকের ডানা ঝটপটানি নিয়ে ট্রেনটা আবার ছাড়লো ।তখুনি অনির্বাণের চোখ যায় ওপরের সিটে ,কে যেন কম্বল জড়িয়ে শুয়ে।অনেক ক্ষন পার হলেও কোনো আওয়াজ না পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শিউরে ওঠে সে,একটা ডেড বডি, মুখটা খুবলানো! খুব চেনা যেন তার ,কিন্তু কিছুতেই কোথায় দেখেছে মনে পড়ছিল না। পরে ট্রেনটা বড় স্টেশনে আসতেই কাল বিলম্ব না করে অনির্বাণ কামড়া চেঞ্জ করে। পরক্ষনেই তার মনে পড়ে,ওটা ছিল রুনুর বাবা,সেদিন নিতে এসেছিল রুনু কে অসুস্থ ভাইয়ের জন্য।রুনুর বাবা কে এভাবে মেরে ফেলে দিলো কামরায়,এর উত্তর আজ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়,আদতে ওটা ছিল তার ভ্রম,মৃত মানুষ নয়,অশরীরী অতৃপ্ত আত্মা,আজও তাদের পিছু ছাড়ছে না!
আসার সময় শ্মশান কালি মন্দিরে পুজো দিয়ে,মায়ের চরণ ফুল ;প্রাসাদ আর লাল টিপ পরে যেন একটু মনের জোড় বেড়ে গেল অনির্বাণের।গলির মুখে ঢুকতেই দেখে মিতালী ,শুভ কে নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে যেন তারই অপেক্ষায়।পেছনে পেছনে রুনু,তার মা,বাবা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে।শুভ ততক্ষনে মা কে বলে দিয়েছে ,”মা দুদিন সে দেখেছে,ঘুমিয়ে গেলে রুনু দি তার শরীরে দাঁত বসিয়ে রক্ত খায়”। ছেলের মুখে ওই কথা শুনে আর এক বিন্দু নিজেদের বাড়িতে আর সুরক্ষিত নয় মনে করেই বেরিয়ে পড়ে মিতালী।
এই অবস্থায় ওদের সামনে কি করবে ভেবে না পেয়ে অনির্বাণ ,সাহস নিয়ে ঘরে ফিরলো সবাই কে নিয়ে। মিতালী কে বলে রাখলো মোটামুটি প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র,টাকা পয়সা নিয়ে নাও,ঠিক সুযোগ বুঝে পালাবো। দুপুরে রুনুর রান্না করা একটা খাবারও গলা দিয়ে নামলো না কারুর।ভেতরে ভেতরে ভয়ের স্রোত,এই ভাবে মৃত দের সাথে কি কাটানো সম্ভব,না যায়! ঠিক সন্ধ্যায় চুপ চাপ ঘর খালি দেখে জলদি লক করে,বাইরে ঠাকুরের পুষ্প বেঁধে নিজেদের নতুন বাড়ি ছেড়ে এক বন্ধুর বাড়ি ওঠলো।কাউকে কিছু না বলে পরের দিন মিতালী বাপের বাড়ি ওঠে শুভকে নিয়ে।মিতালী,অনির্বান কে অনুরোধ করে শ্মশানের পুরোহিত মশাইয়ের সাথে ওই তিনজনের শ্রাদ্ধ শান্তি প্রক্রিয়া কিভাবে করা যায় পরামর্শ নিতে ও জলদি সম্পূর্ন করতে।।রুনুর জন্য খুব মন খারাপ করে মিতালীর,মেনে নিতে কষ্ট হয় যে পরিবারের চার জন এই ভাবে জলদি মারা যাবে! আর যাই হোক শুভ একটা দিদি পেয়েছিল,কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল!