এক
“নিলু আবার চলে গেছে”কান্নার তোড় সামলে ছিটকে আসা ওই শব্দগুলো আমাকে সপাং করে ভোরের বিছানা থেকে দাঁড় করিয়ে দিল শান বাঁধানো ঠান্ডা মেঝের ওপর।একে তো দুচোখ জুড়ে গত রাতের কুয়াশা,মাথার ভেতর ঘুমের তলানিতে ছায়া ফেলে কাটা ঘুড়ির মতো হারিয়ে যাচ্ছে ভোরের স্বপ্নের রেশ।তার ওপর “কি করবো”? “কোথায় যাবো”?”কাকে ডাকবো”? পরস্পর প্রশ্নগুলো একের পর এক শেকলের মতো আমায় বেঁধে ফেলছে নিজের সঙ্গেই।মায়ের চোখের আতঙ্ক আর কান্নায় বেঁকে চুরে যাওয়া অভিব্যক্তির হাত থেকে পালাতেই যেন কোনমতে গায়ে গেঞ্জি গলিয়ে সাইকেলটা নিয়ে নেমে পড়লাম আমাদের বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায়।ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাডেল করতে থাকলাম মিটার সাতেক দূরে শিমূল গাছটার নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খোয়া বাঁধানো রাস্তাটার দিকে।
দাদা আবার চলে গেল,এই নিয়ে দ্বিতীয়বার।প্রথমবার ঘটনাটা ঘটিয়েছিল মাস আটেক আগের এরকমই এক সকালে,টানা পাঁচদিন থানা,হাসপাতাল,মর্গ, জলা, বাদাড় ঘুরে হন্যে হয়ে আমি যখন নিজেকে তৈরি করে ফেলেছি চরম কোনো খবরের জন্য বা সত্যি কথা বলতে কি প্রতিদিনই ওই টেনশন নামক ঘুন পোকার কুড়ে কুড়ে খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে আমি যখন অপেক্ষা করছি ওই চরম অপ্রিয় কিন্তু স্বস্তিদায়ক খবরটার জন্য তখনই ফিরে এসেছিল দাদা।বলা ভালো ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।পাশের গ্রামেরই একজন “মহানুভব” দাদাকে স্টেশনের পিছনে শীতলা মন্দিরের কাছে ঘুর ঘুর করতে দেখে একেবারে বগলদাবা করে নিয়ে হাজির।
জ্যৈষ্ঠের খর রোদ্দুর মাথায় নিয়ে আমি তখন বাড়ি ফিরছি,দূর থেকেই চোখে পড়লো আমাদের তিন কামরার বাড়ির সামনের জানলাটা।সাইকেলটা থামিয়ে একটু সময় নিয়েছিলাম,ভেবেছিলাম এখন অনেক কাজ বাকি,অনেক দৌড় ঝাঁপ সামনে।ও মা,কোথায় কি!দেখি ,দাওয়ায় লাজুক লাজুক মুখে মাথা নিচু করে বসে আমার দাদা নীলাদ্রি স্যানাল, মুখে বিগলিত হাসি।আর দাদার মাথা বুকে জড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছেন আমাদের বিধবা মা ,পাড়া প্রতিবেশীদের চোখে জল,মহিলাদের কারো মুখে আঁচল কারো বা চোখে।শুধু আমার মধ্যে যেন কোন্ ফাঁক দিয়ে জ্যৈষ্ঠের এই দুপুরটা ঢুকে পড়েছে আর ভেতর ভেতর শুকিয়ে খট খটে করে দিচ্ছে আমায়।বুঝেছিলাম,এ যাত্রা কাটলেও ওই টেনশনের ঘুন পোকাদের হাত থেকে রেহাই নেই আমাদের।ঠিকই ভেবেছিলাম, ধরে নিয়েছিলাম দাদা এভাবেই একদিন আবার চলে যাবে।আর তাই হল,এই আট মাস প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত বুকের মধ্যে একটা শির শিরে ভয় নিয়ে কাটিয়েছি আমি আর মা।ধীরে ধীরে যখন ওই ভয়ের সাপটা ফনা নামিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শীতঘুমে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে তখনই এলো মোক্ষম ছোবল।
দুই
আজ দু মাস হয়ে গেল দাদার খোঁজ নেই।মায়ের শোক এখনো তাঁর দু গাল ভেজালেও আর আমার বুক অবধি পৌঁছয় না।ঘুন পোকার কুড়ে কুড়ে খাওয়ার শব্দ আজকাল আর শুনতে পাইনা।এখন আমি আবার নিয়মিত দাড়ি কামাই,কাঁচা-ইস্ত্রিকরা জামা প্যান্ট গায়ে চড়াই, দিন দশেক আগে চুলও কেটেছি।তেল,সাবান,শ্যাম্পুরাও আবার ফিরে এসেছে নিজের নিজের জায়গায়।আবার নিজেকে তৈরি করে ফেলেছি…কিন্তু ওটা কে ?ঘোষাল বাড়ির সামনে তেঁতুল গাছের ছায়ায় কমলা সাদা সালোয়ার কামিজে অনসূয়া না?হ্যাঁ, অনসূয়াই তো।ও আমায় দেখতে পেয়েছে,আমার দিকেই আসছে।ও কবে ফিরল ?দাদার খবর পেয়েই কি ফিরে এসেছে ? না অনসূয়া লাহিড়ীর কাছে ল্যাং খেয়ে নীলাদ্রি স্যানাল শোকে দুঃখে নেশা ভাঙ করে মাথা খারাপ করে ফেলেছে এতোটা প্রেডিক্টেবল্ ব্যাপার স্যাপার আমাদের শীতল পুকুর গ্রামে ঘটেনি। এলাকার সব থেকে মেধাবী, সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলেটির সঙ্গে
গ্রামের ভদ্র,নম্র,গানজানা,অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েটির সম্পর্ক বেশ অবধারিতই ছিল বরং যেটা ঘটেছিল সেটা আরও ভয়ঙ্কর।
বছর দেড়েক আগে হেমন্তের এক তড়িঘড়ি ফুরিয়ে আসা বিকেলবেলা যেন কখনো পূরণ না হওয়া শূন্যস্থানের মতো গেঁড়ে বসেছিল দাদা আর অনসূয়ার মাঝখানে।ঘটনাটা ঘটেছিল পুরনো মল্লিক বাড়ির পিছনের বাদাড়ে।মল্লিকবাড়ির ডান দিকে খোয়া বাঁধানো রাস্তার ওপারে কলমের আমবাগানে পড়ে ছিল দাদা।ওরা প্রচন্ড মেরেছিল দাদাকে নাক- মুখ থেঁতলে দিয়েছিল ,ডানহাতের কব্জিটাও ভেঙে ফেলেছিল।আর বাদাড়ের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল অনসূয়াকে।সংখ্যায় চারজন ছিল ওরা।সেইরাতে টিউশন ফেরত কয়েকটি কলেজ পড়ুয়া নিজেদের শর্টকাটের রাস্তায় খুঁজে পেয়েছিল অসময়ের কালবৈশাখীর দাপটে বিধস্ত অনসূয়াকে। আরও ঘন্টা দুয়েক পরে খুঁজে পাওয়া গেল জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধা, হেমন্তের হিমে মৃতদেহর মতো ঠান্ডা দাদার শরীরটা। অপরাধীরা ধরা পড়েছিল।পাকুরবাগানে পিসির বাড়িতে বেড়াতে আসা কলেজপড়ুয়া ভাইপো ও তার শহরের বন্ধুরা। ওই ঘটনার পর পরই অনসূয়ার অবস্থাপন্ন বাবা, মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতায় তাদের কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি।যদিও তার খুব একটা দরকার ছিলনা।আমাদের শীতলপুকুর গ্রামের মানুষজন যথেষ্টই সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা দেখিয়ে ছিলেন এই বিষয়টাতে।এমনকি অপ্রয়োজনীয় কৌতূহল বা অযাচিত সহানুভূতির লেশমাত্র চোখে পড়েনি কখনো।যাইহোক, গত দেড়বছরের মধ্যে মাত্র একবারই গ্রামে এসেছিল অনসূয়া,ওর দিদার বাৎসরিক কাজে।না আমাদের বাড়ির চৌহদ্দিও মারায়নি সেবার।অবশ্য তারজন্যে আমি ওকে দোষও দিই না।আর তাছাড়া কার কাছেই বা আসবে?যার কাছে পাকাপাকি ভাবে আসার কথা ছিল সেই মানুষটার ভেতরে তো তত দিনে জাঁকিয়ে বসেছে ওই হেমন্তের শেষ বিকেলের কুয়াশা।সাধ্যমতো চিকিৎসা আর অসহ্য অপেক্ষার পরও ওই কুয়াশার আড়ালে থাকা দাদার মনের হদিশ আর আমরা কখনো পাইনি আর এবার তো দাদা নিজেই হারিয়ে গেল সেই কুয়াশায়।
আচ্ছা স্বপ্ন কি ছোঁয়াচে? না হলে মার সাথে থাকতে থাকতে আমিও কেন স্বপ্ন দেখি যে দাদা ফিরে এসেছে।আবার আমাদের তিন কামরার বাড়ির দাওয়ায় গ্রামের লোক ভিড় করেছে,আর সেই ভিড়ের মাঝখানে কান্নায় ভেঙে পড়া আমার বিধবা মায়ের মাথা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দাদা,মুখের সেই বিগলিত হাসি উধাও।দাঁড়ির আড়ালে দৃঢ় চোয়ালের আভাস।আমার কাঁধে হাত রেখে বলছে যে আমি এবার নিশ্চিন্ত আর একা একা এভাবে লড়াই করতে হবে না আমায়।দাদার চোখের দৃষ্টি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।না আমাদের পোড়া সংসারে এই স্বপ্ন এতোটাই বিদেশি যে ঘুমের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করতে ভয় পায়,তাই জেগে জেগেই দেখি।কিন্তু অনসূয়া এসব কি বলছে আমায়? আমি কি ওর কথায় বিশ্বাস করবো?বিশ্বাস না করারও তো কোনো কারণ নেই,ও কেন আবার মিথ্যে বলবে?অনসূয়ার কথা আর আমার মাথায় ঢুকছে না আমি আর ওর কোনো কথা শুনতেও পাচ্ছি না।আমার দু কান জুড়ে আবার ফিরে এসেছে ঘুন পোকাদের কুড়ে কুড়ে খাওয়ার আওয়াজ আবার বুকের ভেতর ফোঁস ফোঁস করে বিষ ছেটাচ্ছে ভয়ের সাপটা,আর সেই বিষে বিষে নীল হয়ে যাচ্ছি আমি।
তিন
আরো বছর দুয়েক কেটে গেছে,দাদা আর ফিরে আসে নি,আমি আর অনসূয়া এখন স্বামী-স্ত্রী। মা কে মানাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল,না দাদা ফিরে আসবে এই আশা বা আশঙ্কার জন্য নয়।কারণ মুখে স্বীকার না করলেও মা ভালোই বোঝেন ওই লাজুক মুখে যে মানুষটি বারান্দায় বসে থাকতো, কখনো সখনো অন্যমনস্কভাবে বিড়বিড় করতো,সেই মানুষটি বড়জোর মায়ের নীলু আমার দাদা,মানুষ নীলাদ্রি স্যানাল চিরকালের মতো গা ঢাকা দিয়েছিল ওই আমবাগানের শেষ বিকেলের অন্ধকারে।আসলে বড় ছেলের একসময়ের বান্ধবীকে নিয়ে ছোট ছেলে শোয়ার দরজায় খিল দেবে এটা মেনে নিতেই মার একটু অসুবিধা হচ্ছিল,সেটাও সামলানো গেছে অনসূয়ার জন্য।দিব্যি আছি আমরা তিনজন,খুব তাড়াতাড়ি চারজন হয়ে যাবো।আগামী দিনগুলোতেও আশাকরি ভালোই থাকবো।যদি না…
দু বছর আগে ঘোষাল বাড়ির তেঁতুল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে অনসূয়া আমায় বলেছিল ও নাকি দাদাকে দেখেছে। কলকাতায় বেন্টিংক স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে হন হন করে উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে যাচ্ছে নীলাদ্রি স্যানাল।খালি গা,ছেঁড়া প্যান্ট পরা,নোংরা,পাগলা,অসুস্থ,নীলাদ্রি স্যানাল।
সিগন্যালে দাঁড়ানো বাস থেকে দাদাকে দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে নেমে পড়েছিল অনসূয়া।চেষ্টা করেছিল তার একসময়ের প্রেমিকের কাছে পৌঁছতে, কিন্তু পারেনি। ভিড়,ধোঁয়া, ধুলো আর জমাট বাঁধা বাস,ট্যাক্সি,ঠেলা ,লরির মধ্যে আবার হারিয়ে গিয়েছিল নীলাদ্রি স্যানাল।মার কানে এখনো কথাটা ওঠেনি,কি করে বলবো? কত বড় শহর!অত মানুষ!এ্যাতো গলি ঘুঁজি!তার মধ্যে কোথায় খুঁজবো আমার মাথা খারাপ দাদাকে? অনসূয়াকে বলেছিলাম তুমি ভুল দেখেছো।চোখের ভুল,মনের ভুল আর তাছাড়া ভুল তো আরও কত রকমেরই হয়।আজও বোঝাই,মাঝে মাঝেই বোঝাতে হয়।যখনই দাদার প্রসঙ্গ ওঠে তখনই চেষ্টা করি দুজন দুজনের দিকে না তাকাতে, চোখে চোখ না রাখতে।আমি সিগারেট বা মোবাইল হাতে সরে পরি আর অনসূয়া রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।এভাবেই চলছে,যদিও আমার ভেতরের বিষের নীল রঙ এখন অনেকটাই ফিকে,কিন্তু আজও অসময়ে দরজার কড়া নড়লে আবার কিলবিলিয়ে ওঠে সেই ভয়ের সাপটা।দম বন্ধ করে প্রহর গুনি, এই বুঝি মা বলে উঠলো”নীলু আবার ফিরে এসেছে”।
সমাপ্ত