“না মা তুমি ওই লোকটা কে খেতে দেবে না একদম” বলে মায়ের পথ আটকালো রোহন।অনেকক্ষণ থেকে একটা ক্ষেপা পাগল গলির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।মনি রান্না ঘর থেকে যেই দেখেছে রান্না ঘরের ড্রেনের মুখে যে নেট বসানো আছে ওখানে খুঁটে খুঁটে লোকটা ভাত গুলো তুলে খাচ্ছে ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে। আজ ভাতের ফ্যান গলানোর সময় রান্নার মেয়ে ফুলকি প্রচুর ভাত ফেলেছিল বেসিনে,অন্যদিন হলে রেগে ঘর মাথায় করতো মনি এভাবে কিনা মা লক্ষীকে অপমান করা! আজ এমন দৃশ্য দেখে হু হু করে উঠেছে ভেতরটা মনির। বাজার হাট দোকান সব লক ডাউনে বন্ধ, রাস্তার কুকুর বেড়াল গুলোরই কিছু জুটছে না।মানুষ পথে না বেরুলে,চা খাবারের দোকান গুলো না খুললে এই ভিখারি,পাগল গুলোরও বড়ো জ্বালা।
গরম গরম ভাত নামতেই মনি একটু আলু সেদ্ধ,ভেন্ডির ঝাল আর ভাত, শালপাতার প্লেটে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল হঠাৎ রোহন এসে পড়েছে সামনে।দুদিন ধরে এতটাই ছেলেটার মন মরা,খাওয়া ঘুম সব ছুটেছে তার। শখের কুকুর মোতিকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না।বাগানের গোটা চারেক গাছ হঠাৎ করে ধেয়ে আসা ঝড়ে উপড়ে সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা।শুধু ওদের নয় গোটা শহরটা লন্ডভন্ড হয়ে আঁধার ও দুশ্চিন্তায় ডুবে থমথমে হয়ে গেছে আজ তিনদিন।
রোহন ছাদে দাঁড়িয়ে ঝড়ের তান্ডবে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া শহরটাকে দেখছিল।তার প্রিয় এ শহর এক রাতেই কেমন যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে।রাস্তার ধারে বন সৃজনের গাছগুলো এমন ভাবে উপড়ে পড়েছে চোখে দেখা যায় না। চারদিকে শহর জুড়ে বিবর্ণতায় এ যেন তার মনের ভেতরেরও দাগ কেটেছে ক্ষত চিন্হ । বাড়ির সদর দরজায় গলির মধ্যে শুয়ে থাকা তিনটে কুকুরের দুটোকে নিরাপদে বারান্দায় জায়গা দিয়ে বাঁচাতে পারলেও আর এক কুকুর অত্যন্ত ছটফটে মোতি’র কোনো দেখা সে পায় নি।মোতি তো এমন করে না,যেখানেই যায় ঠিক খাবারের সময় হলে চলে আসে।সেদিন খবরে কুকুরের মধ্যেও করোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর শুনে বাবা সাবধান করেছিল এগুলোর সাথে এতটা কাছ ঘেঁষে আদর করিস না।এটা ঠিক মোতিটাই বেশি আদরের ছিল রোহনের।ছাদে খেলতে গিয়ে ক্রিকেটের বলটা একবার নিচে পড়ার অপেক্ষা মোতি ঠিক খুঁজে এনে মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।এ দৃশ্য যত মনে পড়ছে অজান্তে চোখ দিয়ে জল নেমে আসছে।
সারারাত প্রবল বৃষ্টি আর প্রায় দেড়শ কিমি বেগে ঝড়ের বেপরোয়া তান্ডবের পরের দিন বেলায় একবার রাস্তায় মোতিকে খুঁজতে বেরুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল রোহন।গলির সামনে ইলেকট্রিক খুঁটি এমন ভাবে পড়েছে,মিত্তাল দের বিরাট পাঁচিলটা ভেঙে নিচে দাঁড়ানো গাড়িটাকে তুবড়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন রাস্তাটা রাস্তা নয় কোনো বুঝি লেক,ভেসে যাচ্ছে কত কি ছেঁড়া চটি,আবর্জনা,গাছের ডাল,মরা পাখি আরও কত কি!বিদ্যুৎ পরিষেবা,ফোন,পানীয় জলের চরম আকালের পর গত কাল থেকে সব একটু স্বাভাবিক হচ্ছে, রাস্তার জলও নেমেছে।কাল সন্ধ্যায় ওরই ক্লাস মেট ঋভু ফোন করে দুঃসংবাদ দিতেই আরো মুষড়ে পড়ে রোহন।মোতির খবর নিচ্ছিলো ঋভু,জোর করতেই বললো ওদের বাড়ির নিচে একটা কুকুর গাছ চাপা পড়ে মারা যায়,তুই একবার মোতির ছবি দেখিয়ে ওর গলায় নীল বেল্টের কথা বলেছিলিস তাই কনফার্ম হলাম বলে ঋভু ফোন রাখতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে রোহন।
আজ রোদ ঝলমল আকাশ দেখে একটু বেরিয়ে ছিল রোহন,মাঠের পেছনে যে ঝোপটা ওদিকে যেতেই চমকে ওঠে এটা দেখে যে,মরে থেঁতলে যাওয়া মোতির মাংস টা খুবলে খাচ্ছে এক ক্ষেপা।কষ্টে বুকটা তার ফেটে যাচ্ছিল,ইস তাবলে খিদেয় জ্বালায় কিনা কুকুরের মাংস তাও কিনা মোতির!এভাবে মোতির অকাল মৃত্যু আর এমন অন্তিম দৃশ্য দেখে মন খুব চঞ্চল ও ভাবুক হয়ে যায় রোহনের।অনেকক্ষণ খোলা আকাশের নিচে বসে প্রায় দুপুর একটা বাজায়,পাছে বাড়িতে চিন্তা করবে উঠে আসে।আরে সেই ক্ষেপাটাতো, বাড়ির সামনে ঘুরছে! হঠাৎ এর ওপর রাগ,মোতির এভাবে নিথর পড়ে থাকা আর মায়ের হন্তদন্ত হয়ে গরম ভাত নিয়ে আসা দেখে রাগ থেকে পথ আগলায় মায়ের।সব শুনে মা আজ অনেক স্বান্তনা দিয়ে বুঝিয়েছে,মানুষ খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারে না বলেই আজ কিনা অখাদ্য কু খাদ্য এমনকি রাস্তায় ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজতে হয় মানুষকে কুকুরের সাথে লড়াই করে!নাহলে পশুর কাঁচা মাংস পর্যন্ত খেতে বাধ্য হয়েছে ও।এ লজ্জা আসলে আমাদের আধুনিক উন্নত মানুষের।