বাড়ি ঘুটিগাছায় । ভোর চারটেতে বিছানা ছেড়ে ওঠে । তারপর প্রাতঃকৃত ও অন্যান্য কর্ম সেরে নিজের হাতে এক কাপ চা তৈরি । চা খেয়ে বাজারের বড় তিনখানা ব্যাগ ও একটি ডেস্কি নিয়ে সোজা বনগাঁ স্টেশন । ৪টে ৪০মিনিটের ট্রেনে রানাঘাট মাছের আড়তে পৌঁছানো । সেখান থেকে পাইকারি দরে মাছ কেনা । প্রাতিদিন পছন্দ মতো মাছ মেলে না । খুব সকালে খরিদ্দারেরা জ্যান্ত মাছ খোঁজ করে । তাই শান্ত মাসিকে ছোট জ্যান্ত বাটা মাছ, আড়াই কিলো বা তিন কিলো ওজনের জ্যান্ত কাতলা ও রুই মাছ, স্থানীয় জ্যান্ত ট্যাংরা/পুটি, ইত্যাদি মাছ অন্যান্য মাছের সঙ্গে অবশ্যই নিতে হয় । কিন্তু প্রতিদিন জ্যান্ত ট্যাংরা বা পুটি মাছ জোটে না । তখন জ্যান্ত ল্যাঠা, শোল, শিং, ইত্যাদিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় । তারপর ডেস্কিতে খানিকটা জলের মধ্যে জ্যান্ত মাছগুলি সমেত ডেস্কিটা মাথায় নিয়ে এবং হাতের ব্যাগে অন্যান্য মাছ নিয়ে ছুটলো পুনরায় রানাঘাট স্টেশন । রানাঘাট স্টেশন আবার বড় রেলওয়ে জংশন । যে ভাবে হোক তাকে ৬টা ৩০মিনিটের মধ্যে চাকদা বাজারে মাছের ব্যাবসা শুরু করতেই হবে । কেননা তার কয়েকজন বাধা খরিদ্দার ঐ সময়ে মাছ কিনে নিয়ে বাড়ি ঢুকে স্নান করে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে ৭টা ৩৫মিনিটের চাকদা স্টেশন থেকে ১২বগি গ্যালোপিং রানাঘাট লোকাল ধরে । তারপর তাঁরা কলকাতায় অফিস করেন।
এইসব বাধা খরিদ্দার চলে গেলে শান্ত মাসির বিপদ । তার আয় কমে যাবে । বাড়িতে অনেকগুলি লোক । শান্ত মাসির স্বামী বোবা, নাম পুলিন । জন্ম থেকে কথা বলতে পারে না । মর্জি ভাল থাকলে শান্ত মাসির মাছ বিক্রির সময় অনেক সহযোগিতা করে । নতুবা নিজের খেয়ালখুশী মতো তাঁর জীবনযাপন ।
সকালের মাছ বিক্রিতে শান্ত মাসির অনেক সমস্যা । সবাই ব্যস্ত । খরিদ্দারদের দাঁড়াবার সময় নেই । এবং প্রত্যেক মানুষ মাছ কেটে নিতে উদগ্রীব । তাই শান্ত মাসির মাছ কাটতে সময় লাগে বেশী । তবে তার বোবা বর উপস্থিত থাকলে মাছ কাটার কাজ সে অনেকটা সামলায় । যে কাজটা করে, নিবিষ্ট চিত্তে করে । কিন্তু তাঁর একটাই দোষ, বড্ড রাগ । তেমনি জেদ । রাগলে আর রক্ষে নেই । হাতের কাছে যা পাবে সেটাই ভেঙ্গে চুরমার । যার জন্য শান্ত মাসি তার বরকে সহজে বাজারে আনতে চায় না।
খরিদ্দারের ভিড় লাগলে শান্ত মাসির সমস্যা বাড়ে । পুটি মাছ কাটাও ঝামেলা । সকালে সকলের তাড়া । শান্ত মাসির মাথা খুব ঠান্ডা । ধীরে সুস্থে খরিদ্দাদের ঝামেলা সামলায় । মাছের ব্যবসাটা শান্ত মাসি ভাল বোঝে । যার জন্য মাছের ব্যবসায় তার বাড়-বাড়ন্ত । কষ্ট হলেও ভোর বেলায় উঠে মাছের ব্যবসার জন্য বেরিয়ে যাওয়া তার নিত্যদিনের রুটিন । সময়ানুবর্তিতা মাসির জীবন দর্শণের একটা উজ্জল উদাহরণ ।
এক ছেলে, নাম অপু । অল্প বয়সেই ভাব ভালভাসা করে তিলি সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করেছে । এইজন্য শান্ত মাসির আপশোশ নেই । তবে তার দুঃখ অন্য জায়গায়, নিজের স্ত্রীকে তো খাওয়াতে হবে ? সে ব্যাপারে অপুর হেলদোল নেই । খাবে আর ঘুমাবে । কাজকর্মে নবডঙ্কা । তার বৌ বাড়িতে দুমুঠো ভাত রান্না করে, তাতেই ছেলের কতো গোসা ! তার বৌকে নাকি বেশী খাটানো হচ্ছে ।
বৌকে নিয়ে সিনেমায় যাবে, তাকে টাকা দাও । এমনকি ফুচকা কিনে বৌকে খাওয়াবে, তাকে টাকা দাও । টাকা চাওয়ার জন্য শান্ত মাসি একদিন ছেলেকে যাচ্ছেতাইভাবে কথা শোনালো । তাতেও সাহেবের উপায়ের তাগিদের জন্য তাগিদ নেই ।
সেদিন পুলিন বাড়িতে । মাসি মাছ নিয়ে চাকদার বাজারে । প্রচন্ড ক্ষিদে পাওয়ার জন্য বোবা শ্বশুর বৌমার কাছে খাবার চেয়েছে । তখন বাড়িতে কোনো খাবার নেই । ভাত রান্না হতে অনেক দেরী ।
তাই বৌমা শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললো, “রান্না হতে দেরী । রান্না হলেই খাবারের জন্য তাঁকে ডাকবে” ।
শ্বশুর মশায় ইশারাতে বৌমাকে বোঝালো, “ভাত রান্না হতে দেরী, সুতরাং তাকে রুটি বানিয়ে দেওয়া হোক । কেননা তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে” ।
বৌমা তাতে গররাজি ।
শ্বশুর মশায় রেগে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওয়াজ তুললো । কী বোঝাতে চাইলো সেটা না বুঝেই বৌমা তার গুণধর স্বামী অপুর কাছে নালিশ করলো, “শ্বশুর মশায় তাকে বকাঝকা করেছে । উল্টোপাল্টা তাঁর গালিগালাজ” ।
শুনেই অপু সাতপাঁচ না ভেবে তার বাবাকে উত্তম মধ্যম অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ । অকথ্য ভাষায় বোবা বাবাকে ভৎসর্না । তীব্র জোরে আরও অনেক অবান্তর কথাবার্তা শোনালো, “তোমাদের ভাত রান্নার জন্য আমার বৌ দাসি নয় । এক পয়সা উপায়ের মুরোদ নেই তাঁর আবার হম্বিতম্বি” ।
ছেলের অসাংবিধানিক কথাবার্তা শুনে পুলিন ভীষণ রেগে গেলো । একেই জন্ম থেকে বোবা । কথা বলতে পারে না । রাগে তখন অগ্নিশর্মা । নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না । সেই মুহূর্তে রাগে সে হাতের কাছে গ্লাস, বাটি, হাড়ি, যা পেলো সেটাই উঠোনে ছুড়তে লাগলো । কখনও আবার তেড়ে ছেলেকে মারতে উদ্যত ।
উল্টো বুঝলো ছেলে । বাবাকে অনেক কটু কথা শোনালো । অভব্য ভাষার কচকচানি । বোবা বাবা হাউ হাউ করে অপুকে বকছে, আর তার গুণধর ছেলে ততোধিক জোরে চিৎকার করে বাবাকে অশালীন ভাষায় বকছে । চিৎকার শুনে গাঁয়ের লোকের জটলা । গাঁয়ের মানুষেরা বাপ-বেটার রাগারাগি অবলোকন করেও চুপচাপ । কেউ মধ্যস্থতায় বা কলহ নিরসনে এগিয়ে গেলেন না । চিৎকার করতে করতে হঠাৎ ছেলে ক্রূদ্ধ হয়ে বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলো ।
গলা ধাক্কা খেয়ে শারিরীকভাবে দুর্বল পুলিন রাস্তার মাটিতে লুটিয়ে পড়লো । তাঁর চোখে জল । ছেলে এমনভাবে গলা ধাক্কা দেবে তাঁর স্বপ্নের অতীত । কাঁদতে কাঁদতে পুলিন বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেনে চাকদা বাজারে এসে দেখে তাঁর স্ত্রী মাছ বিক্রি করে বাড়ি ফিরে গেছে । অগত্যা পুলিন মনে মনে স্থির করলো, “বাড়ি সে কিছুতেই ফিরবে না । দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকেই সে চলে যাবে” ।
পুলিন ভাবছে, তাঁর স্ত্রী শান্ত মাসিও মাঝে মধ্যে তাকে বকাঝকা, করে এমনকি বেত দিয়েও মারে । কারণ একটাই, রেগে গিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ির আসবাবপত্র সে ভাঙচুর করে । বললেও পুলিন শুনতো না । তাহলেও শান্ত মাসি কোনোদিন পুলিনকে আস্পর্ধা দেখায় নি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে । কিন্তু আজ ছেলের হাতের গলা ধাক্কা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । অসহায়ের মতো কাঁদছে ।
এখন সে রীতিমতো ধন্দে, কোথায় গিয়ে উঠবে ?
নৈহাটী স্টেশনের ৪নম্বর প্লাটফর্মে গাছ তলার নীচের বেঞ্চে শুয়ে পড়লো । ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সে বড্ড ক্লান্ত । নিমেষেই ঘুমিয়ে পড়লো ।
ঘুম থেকে উঠে তাকিয়ে দেখে চারিদিক অন্ধকার । ৫নম্বর প্লাটফর্মে কাটিহার যাওয়ার ট্রেন দাঁড়িয়ে । হাঁটেবাজারে এক্সপ্রেস । সাতপাঁচ না ভেবে ঐ হাঁটেবাজারে এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়লো পুলিন । ট্রেনের ভিতরে বাঙ্কে উঠে সটান ঘুমিয়ে পড়লো । হাতে পয়সা নেই । কোনো জামা কাপড় আনেনি । যে অবস্থায় ছিলো ঠিক সেই অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে । সে কস্মিণকালেও ভাবেনি তাঁকে বাড়ি ছাড়া হোতে হবে । ছেলের হাতে নিগৃহীত হওয়ার পর পুলিনের মন বিষন্ন ।
তারপর —– !
তারপর ভোরবেলায় কাটিহার স্টেশন । স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে ঠিক নেই । চারিদিক পুলিনের ঘোরাঘুরি । যদি চেনা মানুষের হদিশ মেলে ! কিন্তু কোথাও কোনো চেনা মানুষের হদিশ মিললো না । সে অনেকদিন আগে শুনেছিলো, কাটিহার রেলওয়ে স্টেশনে রেলওয়েতে প্রচুর বাঙালী মানুষ চাকরি করেন এবং বাঙালীদের পাড়া রয়েছে । সেখানে অনেক বাঙালী দীর্ঘদিন যাবৎ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । কিন্তু তাঁর কপালে একজন বাঙালীর সঙ্গে সাক্ষাৎ জুটলো না । পুলিন হতাশ । এখন সে কী করবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না । “কথা বলতে না পারা” পুলিনের দৈনন্দিন জীবনে বড় বাধা । স্টেশনের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পুনরায় কাটিহার স্টেশনের প্লাটফর্মে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লো পুলিন ।
কিছুক্ষণ পর কালো কোট পরিহিত টিকিট পরীক্ষক পুলিনকে ঠেলে উঠিয়ে বললো, “টিকিট” ?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো পুলিন । তারপর টিটিই’কে বোঝাতে চেষ্টা করলো, সে প্লাটফর্মে বিশ্রাম নিচ্ছে ।
টিকিট পরীক্ষক তাঁর কথা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না । অগত্যা টিকিট না থাকায় পুলিনকে বিনা টিকিটের যাত্রী হিসাবে টিকিট পরীক্ষক ধরে নিয়ে গেলেন । টিকিট নেই, জরিমানা দেওয়ার পয়সা নেই, স্থানীয় এলাকায় কোথায় বাস করে তার ঠিকানা নেই, ইত্যাদি কারণে পুলিন টিকিটহীন যাত্রী হিসাবে গ্ণ্য হোলো । তারপর তাঁর সাজা হিসাবে সাতদিনের জেল ।
তারপর এদিকে শান্তি মাসি বাজার থেকে ফিরেই পুলিনের খোঁজ শুরু । কেননা কিছু মাছ ফেরৎ এসেছে, সেগুলিতে বরফ দিতে হবে । বরফ দেওয়ার কাজটি একমাত্র তার স্বামী ভাল করে ।
হঠাৎ শান্ত মাসির বৌমা ঠান্ডা জলের সরবৎ বানিয়ে তাকে দিচ্ছে । গরমের মধ্যে ঠান্ডা জলের সরবৎ নিঃসন্দেহে ভাল । কিন্তু বৌমার এইরূপ শাশুড়ি তোষন পূর্বে সে কখনো দেখেনি । তাই কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে শান্ত মাসি বলেই ফেললো, কী ব্যাপার ? তোমার এইরূপ মতিগতি কবে থেকে হোলো ?
কী যে বলেন মা । গরম থেকে এসেছেন, তাই সরবৎ দিচ্ছি ।
তোমার বিয়ের পর শাশুড়ির উপর এইরকম আদিখ্যেতা কখনো দেখি্নি ।
মায়ের কথা শেষ না হোতেই অপু এসে বৌয়ের হয়ে সওয়াল করে মাকে বললো, তোমাদের জন্য ভাল কিছু করলেই বিপদ ! বৌমাকে কোথায় তারিফ করবে, তা না করে অযাচিত প্রশ্নবাণে জড়াচ্ছো !
বৌমার হয়ে ছেলের ওকালতি দেখে শান্ত মাসি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে পাল্টা বললো, “কাল থেকে মাছ নিয়ে বাজারে তুই যাবি । তাহলেই বুঝবো মা-বাবার প্রতি তোদের দরদ” !
এবার বাবাকে ডাক্, মাছে বরফ দিতে হবে ।
বাবা বাড়িতে নেই ।
কোথায় গেছে, কিছু বলে গেছে কী ?
ঝাঁঝালো সুরে তার গূণধর ছেলে মাকে বললো, বাবা কোথায় যাবে সেটা কী আমাকে বলে যাবে ?
“তোর কথাবার্তা আমার ভাল লাগছে না । তোর বাবা যেখানেই যাক, হয় তোদের না হয় আমাকে বলে যাবেই । এতকাল ধরে বাবাকে তুই তো দেখছিস ? তাই তোর চিৎকার করে উত্তর দেওয়া আমার মোটেই ভাল লাগছে না । একফোঁটা কাজের মুরোদ নেই তার উপর মায়ের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলা” ।
পুনরায় শান্ত মাসি ছেলেকে বললো, “যেটা বলছি সেটা শোন্ । বাবাকে ডেকে নিয়ে আয় । মাছটা নষ্ট হয়ে যাবে । এক্ষুণি বরফ লাগানো দরকার” ।
ছেলে তার বৌকে ইশারা করে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাবাকে খুঁজতে বের হোলো ।
ইতিমধ্যে গাঁয়ের প্রতিবেশী কমলের মা এসে হাজির ।
কমলের মাকে দেখে শান্ত মাসি বসার পিঁড়িটা এগিয়ে দিয়ে বললো, অনেক দিন পড়ে এলে । বসো । বাড়িতে সবাই ভাল আছে তো ?
আমার বসার সময় কোথায় ? উনুনে রান্না চাপানো । আমি এসেছি, তোমাকে একটা কথা বলতে !
বলো, কী বলবে ?
তোমার কর্তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তোমার ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । তোমার ছেলে ও বৌমার কিসব অভদ্র কথাবার্তা । বেচারা পুলিন ! ছেলের গলা ধাক্কা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে । একমাত্র ভগবান জানে, সে এখন কোথায় ?
কথাগুলি একনাগাড়ে বলে কমলের মা আবার বলছে, আমি যাই । উনুনে মসুরির ডাল বসানো । জানিনা পোড়া লাগলো কিনা ?
শান্ত মাসি কমলের মায়ের কথা শুনে রাগে ফুঁসছে ! ছেলের বেয়াদপির জন্য রাগে তার চোখ লাল ।
তারপর … ?
তারপর ছেলে বৌমা অনেকক্ষণ পরে বাড়ি ঢুকলো ।
ছেলে বৌমা বাড়ি ঢোকা মাত্র শান্ত মাসি আঙ্গুল তুলে চোখ লাল করে কড়া ভাষায় হুমকি দিয়ে বললো, “তোমরা এই বাড়িতে আর ঢুকতে পারবে না । বাবাকে যতক্ষণ না ফিরিয়ে আনতে পারছো ততক্ষণ পর্য্যন্ত এই বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য তোমাদের বন্ধ” । অভব্যতার একটা সীমা থাকা উচিৎ ।
অপু কী যেন বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু শান্ত মাসি পুনরায় আঙ্গুল তুলে রাগান্বিত সুরে ছেলেকে বললো, এক্ষুণি তোমরা বেরিয়ে যাও ! বাবাকে খুঁজে এনে বাড়ি ঢুকবে ।
অগত্যা অপু তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।
শান্ত মাসি পাগলের মতো পুলিনকে খুঁজতে লাগলো । থানায় মিসিং ডায়েরী থেকে যেখানে যেতে পারে সেইসব সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজ নিলো । কিন্তু তাঁর কোনো হদিশ পেলো না । ভেঙ্গে পড়লো মাসি । পুলিনকে মাসি ভালবাসে । বোবা হলেও পুলিন মানুষ হিসাবে সৎ ও ভদ্রলোক । মাসিকেও পুলিন ভীষণ ভালবাসে ।
তারপর —- ?
তারপর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুলিন আর কোথাও গেল না । কাটিহার রেলওয়ে স্টেশনে মুটের কাজ করতে শুরু করলো । এখন স্টেশনের সমস্ত টিকিট পরীক্ষক তাঁকে চেনে ও জানে । ফলে স্টেশনে থাকতে এবং মুটে কাজ করতে তাঁর কোনো অসুবিধা রইলো না । বরং রেল কর্মীরা এখন তাঁকে যথাসাধ্য সহায়তা করে । কেননা স্টেশন চত্বরের সকল রেল স্টাফ, হকার, অন্যান্য মুটে, পোর্টারেরা, জেনে গেছেন, পুলিন বোবা হলেও একজন নির্ভেজাল ভাল মানুষ । সৎ মানুষ ।
ট্রেন ঢুকলে ছুটে প্যাসেঞ্জারদের লাগেজ মাথায় করে বয়ে নিয়ে রিক্সায় কিংবা ট্যাক্সিতে কিংবা অটোতে তুলে দেয় । এইভাবে যেটুকু আয় তাতে তাঁর দিব্যি খাওয়া দাওয়া অন্যান্য খরচ মিটে যায় ।
কালের নিয়মে দিন যায় রাত্রি আসে । রাত যায় দিন আসে । দেখতে দেখতে প্রায় ৯মাস কেটে গেল । শান্ত মাসি অনেক খুঁজে পুলিনকে না পেয়ে হতাশ । মানুষটাকে না পেয়ে শান্ত মাসি মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা ভাবে, সে নির্ঘাত ট্রেনে গলা দিয়েছে নতুবা অন্য উপায়ে আত্মহত্যা করেছে । তবুও শান্ত মাসির দৃঢ় বিশ্বাস সে বেঁচে আছে এবং নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসবে । তাই তার ধারনা, পুলিন একদিন বাড়ি ফিরে আসবেই । এইজন্য প্রতিদিন শাড়ির আঁচল পেতে চোখের জল ফেলে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে পুলিন যাতে বাড়ি ফিরে আসে ।
অপুর অবস্থা আরও খারাপ । শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো । তারা ভেবেছিলো, শ্বশুরের এক মেয়ে-জামাই । সুতরাং একটা হিল্লে হবেই । কিন্তু সেই গুড়ে বালি । শালা বৌদের অত্যাচারে তিষ্ঠোতে না পেরে তারা ঠিক করলো বিহারের পূর্ণিয়ায় মাসি শাশুড়ির কাছে গিয়ে থাকবে । তাদের মাসি শাশুড়ি পূর্ণিয়ায় যাওয়ার জন্য কয়েকবার তাগাদা দিয়েছেন । সেইজন্য তারা পূর্ণিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো । প্রায় ৯মাস শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়ে দিলো । মধ্যেখানে বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলো তার মা চিন্তায় চিন্তায় রোগাচ্ছন্ন । আগের মতো তার রমরমা মাছের ব্যবসাও নেই এবং ব্যবসায়ে তার মতিগতিও নেই । বাবার চিন্তায় সর্বক্ষণ মায়ের চোখে জল । মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে শান্ত মাসির লাগামছাড়া ধমক খেয়ে পুনরায় অপু শ্বশুর বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছিলো । তারপর আর খোঁজ খবর নেয় নি ।
নৈহাটী থেকে হাঁটেবাজারে এক্সপ্রেস ট্রেনে বড় বড় লাগেজ নিয়ে সংরক্ষিত কামরায় উঠলো অপু ও তার বৌ । কাটিহার নেমে বাসে তাদের গন্তব্যস্থান পূর্ণিয়া । বিহার রাজ্যে । রাত্রি ৮টা ৫০মিনিটে ট্রেনটি নৈহাটী থেকে ছাড়লো । দুজনে নির্দ্দিষ্ট সীটে গিয়ে শুয়ে পড়লো । তাদের ইচ্ছা, পূর্ণিয়ায় গিয়ে ছোটো খাটো ব্যবসা শুরু করা । তবে অপুর বৌ’র ইচ্ছা, চায়ের দোকান খোলা । ইতিমধ্যে টিকিট চেকার এসে টিকিট পরীক্ষা করে গেলেন । তারপর তারা ঘুমিয়ে পড়লো ।
সকাল ৭টা । ট্রেন ঢুকছে কাটিহারে । ট্রেনের যাত্রীরা নামার জন্য উদ্গ্রীব । ১নং প্লাটফর্ম । ট্রেনের কামরা থেকে শান্ত মাসির ছেলে ও বৌমা দুটি বড় বড় লাগেজ নিয়ে যখন নামবে এমন সময় একজন বয়স্ক কুলি এসে ঝটাপট তাদের লাগেজ দুটি মাথায় নিয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে । এবার সে নির্দেশের অপেক্ষায়, “কোথায় লাগেজ পৌঁছে দেবে” ?
শান্ত মাসির বৌমা বয়স্ক কুলিকে চিনতে পেরেছে । সে আর কেউ না তার শ্বশুর, পুলিন । সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে শ্বশুরের পা দুটি চেপে জড়িয়ে ধরলো । তার চোখে জল । বৌমা কেঁদে কেঁদে বললো, “বাবা, বাড়ি ফিরে চলো” ।
প্লাটফর্মে লোক জড়ো হয়ে গেলো । পুলিন তখনও লাগেজ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে । সে ছল ছল চোখে ছেলে ও বৌমার দিকে তাকিয়ে !
তারপর —!
তারপর শান্ত মাসি তার স্বামীকে ফিরে পেয়ে আহ্লাদিত । চোখে তার আনন্দাশ্রু ।
———————০———————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী, নদীয়া-৭৪১২৩৫ / মো- +৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
Email : roydk1958@gmail.com