বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, কথা সাহিত্যিক – দিলীপ রায়-এর একান্ত সাক্ষাৎকার।

0
15612

কাব্যের মহাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম দিলীপ রায়। সাহিত্য জগতে যে সকল কবি সাহিত্যিকের অবাধ বিচরণ, কথা সাহিত্যিক দিলীপ রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম । সাহিত্যের মহাকাশে তিনি প্রতিনিয়ত আলো ছড়িয়ে চলেছেন। তাঁর বহু সৃষ্টি দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করে চলেছেন সাহিত্য জগৎকে। সাহিত্যের ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করতে তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হয়। পেশায় তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক আধিকারিক। কিন্তু কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়েও পাশাপাশি তাঁর সাহিত্য চর্চার ব্যাপ্তি সত্যিই এক বিস্ময়কর ! আজ তাঁর ৬২তম জন্মদিনে আমরা জানবো তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানা ওঠা পড়া ও সাহিত্য চর্চার বিভিন্ন দিক গুলো। আর, আমি রয়েছি সুমন, তাঁর সহিৎ মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে।

সব খবরঃ- নমস্কার। “সব খবর” পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত । আপনার নিজের সম্পর্কিত কিছু তথ্যে দেওয়ার জন্যে রাজী হওয়ায় আপনাকে আমরা সাধুবাদ জানাই ।
দিলীপ রায় ঃ – নমস্কার । আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্যে আপনাদের সম্মানীয় পত্রিকার সিদ্ধান্তের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ।
*******************************************************************
প্রশ্নঃ- শুনেছি আপনার জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার গৌরীনগর গ্রামে । জন্মস্থান প্রসঙ্গে যদি কিছু বলেন।
দিলীপ রায়ঃ- সঠিক শুনেছেন । আমার জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাজারসৌ স্টেশন সংলগ্ন গৌরীনগর গ্রামে । আমার জন্ম ১৯৫৮ খৃষ্টাব্দের জোর দিন অর্থাৎ ইংরেজী ১৬ই জুন, ১৯৫৮ । জন্মস্থান অর্থাৎ গৌরীনগর গ্রাম “বাবলা” নদীর তীরে অবস্থিত । নদীতে সারা বছর জল ও স্রোত থাকে । নদী পার হলেই তবে স্টেশন, বাজার-হাট, স্কুল, ইত্যাদি । আমার জন্মভিটার গাঁয়ের রাস্তা এখনও কাঁচা । বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা । ওপার বাংলা থেকে এক ঝাঁক মানুষ ছিন্নমূল হয়ে নিঃশ্ব অবস্থায় বাঁচার তাগিদে জঙ্গল কেটে ঐ গ্রামের পত্তন করেন । খেটে খাওয়া মানুষের বসবাস । মূলতঃ কৃষির উপর নির্ভরশীল । প্রচন্ড অজ পাড়া গাঁ । যার জন্য গ্রামের বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে খুব কষ্ট । যাই হোক এই গ্রাম থেকেই আমার উঠে আসা ।

প্রশ্নঃ- তাহলে আপনাদের পারিবারিক স্থিতি কী ছিলো এবং পরিবারের প্রতি আপনার ভূমিকা কী ?

দিলীপ রায়ঃ- আমরা পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোন । ভাইদের মধ্যে আমি বড় । উপরে দুই দিদি । বাবা-মা ছাড়াও দাদু-ঠাকুমা ছিলেন । শত দারিদ্রতার মধ্যেও ভাই-বোনদের মানুষ করা বা পরিবারের প্রতি দায়িত্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিনি । এমনকি ভাই-বোনদের বিয়ে, বোনের বরের চাকরি সমস্ত কর্তব্যে সম্পাদনে দায়িত্ব পরায়ন ছিলাম ষোলোআনা । বাবা-মা’র মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত নিজের পদোন্নতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁদের পাশে থেকেছি । সংক্ষেপে এইটুকুই

প্রশ্নঃ- সাহিত্য চর্চার শুরু কোন বয়স থেকে ?
দিলীপ রায়ঃ- সাহিত্য চর্চার হাতে খড়ি মূলতঃ কলেজ জীবন থেকে । সেই সময় এখনকার মতো টেলিফোন বা মোবাইলের দাপট ছিলো না। চিঠি পত্র ছিলো যোগাযোগের উত্তম মাধ্যম । চিঠিপত্র লেখা থেকেই সাহিত্যির প্রতি অনুরাগ ।

প্রশ্নঃ- আপনার প্রত্যেকটা উপন্যাসে উল্লেখ থাকে, আপনার বাল্য জীবন কেটেছে গৌরীনগর গ্রামে এবং কৈশোর জীবন কেটেছে কাটোয়ায় । একথা লেখার তাৎপর্য কী ?

দিলীপ রায়ঃ- বাল্য জীবন অর্থাৎ স্কুল জীবন (প্রাথমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক) কেটেছে গৌরীনগর গ্রামে । গ্রাম থেকে বাবলা নদী পার হয়ে সাড়ে তিন মাইল হাঁটলে শক্তিপুর হাই স্কুল । প্রাথমিক শিক্ষা নিজের গ্রামে এবং শক্তিপুর হাই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক । হাই স্কুলে যাতায়াত পুরোটাই পায়ে হেঁটে । দৈনিক সাড়ে তিন মাইল + সাড়ে তিন মাইল মোট সাত মাইল হাঁটা ।
কাটোয়া কলেজে পড়াশুনা চলাকালীন দারিদ্রতার কারণে দুই বছর আমাকে পড়ের বাড়ি থেকে পড়াশুনা চালাতে হয় । সেই বাড়ির বাচ্চাদের দুইবেলা পড়ানোর বিনিময়ে আমার থাকা খাওয়া ফ্রী । তবে সেখান থেকেও হেঁটে কলেজে যাতায়াত । অর্থাৎ পানুহাট বাজার থেকে কাটোয়া কলেজে আড়াই মাইল + আড়াই মাইল মোট পাঁচ মাইল প্রতিদিন হাঁটা । রাত্রিবেলায় সাড়ে দশটার পর থেকে নিজের পড়াশুনার সুযোগ । যেহেতু বাল্য ও কৈশোর দুটি জীবনই কষ্টকর, তাই প্রতিটা উপন্যাসে বাল্য জীবন কেটেছে গৌরীনগর গ্রামে এবং কৈশোর জীবন কেটেছে কাটোয়ায় উল্লেখ থাকে ।

প্রশ্নঃ- তাহলে আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী ?
দিলীপ রায়ঃ- বি-কম, এম-এ, সি-এ-আই-আই-বি ।
প্রশ্নঃ- বি-কমের পরে এম-এ, এই ব্যাপারটা বুঝলাম না ।
দিলীপ রায়ঃ- মাস্টার্স করার জন্য ইতিহাসে স্পেশাল বি-এ দিয়ে ইতিহাসে এম-এ ।

প্রশ্নঃ- চাকরি পেতে গিয়ে এবং চাকরি পাওয়ার পর চাকরি জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা যদি জানান ?
দিলীপ রায়ঃ- এটা একটা সুন্দর প্রশ্ন । পড়ের বাড়ি থেকে পড়াশুনা চালিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে তখন আমি বি-কম পাশ । সেই সময় আমার প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার জ্ঞানের পরিধি খুবই কম । অথচ পেছন থেকে দারিদ্রতা ধেয়ে এসে আমাকে গ্রাস করতে চাইছে । পারিবারিক স্থিতি ও স্বাচ্ছ্বন্দ্যের কথা ভেবে সত্বর আমার চাকরি দরকার । দরকার বললেই তো চাকরি পাওয়া যায় না ! তখন চাকরির বাজার ভীষণ মন্দা । প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় তৈরী হওয়ার জন্যে বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষা বিষয়ক পত্রিকা পড়া শুরু করলাম । দীর্ঘ তিন বছর নিরলস খাটুনির পর ব্যাঙ্কিং সার্ভিস রিক্রূটমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষার মাধ্যমে বাঙ্কের আধিকারিক পদে সরাসরি চাকরি । এখানে উল্লেখ থাকে যে, আমি বি-কম পাশ করার পর বাড়ি ফিরে যাই নি । পড়ের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কাটোয়া শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে টিউশনি করে নিজে থাকা ও চাকরির চেষ্টা চালাই এবং অবশেষে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কে চাকরি ।
ব্যাঙ্কে যোগ দেওয়ার তারিখঃ ১৬-১২-১৯৮৫
সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ চাকরি জীবন ।
তারপর ব্যাঙ্কের কর্মী সংগঠনে সক্রিয়ভাবে যোগদান । সর্বভারতীয় রাঁচী সম্মেলনে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হয়ে অবসরের দিন পর্য্যন্ত ঐ পদে আসীন ছিলাম ।
সাংগঠনিক জীবনে শক্ত সংগঠক ও সদস্যদের প্রতি দায়িত্বপরায়ন হিসাবে বিশেষভাবে সুপরিচিত ।
আমার সাংগঠনিক জীবনের জীবন দর্শন ঃ ডেমোক্রাসি, ট্রান্সপারেন্সি ও ডিসস্পিলিন (Democracy, Transparency & Discipline)
অবশেষে ৩০শে জুন ২০১৮ অবসর গ্রহন ।
১লা জুলাই কলকাতার রোটারি সদনে আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানানো হয় । অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান, দিল্লির ন্যাশেনাল কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ষষ্টিপদ চট্রোপ্যাধায় ও সর্বভারতীয় স্তরের কর্মী ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ।
তারপর পুরোপুরি সাহিত্যে জগতে মনোনিনবেশ।

প্রশ্নঃ- সাহিত্যির প্রতি ভালবাসা জন্মানোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী ?
দিলীপ রায়ঃ- একটু পেছনে যাওয়া যাক । আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন বাংলা বিষয় পড়াতেন একজন শ্রদ্ধেয়া দিদিমণি । তিনি প্রতিদিন আমার হাতের লেখা চাইতেন । সেখান থেকে বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা । তারপর কলেজ জীবনে বাংলার স্যার প্রতিদিন প্রবন্ধ লেখা চাইতেন । প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমার অনেক বানান ভুল হোতো । তিনি স্টাফ্রুমে আমাকে ডেকে নিয়ে সুন্দরভাবে সেই বানানগুলি ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিতেন । সেখান থেকে বাংলা বানানের প্রতি অভিজ্ঞতা । তাছাড়া সেই সময় চিঠিপত্রের আদান প্রদান ছিলো যোগাযোগের মাধ্যম । চিঠিপত্র লেখালেখিতেও ছিলাম সিদ্ধহস্ত । তখন থেকেই লেখার প্রতি ঝোঁক ।
প্রশ্নঃ- সাহিত্যের প্রতি অনুরাগে আসার আগে আপনার নিজের বিবাহিত জীবন ও পারিবারিক স্থিতি সম্বন্ধে কিছু বলুন
দিলীপ রায়ঃ- লজিং থাকার সময়ে আমার স্ত্রী, বুলু রায়ের সঙ্গে ভাব-ভালবাসা । তিনি ছাত্র জীবন থেকেই আমার পাশে । তারপর পরিণয় । আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে । ছেলে ডেভিড বিবাহিত এবং ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত । মেয়ে ঈর্শ্বা পুনাতে চাকুরিরত । ছেলে ও মেয়ে দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত । তাদের বড় হওয়ার পেছনে, পুরোটাই আমার বাবা-মায়ের ও আপনাদের আশীর্বাদ ।

প্রশ্নঃ- এবার সাহিত্যি জগতে কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন ।
দিলীপ রায়ঃ- এটাও একটা অতীব সুন্দর প্রশ্ন । লেখার প্রতি ঝোঁক থেকেই প্রথমে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ম্যগাজিনে, লেখালেখি । তারপর ২০০৪ থেকে গ্রন্থ প্রকাশ । আনন্দ প্রকাশনের কর্ণধারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ কেননা তিনি আমার সমস্ত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন । আর একটা কথা এখানে উল্লেখযোগ্য, আমার গ্রন্থের মার্কেটিং আমি নিজেও দায়িত্বসকারে করেছি । যেমন আমাদের রাজ্যের বাইরে আগরতলা, শিলচর, ডিব্রূগড়, গুয়াহাটি, নওগাঁও, শিলং, রাঁচি, রায়পুর, ইম্ফল, ইত্যাদি জায়গায় এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যেমন ঢাকা, টাঙ্গাইল, চট্রগ্রাম, ফরিদপুর, ময়মনসিং, ইত্যাদি জায়গায় আমি নিজে গিয়ে মার্কেটিং করেছি । যার জন্য আমার কোনো গ্রন্থ স্টোর রুমে অবিক্রি অবস্থায় পড়ে নেই । এর উপর রয়েছে আমার লেখার নিজস্ব বিশেষত্ব ।

প্রশ্নঃ- আপনার লেখার বিশেষত্ব কী ?
দিলীপ রায়ঃ- আমি মূলতঃ গ্রাম-বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর উপর লিখি । যেহেতু আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা গ্রামে, সেই কারনে আমার লেখনির ক্ষুরধার সর্বদা গ্রামকেন্দ্রিক । গ্রাম বাংলার রাস্তাঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইত্যাদি আমার লেখায় উদ্ভাসিত।

প্রশ্নঃ- শোনা যায়, আপনার লেখায় মহিলাদের প্রাধান্য বেশী।
দিলীপ রায়ঃ- আগেই বলেছি আমি গ্রাম-বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে লিখি । সেইসঙ্গে নারী সুরক্ষা, নারীর আত্মনির্ভরতা, নারীর আত্মবিশ্বাস, নারীর স্বাধীনতা, অতিরিক্ত সংযোজন । আপনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন, রাত্রি দশটার পর কোনো একজন বয়স্থা মেয়ের পক্ষে রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট হেঁটে বাড়ি পৌঁছানো খুবই ঝুঁকিবহুল । সেই সময় নিরাপত্তাহীন্তায় ভোগেন । এইসব কথা মাথায় রেখে নারীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ রাখা । এছাড়া সমাজের মূল স্রোতে তাঁদের প্রদীপ্ত প্রকাশ উল্লেখিত ।
প্রশ্নঃ- এযাবৎ কতোগুলি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং আর কোথায় কোথায় আপনার লেখা স্থান পাচ্ছে ?
দিলীপ রায়ঃ- উপন্যাস ঃ
————————-
১। শ্রীপুলক, ২। জেদি মেয়ে, ৩। বোবা মেয়ে, ৪। অভাগীর মন্দ কথা, ৫। জীবন যুদ্ধে নারী, ৬। অপয়ার সংসার, ৭। দজ্জাল মেয়ে, ৮। সাহসিনী রমণী, ৯। তেজস্বিনী দামিনী, ১০। তাতিয়ার শুভ-যাত্রা। ১১। *নারী জাগরণের দশটি উপন্যাস* ১২। গাঁয়ের মাটির ঝাঁঝ, ১৩। ঝাঁঝালো বউ, ১৪। আদর্শ টী স্টল ।।
গল্প সংকলন ঃ
———————
১। গল্প এক ডজন, ২। স্বনির্বাচিত ৫০টি শ্রেষ্ঠ গল্প ।।
এছাড়া দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক-মাসিক- ত্রৈমাসিক- পত্রিকায় নিয়মিত লিখি । দুখানি উপন্যাস (১) অভাগীর মন্দ কথা ও (২) অপয়ার সংসার, ধারাবাহিকভাবে “ত্রিপুরা দর্পন” (ত্রিপুরা রাজ্যে) দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ।
বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা “দৈনিক সবুজ বার্তা”এর নিয়মিত প্রবন্ধ ও গল্প লেখক । এছাড়া অন্যান্য আরও বাংলাদেশের পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে । আমাদের দেশে একসময় “একদিন” দৈনিকে সম্পাদকীয়তে (চার নম্বর পাতায়) আমার লেখা নিয়মিত স্থান পেতো । তাছাড়া “যুগসঙ্খ”, “সুখবর” আপনাদের “সব খবর” ইত্যাদি দৈনিকে আমার লেখা প্রবন্ধ ও গল্প প্রায়শই বের হচ্ছে ।

প্রশ্নঃ- আপনার জীবনের স্মরণীয় একটা ঘটনা বলুন ?
দিলীপ রায়ঃ- ১৯৭৮ সালের বন্যার সময়ের করুন কাহিনীঃ-
———————————————-
১৯৭৮ সাল । শ্রাবন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হোলো বর্ষার তেজ । ভারী বর্ষন । থামার লক্ষণ কম । আকাশ ভরা মেঘ । আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা । একটানা বৃষ্টিতে চতুর্দিকে জলে থই থই । নদী-নালা-খাল-বিল জলে ভর্তি । নদী বোঝাই । চারীদিকে হৈ-চৈ । ময়ূরাক্ষী থেকে জল ছাড়ার জন্য গোটা হিজল এলাকা জলের তলায় । হিজলের খবরে আমার রাতের ঘুম উধাও । হিজল ডুবলে গৌরীনগরের অবস্থা নিঃসন্দেহে দুর্বিষহ । কেননা ঐ জল বাবলা নদী দিয়েই বের হবে । সুতরাং অবধারিতভাবে বাবলা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল বন্যার কবলে জলমগ্ন ।
কাটোয়া থেকে আজিমগঞ্জগামী সমস্ত ট্রেন অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ । রেল লাইনে জন উঠে গেছে । কোথাও কোথাও রেল লাইনের তলা থেকে মাটি সরে গেছে । সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত কাটোয়া থেকে শিবলুন স্টেশন পর্য্যন্ত । রেল লাইন জলের উপরে ভাসছে । অজয় নদীর ব্রীজ পার হলেই জলের স্রোতের তীব্রতা নাকি লাগামছাড়া । রেল লাইনের পরিতস্থিতি বিপদজনক ।
পরের দিন ভোর বেলায় কাউকে কিছু না জানিয়ে আমি সোজা কাটোয়া স্টেশন । তখন কেবলমাত্র আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে । বৃষ্টি নেই । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবে হোক বাড়ি পৌঁছানো চাই ।
কিছুটা হাঁটার পর এলাকার সুখ-দুঃখের সাথী খ্যাতনামা অজয় নদী । ভয়ংকর তার রূপ । স্রোতের বিশাল আওয়াজ । অজয় নদীর ব্রীজ পার হওয়ার পর আমার চোখে শর্ষে ফুল । রেল লাইন জলের উপরে ভাসছে । রেল লাইন দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু নির্দ্দিষ্ট রাস্তা থেকে অনেকটা ভাটিতে । প্রচন্ড স্রোত । স্রোতের টানে কখনও রেল লাইনের লোহার পাটাতন জলের উপরে ভাসছে, আবার কখনও জলের তলায় আবডাল হয়ে যাচ্ছে । রেল লাইন ধরে না সাঁতরালে আমার পক্ষে পরের গঙ্গাটিকুড়ি স্টেশন পর্য্যন্ত যাওয়া অসম্ভব । অগত্যা বাধ্য হয়ে দুহাত দিয়ে রেল লাইন ধরে এগোতে থাকলাম । রেল আইনের তলা দিয়ে জলের স্রোত । অনেক গবাদী পশু মৃত অবস্থায় ভেসে রেল লাইনে এসে ঠেকে রয়েছে । যেদিকে তাকানো যায় শুধু জল আর জল । সবচেয়ে মরা জীব জন্তুর সম্মুখে পড়লে দুগর্ন্ধে এগোনো খুব কষ্ট । বন্যার জল সুতরাং তেমনি ঠান্ডা । কোথাও কোনও মানুষের হদিশ নেই । আমি রেললাইন ধরে সাঁতরাচ্ছি । হঠাৎ সম্মুখে বড় ফনাধারি সাপ । সাপ দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম । এবার কিভাবে এগোবো । বুঝতে পারছি না । অথচ সাপটা ফনা তুলে এবং লেজ দিয়ে রেল লাইন জড়িয়ে ঠায় বসে রয়েছে । নড়ছেও না, সরছেও না । আমি সেই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় । অনোন্যপায় না দেখে রেল লাইন হাত থেকে ছেড়ে দিলাম, ভাবলাম যা হবার হবে । অগত্যা আমি বন্যার জলে অনেক দূর ভাটীর দিকে ভেসে গেলাম ।
দূরে একটা ডিঙি নৌকায় একজন জেলেকে খেপলা জালে মাছ ধরতে দেখতে পেয়ে হাত তুলে ইশারায় জেলেকে ডাকতে থাকলাম । তিনি নৌকায় তুলে সমস্ত জল এলাকা পার করে গঙ্গাটিকুড়ি স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে দিলেন । আবার রেল লাইন বরাবর হাঁটা । জলের স্রোতের টানে অনেক আগেই পায়ের চপ্পল অজয় নদী গ্রাস করে নিয়েছে । এখন খালি পায়ে হাঁটা । প্রচন্ড খিদে । তেমনি জল তেষ্ঠা । কাটোয়া থেকে গঙ্গাটিকুড়ি পৌঁছাতেই বেলা গড়িয়ে পশ্চিমাকাশে । খালি পায়ে হাঁটা । পাথরের কুচি পায়ের তলায় পড়লে বরং কষ্টটা বেশী ।
সালার স্টেশন, তালিবপুর স্টেশন পার হয়ে টেঁয়া স্টেশনের প্লাটফর্মে বন্যার্ত মানুষের ঢল দেখে আমি তো অবাক ! তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রির অন্ধকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । শুধু শুধু হাহাকার । বন্যার্ত মানুষদের মধ্যে সব হারানোর হাহাকার । প্লাটফর্মের বাইরে চারিদিকে বন্যার জলের দিকে তাকিয়ে তাঁদের ভয়ার্ত দৃষ্টি । আবার হাঁটা । বাজারসৌ স্টেশনে যখন পৌঁছাললাম, তখন রাত্রি ন’টা । প্লাটফর্ম বোঝাই বন্যার্ত মানুষ । প্লাটফর্মে রেই লাইনের পাথরের উপর ত্রিপল টাঙানো ঢাকনার নীচে মা তখন টিনের উঁনুনে সিদ্ধ-ভাত বসিয়েছেন । উঁনুনে আগুন ঠিকমত জ্বলছে না । বাইরে বাতাস তীব্র । অনেক কসরত করতে হচ্ছে মাকে । সেই অবস্থায় আমাকে দেখতে পেয়ে মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । বন্যায় সব খোওয়ানোর হাহাকারের কান্না !
জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার স্মরণীয় ঘটনা আজও স্মৃতিতে উজ্জীবিত।

প্রশ্নঃ- এমন কোনো ঘটনা, যা ভেবে আজও আপনাকে খুশিতে ভরিয়ে দেয়?
দিলীপ রায়ঃ- ১২০টি (১১২+৮) অসহায় ও দুস্থ পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী দান করার সুবাদে ঐ মানুষগুলির আশীর্বাদ আজও আমাকে খুশিতে ভরিয়ে দেয় ।

প্রশ্নঃ- শুনলাম আপনি দেশের রাষ্ট্রপতি ও পশ্চিম বঙ্গের দুইজন রাজ্যপালের সান্নিধ্যে এসেছিলেন । সে সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা ?
দিলীপ রায়ঃ- মাননীয় প্রনব মুখার্জী তাঁর পাশে বসিয়ে আমার লেখা বইগুলি একঝলক পড়ে পিঠ চাপড়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “তুমি লেখা ছাড়বে না” । তাছাড়া আমার জন্মস্থানের খোঁজখবর নিলেন । সালার, বাজারসৌ জায়গাগুলি তাঁর খুব ভাল চেনা ।
মাননীয় রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গাঁধী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “শ্রীপুলক” উপন্যাসের থিম কিভাবে পেলেন । উত্তরে আমি বলেছিলাম, গ্রাম বাংলায় জন্ম হওয়ার সুবাদে ও অভিজ্ঞতার নিরিখে আমার উপন্যাসের থিম । তাঁর অমায়িক ব্যবহারে আমি এবং আমার স্ত্রী ভীষণভাবে আহ্লাদিত ।
মাননীয় রাজ্যপাল, কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর ব্যবহারে আমি গর্বিত । মাননীয় রাজ্যপাল আমাকে সাহিত্যিক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন । এটা আমার লেখক জীবনের বড় প্রাপ্তি ।
প্রশ্নঃ- প্রকাশক সম্বন্ধে আপনার অভিজ্ঞতা ?
দিলীপ রায়ঃ- প্রকাশকের জন্ম লগ্ন থেকেই আমি তাঁর প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত । তিনি আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, প্রায় ১১০০ পাতার “নারী জাগরণের দশটি উপন্যাস” প্রকাশ করেছেন । এছাড়া তিনি “আনন্দ সাহিত্যি সম্মাননা ২০২০” দিয়ে আমাকে গর্বিত করেছেন । প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কর্মীগনের সাথে আমার মজবুত হৃদ্যতা ।

প্রশ্নঃ- পরিবারে সাহিত্য চর্চা কতটা ছিলো?
দিলীপ রায়ঃ- সেইভাবে আমাদের পরিবারে বা বংশে কোনো সাহিত্য চর্চা ছিলো না । সেই অর্থে আমি একজন “ওড ম্যান আউট” ।

প্রশ্নঃ- আপনার চাকরি জীবন, আর সাহিত্য জীবন-কোনটা আপনাকে বেশী সমৃদ্ধ করেছে ?
দিলীপ রায়ঃ- চাকরি জীবন ও সাহিত্য জীবন, দুটি ভিন্ন ধরনের জীবন । দুটি জীবনের গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম ।

প্রশ্নঃ- বর্তমানে আপনার অবসর জীবন গোটা জুড়ে কি এখন কেবলি সাহিত্য?
দিলীপ রায়ঃ- একদম সঠিক । বাকী জীবন সাহিত্যির জগতে সৃষ্টির নেশায় বেঁচে থাকতে চাই । সাহিত্য জগতে বিচরণ আমার ধ্যান-জ্ঞান ।

প্রশ্নঃ সাহিত্যি সৃষ্টির কাজকর্মে কাকে সবচেয়ে কাছে পান।
দিলীপ রায়ঃ- আমার স্ত্রী, বুলু রায়কে ।

কতকগুলো ভালো লাগার প্রশ্ন।
********

প্রিয় সাহিত্যিক :- শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।

প্রিয় গায়ক:- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ।

প্রিয় অভিনেতা:- উত্তম কুমার ।

প্রিয় বেড়ানোর জায়গা–পাহাড়/নদি:- পাহাড় – লে-লাদাখ্‌ ।

পছন্দের রেসিপি:- অল্প মশলায় সবজী ও মাছের ঝোল ভাত ।

প্রিয় গল্পের বই:- শ্রীকান্ত (৪খন্ড) ।

অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে, সব খবর-কে সময় দেওয়ার জন্য। আগামী দিনে আপনার আরো সৃষ্টি দিয়ে সাহিত্য জগৎ সমৃদ্ধ হোক এই কামনা করি। মঙ্গলময় ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
—————-০————————