সুশান্ত’র সাথে আমার পরিচয় খুব বেশিদিন নয়। রঙিন পর্দায় ওনাকে প্রথম দেখি ‘এম এস ধোনি আনটোল্ড স্টোরি’র মধ্যে দিয়ে। যদিও চলচিত্র জগতে ওনার কেরিয়ার শুরু তারও বেশ কয়েক বছর আগে। হিন্দি সিনেমা বরাবরই একটু কম দেখি। যেহেতু ধোনির বায়োপিক,তাই বাড়তি আগ্রহ একটা ছিলোই। শুধুমাত্র এই একটা সিনেমা, এই একটা সিনেমাই ভাবতে বাধ্য করেছিল, ভারতীয় ক্রিকেটে আরেকটা ধোনি এলেও তো আসতে পারতো! যদিও বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব। তবু এই ছেলেটাকে দেখে কেমন যেন বিশ্বাস হয়েছিল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির চলন-বলন কথার ভঙ্গি হুবহু এক হতে পারে কি করে? ভাবতেও অবাক লাগে শুধুমাত্র এই চরিত্রটিকে হুবহু ফুটিয়ে তোলার জন্যই কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন একজন অভিনেতা। নিজের ওপর অগাদ আস্থা ছিল ‘আমি পারবো’। আমাকে যে করে হোক চরিত্রের ভিতরে ঢুকে যেতে হবে। আর তাই আনটোল্ড স্টোরির নায়ক আমাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। বাস্তবের ধোনির যেমন উত্থান আছে, সামান্য এক স্মলটাউন বয় থেকে রূপকথার রাজুপুত্তুর হয়ে ওঠার গল্প আছে, তেমনি রূপালী পর্দার নায়কের জীবনেরও একটা গল্প আছে। অলিখিত অধ্যায় আছে। এগারোটি ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্সে সফল, দেশের তাবড়-তাবড় ফিজিক্সবিদ’দের পিছনে ফেলে ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড জয়ী হিরো, দিল্লি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং’এ স্নাতক, কেরিয়ারের মাঝপথে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে মরীচিকার পিছু ধাওয়া!তারপর? না না হারিয়ে যাওয়া নয়। বরং নিজের ইচ্ছা-জেদ আর অধ্যাবসায় দিয়ে ভাগ্য বদল! স্বপ্নের উড়োজাহাজে চেপে লঙ ড্রাউভ! ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সার হয়ে টেলিভিশনে পা। ২০০৮-এ বালাজি প্রোডাকশন আয়োজিত ‘কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল’ সিরিয়ালের হাত ধরে প্রথমবার ছোটোপর্দায় আত্মপ্রকাশ। ২০০৯ এ ‘পবিত্র রিস্তা’ সিরিয়ালটি জনপ্রিয়তায় আকাশ ছোঁয়। সেই শুরু। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রাজপুতকে। ২০১৩ সালে ‘কাই পো চে’, ওই বছরেই ‘শুদ্ধ দেশী রোমান্স’, ২০১৪ সালে ‘পিকে’, ২০১৫ সালে ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’র পর ২০১৬ সালে নিরোজ পাণ্ডে পরিচালিত ‘এম এস ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ সুশান্ত সিং রাজপুতকে আশাতীত সাফল্য এনে দেয়। শুধু বলিউড নয়, ধোনির নাম ভূমিকায় এই ছবিটিতে অভিনয় করে সুশান্ত ক্রিড়া মহলেও প্রশংসা লাভ করেছিলেন।
এরপর একে একে ‘রাবতা’, ‘কেদারনাথ’, ‘সোনচিড়িয়া’ ‘ছিছোড়ে,’। মুক্তির পথে আরও একটি ছবি ‘দিল বেচারা’। মনেহয় সুশান্ত একটু ধন্দে পড়েছিলেন। শুধুই ব্লকবাস্টার নায়ক নাকি জাত অভিনেতার মত যে কোনো চরিত্র? কোন দিকে যাবেন তিনি? মনে হয় শেষটাকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। নিজেকে ভাঙতে ভালোবাসতেন। সুশান্ত’র উইশ লিস্ট বেশ লম্বা। তারমধ্যে কয়েকটি বিবেকানন্দ নিয়ে তথ্যচিত্র, তীরন্দাজি খেলা, বাবা মহাদেবের মত কৈলাশে ধ্যান, মস কোর্ড শেখা, বিমান চালানো ইত্যাদি। সারা দেশে ‘ফ্রি এডুকেশন সিস্টেম’ নিয়েও ভেবেছিলেন। ছোটো ছোটো বাচ্ছাদের নিজের খরচে ট্রেনিংয়ের জন্য নাসায় নিয়ে যেতেও চেয়েছিলেন। মহাকাশ বিজ্ঞান বরাবরই তাঁর পছন্দের বিষয়। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বাড়ির ছাদে একটা দূরবীন লাগিয়ে বিপুল আগ্রহে তারা দেখতেন। মুম্বাইয়ের বান্দ্রার ফ্ল্যাটেও লাগিয়েছিলেন ‘প্রোফেশনাল’ দূরবীন। মহাকাশ নিয়ে কেন এত আগ্রহ? সুশান্ত হাসতেন। ‘ইচ্ছে ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার। সারাদিন হয়ত কাজ করেছি, খুব ক্লান্ত লাগছে। রাতে মহাকাশ বিজ্ঞানের বই গুলো নিয়ে বসে যেতাম। বই হল ক্লান্তি কাটানোর সেরা উপায়। সপ্তাহে একদিন দূরবীনে চোখ রাখতাম। দেখতাম চাঁদ অথবা,বৃহস্পতির কক্ষপথ’।
প্রেমঘটিত একাধিক সম্পর্কেও জড়িত নায়ক। প্রথমে অঙ্কিতা লোখাণ্ডা, তারপর কৃতি শ্যানন,তারপর দিশা পাটানি, রিয়া চক্রবর্তী! সকলেই নায়কের হৃদয় ছুঁয়ে বেড়িয়ে গেছেন। অঙ্কিতার সাথে সুশান্তের অবশ্য পাঁচ-ছ টানা বছর রিলেশন ছিল। শোনাযায় সুশান্ত’র দিক থেকেই সম্পর্কটা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সেই সময় অঙ্কিতা অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। সুশান্তের স্বচ্ছামৃত্যুর খবরে আরও একবার জোড় ধাক্কা খেলেন প্রাক্তন প্রেমিকা।
পুলিশসূত্রে জানানো হয়েছে শনিবার রাতে নিজের ফ্ল্যাটে কয়েকজন বন্ধুর সাথে গল্পে মসগুল ছিলেন সুশান্ত। রাত বাড়তেই বন্ধুরা ফিরে যায়। বাড়িতে থাকার মধ্যে ছিলেন একবন্ধু,এক পরিচারিকা,সিকিউরিটিরা। পরদিন সকালেও সুশান্তের আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাননি প্রতিবেশীরা। সকাল দশটায় জুসের গ্লাসনিয়ে নিজের রুমে আসেন সুশান্ত। তারপর দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় বারোটা বেজে গেলেও দরজা খোলেনি দেখে সুশান্তের পরিচারিকা,বন্ধু, সিকিউরিটি সকলেই ডাকাডাকি করেন। কিন্তু ঘরের ভিতরে থাকা সুশান্তের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখা যায় সিলিং’এ ঝুলছে প্রিয় অভিনেতার দেহ। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ সুশান্ত’র রুম থেকে ডাক্তারি প্রেস্কিপশন, এবং ডিপ্রেশনের কিছু ওষুধপত্র পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে কি মানসিক অবসাদই সুশান্তর অকাল প্রণায়ের কারণ? তার কোনো সদুত্তর মেলেনি। দুধসাদা বিছানায় শোয়া ব্ল্যাক টিশার্ট, বক্সার পরা সুশান্তের মরদেহ সোশ্যালমিডিয়ায় ভাইরাল হয়! অনেকেই একে সুইসাইড বলতে রাজি নন। অনেকেরই মতে এটা ঠান্ডা মাথার খুন। ওনার মৃত্যুর দিন চারেক আগেই ওনার সহকারী দিশা সোহেগাল বারো তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হন। এই দুটো মৃতদেহের মধ্যে কোথাও কি কোনো যোগসূত্র রয়েছে? ভাবাচ্ছে পুলিশকে।
সুশান্তের টুইটার হ্যান্ডল ফলো করে আমরা জানতে পারি উনি মা কে খুব মিস করতেন। ২০০২ সালে ওনার মা পরলোকগতা হন। সুশান্ত অনেক সহঅভিনেতা অভিনেত্রীর কাছেই দুঃখ করে বলতেন ‘মা আমার সাফল্যটা দেখে যেতে পারেননি।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যেখানে রাতদিন প্রেম,রান্না,রাজনীতি,বাড়ি,
বাগানে গল্প ফেঁদে বসি,সেখানে ওনার পোস্ট জুড়ে শুধুই মা। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতেও নিয়মিত অ্যাক্টিভ থাকতেন না অভিনেতা। একটা পোস্টে লিখেছেন মেডিটেশনের সাহায্য নিচ্ছেন। জীবনপ্রবাহের মান ভালো করার জন্য। প্রাপ্তিতে আনন্দ নয়। যা ত্যাগ করতে হবে তারজন্য গর্ব করে কি লাভ?
সুশান্তের স্বেচ্ছাবিদায়ের খবরে ভেঙে শোকস্তব্ধ ভারত। শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী,রাষ্ট্রপতিরাও। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও সুশান্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শুধু নেতামন্ত্রীরাই নন। সংস্কৃতি জগতের মানুষেরাও সুশান্তের এই অকালমৃত্যুতে বিস্ময়াহত। সঙ্গীত সাম্রাজের অধিশ্বরী লতামঙ্গেশকর জানিয়েছেন ‘ আমাদের কোনোদিন দেখা হয়নি। কিন্তু ধোনি ছবিতে উনি এত সুন্দর অভিনয় করেছেন ওনাকে ভুলবো কিভাবে? সুশান্তের আত্মহত্যার খবর শুনে আমার বড় ধাক্কা লেগেছে।’ চমকে গেছেন বলিউড বাদশা এসআর কেও! তিনি জানিয়েছেন ‘এত এনার্জি,এত উৎসাহ ভরপুর হাসি ভোলা যায়।’, বাকরহিত হয়ে গেছেন হৃত্বিক থেকে অক্ষয় রাও৷
সুশান্তের এই মৃত্যু যেন একটা উন্মোচন। আমাদের আরও কথা বলতে হবে। একে অন্যকে জানতে বুঝতে হবে এমনটাই মনে করছেন দীপিকা পাডুকান। দিশা পাটানির ওয়ালেও হার্টব্রেক ইমোজি, নিজের ইন্সটায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রিয়াঙ্কা চোপরাও।
পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন ব্যোমকেশ করতে কলকাতায় এসেছিলেন রাজপুত। কলকাতা শহরটাকে খুব ভালো লেগে যায় ওর। ভালোলাগে বাঙালি রান্নাও। ভাত,মাছ,দই, মিষ্টি সুশান্তের অন্যত্তম প্রিয় খাবার হয়ে ওঠে। বারবার আক্ষেপ করত আগে কেনো কলকাতায় আসিনি।
শুধু সাংস্কৃতিক জগত নয়, ক্রিকেট মহলেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ধোনির বায়োপিক বানানোর জন্য প্রায় ন মাস ট্রেনিং নিয়েছিলেন প্রাক্তন ভারতীয় উইকেট রক্ষক কিরণ মোরের কাছে। এছাড়া ধোনির ছেলে বেলার শিক্ষক কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও প্রাক্টিস করেছিলেন পনেরো দিন। বারবার বলতেন ‘দেখুন তো স্টান্সটা ধোনির মত হয়েছে নাকি’ কিরণ মোরে থেকে কেশব সকলেই মেনে নিতে পারছেন না সুশান্তের মৃত্যু। শচীন টেণ্ডুলকর, বিরাট কোহলি, বীরেন্দ্র সহবাগরাও নিজ নিজ টুইটার হ্যান্ডেলে ‘সুশান্তের আত্মার শান্তি’ কামনা করেছেন। সুশান্তের মৃত্যুতে রিয়েল লাইফের ধোনির প্রতিক্রিয়া কি? ধোনির সহকারী অরুণ পাণ্ডে জানিয়েছেন ‘খবরটা পাওয়ার পর মাহি কারুর সাথেই কথা বলার মত অবস্থায় নেই। রীতিমতো মুষড়ে পড়েছেন। বাড়ির লোকের সাথেই ঠিকমত কথা বলছেন না। নিজেকে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন’
‘সাফল্য নয়। প্রচেষ্টাই সাফল্য বা ব্যর্থতার মাপকাঠি’ ছিছোড়ে ছবিতে অনিরুদ্ধ পাঠক ওরফে সুশান্ত বলেছিলেন নিজের ছেলেকে। আত্মহত্যা করোনো। আত্মহনন কোনো সমাধান নয়। ‘নট ডান বেটা’
কিন্তু এ কি ঘটে গেল! না না রাজপুত তুমি ফিনিশার ধোনি হতে পারোনি। তোমার গল্পটা আনটোল্ডই রয়ে গেল। ম্যাচটাও আনফিনিশড…।।
———————-
শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়
নবগ্রাম পূর্ব বর্ধমান
মুঠোফোন- 9093367041