বিধবা মহিলা পুরোহিত : দিলীপ রায়।

0
925

তিন্নির মেয়েটা এখন স্কুলে । সবে ক্লাস ওয়ানে । বাবা গেছেন ব্যাঙ্কে । ব্যাঙ্কে কে-ওয়াই-সি ডকুমেন্টস্‌ জমা দিতে । কিছু টাকা তোলারও প্রয়োজন রয়েছে । বাবা বের হওয়ার সময় বলে গেছেন, ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে দুপুরের খাবার বাপ-বেটি একসঙ্গে খাবেন । একটু আগেই কাজের মেয়ে পঞ্চকলি বেরিয়ে অন্য বাড়ি ছুটলো । পঞ্চকলি বাড়িতে থাকলে তার কথার জ্বালায় কান ঝালাপালা । দুনিয়ার খবর তার ঠোটের ডগায় । অনবরত কথার ফুলঝুরি । ঠিক এই মুহূর্তে তিন্নি বাড়িতে সম্পূর্ণ একা । পঞ্চকলির সাহায্য নিয়ে তিন্নি কেবল দুপুরের খাবারের রান্না শেষ করে সোফায় গা হেলান দিয়ে বসলো । দুপুরের খাবার যেমন উচ্ছে ভাজা, লাউ দিয়ে মসুরির ডাল, আলু-পটল দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল, রসুন-পিয়াজ দিয়ে পাট পাতার শাক ও তিন্নির মেয়ের আবদারের জন্য হালুয়া ।

বর্ষাকাল । আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা । মাঝে মাঝে কালো মেঘে আকাশ ভরে যাচ্ছে । কিন্তু বৃষ্টি ঝরে না । ফলে সূর্য উজ্জ্বলভাবে আকাশে উদীয়মান । সূর্যের কিরণের তীব্রতার জন্য সর্বত্র ভ্যাপসা গরম । তাই সিলিং ফ্যান হাই স্পিডে দিয়ে সোফায় বসে তিন্নি চিন্তার জগতে নিমজ্জিত । গরমের জন্য তিন্নির হাল্কা পোশাক । হাল্কা পায়জামা ও সুতির টপ ।

তিন্নি ভাবনার জগতে আছন্ন, “তার জন্মাবার ঠিক পর পরেই মা মারা যান । মাকে বাঁচাবার জন্য বাবার মরিয়া প্রয়াস । টাকার জন্য মায়ের সমস্ত সোনার গহনা খোয়াতে হয়েছিল । তবুও মায়ের মারণ রোগ থেকে তাঁকে বাবা বাঁচাতে পারেন নি । দুই পিসির পাল্লায় পড়ে তিন্নির বাবা পুনরায় রুপনারায়নপুরের কৃষ্ণকান্ত সাটুইয়ের ছোট মেয়েকে বিয়ে করেন । উদ্দেশ্যে তাকে দেখাশুনা । কৃষ্ণকান্ত সাটুইয়ের ছোট মেয়ের বয়স ছিলো ভীষণ হাল্কা । তিন্নির দেখ-ভালের জন্য বিশেষ করে নতুন মাকে আনা । অথচ সেই নতুন মা তিন্নিকে কখনই আদর করতেন না । বরং পাড়া বেড়াতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন বেশী । সকালে, বিকালে বা সময়-সুযোগ পেলেই ছোটেন পাড়া ঘুরতে । তিন্নির বাবাকে নতুন মা গুরুত্বই দিতেন না । তাঁর মেজাজ সর্বক্ষণ চড়া । ভীষণ দাপুটে মহিলা । ভয়ডর তাঁর একদম ছিলো না । পাশের গ্রামের পরেশ ঘটকের সাথে নতুন মায়ের খুব ভাব । পরেশ ঘটক আবার তিন্নিদের দূর সম্পর্কের আত্নীয় । যার জন্য পরেশ ঘটকের তিন্নিদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত । তিন্নি বুঝতে পারতো, পরেশ ঘটক বাড়িতে এলে তাঁর প্রতি তিন্নির নতুন মায়ের অনলস যত্নাদি চোখে পড়ার মতো । তারপর জানা গেল পরেশ ঘটক প্যারা-মিলিটারি ফোর্সে চাকরি পেয়ে জলপাইগুড়িতে পোস্টিং নিয়ে চলে গেছেন । পরেশ ঘটক চলে যাওয়ার পর তিন্নি ভেবেছিলো, “এবার নতুন মা তার বাবার প্রতি যত্নশীল হবেন ।“ কিন্তু বাস্তবে ঘটতে থাকলো তার ভাবনার উল্টো । তার নতুন মা পরেশ ঘটকের মতো মানুষদের সান্নিধ্যে পেতে সর্বদা উশখুশ । তারপর তিন্নির যখন এগারো বছর বয়স, নতুন মা কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে উধাও । পরে তিন্নি জানতে পারলো, “নতুন মা পরেশ ঘটকের সঙ্গে গাঁটছঢ়া বেঁধে নিরুদ্দেশ !” তিন্নির বাবা নতুন মাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আর খোঁজ খবর করলেন না । বরং শুনতে পেয়েছেন, পরেশ ঘটক তিন্নির নতুন মাকে নিয়ে ভিন রাজ্যে পোস্টিং-এ চলে গেছেন । সেই থেকে বাড়িতে বাবা ও তিন্নি । যার জন্য তিন্নি রান্না-বান্নায় সড়্গড় । বাজার হাট, রান্না-বান্না, স্কুল-কলেজ ইত্যাদি নিয়ে দিব্যি চলছে তিন্নির জীবন ।

অন্যদিকে বাবা হরিহর গাঙ্গুলি পূজো-অর্চ্চনা নিয়েই বেশী ব্যস্ত । পুরোহিতগিরি তাদের বংশ পরম্পরা । পুরোহিতের কাজে হরিহর গাঙ্গুলির কদর আকাশ্চুম্বি । চারটি গ্রামে এগারোটি বাড়িতে দৈনিক পূজো । তার মধ্যে ছয় বাড়িতে মা-কালির, তিন বাড়িতে রাধা-কৃষ্ণ ও দুটো বাড়িতে শিবের দৈনন্দিন পূজো । হরিহর গাঙ্গুলির এইসব দৈনন্দিন পূজায় বেশী আনন্দ । খুব ভোরে ওঠেন । তারপর হাত-মুখ ধুয়ে স্নান সারেন । দুইজন গাঁয়ের মাসি প্রতিদিন ফুল তুলে তিন্নির বাবাকে দিয়ে যান, সেই বাবদ তাঁরা কিছু মাসোহারা পান । হরিহর গাঙ্গুলির স্নান সারা হয়ে গেলে সাইকেল নিয়ে প্রথমে গোপালপুর গ্রামে ঢোকেন । তারপর আমলাই ও বড়শোলপুর । এই তিনটি গ্রামে মিলে দশ জন যজমানের বাড়ির নিত্য পূজা সারেন । শেষে লোহাদহ গ্রামে । সেখানে একঘর নিত্যপূজার যজমান । এগারো বাড়িতে নিত্য পূজা সারতে হরিহর গাঙ্গুলির সকাল দশটা বেজে যায় । তারপর বাড়ি ফিরে হাল্কা জল খাবার । অনেকদিন বাড়ি ফেরার সময় আমলাই বাজার থেকে সবজির বাজার করে ফেরেন । তবে আমলাই বাজারে আনাজ-পাতির ভীষণ দাম । মাছটা গাঁয়েই মেলে । সাইকেলে মাছের ব্যাগ নিয়ে দুকড়ি একবার অন্তত পুরোহিত ঠাকুরের বাড়িতে পাক দেবেই । ফলে মাছটা সহজেই পাওয়া যায় ।

হরিহর গাঙ্গুলির সমস্যা হয় পূজা-পার্বনের সময় । তখন তিন্নি হরিহর গাঙ্গুলির সাথে সাথে ঘোরে । পূজার জোগাড়যন্ত্র সামলায় । দুর্গা পূজার সময় তিন্নি বই দেখে মন্ত্র পড়ে আর সেটা শুনে শুনে হরিহর গাঙ্গুলি সেইমন্ত্র উচ্চারণ করে মা দুর্গার পূজা করেন । বাঙালীদের বারোমাসে তেরো পার্বন । প্রায় প্রতি মাসে পূজো-অর্চ্চনা লেগেই রয়েছে । “বড় বড় পূজোর ক্ষেত্রে যেমন মা মনসা, বিশ্বকর্মা, মা দুর্গা, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী, ইত্যাদি পূজার ক্ষত্রে তিন্নি বাবার সঙ্গে পূজোর মন্ডপে যাওয়া এবং পুজার সময় বাবাকে সবরকম সহযোগীতা করা” তিন্নির জীবনের রুটিনের অন্যতম । বাবার সঙ্গে ঘোরাঘুরিতে তিন্নি মোটামোটি পূজার মন্ত্র উচ্চারণ, পূজা পদ্ধতি, পূজার উপকরণ, কোন্‌ পূজায় কী ধরনের পদ্ধতি, ইত্যাদি তার রপ্ত । মেয়ের শেখার আগ্রহে হরিহর গাঙ্গুলি আপ্লুত । মেয়েকে নিয়ে গর্বিত । তাই তিনি উৎসাহিত হয়ে মেয়েকে পুরোহিতগিরির জ্ঞান অর্জনের জন্য চার মাসের কোর্সটা করালেন । তিনি নিজেও এই কোর্সটা তাঁর বাবার আমলে করেছিলেন । হরিহর গাঙ্গুলির ছেলে নেই । তাই মেয়েকে তিনি তৈরী করে রাখছেন । ভবিষ্যতে সমাজ মহিলা পুরোহিতদের কদর দিলে তাঁর মেয়ে অনায়াসে পুরোহিতের কাজটা চালিয়ে যেতে পারবে । তাতে মেয়ের হৃদয়ে আরও শুদ্ধাচার ও পবিত্রতা বাড়বে ।

সমস্যাটা অন্য জায়গায় । মেয়ে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে পূজা পদ্ধতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল । অথচ গ্রামের মানুষের এখনও তাঁর মেয়েকে পুরোহিত পূজোয় বসাতে অনীহা । যদিও রাষ্ট্র কাঠামোতে মহিলাদের পুরোহিতগিরিতে আপত্তি নেই । শহরে মহিলারা পূজা অর্চ্চনা করছেন, তাঁর কানে আসছে । এমনকি তিনি শুনেছেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট মহিলাদের পুরোহিতগিরিতে মান্যতা দিয়েছে । অথচ গ্রামের মানুষদের কাছে তাঁর মেয়েকে দিয়ে পূজা করানোর কথা বলতে গেলে ‘রে-রে’ করে গ্রামের মানুষেরা তেড়ে ওঠেন । হরিহর গাঙ্গুলি দুর্বল চিত্তের মানুষ । কোনো ঝুঁটঝামেলায় যেতে চান না । এটাও ভাবেন, “ঝুঁটঝামেলায় গেলে তাঁর পুরোহিতগিরি বন্ধ হয়ে গেলে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে ।“ কিন্তু তিন্নিটা আবার ভীষণ জেদী । মাঝে মাঝে মানূষের সঙ্গে এই নিয়ে ঝামেলাও করে । ঝামেলা বাঁধিয়ে নিজেকে পুরোহিতগিরিতে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া প্রয়াস অব্যাহত রাখে । কিন্তু তাঁর বাবার অনুরোধে শেষ পর্য্যন্ত থেমে যায় তিন্নি ।

একবার স্যানালচরে মানসিক জোড়া-কালী পূজায় হরিহর গাঙ্গুলির ডাক পড়লো । জোড়া-কালীর পূজোর ক্ষেত্রে রাত্রিতে পূজো শুরু করে রাত্রিতেই সেই পূজো শেষ করতে হবে এবং পূজো শেষ হবার পর ঐ রাত্রিতেই ঠাকুর বিসর্জন দেওয়া অবশ্যাম্ভাবী । দায়িত্বপূর্ণ কাজ । তাঁরা কায়স্ত সম্প্রদায়ের মানুষ । বাড়ির ছোট ছেলের একবার ভীষণ অসুখ । জীবন মরণ অবস্থা । প্রথমদিকে রোগ ধরতে না পারায় ছোট ছেলের শারিরীক স্থিতির অবনতি ঘটেছিল । তখন বাড়িতে ছোট ছেলের আরগ্য কামনায় জোড়া-কালী পূজো দেওয়ার মানসিক্‌ শপথ করেছিলেন । মেয়েকে নিয়ে সারা রাত্রি সেই পূজো শেষ করেছিলেন হরিহর গাঙ্গুলি । বিসর্জন হোলো ভোর চারটের সময় । হরিহর গাঙ্গুলি যখন ভোর বেলায় মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরী, তখন সেই বাড়ির কর্তা ত্রৈলক্যবাবু হাত জোড় করে হরিহর গাঙ্গুলিকে বললেন, “আপনার মেয়েকে আমার ছোট ছেলের জন্য ঘরের লক্ষ্মী বানাতে চাই । আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের ইতিমধ্যে খোলামেলা আলাপ হয়ে গেছে । আপনার অনুমতি পেলে আমরা বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারি ।“

তারপর ত্রৈলক্যবাবুর ছোট ছেলে হিমাদ্রীর সাথে মহাধূমধামে তিন্নির বিয়ে সম্পূর্ণ হোলো । হিমাদ্রীর মিলিটারিতে চাকরি । তখন তার কাশ্মীরে পাকিস্তান বর্ডারের কাছে কার্গিলে পোস্টিং । তিন্নি বিয়ের পর হিমাদ্রীর সাথে তাদের মিলিটারি ব্যারাকে গিয়ে বেশ কয়েকদিন থেকেছিলো । সেখানে পৌঁছানোও ঝঞ্ঝাট । শ্রীনগর থেকে গাড়িতে সোনমার্গ হয়ে ড্রাস হয়ে ইন্দাস নদীর পাশ দিয়ে তারা কার্গিলে পৌঁছেছিলো । মিলিটারি ব্যারাক আবার কার্গিল শহরে ঢোকার মুখে । চারিদিকে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য । পাহাড়ী দৃশ্য দেখলে মন ভরে যায় । কার্গিল থেকে পাকিস্তানি বর্ডার খুব কাছে । ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ মার্কিং এলাকায় রোজ হিমাদ্রীদের টহল দিতে হয় । হিমাদ্রীর কাছে শোনা, তার চাকরির ধরনটা খুব ঝুঁকিবহুল । বিয়ের আগে আগে তার নতুন পোস্টিং কার্গিলে । কার্গিল শহরে ঢুকলে তিন্নির মনে হয়, সে পাকিস্তানে পৌঁছে গেছে । কেননা মানূষজনের হাবভাব বা চালচলন একটু অন্যরকম ? প্রায় দেড় বছর একসঙ্গে কাটানোর পর পোয়াতী অবস্থায় তিন্নি্র শ্রীনগর থেকে ফ্লাইটে বাড়ি ফেরা । তারপর সোজা স্যানালেরচরের শ্বশুর বাড়িতে ওঠে । শাশুড়ি তিন্নির মেয়ে হওয়ার দায় দায়িত্ব বহন করেন । মেয়ে হওয়ার প্রায় একবছর পর তিন্নি সান্যালচর থেকে বাড়িতে ফেরে ।

তিন্নির বিয়ে হওয়ার পর তার বাবা মনমরা । কাজের গতি ধীরো । তিন্নি থাকতে যেভাবে বাপ-বেটি খাটতেন, সেটা এখন হরিহর গাঙ্গুলি আর পারেন না । বয়সও অনেক । শরীরটা আর আগের মতো নীরোগ নেই । ক্রমশ রোগ তাঁকে আক্রমন করছে । খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম-নিষ্ঠা নেই । যজমান বাড়িতে পূজো করে ফেরার পর বাড়িতে ফিরে যা জোটে তাই খেয়ে তাঁর দিন কাটে ।

হঠাৎ দিদু-ভাইকে নিয়ে তিন্নির আগমনে হরিহর গাঙ্গুলি চাঙা হয়ে উঠলেন । নাতনীকে নিয়ে হরিহর গাঙ্গুলির হুটোপাটি । সংসারে ব্যস্ততা । তিন্নি বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই বাড়ির চেহারাটাই পালটে গেল । বাড়িতে আবার আগের মতো হৈ-চৈ শুরু । তিন্নি রান্নাসহ অন্যান্য কাজকর্মে মনোনিবেশ করলো ।

এদিকে ‘লাইন অফ কন্ট্রোলে খুব কড়াকড়ি । পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানীতে । বর্ডারে গোলাগুলি । ভারতীয় জওয়ানেরা পাকিস্তানী সেনাদের উপর ভীষণ সতর্ক । পাকিস্তানী সৈন্যরা লাইন অফ কন্ট্রোল ভেদ করে ভারত অধিকৃত ভূখন্ডে ঢুকতে মরিয়া । এলাকা দখল নেওয়া তাঁদের টার্গেট । খবর পৌঁছালো দিল্লীতে । নড়েচড়ে বসলেন দিল্লীর প্রশাসন । যুদ্ধের প্রস্তুতির আবহাওয়া । সংবাদপত্রে এসব খবর দেখে তিন্নি চিন্তান্বিত । মোবাইলের সংযোগ বন্ধ । হিমাদ্রীদের মিলিটারি ব্যারাকে নেট সার্ভিস বন্ধ । ফলে তিন্নি হিমাদ্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই পারছে না । ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লো তিন্নি ।

পরেরদিন টিভির খবরে আত্‌কে উঠলো তিন্নি । পাকিস্তানী বর্ডারে পাকিস্তানী সেনারা মারমুখি । প্রচুর গুলিগোলার আওয়াজ । আক্রমন – প্রতি আক্রমনে পাকিস্তানী সেনারা নিহত । ভারতীয় চার জওয়ান নিহত । দুশ্চিন্তায় তিন্নির কপালে ভাঁজ । মনের ভিতর এক অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত । তারপর ভারতীয় ফৌজিদের কাঁধে চেপে হিমাদ্রীর নিথর দেহ কফিন বন্দী অবস্থায় বাড়িতে ফিরলো । করুণ পরিস্থিতি । তারপর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হোলো ।

তারপর……………………?

তারপর হরিহর গাঙ্গুলি সোজা ঘরে ঢুকে তিন্নিকে ডাকলেন । তিন্নি মা উঠো । হুড়মুড়িয়ে তিন্নি জেগে উঠলো । হরিহর গাঙ্গুলি তিন্নিকে বললেন, “বাড়ির সদর দরজা খোলা । কেউ ঢুকে গেলে টের পেতিস না মা ।“ তারপর স্নান সেরে হরিহর গাঙ্গুলি দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লেন । কেননা রাত্রিতে খয়রা গ্রামে বড়াল বাড়িতে জোড়া মা-কালীর মানসিক্‌ করা পূজো । সুতরাং রাত জাগার পালা ।

সন্ধ্যা ছ’টা বাজে । ঘুম থেকে হরিহর গাঙ্গুলি উঠছেন না । তিন্নির মেয়ে কয়েকবার দাদুকে ডেকে এসেছে । তবুও তিনি ঘুম থেকে উঠছেন না ।

শেষে তিন্নি বাবার কপালে হাত দিয়ে দেখে তাঁর ভীষণ জ্বর । শীতে জড়সড় । লেপ মুরি দিয়েও তাঁর শীত কমছে না । গাঁয়ের হাতুড়ে নিতাই ডাক্তারকে খবর দেওয়া হোলো । তিনি বললেন, তিন্নির বাবার অবস্থা ভাল না । হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে মঙ্গল । তোড়জোড় করে আমলাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হরিহর গাঙ্গুলিকে ভর্তি করে তিন্নি ছুটলো খয়রা গ্রামে বড়াল বাড়িতে । তিন্নি জানে, বড়াল বাড়ি থেকে জোড়া-কালীর পূজো করার জন্য তাঁর বাবাকে অগ্রিম টাকা দিয়ে গেছেন । অতো জ্বরের মধ্যেও হরিহর গাঙ্গুলি বড়াল বাড়ির পূজোর কথা তিন্নিকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করেন নি । কারণ হরিহর গাঙ্গুলি কোনোদিন কথার খেলাপ করেন নি ।

তিন্নি বিধবা । তাই বিধবা তিন্নিকে দিয়ে পূজো করানোতে বেঁকে বসলো বড়াল গিন্নি এবং গাঁয়ের মোড়ল মাতব্বরেরা । বড়াল গিন্নি ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “মহিলা পূরোহিত দিয়ে যেখানে পূজোর চল নেই সেখানে বিধবা মহিলা দিয়ে তাঁদের বাড়ির পবিত্র মানসিক্‌ করা জোড়া-কালী পূজা করানো নৈব-নৈ-চ ।“ তিন্নি বোঝাচ্ছে, এখন পুরোহিতগিরিতে নারীরাও পারদর্শী । নারীদের মান্যতা স্বয়ং দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে । তাছাড়া শহরের দিকে তাকান, হামেশাই মহিলারা পূজা-অর্চ্চনা করছেন । সুতরাং আমি একজন নারী এবং মা-কালী নিজেও একজন নারী, সুতরাং নারী পুরোহিত হয়ে নারী ঠাকুরের পূজো আমি করছি । এছাড়াও আমি পুরোহিতের কাজে যথাযথ প্রশিক্ষণরত । বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিন পূজা অর্চ্চনায় অংশ নেওয়ার সুবাদে আমি পূজোর উপাচার সম্বন্ধে অবগত । সুতরাং আমার পূজো করায় আপনাদের আপত্তি থাকার কথা নয় ? তিন্নির সওয়ালে উপস্থিত মানূষেরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না । বিশেষ করে বয়স্ক মানুষেরা বিধবা মহিলা পুরোহিত দিয়ে পূজা করানোর বিরুদ্ধে । তাঁরা তীব্র গর্জে উঠলেন, “এটা অনাচার । শাস্ত্র বিরোধী । পবিত্র পূজায় অপবিত্রতার বাতাবরণ ।“

“মহিলারা পুজো করে তবুও ঠিক, কিন্তু বিধবা মহিলাদের কোথাও পূজো করতে কী কেউ কোথাও দেখেছেন ?” গাঁয়ের কিরীটি মোড়ল উপস্থিত গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন । মোড়ল মশায়ের সাথে যোগ দিলেন গ্রামের মাতব্বরেরা । বিধবাদের এমনিতেই পূজো-অর্চ্চনায় অংশ নেওয়াতে অমঙ্গলের ছায়ার কোপ পড়ে । তার উপর স্বয়ং মা-কালীর মতো শক্তি দেবতার পূজোতে বিধবা মহিলা পুরোহিত । আলোচনা-সমালোচনায় একটা হুলস্থুল পরিস্থিতি ।

বড়াল বাবু খয়রা গ্রামের ধনী মানুষ । তাঁর বাড়িতে পূজো । অনেক মানুষের সমাগম । সকলের দৃষ্টি তিন্নির উপর । তিন্নির পূজো করার আস্পর্ধা দেখে উপস্থিত সকলে অবাক !

গাঁয়ের ভবা, কেষ্টা, দুর্যোধন, গদাই, আরও জনা দশেক যুবক ছেলেরা চেপে ধরলো মোড়ল-মাতব্বরদের । আপনারা রাত্রিবেলায় পেয়েছেন কী ? অল্প বয়সী বিধবা মহিলা তিন্নিকে ছোটবেলা থেকে আপনারা সকলেই চেনেন ও জানেন । পুরোহিতগিরি ওদের পারিবারিক পরম্পরা । তিন্নির স্বামী দেশ রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন । দেশের মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁর জীবন বলিদান । তিন্নিকে এতবার বিধবা বলার কী আছে ? আপনাদের ঘরের মেয়ে । মেয়েরা এখন সর্বত্র পুরোহিতের কাজ করছে । আপনারা এখনও মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারনার গোঁ ধরে রয়েছেন । দিন পাল্টাচ্ছে । সমাজ ব্যবস্থা অনেক আধুনিক হচ্ছে । আপনাদের মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে । আধুনিক সুযোগ সুবিধা পেতে মেয়েরা হাতে মোবাইল নিয়ে সর্বক্ষণ নাড়াচাড়া করছে । নেট ঘেটে বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করছে । অথচ আপনারা এখনও নিজেদের জেদ বজায় রাখার জন্য বড়াল মশায়কে উস্কাচ্ছেন । বিধবা মহিলা পুরোহিত দিয়ে পূজো না করানোর বিধান দিচ্ছেন । ছিঃ ! আপনাদের লজ্জা হোয়া উচিৎ ! এটা অন্যায় । তাছাড়া তিন্নি বললো, সে পুরোহিত বিদ্যায় প্রশিক্ষণরত । পুরোহিতের কাজে সে ষোলোআনা রপ্ত । সুতরাং তিন্নিকে পুরোহিত হিসাবে পূজো না করিয়ে তাড়িয়ে দিলে, এর নেতিবাচক প্রভাব সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে । সোসাল মিডিয়ায় ঝড় উঠবে । তখন হ্যাপা ঐ বড়াল বাবুকেই পোওহাতে হবে । আপনারা তো পালিয়ে বাঁচবেন, কিন্তু বড়াল বাবুকে জবাবদিহি করতে হবে । গোটা মহিলা সমাজের কাছে আপনারা হেয় হয়ে যাবেন । সুতরাং আপনাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা বলছি, কথা না বাড়িয়ে তিন্নিকে পূজোয় বসতে বলুন । নতুবা আমরাই তিন্নিকে পুরোহিত হিসাবে পূজো করতে বসিয়ে দেবো । আমরা আধুনিক মনস্ক । আধুনিক ধ্যান-ধারনায় বিশ্বাসী । তাই আপনাদের অনুমতির ধার-ধারবো না ।

মোড়ল-মাতব্বরেরা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকলেন । গোটা পাঁচেক মাতব্বর গোছের গ্রামবাসী রাগে বিড় বিড় করতে করতে স্থান ত্যাগ করলেন ।

সেই সময় তিন্নি তখন বিনীতভাবে বললো, “খোঁজ নিয়ে দেখুন । কর্ণাটক রাজ্যে মাঙ্গালোরে কুদরোলি “শ্রী গোকর্ণনাথেশ্বরা মন্দিরে” দুজন হিন্দু বিধবা নারীকে পুরোহিত হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে । তাঁদের নাম লক্ষ্মী ও ইন্দিরা । তাঁরা যদি অতো বড় মন্দিরে পুরোহিত হিসাবে পূজো করতে পারেন তাহলে আমার ক্ষেত্রে মা-কালীর পূজোতে আপত্তি কোথায় ?”

শুরু হোলো উপস্থিত মানুষের মধ্যে জল্পনা কল্পনা । অবশেষে তিন্নিকে বড়াল বাড়ির জোড়া-মা কালী পূজোর পুরোহিত হিসাবে পূজো করার অনুমতি উপস্থিত গ্রামবাসীরা দিয়ে দিলেন । তিন্নি শুরু করলো শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ ।

তারপর ……………………।।?

—————–০————————–

বি-দ্র ঃ গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক । কারও ঘটনার সঙ্গে মিলে গেলে তা নেহাতই কাকতালীয় ও অনিচ্ছাকৃত ।