বাংলা চলচ্চিত্র কী তার পুরনো হৃতগৌরব ফিরে পাবে? তেমন সম্ভাবনা কিন্তু বর্তমানে তো নয়ই, অদূর ভবিষ্যতেও দেখা যাচ্ছে না। স্বর্ণযুগের কথা না হয় বাদই দিলাম, আগামী দিনে বাংলা চলচ্চিত্র কতটুকু দর্শক ধরে রাখতে পারবে সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকছে। একটা সময় ছিল উত্তম- সুচিত্রার সিনেমা আসলে হলের একটা সিট তো ফাঁকা থাকতই না, বরং টিকিটের জন্য রীতিমতো কালোবাজারি হত। কলেজপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্ক দাদু-ঠাকুমা পর্যন্ত সবারই পছন্দ ছিল সে সিনেমা। এখন সেই সিনেমা হলগুলোর ভগ্ন দশা দেখলে ভীষণ কষ্ট হয়। কত নাম করা সিনেমা হল তো চালাতে না পেরে এখন শপিংমল কিংবা ব্যাঙ্কোয়েট হল হয়ে যাচ্ছে। মার্কুয়িস স্ট্রিটে একসময় রমরমিয়ে চলা যমুনা সিনেমা হল এখন ভোল পাল্টে হয়ে গেছে যমুনা ব্যাঙ্কোয়েট। ধর্মতলার এলিট, লাইটহাউস, জ্যোতি, গ্লোব, মেট্রো সিনেমার মতো ঐতিহ্যপূর্ণ হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি একশো বছরেরও বেশি পুরনো রক্সি কিংবা অষ্টআশি বছরের পুরনো হাতিবাগানের মিত্রা সিনেমার মত হলগুলোও ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আপনারা বলবেন সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়ার জন্য শুধুমাত্র বাংলা সিনেমাকে দায়ী করা ভুল হবে। হিন্দী কিংবা ইংলিশ ফিল্মগুলোও তো সিনেমা হলগুলোর ব্যবসায়িক মন্দা কাটাতে পারত? হ্যাঁ পারত ঠিকই। এখনো যেসব সিনেমা হলগুলো টিমটিম করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সেগুলো এই হিন্দী, ইংলিশ কিংবা ভোজপুরী সিনেমার দৌলতেই। এমনকি শহরের বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে ওঠা শপিংমলের ভিতর মাল্টিপ্লেক্সগুলোতেও বাংলা ছবি খুব কম দেখা যায়। অথচ হিন্দী বা ইংলিশ ফিল্ম সেখানে রমরমিয়ে চলছে।
একথা খুব সত্যি যে কেবল টিভি আসার পর সিনেমা হলগুলো তাদের ব্যবসা হারিয়েছে। ঘরে বসেই এখন মানুষ সিনেমা দেখে নিচ্ছে। এসে গেছে নেট ফ্লিকস কিংবা ওয়েব সিরিজ। অনলাইনে মোবাইলেই দেখে নিচ্ছে পছন্দের মুভি কিন্তু একটু চিন্তা করে বলুন তো কেবল টিভি আসার পর মানুষ কী সিনেমা হলে যাচ্ছে না? অবশ্যই যাচ্ছে। রীতিমতো লাইন দিয়ে টিকিট কেটে মানুষ ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ কিংবা ‘বেবিস ডে আউট’ দেখেছে। বাঙালী চিরকালই গুণের কদর করে এসেছে। ভালো জিনিস বেশি টাকা দিয়ে দেখতে তার আপত্তি নেই। গুণের কদর করে বলেই সে আজও পাড়ার দোকান ছেড়ে দু’মাইল দূরে নকুরের সন্দেশ অথবা আর্সালানের বিরিয়ানী আনতে ছোটে। কেবল টিভির আবির্ভাবকে তাই কখনোই সিনেমা হলের দুরবস্থার জন্য দায়ী করা যায় না। টিভিতেও তো পুজো পরিক্রমা দেখায়, তাহলে মানুষ এতো দূর দূরান্ত থেকে এসে দুর্গাপুজোয় প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে ভিড় করে কেন? টিভিতেও তো ম্যাচ দেখায়; তবু মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখতে মাঠে এতো দর্শক সমাগম হয় কেন? তাই সিনেমা হলগুলোর দুরবস্থার জন্য যাঁরা কেবল টিভিকে দায়ী করেন তাঁরা এক্ষেত্রে কী উত্তর দেবেন?
আসল সত্যিটা হল বাংলা সিনেমা থেকে বাঙালী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। টিভিতে উত্তম কুমারের সিনেমা থাকলে মা-কাকিমারা এখনো যেভাবে তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে টিভির সামনে বসে পড়েন, সেই আগ্রহ নিয়ে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমাগুলো দেখেন কী? কখনোই দেখেন না। কেন দেখেন না? তাহলে কী ভালো বাংলা সিনেমা তৈরি হচ্ছে না? সিনেমা প্রচুর তৈরি হচ্ছে। বেশ বড় বাজেটের ফিল্মও হচ্ছে। এমনকি আগে যেটা সুদূর কল্পনাতেও ভাবা সম্ভব ছিল না সেই বিদেশে গিয়েও বাংলা সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে। তবুও সেই ফিল্ম দর্শক মহলে সারা ফেলতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার কারণ দর্শক বিদেশে নায়ক নায়িকার রোমান্স দেখার থেকে ফিল্মের অভিনয় দেখতে বেশি পছন্দ করে।
একটা সময় সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় অসাধারণ সব ফিল্ম উপহার পেয়েছে বাঙালী দর্শক। তাহলে এখন বাংলা ফিল্মের এই দুরবস্থা কেন? দক্ষ পরিচালকের অভাব? তা তো নয়। ঋতুপর্ণ ঘোষের অকালে চলে যাওয়া বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতি করলেও এখন বাংলা সিনেমার গুরু দায়িত্ব যাঁদের কাঁধে সেই অপর্ণা সেন, কমলেশ্বর মুখার্জী, কৌশিক গাঙ্গুলী কিংবা সৃজিত মুখার্জীরা কম দক্ষতাসম্পন্ন নন। বরং ডিজিটাল যুগে ওনারা অনেক বেশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। সত্যজিৎ রায় নিজের হাতে ছবি এঁকে যেখানে সেট ডিজাইন করতেন আধুনিক যুগে সেখানে ব্যবহার হচ্ছে ফটোশপ। সেকালের মতো ডায়েরি বা নোটবুক নয়, এখন প্রজেক্টের সমস্ত ডেটা জমা থাকছে ডিরেক্টর, এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরদের ল্যাপটপে। সৃজিত মুখার্জী গুগুল ঘেঁটেই পেয়ে যান ফিল্মের যাবতীয় তথ্য। এই যেমন কোন সালে কোন জিনিস ব্যবহার হত সেটা গুগুল সার্চ করেই জানা হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে চলে এসেছে থ্রিডি প্রযুক্তি। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যেই কমলেশ্বর মুখার্জী ‘চাঁদের পাহাড়’ কিংবা ‘আমাজন অভিযান’ ফিল্মগুলো নির্মাণ করেছিলেন। সেইসব ফিল্মের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন জায়গা নেই। তবু বাংলা সিনেমা সেভাবে দর্শক টানতে পারছে না কেন? তার কারণ গোড়ায় গলদ। সৃজিত মুখার্জী কিংবা কমলেশ্বর মুখার্জীরা তো মাঠে নেমে গোল করবেন না। সিনেমায় তাঁদের ভূমিকা কোচের। পিকে ব্যানার্জী কিংবা অমল দত্তকে যদি মিলন সমিতি কিংবা খিদিরপুরের কোচ করে বলা হত টিমকে লীগ চ্যাম্পিয়ন করো তাহলে সেটা যুক্তিযুক্ত হবে কী? সেটা সম্ভবও নয়। তার জন্য দরকার দক্ষ খেলোয়াড়ের। ঠিক তেমনি বাংলা সিনেমায় দক্ষ অভিনেতার অভাবটা বড় প্রকট হয়ে উঠেছে।
স্বর্ণযুগে কত বড় বড় অভিনেতাই না বাংলা চলচ্চিত্রকে আলোকিত করেছেন। উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা বাদই দিলাম। ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, পাহাড়ি সান্যাল, তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গাঙ্গুলী এঁরা কেউ কারোর থেকে কম নন। উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক জুটি চিরকালীন বাঙালীর মানসপটে আঁকা হয়ে আছে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয় আজও দর্শকদের মনে দাগ কাটে কিংবা সাফল্যের শীর্ষে থাকা উত্তম কুমারের বিপরীতে নবাগতা অঞ্জনা ভৌমিকের সাবলীল অভিনয় অভিনেত্রীর জাত চিনিয়ে দেয়।
বর্তমানে সিনেমায় মুখ দেখানোটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। গজিয়ে উঠছে হাজার একটা প্রতিষ্ঠান। ক্রাশ কোর্স আদতে কার্সড কোর্স। ভর্তি হলেই সিনেমায় মুখ দেখানো বাঁধা। মুখ তো না হয় দেখানো গেল কিন্তু তার জন্য অভিনয়টাও জানতে হবে তো? সত্যজিৎ রায়ের মত পারফেক্শানিস্ট পরিচালক শট শেষ হয়ে যাবার পর ‘কাট’ বলে প্যাক আপ এর নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে উত্তম কুমার তাঁর নিজের ডায়লগ থ্রোয়িং পছন্দ না হওয়ায় আবার টেক করতে বলছেন। এসব কী এখন ভাবা যায়? আসলে সকলেই কবি নন কেউ কেউ কবির মত এখানেও বলা যায় সকলেই অভিনেতা নন, কেউ কেউ অভিনেতা। শিল্পীরা জন্মান, তাঁদের তৈরি করা যায় না। সাধারণ যাঁরা তাঁদের ঘষে মেজে একটা শেপে আনা যায় শুধু।
বাংলা চলচ্চিত্রের দুরাবস্থার আর একটা মস্ত বড় কারণ ভালো গানের অভাব। এখন বাংলা সিনেমায় ভালো সঙ্গীতশিল্পীর অভাব নেই, অভাব আছে ভালো সুরকার আর গীতিকারের। সিনেমায় সঙ্গীতের ভূমিকাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। শুধুমাত্র গানের জন্য একটা সিনেমা হিট করে গেছে এমন উদাহরণ অনেক আছে। ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ কিংবা ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানগুলো অমর হয়ে আছে কথা আর সুরের জন্য। এখনকার সিনেমায় সেই সুরই বা কোথায় আর গানের কথাই বা কোথায়? যে গানের সুর মানুষের মর্মে পৌঁছায়, সে গানই তো চিরন্তন আসনে সমাদৃত হয়। দক্ষ সুরকার আর গীতিকারের অভাব বাংলা সিনেমাকে কয়েক যোজন পিছিয়ে দিচ্ছে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।