“শোনো না,বলছি কিছু টাকা হবে?”
কেন ? টাকা কি করবে ?
“না মানে ,অনেকদিন পর মায়ের কাছে যাচ্ছি তো,একটু কিছু নিয়ে যেতাম।”
গৌতম একটু গম্ভীরভাবে তাকাল ইন্দ্রানীর দিকে।তারপর বিরক্তমুখে বলল,
“দেখো ইন্দ্রানী আগেই বলেছি তোমাকে,তোমার যা দরকার হবে আমায় বলবে আমি এনে দেবো।আগে কি তুমি বাপের বাড়ী যাওনি ? না আমি তোমায় এনে দিইনি?”
ইন্দ্রানী কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়,তারপর ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
মিষ্টু এতোক্ষন পুতুলকে শাড়ী পরাচ্ছিল,মা আর বাবার কথা শুনে একটু থেমে একবার মা আর একবার বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল,এবার মা চলে যেতে ও কিছুক্ষন চুপ করে মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।ও এখন ক্লাস টুতে পড়ে,অনেক কিছুই তাই বোঝে।অনেক কিছু জানে।জানে যে বাবা এখন সামনের ছোট্ট মিষ্টির দোকান থেকে দানাদার আনবে।
আগেরবারেও এনেছিল।আর এটাও জানে যে ওদের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেখলেই মামী কেমন মুখ টিপে হাসবে,তাতাইদাদা তো সেবারে বলেই দিলো,
“ধুর,পিমনি ,তুমি খালি দানাদার আনো,জানো না আমরা কেউ দানাদার খাইনা।”
সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখটা কেমন কালো হয়ে গিয়েছিল তাও মিষ্টু দেখেছিল।ও শুনতে পেয়েছিল,দিদা আর মা যখন খেতে বসেছিল দুপুরে,তখন দিদা মাকে বলছিল,
“তুই আর এসব আনিস না ইন্দু,এর থেকে খালি হাতেই আসবি,কি করবি বল মা,জামাইকে তো সবাই জানে,কেউ কিছু মনে করবে না”
মিষ্টুর খুব লজ্জা করছিল।
সত্যিই কেন যে মা আবার বাবার কাছে পয়সা চাইতে গেলো,কে জানে।মিষ্টুর বাবা টাকাপয়সার ব্যাপারে খুব সাবধান।একটা পয়সা কি একটা জিনিস এদিক ওদিক হবার জো নেই।
এইতো গত শুক্রবার বাড়িতে তুলকালাম হয়ে গেলো,মা বাবার জামা কাচে ,তা সেই জামার পকেটে নাকি একটা দশটাকার নোট ছিল,মাঝে মাঝে ওরকম দু-একটা টাকা থেকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মা বাবাকে দিয়ে দেয়।কিন্তু সেবার মা কিছুই পায়নি খুঁজে ,অথচ বাবার বক্তব্য “হ্যাঁ,আমার স্পষ্ট মনে আছে,বাজার করে দশটাকা ফেরত হয়েছিল,আর আমি তা পকেটেই রেখেছিলাম।”
মা বলল,”দেখো হয়তো, পকেটে রাখতে গিয়েই কোথাও পরে গেছে কি না।”
তাতে বাবা খেপে আগুন,”কি আমার হাত থেকে টাকা পরে যাবে ? গৌতম মিত্তিরের হাত দিয়ে জল গলে না,আর টাকা ?”
সত্যিই তাই বাবার হাত দিয়ে জল গলে না।বাবার যখন মেজাজ ভালো থাকে ,বাবা তখন হাতে গন্ডুষ করে ওকে বলে ,
“দেখি তো মিষ্টু তোর হাত দিয়ে জল গলে কি না ?”
বলে মিষ্টুর হাতে একটু জল দেয়,মিষ্টুর ছোট ছোট ফাঁকা ফাঁকা আঙুলের মধ্যে দিয়ে সব জল গলে পরে যায়।
বাবা তখন ‘ছ্যাঃ ছ্যাঃ’ করে ওঠে।বলে “জল তো গলবেই,মেয়েছেলে কি না,বাপকে ভিখারী করে তবে বিদায় হবে।”
মিষ্টুর খুব মন খারাপ লাগে তখন।
সংসারের নুন,তেলটার পর্যন্ত পাই টু পাই হিসাব রাখে বাবা।সব নিজের জিম্মায় রাখে,আলমারীর মধ্যে,রোজের রোজ মাপে মাপে বের করে দেয়।অথচ মিষ্টুর বাবা সরকারী চাকরি করে।সরকারি চাকুরেদের নাকি অনেক মাইনে।এই কথাটা ওকে পায়েল বলেছে।পায়েল ওদের পাশের বাড়ীতে থাকে।মেলা থেকে কি সুন্দর একটা চোখ বোজা পুতুল কিনেছে।তাই দেখে মিষ্টু একবার পায়েলের কাছে পুতুলটা দেখতে চেয়েছিল।তখনই পায়েল ওকে বলেছে,
“কেন রে আমার পুতুল নিবি কেন ? তোর বাবার তো অনেক মাইনে,আমার বাবা বলে,তোর বাবাকে কিনে দিতে বলতে পারিস না ?”
পায়েলের মুখে কথাটা শুনে দুঃখের থেকে অবাক বেশী হয়েছিল মিষ্টু,তবে যে বাবা বলে সবসময় পয়সা নেই,পয়সা নেই।ওকে কখনো মেলাতেই নিয়ে যায় না।বলে,
“অত মেলা ঘুরে কি হবে ? খালি ফালতু পয়সা খরচের ফিকির যত।আমার অত পয়সা নেই।”
সেবছরই পুজোয় অষ্টমীতে পাড়ার প্যান্ডেলে তুয়াকাকীমা ওকে আর ওর মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলছিল,’কেউ অভাবে গরীব আর কেউ স্বভাবে ।’
এখন মিষ্টু বোঝে ওরা স্বভাবে গরীব।মাকে দেখে, সবসময় মা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকে।আগে মিষ্টু দুধের সঙ্গে দুটোর জায়গায় চারটে বিস্কুটের বায়না করলে দেখত,মায়ের চোখে জল।এখন মিষ্টু বড়ো হয়ে গেছে,বুঝতে শিখে গেছে, আর বায়না করে না ,বরং ওর থেকে একটা বিস্কুট জোর করে মায়ের মুখে দিয়ে দেয়।মায়ের অবশ্য তাতেও চোখে জল।কেন যে মা এতো কাঁদে কে জানে?অথচ মা হাসলে কত সুন্দর লাগে,মিষ্টু দেখেছে।মামাবাড়ী গেলে মা তবু একটু হাসে,দিদার সঙ্গে গল্প করে।মামী আর তাতাইদাদার কথায় লজ্জা পেলেও তাই মিষ্টু মামাবাড়ীটা যায়।প্রতিবার বাড়ী ফেরার সময় দিদা ওকে আদর করে বলে,
“মা কে দেখে রেখো সোনা।”
মিষ্টু তাই এখন সবসময় মায়ের খেয়াল রাখে।মায়ের সঙ্গে গল্প করে,খেলে ,মা-ই ওর একমাত্র বন্ধু।মিষ্টু চুপি চুপি মায়ের জন্যে একটা দারুন চমক ঠিক করেছে।
আজ বাড়ীতে কেউ নেই, মিষ্টুর পিসিমনির বাড়ীতে একটা পুজো আছে,বাবা আর ঠাম্মা সেখানেই গেছে,পিসিমনি অবশ্য সবাইকেই যেতে বলেছিল,কিন্তু অনেক গাড়ীভাড়া লাগবে বলে বাবা ওদের নিয়ে যাইনি।তাতে কিন্তু মিষ্টু খুশীই হয়েছে।মা আজ ওর পছন্দের ফেনা ভাত,আলুসেদ্ধ,ডাল সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ করেছিল,একটুখানি গরম ঘি দিয়ে তা যেন অমৃত ।
খেয়ে উঠে মা থালাগুলো ধুতে যেতেই সেই সুযোগে,মিষ্টু সব তৈরী করে নিলো।কি করবে রাত্রি পর্যন্ত তো আর অপেক্ষা করা যাবে না,তখন সবাই এসে যাবে।
বাসনপত্র ধুয়ে গুছিয়ে ঘরে ঢুকেই ইন্দ্রানী চমকে গেলো।
“এসব কি?”
একটা ছোট্ট টুলের ওপর একটা পেস্ট্রী কেকে লেখা মা,তার উপরে একটা জলন্ত মোমবাতি,একটা ক্যাডবেরীর প্যাকেট আর বাগানের কিছু ফুল সাজানো আছে।
“তোমার জন্মদিন করছি মা। ”
“আমার জন্মদিন ?”
“হুম,তোমার কবে জন্মদিন তাতো আমি জানি না।কিন্তু আজ কেউ বাড়ী নেই ,তাই এই সুযোগটা ছাড়তে চাইনি।”
“তুই এইসব পেলি কোথায় ?টাকাই বা কোথায় পেলি ?”
“কেন দিদা আমাকে প্রতিবার আসার সময় টাকা দেয় না,তাই জমিয়েই তো কিনেছি আজ স্কুল থেকে আসার পথে।”
“ও তাই বুঝি ,আজ শান্তাকাকীমার সঙ্গে স্কুল থেকে ফিরবি বলে বায়না করে আমায় আনতে যেতে দিলি না ?”
মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পরে বলল মিষ্টু ” ও মা তুমি তো সবই বোঝো,এবার কেকটা কাটো না প্লিজ।”
ইন্দ্রানী বলল,”আমার জন্যে এভাবে তুই তোর জমানো টাকা খরচ করে ফেললি,তুই না ওটা দিয়ে পুতুল কিনবি বলেছিলি। ”
মিষ্টু মাকে আদর করে বলল,”তোমার থেকে কিছুই আমার কাছে প্রিয় নয় মা,কোন পুতুলই নয়।”
মা ওকে জড়িয়ে ধরল।
মায়ের ব্যাগটা খুলে এতক্ষন এই পুরোনো কথাগুলোই ভাবছিল মিষ্টু।আজ একমাস হলো মা চলে গেছে,কাল ও ফিরে যাবে নিজের কর্মস্থলে।আজ তাই একবার সবকিছু দেখে নিচ্ছিল মায়ের স্মৃতিগুলো।না বিশেষ কিছু মায়ের ছিল না।গয়না মা আগেই বিক্রি করে দিয়েছিল মিষ্টুর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্যে,কারন বাবা ওর পিছনে বেশী পয়সা খরচ করতে রাজি ছিল না।
মিষ্টু ভেবেছিল চাকরী পেয়েই মাকে ওর সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে,খুব সুখে রাখবে।কিন্তু এক একটা মানুষের কপালে বোধহয় সুখ লেখাই থাকে না,তাইতো আচমকা এইসব হয়ে গেলো।আলমারীতে খুব সস্তা কিছু শাড়ীর সঙ্গে আরো সস্তা একটা ব্যাগ ছিল মায়ের,তারই চেনগুলো একটা একটা করে খুলছিল মিষ্টু,সবথেকে ভেতরের চেনটায় গিয়ে থমকে গেলো,কিছু আছে,হাত দিতেই একদম ঝুরঝুর করে পরে গেলো,কিছু শুকনো ফুল আর খচমচ করে উঠলো একটা ছেঁড়া ক্যাডবেরীর প্যাকেট।