যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।

0
1330

৯ই জুলাই ২০১৯, ম্যাঞ্চেস্টারে আয়োজিত ভারত বনাম নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনাল ম্যাচে 48.3 ওভারে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উইকেট পড়তেই, গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে কি এই বিশ্বকাপই মাহির শেষ বিশ্বকাপ? মাহি কি আজই অবসর ঘোষণা করে ফেলবেন! টুইটার ছেয়ে গিয়েছিল হ্যাজ ট্যাগে ‘প্লিজ নেভার রিটায়ার’। ফ্যান ফলোয়ার্সের বাইরে দাঁড়িয়ে লতামঙ্গেশকরের মতন সেলিব্রিটিরাও, ধোনিকে সেই মুহূর্তে অবসর নিতে মানা করে ট্যুইট করেছিলেন। তারপর থেকে ১৫ই আগস্ট ২০২০ সময়ের হিসাবে ৪০২ দিন পর, সমস্ত জল্পনা কল্পনা সরিয়ে, সতীর্থ,সহকর্মী,ভক্তদের ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে আমাদের প্রিয় মাহি সত্যি সত্যিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে চির বিদায় জানালেন। ভারতীয় ক্রিকেট মহেন্দ্রক্ষণ-শূন্য হল।
এটা ঠিক যে একজন অধিনায়ক হিসাবে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নূতন করে পাওয়ার কিছু নেই। বলা হয় তাঁর নেতৃত্বকালটাই ভারতীয় ক্রিকেটের সূবর্ণময় যুগ। ২০০৭ সালে অন্দর রাজনীতির আবহে থেকেও, স্থায়ী কোচহীন,অধিনায়ক হীন একটা টিমের যাবতীয় দায়িত্বের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে যে মানুষটা আমাদের প্রথম টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ডকাপের স্বাদ পাইয়েছিলেন তিনি ধোনি। ঠিক সেই মুহূর্ত! যে মুহূর্তে বিশ্বত্রাসী অস্ট্রেলিয়ার চোখে চোখ রাখার সাহসই কারুর ছিলনা, ঠিক সেই মুহূর্তে, পন্টিং, গিলিদের কবল থেকে কীভাবে চোখ রাঙিয়েই ম্যাচ বার করে আনতে হয় শিখিয়েছিলেন ধোনি। হয়ত এজন্যই অ্যাডম গিলক্রিস্টের মতন কিংবদন্তীও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘এম.ইজ ইজ’নট সেকেন্ড গিলক্রিস্ট। হি ইজ ফার্স্ট ধোনি’।
২০১১ ভারতে বসল ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের আসর। নূতন -পুরোনো খেলোয়াড়দের মেলবন্ধনে একটা ব্যালেন্সড্ টিম নিয়ে ২রা এপ্রিল মুম্বাই ওয়ানখের স্টেডিয়ামের আকাশে আবার আতশবাজির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিলেন ‘ মহানায়ক’! হ্যাঁ এটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। তিনিই পারেন প্রায় একশো-একুশ কোটি ভারতবাসীর আঠাশ বছরের তৃষিত বক্ষে, মন্দাকিনীর স্রোত বইয়ে দিতে। মনে পরে ছেলেটা একদিন বলতো ‘রাঁচীকে কেউ করাচী বলে চিনবে না,রাঁচীকে রাঁচী বলেই চিনবে সবাই’ সেদিন চিনেছিল৷ সব্বাই চিনেছিল রাঁচীকে রাঁচী বলেই। কারণ ওটা যে বর্তমান বিশ্বকাপজয়ী ভারত-অধিনায়ক মহেন্দ্রসিংহ ধোনির হোম-টাউন! এক ছোট্ট শহরে ধোনি যেন বাতিঘরের আলো। কোটি কোটি অভাবির অনুপ্রেরণা। কোন অজানা গলি থেকে ছয় মারতে মারতে মেলবোর্ন,সিডনি,অ্যাডিলেড, ম্যাঞ্চেস্টার,ব্রিসবেনে পৌঁছে যাওয়া। এক অখ্যাত স্মলটাউন-বয়ের আকাশ-জয়ী রূপকথার গল্প।
২০১৩, আবার একটা নূতন দল। কিছু পুরোনো সতীর্থকে ভারতীয় টিম-ম্যানেজমেন্টই তাঁদের পারফর্মেন্সের নিরিখে দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন। যার পূর্ণ প্রতিক্রিয়া এসে পরে ধোনির দিকে। হ্যাঁ হয়ত চাইলে আরও কিছুদিন ধোনি তাঁদের খেলিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। তিনি মনে করেছিলেন এমন একটা নব্য-বাহিনী তিনি তৈরি করবেন যাদের ফিটনেসে কোনো ঘাটতি নেই। যারা নিজেদের শতাংশ দিয়েও কয়েক বছর স্বচ্ছন্দে খেলে যেতে পারবেন। বীরেন্দ্র শেহবাগের জায়গায় রোহিতকে তুলে এনেছেন,গম্ভীরের জায়গায় ধাওয়ান,শচীনের পরিবর্ত বিরাট, যুবরাজের পরিবর্ত হার্দিক,জাহিরের বদলে বুমরা, নেহেরার পরিবর্ত ভুবনেশ্বর। প্রথম দিকেই যে, সকল জুনিয়র খেলোয়াড় নিজেদের পারফর্মেন্স দেখিয়ে অধিনায়ক’কে চাপ মুক্ত করেছেন,কিংবা দর্শকদের আস্থাভাজন হয়েছেন তা কিন্তু নয়। বরং দিনের পর দিন তারা নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবু দলের একজন ক্যাপ্টেন হিসাবে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আশা হারাননি। আজ রোহিত বিশ্বসেরা ওপেনারদের একজন,বিরাট তো সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার রাস্তায় প্রতিদিনই এগোচ্ছেন, ধাওয়ান,হার্দিক,বুমরা, ভুবিদের পারফর্মেন্স নিয়েও প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই।
হঠাৎ অবসর কেনো? ভেবে দেখতে গেলে আমাদের মনে হয় হঠাৎ কি আর? তিনি ক্যাপ্টেন্সি ছেড়েছেন ২০১৭ সালে। তারপরেও প্রায় দু বছর জাতীয় দলের সঙ্গে থেকে বিরাট কে খুব কাছ থেকে হাতে ধরে ক্যাপ্টেন্সির পাঠ শিখিয়েছেন। ধোনি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি এত আগে ক্যাপ্টেন্সিপ ছাড়লাম, তার কারণ পরবর্তী ক্যাপ্টেন যেন বিশ্বকাপের আগে দল গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়।” বছর আটত্রিশ ছুঁয়ে গেছে, সারা বিশ্বে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের সাথে আবার কবে বাইরের দেশের ম্যাচ গুলির আয়োজন করা যায়, তা নিয়ে একটা চিন্তা থাকছেই। বোর্ড কর্তাদের কপালেও ভাঁজ পরেছে। খেলোয়াড়দের শারীরিক সুস্থতার দিকটিও মাথায় রাখতে হবে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ,অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ শেষে,সাদাজার্সিকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি। সুতরাং একদিন আর টি-টোয়েন্টি ম্যাচের জন্য আবার কবে ডাক পাবেন ধোনি তা প্রশ্নচিহ্ন। যোগ্যতার কথা নয়। বিশেষকরে এখানেও সেই রাজনৈতিক আবহ। সত্যিই তো,একটু ভেবে দেখুন,উইকেট রক্ষক ফিনিশার ব্যাটসম্যান ধোনির সমান আর কে আছে ভারতীয় টিমে?আর ফিটনেসের দিক থেকেও তিনি তাঁরচেয়ে দশ-বারো বছরের জুনিয়র সতীর্থকে অবলীলায় হারিয়ে দিতে পারেন। সময় নয়।পরিস্থিতিই তাঁর অবসরের কারণ। তিনি বেশ বুঝে গেছেন,জাতীয় দলের পিছনে পরে থেকে আর কোনো লাভ নেই। ১৬টা বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। অনেক সেবা করেছেন দেশকে। পেয়েওছেন,তিরস্কার,বঞ্চনা,ঘৃণা,ধিক্কার,
ভালোবাসাও৷ একরুদ্ধশ্বাস কষ্ট বুকে চেপে ছোট্ট একটি ভিডিও এবং ক্যাপশন দিয়ে তিনি নিজের আন্তর্জাতিক বিদায় জানিয়ে দিলেন। কোনো ফেয়ারওয়েল ম্যাচ নয়।কোনো গার্ড অফ অনার নয়, এক নির্বেদ বিশ্রাম। টাকা-পয়সা,সম্মান-আড়ম্বর বহু পেয়েছেন জীবনে৷ আর লোভ নেই৷ উত্তরায়ন কাল আগত, কর্মজীবনের অন্তিমে চুপিচুপি মহাপ্রস্থান। বিশ্বের সবুজ কার্পেট পাতা ময়দানে এখন থেকে তিনি অতিথি। তাঁর নামের আগে ‘Former’।
নিজে মুখে বলতেন, “যদি আমি মনে করি আমি আজকের চেয়ে আগামীকাল আরও দ্রুত দৌড়াতে পারছিনা,সেদিন খেলা ছেড়ে দেব।” আপনি কথা রাখেননি। ফিটনেসের তুঙ্গবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ফিরে গেলেন প্যাভিলিয়নে। একদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে রান আউট দিয়ে যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল,পনেরো বছর পর সেই রানআউট দিয়ে কেরিয়ারের অন্তিম ইনিংসটির সমাপ্তি টানা হল৷ এই দুই রান আউটের ব্যবধানে রয়ে গেল এমন কিছু মাইলস্টোন যেটা আগামী প্রজন্মের কাছে ভাঙা কঠিন হবে। সাদা,নীল কোনো জাতীয় পোষাকেই আর দেখা যাবেনা তাঁকে৷ পরে রইল খন্ড খন্ড মুহূর্ত গুলো। অজস্র স্মৃতির চুম্বন। ভালো থেকো অধিনায়ক.. ভালো থেকো এম.এস।

“আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।”

শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়