(প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুমোপাধ্যায়ের স্মরণে )
————————–
বীরভূমের মেঠো পথ ধরে রাষ্ট্রপতি ভবন। সুদীর্ঘ এক আলোকিত যাত্রাপথের পথিক ছিলেন তিনি। এই ক্লান্তবিহীন পথপরিক্রমার পরিসমাপ্তি ঘটল দেশ তথা দুনিয়ার এক ঘনঘোর দুর্যোগের কালে। মৃত্যু, জীবনের বিকল্পহীন এক পরিণাম এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। বয়সটাও যখন পঁচাশি ছুঁয়েছিল, স্বাভাবিক মৃত্যুর বিয়োগজনিত বেদনায় মন কিছুটা গতানুগতিক সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পারত। কিন্তু দেশের প্রাক্তন এক এবং অদ্বিতীয় বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু যে দুর্ঘটনাজনিত কারণে ঘটবে, এমন আশংকা আমরা কোনোদিন করিনি। স্নানাগারে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত, সাথে বিভীষিকা সঞ্চারকারী করোনার সংক্রমণ, এসব তথ্যের আবহে তাঁর মৃত্যুর অভিঘাত একটু বেশিই হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যথাটা
আরো বেশি করে বাজছে এই কারণে যে, তিনি আমার জেলারই মানুষ হিসাবে গর্ব করার আলাদা সুযোগ এনে দিয়েছিলেন,আমার তথা বীরভূমবাসীর মনে।
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আমার খুব কাছ থেকে চাক্ষুষ দেখাটা প্রায় চল্লিশ বছরেরও আগে। তখন আমি আমার নিজেদের গ্রামের, বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বর হাইস্কুলের নীচের দিকের কোনো এক ক্লাশের ছাত্র। বামফ্রন্টের রণদামামার আওয়াজ শুনতাম চারদিকে। বর্গা আন্দোলন সরগরম করে রেখেছে গ্রামবাংলার সামাজিক পরিবেশ। কংগ্রেসের দোর্দণ্ড প্রতাপ কমছে ক্রমেই। স্কুলে যেতে আসতে পথের প্রান্তের একটা দেওয়ালের লেখায় চোখ যেত আটকে। কাস্তে হাতুড়ি তারার হাতে-আঁকা ছবির পাশে জ্বল জ্বল করত লেখাটা… ‘ প্রণব দালাল শ্যাম সিং হুঁশিয়ার..’ নীচের কোণায় ছোট্ট হরফে লেখা -সি.পি.আই.(এম)’
তখন কে ‘প্রণব’, কে ‘সিপিএম’ এসব সম্যকভাবে উপলব্ধি করার বয়স ছিলনা। বড়দের কাছে জেনেছিলাম, প্রণব মুখার্জী এ জেলার কংগ্রেসের নেতা, সিপিএমের দাপুটে প্রতিপক্ষ। সে সব রাজনীতির বিষয়ে কিছু বুঝি, বা নাই বুঝি প্রণব মুখার্জী নামটি কিন্তু চেনা হয়ে গেছিল জীবনের সেই কৈশোরকালেই । হয়তো তাই একদিন, যখন সহপাঠী এক বন্ধুর মুখে শুনলাম, প্রণব মুখার্জী পার্টির লোকদের নিয়ে থানার সামনের দোতলা মাটির ঘরের উপরের কোঠায় পার্টির ঘরোয়া মিটিং করতে এসেছেন, তখন তাঁকে একবার চাক্ষুষ করার লোভ সামলাতে পারিনি। বন্ধুর বাবা স্থানীয় কংগ্রেসকর্মী ছিলেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ে ভয়ে উঠেছিলাম উপরের ঘরে, সিপিএমের দেওয়াললিখনের ‘প্রণব’কে দেখতে। সেই আলো-আঁধারীর মাটির কোঠাঘরের মেঝেয় পাতা শতরঞ্জিতে বসে আছেন তিনি। জনা পনের-বিশেক চেনা লোকের মাঝে নিতান্ত ঘরোয়া মেজাজে। ধোপদুরস্ত ধুতি আর ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবীতে আপাদমস্তক সম্ভ্রান্ত এক বাঙালি ভদ্রলোক । কথাবার্তায় উগ্রতার লেশমাত্র নেই। গলার স্বরের মিষ্টতায় কথা তাঁর শ্রুতিমধুর। আমরা দুই কিশোর গিয়ে বসেছিলাম তাঁরই কাছাকাছি। বৈঠক বোধহয় শেষ হওয়ার মুখেই ছিল। নীচের ‘নারান-কাকা’র চায়ের দোকান থেকে থালায় সাজানো চায়ের কাপ এলো। সবার সঙ্গেই তিনি চা পান করতে লাগলেন।
সেদিনের সেই সাদামাটা মানুষটিকে দেখে একবারও ভবিষ্যতের কোনো স্বর্ণালী ছবি মনে ভেসে ওঠেনি। ভাবিইনি তখন, যে মানুষটির পাশে আজ এই মাটির মেঝের ধুলোমলিন শতরঞ্জিতে বসে আছি, গাঁয়ের আর পাঁচটা বয়স্ক চেনা মানুষের সাথে ঘরোয়া আলাপ করতে দেখছি, তাঁকেই একদিন ভারতের রাষ্ট্রপতির দুর্মূল্য রাষ্ট্রীয় আভিজাত্যে মোড়া আসনে বসতে দেখবো। কালের পরিক্রমায় কখনো তিনি দেশের বিদেশমন্ত্রী, কখনো অর্থমন্ত্রী বা কখনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বশীল পদ অলংকৃত করবেন। পরবর্তী জীবনে কতই না আড়ম্বরের আলোকিত আবহে তিনি ছবি হয়ে ধরা দিয়েছেন। বিমুগ্ধ হয়েছি তাঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ চালচলন ও কথাবার্তায়। জেলার মানুষ হিসাবে গর্বে বুক ভরে উঠেছে। কিন্তু কৈশোরে খুব কাছে বসে দেখা, মাটির ঘরের মেঝেয় বসা প্রণব মুখার্জীর সেই অনাবিল মাধুর্যের ছবিটি কোনোদিনও ম্লান হয়নি। আপন উজ্জ্বলতার বৈভব নিয়ে সে বাস্তব ছবিতে আঁকা মানুষটি আজো জেগে ওঠেন মনের আয়নায়।
এই দেখাটা তাঁকে দেখা প্রথম দেখা হলেও, সেটাই সামনাসামনি শেষ দেখা নয়। তারপরেও তাঁকে আমার নিজের গ্রাম বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে দেখেছি। এবং আশ্চর্য যে, সে সময়টাও ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক অস্বস্তির কাল। ক্ষমতা আর পদগরিমার আলো থেকে দূরে চলে আসতে বাধ্য হওয়া এক অন্য প্রণব মুখার্জী। ১৯৮৬ র ঠিক পরের সময়টাতে। যখন রাজীব গান্ধির সঙ্গে মতান্তরের কারণে বহিস্কৃত হয়েছেন জাতীয় কংগ্রেস থেকে। নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ধরে রাখতে দল গড়েছেন অন্য। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। সেই দলের হয়ে জনসভা করতে এসেছিলেন। স্বস্তিহীন এই জীবনআবহে তাঁকে অনেকটাই ভারাক্রান্ত মনে হয়েছিল তখন। জনাকয়েক স্থানীয় পুরনো সাথীদের আয়োজনে জনসভা ছিল। আড়ম্বরের ছিঁটেফোঁটাও ছিলনা আয়োজনে। ইন্দিরা গান্ধির কাছের মানুষ, তাঁরই মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রীর পদে একসময় থাকা মানুষটিকে বড়ো অসহায় মনে হয়েছিল। কাঠের তক্তপোশের সাদামাটা খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সীমিত সংখ্যক শ্রোতার কাছে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছিলেন। রাজীব গান্ধির ভুল নীতিগুলির সমালোচনাও করেছিলেন। আজো কানে বাজে তাঁর সেই পরিশীলিত বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য। অবশ্য এই ঘটনার বছর দুই-তিনেকের মধ্যেই ১৯৮৯-এ আবার রাজনৈতিক জীবনের পটপরিবর্তন ঘটে গেছিল তাঁর। অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকদীপ্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতির মূলকেন্দ্রেই নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জী। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
আজ রাজধানীর লোধী রোডের শ্মশানঘাটে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নশ্বর দেহ দাহ হয়ে গেল। আলোর পথের ক্লান্তিহীন এক অভিযাত্রীর পথ চলা হল শেষ। পিছনে পড়ে রইল তাঁর নিজের গড়া উত্তরণের এক ব্যতিক্রমী জীবন-ইতিহাস। বীরভূম জেলার কীর্নাহারের কাছের মিরাটি গ্রামের মেঠোপথ ধরে যে যাত্রার একদিন সূচনা হয়েছিল, অজস্র আলোকতীর্থ ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটলো জীবনের অনন্য এক পরিপূর্ণতায়।
দুর্গাপুজোয় আর তাঁকে সশরীরে মিরাটি হয়তো পাবেনা। বীরভূম জুড়েও তাঁর আগমনে সাজো সাজো রব উঠবে না। কিন্তু প্রণব মুখার্জী আসবেন বরাবরই, বীরভূমবাসীর নীরব স্মৃতির পথ বেয়ে। থেকে যাবেন আমাদের হৃদয়ের আলোকিত সিংহাসনে।
★কাজী নুদরত হোসেন
পূর্বপল্লী, নলহাটি, ওয়ার্ড -০২
জেলা-বীরভূম। (প.ব)-ভারত।