গৃহবন্দিত্বের অবসান হলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসুক নতুন ভারতবর্ষ : কাজী নুদরত হোসেন।

0
666

(আজ ও আগামী বিষয়ে একটি বিশেষ পর্যালোচনা)

এতদিনে বিষয়টা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমন কেবল জনস্বাস্থ্যের সমস্যা নয়, একটি রাষ্ট্র বা নিদিষ্ট ভূখণ্ডের বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর গুরুতর আর্থসামাজিক সমস্যাও । এ পর্যন্ত অনেক ভাইরাসই সুযোগ পেলে অতীতে কোথাও কোথাও মহামারির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এমন করে বিশ্বজুড়ে মানবদেহের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজদেহকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি, যেমন করছে নোভেল করোনা। তার দোর্দণ্ড প্রভাব ও প্রতাপে দেশের শিল্প, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার দফারফা তো হয়েছেই, শিক্ষা সংস্কৃতি ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও অচলাবস্থা নেমে এসেছে। এই সার্বিক গোলযোগে দেশের সামাজিক ও আর্থিক শৃঙ্খলাকে বজায় রাখাটাও সব দেশের সরকারের কাছেই নিঃসন্দেহে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে সবাই সবার মতো করে পরিকল্পনা মাফিক লড়ছে। তবে, মুশকিল হলো এ লড়াইয়ের শেষ কোথায় তা এখনই বলা যাচ্ছেনা।

বিশ্বে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এ জাতীয় ঘটনার এটা সূচনামাত্র বলে সতর্কও করছেন অনেকে।আসলে, ‘গ্লোবাল কমিউনিকেশন’- এর দৌলতে গোটা পৃথিবী ভাইরাসের অবাধ বিচরণের স্বর্গভূমি হয়ে উঠেছে। মানুষের হাত ধরেই তার দেশে দেশে এই যুদ্ধযাত্রা। অতীতে কোনো বিশেষ প্রাণীদেহের নিজস্ব নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে কোনো ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হওয়ার জৈবিক ক্ষমতা অর্জন করলেও একটি ভৌগোলিক অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হতো। কিন্তু আকাশপথে বিদেশযাত্রা সহজলভ্য হওয়ায় ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী সশরীর ‘ভাইরাল’ হতে কোনো বেগ পেতে হচ্ছেনা। তাই সম্মুখ সমরে যে লড়াইটা এখন মানুষে-করোনায় চলছে তার গতি একটু স্তিমিত হলেই সব দেশকে নতুন করে আত্মরক্ষার আঁটোসাটো কূটকৌশল স্থির করতে হবে। পরবর্তী সম্ভাব্য আক্রমনের হাত থেকে নিজের নিজের দেশকে বাঁচাতে ঢালতরোয়াল নিয়ে প্রস্তুত থাকতেই হবে। সেই ঢালতরোয়াল না থাকার খেসারত নিশ্চয় এমন করে আগামী পৃথিবীর মানুষ দিতে চাইবে না। দিতে চাইবে না শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী অসহায় অথচ দাম্ভিক রাষ্ট্রনেতারাও।

পরিবেশ এবং অণুজীববিজ্ঞানীদের সকলেই একমত যে, অরণ্যপ্রকৃতির ধ্বংসসাধন অনিবার্য করে তুলেছে নিত্যনতুন ভাইরাসের আক্রমন-সম্ভাবনাকে। তাই তাদের নানান প্রজাতির আক্রমনজনিত মহামারির ঘটনা আর বিলম্বিত ব্যবধানে বিশ্বে ঘটবে না, ক্রমান্বয়ে ঘটেই চলবে। সময়ান্তরে একের পর এক, মানুষের দরজায় এসে কড়া নাড়বে এতকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা আশ্রয়হীন অজানা ভাইরাস। তাদের মারণছোঁয়া থেকে বাঁচতে,মানুষের প্রচলিত গতানুগতিক জীবনধারাতে পরিবর্তন আসা অসম্ভাবী। সেটা যে অমূলক আশংকা নয়, তা তো সাম্প্রতিক লকডাউনের ঘটনা থেকেই পরিস্কার। নইলে, কে কবে ভেবেছিল ছেলেবেলার সেই ‘স্টাচু’ বললেই থমকে দাঁড়ানোর খেলাটা আমাদের নিত্যকার বাস্তব চলমান জীবনযাত্রাতেই নেমে আসবে এমন আচমকা। খেলার মতোই আমাদের নড়নচড়নের স্বাধীনতাও এক অজানা আণুবীক্ষণিক ভাইরাসের কাছে বন্ধক দিয়ে আপনাকে আমাকে ঘরে বসে থাকতে হবে চুপচাপ !

অন্যান্যদের মতো আমাদের দেশেও হয়তো এরপর আবশ্যিক সমাজ-জৈবনিক পরিবর্তনগুলো আসবে। জনগনের সামাজিক জীবনপ্রবাহের ধারা এতদিন যে নিদিষ্ট খাতে বইছিল, তাতে এতবড়ো ঢেউ আগে আছড়ে পড়েনি। এতদিন রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির নানান সঙ্কটআবর্তে ঘুরপাক খেয়েও, নিজেদের অবস্থানকে সহনীয় করে এগিয়ে চলছিল দেশবাসী। জীবনসংগ্রাম, চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্নবিলাস আর আশা-হতাশার হাজারো অনৈক্যের মাঝেও একটা সার্বিক ছন্দ গড়ে উঠেছিল সে চলাতে। আচমকা সেই গতানুগতিক ছন্দটা এলোমেলো হয়ে পড়েছে। এই ছন্দহীনতার অভিঘাত এত জোরালো যে, পুরনো ছন্দে ফিরে আসতে সময় যেমন লাগবে, তেমনি কাঠখড়ও পোড়াতে হবে বিস্তর।

ভারতের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির বেহালহকিকৎ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের জল্পনাকল্পনাও শুরু হয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে এক ধাক্কায় প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি এসে পড়বে বলে শুরুতেই আশংকা ছিল। ভারতের মোট কর্মীর শতকরা নব্বই ভাগই কাজ করে অসংঘটিত ক্ষেত্রে। কর্মহীন এই সব মানুষের জীবন-জীবিকা আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে কবে সেটা কারো জানা নেই। দীর্ঘকালীন লকডাউনে বন্ধ হয়ে কলকারখানায় স্বচ্ছন্দ গতি হঠাৎ করে আসবে না। চালু হলেও কাঁচামালের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। উৎপাদনব্যবস্থার সাথে সাথে আমদানি রপ্তানিও বড়ো ধাক্কা খেয়েছে এবং এখনো খাচ্ছে। খনিজ পদার্থের উত্তোলন ও জোগানও আগের মতো স্বাভাবিক ছন্দে নেই। কৃষিজ পণ্যও পরিবহণ ও বিপননের স্বতঃস্ফূর্ত সুযোগ পাচ্ছে না। বিমান,রেল সহ সরকারি বেসরকারি পরিবহণের পরিষেবাও স্বচ্ছন্দ করা যাবে কিনা, তা সময়ই বলবে। কারণ, এখনই করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

সন্দেহের অবকাশ নেই, লকডাউন দেশের দুর্দশাগ্রস্ত আর্থিক পরিস্থিতিকে টেনে নামাচ্ছে আঁধারের অতল খাদে। চটজলদি উত্তরণের কোনো পথই এখন খোলা নেই। তবু বিপর্যয় কাটানোর সবরকম চেষ্টা সরকারি তরফে নিশ্চয় জারি থাকবে। এই সর্বগ্রাসী হতাশার মাঝেও কয়েকটা দিনের জন্য পরিবেশের স্বস্তির নিশ্বাসে আশার আলো দেখছেন অনেকে। আশাটা আরও সার্থক হয়, যদি দেখা যায় এই বিপর্যয় সাধারণ মানুষের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যচেতনার সাথে সাথে মানবিক তথা সামাজিক চেতনায় নতুন আলোর স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। আগামীর জীবনজীবিকার লড়াইটা যত কঠিনই হোক, সমাজবদ্ধ হয়েই তো সেটা দেশবাসীকে লড়তে হবে!

এদিকটায় নজর ঘোরালে দেখি, এই ঘোর দুর্বিপাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার নানান উজ্বল ছবি আঁকা হয়েছে। অসহায় দরিদ্র মানুষের দিকে অগণিত মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিকল্পিত স্বাস্থ্যবিধি মানতে নিজে যেমন অধিকাংশ মানুষ সক্রিয় থেকেছে, অন্যান্যদেরও উদবুদ্ধ করেছে। সম্প্রীতির ভাবনাও জাগ্রত থেকেছে গৃহবন্দিত্বের এই ক’দিনে। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধের এই আলো সমাজে নতুন স্বপ্নের জন্ম দেয়।

এগুলি যেমন আশার ছবি, তেমনি মর্মাহত করেছে হতাশার অনেক চেনা ছবিও। লকডাউনের মাঝেই নারীধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মতোই এই দিনগুলিতে আমাদের সমাজের নারীরা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়েছে অধিক সংখ্যায়। শিশুদের প্রতি নির্যাতনেরও মাত্রা বেড়েছে। রাষ্ট্র সংঘের মহাসচিব এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ডিরেক্টর জেনারেলের সতর্কতার সুরে সুর মিলিয়ে আমাদের জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মাকেও বিবৃতি দিতে হয়েছিল এ নিয়ে।
তবু আমরা আশাবাদী, ঘনিয়ে আসা দুর্যোগ কাটিয়ে উঠে আবার এ দেশ আপন অন্তর্নিহিত ঐক্যের সামর্থ্যেই ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের লড়াইয়ের সাথে সমাজসংস্কৃতির পুনর্গঠনের লড়াইটাও সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে। শেষ পর্যায়ের লকডাউনের মেয়াদ শেষে আবদ্ধ ঘরের দরজা খুলে বাইরের শক্ত বাস্তবের মাটিতে পা রাখবে নতুন চেতনায় আলোকিত ভারতবাসী। সে আলো স্বাস্থ্য ও পরিবেশচেতনার আলো, সংহতিবোধ আর সমাজচেতনার নতুন আলো।
—————–
লেখক-
কাজী নুদরত হোসেন

নলহাটি — বীরভূম
(প.ব) / ভারত