গল্প-শিকড় : শতাব্দী মজুমদার।

0
708

বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া ,এতক্ষন বৃষ্টি দেখবো বলে জানালা দুটো খুলে রেখে ছিলাম কিন্তু হাওয়ার দাপটে তা আর সম্ভব হলোনা।কারেন্টটাও দুম করে চলে গেলো, কি হবে এখন?দেবু কাকার কাছ থেকে মোমবাতি চেয়ে রাখা উচিত ছিল আগেই,এতো কলকাতা শহর নয়,এখানে এমনিতেই যখন তখন কারেন্ট যায় আর ঝড় বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।দরজা খুলে দেবু কাকাকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম হ্যারিকেন হাতে নিয়ে দেবু কাকা আমারই ঘরের দিকে আসছেন ,হাতের হ্যারিকেন টা মেঝেতে নামিয়ে রেখে তার নিজের ভাষাতেই বললেন,

“এমন বাতাস হলি কত যে গাছ পড়বে তার ঠিক নাই, কারেন্ট আসতি দু’তিন দিন সময় লাগি যাতে পারে”।
“মামনি আমি তোমার খাবার টা ঘরে দিয়ে জাবানে”।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
“ভয় পেওনা কিন্তু মামনি,আমরা সবাই নিচেই আছি।আর রাতে ঘুমানোর সময় হ্যারিকেনটা নিভায়ে দিও”।
আমি আবারও বললাম, ঠিক আছে।

দেবু কাকার দুই বঙ্গের মেশানো শব্দের কথা আমার শুনতে বেশ লাগলো।দেবু কাকা চলে যেতেই আরেকটা ভাবনা মাথায় এলো, কারেন্ট না এলে রাতে ঘুমোব কি করে!এমনিতেও এই ঘরের ফ্যানের অবস্থা খুব খারাপ,কড়িবরগা থেকে ঝুলছে বড় একটা ফ্যান , ওই ঘুরতে হয় বলেই যা ঘোরে একটু,রেগুলেটর পাঁচ এ দিয়েও যা, না দিয়েও তাই।আমি নিচের বারান্দায় বড় একটা টেবিল ফ্যান দেখে এসেছিলাম ওটাকেই ওপরে আনাবো ভাবছিলাম কিন্তু দেবু কাকা যথেষ্ট বয়স্ক ,ওনাকে দিয়ে ওটা আনানো ঠিক হবেনা তাই কিভাবে আনা যায় সেটাই ভাবছিলাম কিন্তু এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য কারেন্ট যাওয়াতে সেই ভাবনা আপাতত মুলতবি রেখে ভেবে নিলাম মাত্র একটা রাতের ব্যাপার তো ,ম্যানেজ করেই নেব।

স্বর্ণলতায় আমি আজ সকালেই এসেছি,এই বাড়ির নাম স্বর্ণলতা ।বাড়ি মানে বিরাট অট্টালিকা ,যা একশো বছরেরও বেশি সময়ের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে। শুনেছি আমার দাদুর ঠাকুমার নাম ছিল স্বর্ণলতা ,নিচের বৈঠকখানা ঘরে অন্য অনেক ছবির সঙ্গে স্বর্ণলতাদেবীরও মস্ত একটা বাঁধানো ছবি আছে ,ভীষণ জীবন্ত সেই ছবি ,কোনো একজন বিখ্যাত শিল্পী কে দিয়ে নাকি আঁকানো হয়েছিল সেইসময়।সুন্দর মুখশ্রী আর ব্যক্তিত্বের সমন্বয় সেই ছবি ,এ বাড়িতে ঢুকেই আমি মুগ্ধ হয়ে অনেক্ষন দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম।

আমি মা বাবার সঙ্গে কলকাতায় থেকে বড় হয়েছি।স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে এখন একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করছি।,গত বছর মা কে হারিয়েছি , তারও বছর তিনেক আগে বাবাকে।এখন একেবারে একা আমি,বিয়ে করিনি এখনো।বয়স তো সবে সাতাশ ,মনের মতো কাউকে পেলে করে নেব সময়মতো।তার আগে কেরিয়ার বানাবো আরো ভালোমতো।আত্মীয় বলতে মামাবাড়ির দিকের আত্মীয়রা আছেন ঠিকই কিন্তু বাবার বাড়ির দিকে কারুর সঙ্গে বাবাকে সেভাবে যোগাযোগ রাখতে দেখিনি, তাই আমার সঙ্গেও কারো যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি ।গত সপ্তাহে মেজ জ্যেঠিমার লেখা একটা চিঠি পাই ।
তাতে লেখা ছিল,

তাড়াতাড়ি যেনো একবার আমি স্বর্ণলতা য় এসে ঘুরে যাই, খুব দরকার আছে।

বাবা মা নেই ,অথচ তাদেরই কোনো আপন জন যখন আমাকে ডাকছেন তখন মনের মধ্যে হাজার কৌতূহল তৈরি হলেও বাবার আত্মীয়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ফেললাম।অফিসে দু’দিনের ছুটি নিয়ে চলে এলাম উত্তর চব্বিশ পরগনার মছলন্দপুরে।
——————————————-

মেজ জ্যেঠিমার সঙ্গে আমার মায়ের যোগাযোগ ছিল শুনেছিলাম।মা বাবার বিয়েটা দাদু মেনে নেননি ,বাবাকে প্রায় ত্যাজ্য পুত্রই করেছিলেন।বাবাও অভিমানে আর যোগাযোগ রাখেন নি এই বাড়ির সঙ্গে কিন্তু মেজ জ্যেঠিমা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।মেজ জ্যেঠিমা মানুষ হিসেবে খুব ভালো মনের, মায়ের মুখে সেটাও শোনা ছিল।এখানে এসে দেখলাম জ্যেঠু শয্যাশায়ী, গলায় ক্যানসার, একদম লাস্ট স্টেজ। জ্যাঠিমারও বয়েস হয়েছে কিন্তু কথায় এতো আন্তরিকতার ছোঁয়া, মনে হলো যেন কতদিনের চেনা ,অথচ আমি ওনাকে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম।আমার ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর শ্রদ্ধানুষ্ঠানে বাবা আমাদের নিয়ে এখানে এসেছিলেন ,সেবার দিন তিনেক এই বাড়িতে ছিলাম আমরা।তখন আমার বছর দশেক বয়স হবে, এ বাড়িতে আমার কাছাকাছি বয়সের কোনো বাচ্চা ছিলনা তাই তখন আমার এখানে থাকতে একদমই ভালো লাগে নি।

আসলে আমার বাবারা চার ভাই ছিলেন।মেজজ্যেঠু আর বাবা বিবাহিত ,বড় জ্যেঠু অবিবাহিত ছিলেন আর ছোট কাকু খুব অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। স্বর্ণলতা দেবীর পাঁচ পুত্রের কনিষ্ঠ পুত্র আমার বাবার দাদু।দুই পুত্র অবিবাহিত থাকা অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন আর দুই পুত্র বিবাহিত হয়েও নিঃসন্তান ছিলেন।আর আমার দাদুরা তিন ভাই ছিলেন তার মধ্যে একভাই অবিবাহিত ও একভাই নিঃসন্তান ছিলেন।তবে অদ্ভুত ভাবে এতগুলো জেনারেশনের মধ্যে কারুর কোনো কন্যা সন্তান ছিল না ,এক মাত্র এই পঞ্চম প্রজন্মে আমি ছাড়া।

ঝড় থেমে গেছে অনেক্ষণ ,বৃষ্টি পড়ছে এখনো।দেবু কাকু রাতের খাবার দিয়ে গেলেন রুটি ,আলুর দম আর ডিম ভাজা।দুপুরে জ্যেঠিমা আমাকে অনেক যত্ন করে খাইয়েছেন ,অশক্ত শরীরে নিজের হাতে চিংড়ি মালাইকারি রান্না করেছেন।হয়তো মা কখনো বলেছিলেন আমি চিংড়ি মাছ খেতে খুব পছন্দ করি।এরকম নিজের লোকের যত্ন – আদর আমি মা বাবা ছাড়া সেভাবে কারুর কাছ থেকে পাইনি, ভীষণ ভালোলাগার সঙ্গে সঙ্গে তখনই একটা প্রশ্ন উঁকি মারলো মনের কোণে।আচ্ছা জ্যেঠুর অবর্তমানে জ্যাঠিমার কি হবে? কে দেখবে তাঁকে?

দুপুরবেলা খাওয়ার সময় জ্যেঠিমা আমাকে এখানে আসতে বলার কারণটা স্পষ্ট করেছেন। “মামনি তোমাকে ডেকেছি কেন জানো, জ্যেঠুর অবস্থা তো দেখছো,ডাক্তার বলেছেন বড়জোর দিন কয়েক”।

একটু থেমে আবার বললেন,

“আমি তার অবর্তমানে পেনশন পাবো কিন্তু এতো বড় বাড়িটা আর তো রক্ষণাবেক্ষন করা সম্ভব হচ্ছে না।দেবুদারও অনেক বয়েস হয়েছে ,দেবুদা আমাদের অনেক দিনের লোক এই বাড়িতে আছেন ,আমি দেবুদার মাইনের এক তৃতীয়াংশ দিয়ে ব্যাংকে রেকারিং করে দিয়েছিলাম কাজেই ওরও কিছু টাকা পয়সা আছে কিন্তু আশ্রয় নেই।এই বাড়ি ছেড়ে দেবুদারও যাওয়ার জায়গা নেই।স্থানীয় প্রমোটাররা অনেকদিন ধরে ঘোরাঘুরি করছে বাড়িটা ভেঙে প্ল্যট করে করে তারা জমি বিক্রি করবে কিন্তু তোমার জ্যেঠু এসব প্রস্তাবে রাজি হন নি।এই বাড়ির সঙ্গে ওনার অনেক সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে ।তুমি ছাড়া এই বাড়ির আর কোনো উত্তরাধিকারও নেই তাই তুমি ই ঠিক করবে এখন এই বাড়ি নিয়ে কি করবে”।

আমি জ্যাঠিমার কথা মন দিয়ে শুনলাম,সত্যি বলতে কি, যে বাড়ির সঙ্গে কোনদিনও আমার যোগাযোগ ছিল না আজ হঠাৎ যখন শুনছি সেই বাড়ির উত্তরাধিকার একমাত্র আমার, তখন ভালোলাগার সাথে সাথে একটা অন্য বোধ কাজ করছে।সত্যিই কি আমি যোগ্য এই বাড়ির মালিকানার!বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছিল অনেকদিন আর আমার সঙ্গে তো কোনো যোগাযোগের প্রশ্নই ছিলনা ,তাহলে শুধু মাত্র উত্তরাধিকার সূত্রেই এই প্রাপ্তি আমার!
এই অযাচিত প্রাপ্তির জন্য আমি তো কখনও প্রস্তুত ছিলাম না।কলকাতায় আমার বাড়ি আছে ,নিজের চাকরি আছে ,এতো বড় বাড়ির মালিক হয়ে আমিই বা কি করবো!কিন্তু ওই যে আর তো কোনো দাবিদার নেই স্বর্নলতার,তাহলে আমাকেই দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে এবার।বিক্রি করলে তো অনেক টাকা,জ্যেঠিমা আর দেবু কাকাকে না হয় কলকাতাতেই নিয়ে গেলাম।

দুপুরে জ্যেঠিমা আরও বললেন,স্বর্ণলতা দেবীর বাপের বাড়ির সম্পত্তির একটি অংশ এটি।পুকুর,বাগান সহ বিস্তীর্ন জমির ওপর নতুন বাড়ি তৈরি করেন দাদুর দাদু,তাই স্ত্রীর নামেই নামকরণ করেছিলেন “স্বর্ণলতা”। আমি যেন এক মুহূর্তে একশো বছর পিছিয়ে গেলাম। কত ভালোবাসা, কত আশা দিয়ে এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল।ওপর নিচ মিলিয়ে দশ টি বড় বড় ঘর। ছেলে, বউমা, নাতি ,কাজের লোক সবাইকে নিয়ে জমজমাট ছিল এই বাড়ি ।সবাইমিলে একবাড়িতে থাকা হবে বলে এতো বড় বাড়ি তৈরি হয়েছিল।কিন্তু অকাল মৃত্যু আর সন্তানহীনতা , বংশ পরম্পরা প্রায় শেষ করে দিল। যেন কত প্রজন্ম পার করে এই বাড়িটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কত কিছুর স্বাক্ষী হয়ে।ধ্বংসের মুখে চলে যাবে স্বর্ণলতা, না আবার এক প্রজন্মের হাত ধরে নতুনকরে গড়ে উঠবে !এই বিশাল অট্টালিকার জীওন কাঠি যেন এখন আমারই হাতে।
—————————————-
রাতে শুতে গিয়ে দেখলাম, খুব একটা গরম লাগছে না ,বরং বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে।জোৎস্না রাত ,চাঁদের আলো এসে পড়ছে বিছানায়।বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে ,মাঝে মাঝে ব্যাঙও ডাকছে।কেমন যেন অদ্ভুত এক পরিবেশ।আমি আমার নিজের বাড়িতে।এই বাড়িতে আমার বাবার শৈশব কেটেছে, আমার দাদু শৈশব থেকে বৃদ্ধ হয়ে এই বাড়িতেই মারা গেছেন ,এই বাড়ি তাঁদেরই জীবন স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে।এই বাড়ির মানুষেরা নিজেদের কৃতিত্বের মধ্য দিয়ে বাড়ির নাম আরও উজ্জ্বল করেছেন।কেউ ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা দিয়ে এলাকাবাসীর উপকার করে সুনাম কুড়িয়েছেন তো কেউ শিক্ষক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তুলে সম্মান পেয়েছেন।আর তাঁদের সঙ্গে স্বর্ণলতা গর্বিত হয়েছে ।লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে স্বর্ণলতার ডাক্তারবাবু বা স্বর্ণলতার মাস্টারমশাই। বিকেল এ দেবু কাকা প্রতিটি বন্ধ ঘর তালা খুলে খুলে দেখিয়েছেন।দাদুর এক ভাই প্রচুর বই পড়তেন ,তিনি কলেজ শিক্ষক ছিলেন তার ঘর জুড়ে শুধুই বই । আরেকটি ঘরে হারমনিয়াম ,তবলা ,সেতার এবং ঘরের কোণে পিয়ানো।দাদুর বাবা মানে আমার প্রপিতামহ সংগীত অনুরাগী ছিলেন,চমৎকার পিয়ানো বাজাতে পারতেন। রান্নাঘরটিতে ছিল আরো চমক,সেই পুরোনো দিনের বড় হাঁড়ি,কড়াই ,সবজি কাটার বটি,রুটি বেলার বেলান চাকী,মশলার কৌটো,শীল নোরা সবই খুব যত্নে রাখা রয়েছে এখনো।স্বর্ণলতা দেবীর রান্নার প্রতি আগ্রহ ছিল খুব।তার নিজস্ব একটি রান্নার রেসিপি লেখা খাতা আছে যা নাকি পরবর্তী প্রজন্মের বউদের খুব কাজে লেগেছিল।

আজ কেন জানিনা আমার আর নিজেকে একা মনে হচ্ছে না।অফিসের দায়িত্ব,ব্যস্ততা আর বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডায় বাইরের আমিটা হয়তো পূর্ন কিন্তু ভিতরের আমিটা যে একেবারেই একা।রোজই তো অফিস থেকে রাতে বাড়ি ফিরে একলা ঘরে আমি কেঁদে ফেলি,সে কান্না আর থামে না ,যতক্ষণ পর্যন্ত না দু চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।আজ অদ্ভুতভাবে আমার আর কান্না পেলো না।

“স্বার্নলতায়”আজ যেন কিসের উৎসব!
এ বাড়িতে আজ যে অনেক মানুষের সমাগম,সবাই খুব ব্যস্ত কিছু একটা নিয়ে।মাথায় অর্ধেকটা ঘোমটা দেওয়া ,অসম্ভব স্নেহময়ী ,হাসিমাখা মুখে স্বর্ণলতা দেবী এসে আমার হাত ধরলেন ।আমাকে নিয়ে তিনি এঘর ওঘর ঘুরছেন ,সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।এবার আমি দাদুর বাবা ,দাদু,আমার বাবা কাকা জ্যাঠা সবাইকেই দেখতে পাচ্ছি আমরা সবাই একই সঙ্গে পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আজ যেন আমারও ভীষণ আনন্দ হচ্ছে সবাইকে দেখে। এরা আমার নিজের মানুষ ,আমার পূর্ব পুরুষ।আমার তো আর নিজেকে একা মনে হচ্ছেনা একেবারেই।

হঠাৎ মেজ জ্যেঠু এলেন,নিচের বৈঠক খানার ঘরে ,আমি স্পষ্ট দেখলাম মেজ জ্যেঠুর মুখে ভীষণ অসহায়তা,চোখে যেন আকুল আর্তি। আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করলেন যেন।”

মামনি ,মামনি দরজা খোল।দেবু কাকা বেশ জোরে জোরে দরজা নক করে আমাকে ডাকছে। চোখ খুলতেই দেখলাম সকাল হয়ে গেছে ,আলো এসে পড়েছে ঘরে।তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই দেবু কাকা কাঁদতে কাঁদতে বললো ,

“মেজদা আমাগো ছাড়ি চলি গেল মামনি”।

আমি হতবাক,স্বপ্নে তাহলে আমি ঠিকই দেখলাম ! সব মৃত মানুষদের মধ্যে মেজ জ্যেঠুও এলেন শেষ পর্যন্ত !ঘটনার আকস্মিকতা কোনোরকমে সামলে তাড়াতাড়ি নিচে এসে দেখলাম ,মেজ জ্যাঠিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছেন।আমাকে দেখে বললেন সব শেষ হয়ে গেল আমার,তোমার জ্যেঠু একটু আগে চলে গেলেন।

মা বাবার মৃত্যু আমি দেখেছি ,অনেক কেঁদেছি কিন্তু মেজ জ্যেঠুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে চললো আমার জীবনে।পূর্বপুরুষের স্মৃতি আগলে রাখার দায়িত্ব আর দু’জন বয়স্ক মানুষকে নিশ্চিত আশ্রয়ে রাখার দায়িত্ব।উত্তরাধিকার মানে তো শুধু প্রাপ্তি নয় বরং দায়িত্ব নিয়ে সেই প্রাপ্তিটুকুকে অনেক যত্নে আগলে রাখতে হয়।না,শুধুমাত্র টাকার জন্য এই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া বোধহয় ঠিক হবেনা,টাকার থেকেও অনেক মূল্যবান সম্পদ এই বাড়ি জুড়ে।একে আগলে রাখতে হবে,এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে পূর্ব প্রজন্মের স্মৃতিকে সংরক্ষন করে যেতে হবে আমাকেই।বুঝতে পারছি , আমারও একটা শিকড় আছে আর এই শিকড়ের চার পাশ খুব যত্ন করে জল মাটি দিয়ে আরও শক্ত করলেই আমি আমার মনের ডালপালাগুলো ছড়িয়ে নিজেকে মেলে দিতে পারবো।

শ্মশান যাত্রীরা স্বর্নলতায় এসে জড়ো হয়েছেন, মালা,চন্দনে সাজানো জ্যেঠু কে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হবে এখনই।জ্যেঠিমা যেন আরও বেশি ভেঙে পড়লেন ।কান্না বড্ড ছোঁয়াচে ,জ্যাঠিমার কান্না দেখেই কি না জানিনা আমারও ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো ,জ্যেঠিমাকে দু হাত দিয়ে নিজের বুকে আগলে নিলাম আমি ।

সমাপ্ত