অগ্নিদগ্ধা : প্রদীপ দে।

0
616

প্রচন্ড গরম পড়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরকে অলস করে দিচ্ছে এই বিকালের শেষে। যখন ভ্যাপসা আবহাওয়ায় সূর্য সমান তেজে গমনোন্মূখ।

তানিয়া ইয়াসমিন, প্রকাশ ঝার স্ত্রী, ৩২ বছরের গৃহবধূর, নিঃসঙ্গ জীবনের একটি কামনা মাখা বিকাল, অতৃপ্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে পড়ে। আচ্ছন্নতা গ্রাস করে , চোখ বুজে আসে, আশার মনকে ভেঙ্গে।

দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে এটা। প্রকাশ ঝা’র স্ত্রী মৃত।

তানিয়া ইয়াসমিনের তালাক পাওয়া জীবন। রাঁচিতে ওদের পরিচয়, তারপর হিন্দুমতে বিবাহ।

প্রকাশের কাজ ,পেশাদার, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। নিজের ছোটখাটো অফিসে আর বাইরে ঘুরে ওর কাজ। সারাবছরের ৯ মাসই বাইরে কেটে যায়। তানিয়া সব বুঝে জেনেই এই বিয়েতে রাজী হয়। উপায়ন্তর যেখানে অমিল। সে শিক্ষিত।

হিন্দি ভাল জানা থাকায় এখানের একটা হিন্দি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। অল্প বেতনে, সময় কাটানোর ভদ্রস্থ উপায়। সকাল ৭ টা থেকে বেলা ১১ টা কোথা দিয়ে যেন কেটে যায় তার। প্রকাশের অভাব তাকে পেয়ে বসে বিকালের পরে। মাঝেমধ্যে যখন থাকে তখন সময় যেন হু -হু করে কেটে যায়। তানিয়া রাঁচির রাস্তাঘাট তেমন করে চিনে উঠতে পারেনি এখনো। আগে তার শ্বশুর বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশের এক প্রত্যন্তে গ্রামে। ওখানে যখন ওর তালাক হয়, তখনই জেদী,শিক্ষিতা মেয়ে তানিয়া ইয়াসমিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে এবং পথে নামে। সেই একটা গান আছে না -” পথে এবার নামো সাথী। পথেই হবে পথ চেনা “। সেই পথেই পরিচয় হয় প্রকাশের সঙ্গে। ব্যাচেলর প্রকাশ তখন পেশাগত কারণে উত্তরপ্রদেশে ছিল। পরিচয় থেকে প্রেম এবং বিবাহ, খুব বেশি সময় লাগেনি। দুজন দুজনকেই চেয়েছিলো তাই বোধদয়।

নিঃসঙ্গতা কিন্তু থেকেই গেল। তার জীবনে একাকীত্ব একটা বড়ই প্রয়োজনীয় শব্দ। এই সকল ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা এসে গেল। চোখ জুড়িয়ে গেল। সামান্য কিছু সময়ের ব্যবধান, একটা কিরকম অসস্তি হলো সমস্ত শরীরে, কে যেন খুব কাছে থেকে তাকে দেখছে মনে হলো, এটা যাকে দেখে, সে যেন ঠিক টের পায়,এই ধরনের, চোখ খুলে আবার বুঁজে নিল তানিয়া, না এবার পদধ্বনি যেন শোনা গেল, নুপুরের আওয়াজ, ঝমঝম শব্দে।

তানিয়া নিশ্চিত তার ঘরে কেউ অনাধিকার প্রবেশ করেছে। তরাং করে উঠে বসলো, কেউ যেন দরজায়, লাফিয়ে গেল তানিয়া তার সামনে, স্পষ্ট দেখলো এক বিদূষী নারী, ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেল, নুপুরের আওয়াজ তুলে, ঘাগড়া তুলে ধরে।

তানিয়া দৌড়ে বাইরে বারন্দা লাগানো উঠানে পৌঁছে গেল,  দেখলো কিছু নেই,  শুধু “হিস -হিস ” শব্দে এক মা মনসার বাহন এঁকেবেঁকে সামনের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

তানিয়া ইয়াসমিন ভয় পেল। গা ছমছম করে উঠলো। সন্ধ্যায় আবার নিজেকে সামলে নিল। রাতে প্রকাশের সঙ্গে মোবাইলে কথা হলো, ওকে সব জানলো। প্রকাশ ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিয়ে জানালো — তুমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছো, তবে জঙ্গলে সাপ থাকতেই পারে, ওরা কারোর ক্ষতি করে না।

এরপর আর কিছু হয়নি। তানিয়া ভুলে গেছিল। মাস খানেক বাদ প্রকাশ বাড়ি ফিরলো। ফেরার পর দ্বিতীয় দিন মধ্যরাতে হঠাৎই রান্নাঘরের সমস্ত বাসনপত্র ঝনঝন করে পড়ে গেল। আওয়াজে দুজনেরই ঘুম ভেংগে গেল। বিড়ালের কথা ভেবে তানিয়া রান্নাঘরে ঢুকে দেখতেই এক বিদূষী নর্তকীর উল্লাস দেখে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। প্রকাশ দৌড়ে গিয়ে সে যাত্রায় তানিয়াকে ধরে ফেলে, এবং চোখে মুখে জল দিয়ে সুস্থ করে তোলে।

তানিয়া ভয় পেয়ে প্রকাশ এ বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে,  প্রকাশ রাজী হয় না, বলে -এটা কোন সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়।

তানিয়া সু্যোগে ছিল। প্রকাশ বাইরে চলে গেলে, ও একদিন এক পাশের পাড়ায় ফকিরের সংগে যোগাযোগ করে এবং সমস্ত ঘটনা জানায়। তন্ত্রের সাহায্যে ফকির কিছু জানতে পারে এবং তানিয়াকে জানায় — গলদ যো হ্যায় ও তুমহারা ঘর মে নেহি, ও দুসরা নজর —

তানিয়া জানতে চায় –সেটা কোথায়?

তান্ত্রিক সঙ্কোচ করে — তুম দুখ মিলেগা।

তানিয়া চমকে ওঠে  — তবুও বলুন। আমাকে বাঁচান। আমি আপনার মেয়ের মতোন।

ফকিরের মায়া হয় — শুন বেটি , তুমহারা মরদ কা পহেলা বিবি থি ওহি নাচনেবালী। বহুৎ খুব সুরত থা, বহুৎ জানকারি থা, ইসি লিয়ে শাদি কা বাত ঝামেলা আগিয়া, যো শাদি কা পহলে আপকা সোয়ামীকা আন্দাজ মে নেহি থা। থোর দিন গিয়া মুশকিল জাদা হো গিয়া তো প্রকাশ আসান কর দিয়া। এক সাম নিদনেকা সময়, উসিকো আগ লাগা দিয়া গিয়া, সব জ্বল কর খতম হো চুকা গিয়া।

তানিয়া চোখ বুঁজে নিল। হাত পা থরথর করে কেঁপে উঠলো। ফকির সাব ওর চোকে মুখে জল দিয়ে শান্ত করলো।

কিছুবাদে তানিয়া জানালো, — তাই প্রকাশের হাতের আঙুল গুলো পোড়া। ও মিথ্যা কথা বলতো।আমাকে বলেছিল ওর স্ত্রী রোগে মারা গেছে।

ফকির মাথা নাড়লো — ও আভি নাগিন কা রুপ মে হ্যায়। হাম দাওয়াই দেতি হু, ও নাগিন কো দেনে হোগা। ঠিক সে কাম করেগী তো ও খতম হো যায়েগা , লেকিন সামাল কে, নেহি তো —

তানিয়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ঔষুধ নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। প্রকাশকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। নানান চিন্তা করতে করতে সে বাড়ির গেট খুলে উঠোন পেরোনোর সময়ে অকস্মাৎ ” হিস -হিস শব্দে নাগিন টা তার সামনে এসে পথ আটকায়, ছোঁবল তোলে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে তানিয়া এই আচম্বিত আক্রমণে, তবুও হাত থেকে ঔষুধ দিতে যায় ওর শরীরে, কিন্তু ততোধিক ক্ষিপ্রতায় সাপ তার পায়ে তাঁর বিষদাঁত বসিয়ে দেয়, তানিয়ায় হাতের কৌটো ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে। তানিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

পুনশ্চ : এর পরেরদিন প্রকাশকে স্থানীয় থানায় দেখা যায়। পূর্বের স্ত্রীকে হত্যার অপরাধ কবুল করে এবং নিজেকে পুলিশের হেফাজতে নেয়।