(পূর্ব প্রকাশের পর)
আজকের পর্বে এবার যে ঘটনার কথা বলবো , আমার মনে হয় এই ঘটনাটি চূড়ান্ত বাস্তববাদী বলে যাঁরা নিজেদেরকে ভাবেন তাঁরাও পড়ে বিস্মিত হবেন আর প্রভুপাদের ভজন-প্রভাবের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করবেন। বাস্তবিক ,ভীষণ লোমহর্ষক ঘটনা এটি একটি, যার প্রতক্ষ্য সাক্ষী বহু বহু জন ছিলেন।
বাংলায় ১৩৩৪ সন, আর ইংরেজির ১৯২৭ সাল । প্রভুপাদ সপরিবারে , সপরিকরে চলেছেন ব্রজধামে। হাওড়া থেকে ট্রেন ছেড়েছে । তুফান এক্সপ্রেস। সারা রাত ট্রেনেই কাটবে। প্রভুপাদ যে কম্পার্টমেন্টে আছেন সেই কম্পার্টমেন্ট ট্রেনের যে বগীতে , তার পুরোটাতেই ভক্তদের ভিড়। রাত তখন প্রায় নটা হবে , বিশ্রামের সময়। সামান্য কিছু শুকনো প্রসাদ গ্রহণের পর প্রভুপাদ চোখবুজে লীলাস্মরণ করতে করতে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। তারপরই হঠাৎ চোখ খুলে একটু চঞ্চলতার দৃষ্টি সহ এদিক সেদিক তাকাতে থাকলেন। সেবক উপেন তাঁর পাদসম্বাহন করছিলেন, তিনিও আশ্চর্য হলেন অকস্মাৎ প্রভুপাদের অমন ব্যগ্রতায় ।
উপেন–“কী হয়েছে প্রভু ? কিছু খুঁজছেন? বলবেন কিছু?”
প্রভুপাদ–” হ্যাঁ। শোন উপেন , তুমি এখুনি এক কাজ করো তো ! সকল ভক্তদের জানিয়ে দাও, যে , প্রত্যেকে যেন রাত তিনটের আগে উঠে পড়ে মালা জপতে শুরু করে দেয় । কেউ যেন বাদ না যায় । এক জনও যেন ঘুমিয়ে না থাকে। বলে দেবে, এ আমার আদেশ। আর , আলস্য করে কেউ যদি নিজের ইচ্ছে মতন চলে , তবে সে নিজের বিপদের দায়িত্ব নিজে বুঝে নেবে।”
উপেন অনুভব করলেন ,যে, প্রভুপাদ যখন এমন ভাবে আদেশ করলেন , তখন নিশ্চয় কোন ব্যাপার আছে। কিন্তু, কী সেই ব্যাপার হতে পারে এটাই তাঁর মাথায় আসছিল না। এদিকে জিজ্ঞেস যে করবেন সে সাহসও নেই। আর, তা উচিৎও নয়। তাই পরিস্থিতির গাম্ভীর্যতা বুঝে অতি শীঘ্রতায় সকলকে জানাতে থাকলেন প্রভুপাদের নির্দেশের কথা।
সকলে শুনলেন এবং শিরোধার্য করে নিলেন প্রভুপাদের আদেশ। উপেন এও জানিয়ে দিলেন যে অন্য বগীতে তাঁদের কেউ থেকে থাকলে যেন তাঁরা এই বগীতে চলে আসেন সকলে।
যথারীতি সকলেই তিনটের আগে উঠে পড়লেন। মালা হাতে নিয়ে জপ করতে থাকলেন। ওদিকে প্রভুপাদ তো জপ করছেনই। তুফান এক্সপ্রেসের সেই বগীটি কিন্তু দেখতে বেশ অপূর্ব হল। প্রত্যেকে গভীর মনোযোগ সহ জপে মগ্ন। তবে ব্যতিক্রম হলেন তিনজন। প্রভুপাদের পত্নী, শ্রীযতীনবাবু ও গোপীমোহন চক্রবর্তী মহাশয়ের ক্ষেত্রে। প্রভুপাদের পত্নী ছিলেন পাশের বগীতে। আর, যতীনবাবু ও গোপীমোহন নির্ধারিত সময়ে উঠতে পারেননি।
সুগভীর মনোযোগসহ জপ করতে করতে হঠাৎ প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী উচ্চকন্ঠে ‘জয় নিতাই’ বলে হুঙ্কার করে উঠলেন। সকলের প্রাণের ভিতর সেই হুঙ্কার গিয়ে যেন আলোড়ন তুললো। সকলেই স্তব্ধ, স্থির হয়ে গেলেন। কী যেন একটা ঘটে গেল। প্রচন্ড জোরে আওয়াজ হল। আর, তারপরই প্রচন্ড চীৎকার , আর্তনাদ আর হুড়োহুড়ির শব্দ। এদিকে এই বগীতে সকলেই শঙ্কিত চিত্ত। কী যে ঘটলো বুঝতে পারছেন না। তবে সাঙ্ঘাতিক কিছু যে ঘটেছে তা সহজেই অনুমেয় হয়েছে প্রত্যেকের কাছে।
হয়েছে কী, বামরৌলি ষ্টেশনে তুফান এক্সপ্রেসের দাঁড়ানোর কথা ছিল না। সেটি মধ্যরাতে যেমন তীব্র গতিতে ছোটার কথা তেমনই ছুটছিল। কিন্তু, সিগন্যালের ভুলের জন্য পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় এই ট্রেনের । ফলস্বরূপ , প্রচন্ড শব্দ হয় । তবে, পরম আশ্চর্যের কথা হল এই যে , সপরিকর প্রভুপাদ যে বগীতে ছিলেন , সেই বগীটি খুলে গিয়ে পাশের লাইনে চলে যায় । আর, সেই বগীর সামনের ও পিছনের বগী দুটি একটি অপরটির মধ্যে ঢুকে যায়, দেশলাই বাক্সের মতন। এমন আরও অনেক বগীতেই ঘটেছে। কেবলমাত্র একটি বগীই অক্ষত অবস্থায় পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে। আর , ওটি প্রভুপাদ যাতে আছেন সেটি। গোটা ট্রেনে সেদিন এমন কেউ ছিলেন না যিনি অক্ষত ছিলেন। অসংখ্য লোকের মৃত্যু হয়। অথচ, প্রভুপাদের বগীর কারোর দেহে একটি আঁচড়ও লাগেনি। কেবল সেই তিন জন ছাড়া , যাঁরা প্রভুর নির্দেশ পালন করেছিলেন না। শ্রীল প্রভুপাদের ভজনপ্রভাবেই সেদিন তাঁর আশ্রিত জনেরা মহা বিপদমুক্ত হয়েছিলেন, প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। সেদিন প্রভুপাদের সহযাত্রী যেসব ভক্তরা ছিলেন তাঁরা আজীবন মনে রেখেছেন সেই ভয়াবহ রাত্রি ও রেলদুর্ঘটনার কথা। শিহরিত হয়েছেন প্রভুপাদের অলৌকিক ভজন ক্ষমতার গুণের কথা ভেবে। আর, মনে মনে বিনম্র শ্রদ্ধায় অবনতমস্তক হয়েছেন প্রভুপাদের প্রতি।
(ক্রমশঃ)
ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।