আশ্চর্য অলৌকিক লীলায় প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী..(৮ম পর্ব-শ্রীশ্রীগুরুনির্য্যাণ মহোৎসব ) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
645

(পূর্ব প্রকাশের পর)
……..প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর এক অনবদ্য কর্মযজ্ঞ হল নবদ্বীপে প্রতি বৎসর আয়োজিত শ্রীগুরুনির্য্যান মহোৎসব। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে , উৎসব এমন এক মাধ্যম যা দ্বারা বিভেদক্লীষ্ট মানুষদের এক করে দেওয়া যায়। মানবমনের হাটে কৃষ্ণকথা আর হরিনামের বিকিকিনি ঘটিয়ে মানুষে-মানুষে পরস্পরকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে দেওয়া সম্ভব। ত্রিতাপ জ্বালায় জর্জরিত আমাদের চিত্তকে খানিক চন্দনসম শীতলতা প্রদানে উৎসবের আনন্দের ভূমিকা অনেক। আবার উৎসবের দ্বারাই ভক্তমনে ভক্তির তরঙ্গ উচ্ছ্বলিত করে দেওয়া যায় । ভক্ত সেই তরঙ্গের দ্বারা ভক্তিরসে অভিস্নাত থাকে বছর ভরে। সারা বৎসর সেই অনুষ্ঠানের আনন্দাবেশে থেকে নতুন উন্মাদনায় , নবভাবে পরবর্তী বছরের উৎসবের আনন্দে মাতে। অর্থাৎ, মহোৎসব হল এক মহা পদ্ধতি মানুষকে ভক্তিপথে চালিত করার। আর, তাইতো, প্রভুপাদ তাঁর পত্নীর অপ্রকটের পর বৃন্দাবনে যে বিরহ উৎসবের আয়োজন করলেন , সে উৎসবে ভোরবেলা থেকে রাত পর্যন্ত এমন অনুষ্ঠান সূচী নির্ধারণ করলেন , যার প্রতিটি অনুষ্ঠান হল ভজনকেন্দ্রিক। ক্রমান্বয়ে যেমন, নিশান্তে নিশান্তলীলা কীর্তন, আরতি দর্শন ,মন্দির পরিক্রমা , তারপর শ্রীমদ্ভাগবত প্রবচন শ্রবণ, গোস্বামী গ্রন্থের পারায়ণ, মধ্যাহ্নে ভোগরাগ, প্রসাদ সেবন, নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের প্রার্থনা, গৌরলীলা, শ্রীকৃষ্ণলীলা কথা শ্রবণ ইত্যাদি নানা ভজন কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান সম্ভার। বৃন্দাবনের বৈষ্ণবমন্ডলীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে যে মনোমালিন্য বর্তমান ছিল সেসময় পরস্পরের মধ্যে —-প্রভুপাদের সুচারু আয়োজনে সেই সকল বিভেদের অবসান ঘটিয়ে ভক্ত-মহামিলনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সেই বিরহোৎসব। সকল ভক্তরা যেন পরানন্দপাথারে ভেসেছিল ।

প্রভুপাদের পত্নীর বিরহ মহোৎসবের এই সুমহান প্রতিক্রিয়া অনুপ্রেরণা তৈরী করেছিল প্রভুপাদের মনে অমন অনুষ্ঠান আরও শ্রীবৃদ্ধি সহ , আর অধিক দিন ধরে নবদ্বীপে করার। আর তাই, যখন শ্রীমতী সারদা মাতা গোস্বামিনী অর্থাৎ প্রভুপাদের শ্রীগুরুদেবী তথা মাতা গোস্বামিনী নিত্যলীলায় প্রবেশ করলেন তখন প্রবল বিরহভারে আচ্ছন্ন প্রভুপাদ আয়োজন করলেন শ্রীশ্রীগুরুনির্য্যাণ মহোৎসবের।

১৫৫৩ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর আয়োজিত ঐতিহাসিক খেতরীর মহোৎসবের পর সম্ভবতঃ সেই ধারায় এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মহোৎসব। বিগত ৯০ বৎসর ধরে এই উৎসব একই রকম প্রেমভক্তি, প্রাচুর্য ও নিষ্ঠাপ্রচেষ্টাসহ আয়োজিত হয়ে আসছে শ্রীধাম নবদ্বীপের ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডে শ্রীশ্রীমদনমোহন মন্দিরে । আগামী ২রা ডিসেম্বর,২০২০তে ৯১তম এই মহোৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শুভ অধিবাসের মধ্য দিয়ে। এগারো দিন ধরে শ্রীপাট ও কীর্তনাদির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান চালিত হবার পর , ১২ই ডিসেম্বর তার পরিসমাপ্তি হবে।
শ্রীশ্রীমদনমোহন মন্দিরের বর্তমান প্রভুপাদদ্বয় শ্রীনিত্যগোপাল গোস্বামী ও শ্রীপ্রেমগোপাল গোস্বামী এই শ্রীগুরুনির্য্যাণ মহোৎসবের আয়োজক। শ্রীমতী সারদা মাতা গোস্বামিনীর ৯১তম, তাঁর পুত্র শ্রীল প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর ৭৯তম, তাঁর পুত্র শ্রীল যদুগোপাল গোস্বামীর ৬১তম এবং তাঁর পুত্র শ্রীমদনগোপাল গোস্বামীর ১২তম নির্য্যান উৎসব পালিত হবে এই বৎসর।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য , এই উৎসব কেবলমাত্র একটি আধ্যাত্মিক উৎসব নয় । এই উৎসবে বিগত ৯০বৎসর ধরে দরিদ্রনারায়ণ সেবার বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। শ্রীমন্ মহাপ্রভু বলেছিলেন,
ভারতভূমিতে জন্ম হল যার।
জন্ম সার্থক কর, করি পরোপকার।।—–এই উক্তির বাস্তবায়ন রূপ হল এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যশালী শ্রীগুরুনির্য্যাণ মহোৎসব ।

এই বৎসরের উৎসবে যেসব মহতী পদক্ষেপ গুলি নেওয়া হতে চলেছে সেগুলি হল—-
১) ২০০জন ছাত্রকে বস্ত্র ও শীতবস্ত্র প্রদান,
২)২০০ জন ছাত্রীকে বস্ত্র ও শীতবস্ত্র প্রদান,
৩)২০০জন মুসলিমকে বস্ত্র ও লুঙ্গি প্রদান,
৪)২০০ জন মহিলাকে বস্ত্র ও শীতবস্ত্র প্রদান,
৫)২০০জন পুরুষকে প্যান্ট-শার্ট ও শীতবস্ত্র প্রদান,
৬)একদিন নবদ্বীপ হসপিটালে রোগীদের
ফলবিতরণ,
৭) ৩ লক্ষ টাকার ঔষধ প্রদান ,
৮) অন্ধ স্কুলে সব ছাত্র-ছাত্রীদের শীতবস্ত্র প্রদান ও তাদের এক মাসের আহারের অর্থানুকুল্য প্রদান,
ইত্যাদি আরও নানান জনহিতকর ব্যবস্থা।

অতএব, শ্রীল প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর সূচীত সেই মহান কর্মযজ্ঞ যে কতখানি সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে আজও মধু মন্দাকিনীর অবিরত ধারায় বহমান তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীদের দ্বারা , তা সহজেই অনুমেয়।

(ক্রমশঃ)
ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।