(পূর্ব প্রকাশের পর)
……..খুব ভয়ে ভয়ে মনে সাহস এনে কোনমতে গোবিন্দ সাহা জিজ্ঞাসা করলেন, “মন্দিরের মধ্যে আপনি কে রয়েছেন ? কী কাজ এখানে আপনার?গর্ভগৃহে আপনি কি করছেন?” অমনি উত্তর এল খানিক সানুনাসিক কন্ঠে,”আমি তোমারই পূর্বপুরুষ একজন। বিগ্রহ সেবার লোভ ত্যাগ করতে না পেরে ঘোরাঘুরি করে মরি এখানে, এই মন্দিরের চারপাশে। এখন তো আর আগের মতন করে সেবা হয় না, তাই।” একথা শুনে গোবিন্দ সাহা বললেন,”কিন্তু, এখনও তো নিয়মনিষ্ঠা মেনেই পুজো দেওয়া হচ্ছে রোজ।” প্রেতাত্মা বললেন, “হবে কী করে! তুমি তো এখনও অবধি দীক্ষাই নেওনি। শোন , একটা ভালো কথা বলি। ফতেয়াবাদে প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী এসেছেন ভাগবত পারায়ণ করতে। তুমি বরং সেখানে তাঁর কাছে যাও। তাঁর থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে এসে সেবা দাও নিত্য । আর , হ্যাঁ ,আসার সময় আমার জন্য অবশ্যই তাঁর অধরামৃত-প্রসাদ নিয়ে আসবে । এই দুটি কাজ করো, আমি তাহলে আর আসবো না এখানে। তাঁর উচ্ছিষ্ট প্রসাদ গ্রহণের গুণে আমি উদ্ধার হয়ে যাব। আর, ওঁনার থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে সেবা দিলে তোমার সেবা গ্রহণ করবেনই করবেন বিগ্রহরা।”
প্রেতাত্মা-পূর্বপুরুষের কথা মতন কাজ করলেন গোবিন্দ সাহা। তিনি সন্ধান করে জানতে পারলেন প্রভুপাদ কোথায় আছেন। সব ঘটনা বলে দীক্ষা নিলেন তাঁর থেকে। আর , ফেরার সময় প্রাণগোপাল প্রভুপাদের উচ্ছিষ্টান্ন প্রসাদ আনলেন। মন্দিরের পাশের এক নির্জন স্থানে সেই প্রসাদ অর্পণ করলেন পূর্বজ প্রেতাত্মার উদ্দেশ্যে । তারপর থেকে আর কোনদিনই মন্দিরের ধারে-কাছে সেই প্রেতাত্মাকে চলাফেরা করতে দেখেননি কেউ। সেই প্রসাদ ভক্ষণ করে উদ্ধার হয়ে গিয়েছিলেন প্রেতাত্মা। এমনই ভজন প্রভাব ছিল প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর।
এতো গেল প্রেতাত্মার উদ্ধার হবার কাহিনী। ঠিক এমন করেই তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের মনেরও আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারতেন। আর , আশ্চর্যের কথা , রীতিমতো সমাজের উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক বড় সংখ্যায়।
১৩৩২ বা ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ঘটনা। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের
সুবিখ্যাত সম্পাদক ডঃ শ্রীরাধাগোবিন্দ নাথের উদ্যোগে তখন বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মিলনী। সেখানে গণ্যমান্য পন্ডিত ব্যক্তিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ তর্কভূষণ মহোদয় । তিনি প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামীকে বলেছিলেন ,” বলতে পারেন কী, আপনাদের বৈষ্ণবধর্মে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বা তথ্য নিহিত আছে যা ধর্মজগতে শীর্ষস্থান অধিকার করতে পারে? আমি তো তেমন কিছু সম্পদ দেখতে পাই না।” এহেন তর্কভূষণ মহোদয় উক্ত অনুষ্ঠানে যখন প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর বচনামৃত শ্রবণ করলেন , তখন তাঁর মনে এমন ভাবান্তর ঘটলো যে তিনি অশ্রুসজল নয়নে এসে বলেছিলেন, “প্রাণগোপালের ভাষণে আমার হৃদয়ের আকাশে এক নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে আজ। আমি আজ বুঝলাম, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম কত উন্নত , কতখানি উজ্জ্বল।” এরপরই তিনি তুলসীমালা ধারণ করে সদাচারী ভজনশীল ভক্ত হয়ে যান ।
আবার ,চট্টগ্রামের বিশকাঠালির একটি ঘটনাও এমনই আশ্চর্যকর ছিল। শ্রীযুক্ত গঙ্গাপ্রসন্ন কবিরাজ মহাশয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রভুপাদের ভাগবত কথার । তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন সমাজের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি। প্রভুপাদের একদম সম্মুখেই প্রথম সারিতে আসন গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। কারা তাঁরা , তা পরে জানাচ্ছি । তাঁরা দু’জনই পাশ্চাত্য শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। প্রভুপাদ বক্তব্য রাখছেন , আর তাঁরা নিজেদের মধ্যে অন্য আলোচনা করছেন নিম্ন কন্ঠে। প্রভুপাদের সেই বক্তব্য নিয়ে ব্যঙ্গোক্তিও করছেন এবং অস্ফুটে হাসাহাসি করছেন । প্রভুপাদ সবটাই অনুধাবন করলেন ও বললেন,”গীতাশাস্ত্রের যেখানে শেষ, যেটি শেষ কথা , সেটিই শ্রীমদ্ ভাগবতের শুরু ও প্রথম কথা। ” তিনি তো সুবক্তা , কীভাবে শ্রোতাকে আকর্ষণ করে নিজের বক্তব্যের মধ্যে টেনে ধরে রাখতে হয় , বা , কোন ধরণের কথা শোনার পাঠক তাঁর সম্মুখে উপস্থিত—সেসব অতি শীঘ্রই বুঝে যান উচ্চ ধী-শক্তির অধিকারী তিনি । তাই , এবার তাঁর বক্তব্যের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এভাবে। ব্যাখ্যা শুরু করে দিলেন তুলনামূলক যুক্তি দেখিয়ে গীতা আর ভাগবতের বিষয়বস্তুর শেষ-শুরুর প্রেক্ষাপটের । আর , সেই আলোচনা এমন রসপূর্ণ ও যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে করতে থাকলেন যে উপস্থিত অন্যান্য শ্রোতাসহ সেই দুই উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মনস্ক ব্যক্তিও গভীর মনোনিবেশ করে ফেলে শ্রবণ করতে থাকলেন প্রভুপাদের কথার। তবে প্রভুপাদ যে কেবল তাঁর কথার আকর্ষণী ক্ষমতায় তাঁদের বাঁধলেন , তা নয় । তিনি মনে মনে তাঁদেরকে কৃপাকর্ষণ করে ভক্তিপথে আনছিলেন। ফলতঃ , যা হবার তাই হল । পাঠের শেষে তাঁরা দু’জন প্রভুপাদের শ্রীচরণে লুটিয়ে পরে প্রণাম নিবেদন করলেন। পাঠ পরবর্তী কীর্তনে ‘কৃষ্ণ ,কৃষ্ণ’ বলে ক্রন্দন করে বক্ষ ভাসাতে থাকলেন । অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটে গেল দুই পাষাণ হৃদয়ধারী ব্যক্তির। এমন অবস্থা হল ক্রমে যে , ধূলায় গড়াগড়ি যেতে থাকলেন তাঁরা। তখন প্রভুপাদ তাঁর শ্রীচরণে শরণাগত সেই দুই মহামান্য ব্যক্তিকে ভক্তিপথে শ্রীশ্রীনিতাই-গৌরাঙ্গ ভজনের উপদেশ করলেন। তাঁরা তা-ই করলেন পরবর্তীতে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর অপরজন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের বিচারক মন্ডলীর একজন।
প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী এমন করে কত বিশিষ্টজনেদের যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে তাঁদের ভক্তিপথে এনেছিলেন তার ইয়াত্তা নেই। তাঁরা কন্ঠী-তিলক পরেছেন, জপমালা গ্রহণ করেছেন, প্রসাদভোজী হয়েছেন ,যুগলসেবায় ব্রতী হয়েছেন। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পন্ডিত প্রবর নবদ্বীপচন্দ্র ভট্টাচার্য বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভ্রাতা ব্যারিস্টার পি. আর. দাসের কথাই ধরা যাক যেমন। নবদ্বীপচন্দ্র ভট্টাচার্য তো প্রথম জীবনে ঘোর বৈষ্ণববিরোধী ছিলেন । প্রভুপাদের পান্ডিত্যের কথা লোকমুখে শ্রবণ করে তিনি নিজের পান্ডিত্যের গর্ব নিয়ে গিয়েছিলেন পরীক্ষা করতে তাঁকে। কিন্তু, শেষমেশ নিজেই সব অহঙ্কার ত্যাগ করে প্রভুপাদের শরণ গ্রহণ করেন শ্রীচরণে পতিত হয়ে তাঁর । প্রখ্যাত পরম বৈষ্ণব হন তিনি। তাঁকে অনুসরণ করেন বাংলাদেশের সেসময়ের স্মার্ত সম্প্রদায় । প্রভুপাদ তাঁকে শ্রীগিরিধারীলালের সেবাসমর্পণ করেন। সেই গিরিধারীলালের সেবা বর্তমানে সম্পন্ন হচ্ছে ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া শহরে।
আবার পি. আর. দাশ ছিলেন প্রবল পাশ্চাত্য আদব কায়দায় চলনশীল ব্যক্তি। বাবুর্চিদের তৈরী আমিষাহার ভিন্ন তিনি ভাবতেই পারতেন না অন্য কিছু। কিন্তু, এমন মানুষও এসব অভ্যাস জলাঞ্জলী দিয়ে কন্ঠী-তিলকধারী নিরামিষাশী ভজনশীল মহাত্মা হয়ে ওঠেন।
একবার প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী গেলেন পাটনায় । পাটনা হাইকোর্টেরই ব্যারিস্টার ছিলেন পি. আর. দাস। তাঁরই উদ্যোগে প্রভুপাদের পদার্পণ পাটনায় ভাগবত কথা পরিবেশনের জন্য । প্রভুপাদ ট্রেন থেকে নামতেই দেখলেন প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ভিড় । প্রবল জনসমাগম হয়েছে সেখানে। অনেকের হাতেই মালা , ফুল । তিনি বেশ একটু হকচকিয়েই গেলেন এত লোক দেখে! তিনি পি.আর.দাসকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ , গো , কী হয়েছে ,এত লোকসমাগম কেন(!) ? কোন বিখ্যাত জনের কী আসার কথা (!)? আমি অন্যদিন এলেই বোধহয় ভালো হতো।” …………
( ক্রমশঃ)
ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।