(পূর্ব প্রকাশের পর)
……..প্রভুপাদের এহেন বচন শ্রবণ করে পি.আর.দাস বললেন,”এ জনসমাবেশ তো আপনাকে উদ্দেশ্য করেই প্রভু ! আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে সকলে সানন্দে হাজির হয়েছেন এখানে।” প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী আশ্চর্য হয়ে বললেন, “বলো, কি হে! এরা সব আমার কথা জানলো কি করে! আমার নাম শুনেছে নাকি!” পি.আর দাস. বললেন,”প্রভু, আপনার নাম তো সারা ভারতের লোকই জানেন। আর কিছুদিন পর সমগ্র বিশ্ব জানবে।” একথা শুনে প্রভুপাদ বেশ অবাকই হলেন অন্তরে অন্তরে। কোথায় যেন একটা দ্বিধা খেলে গেল তাঁর। বস্তুত ,সেদিন কিন্তু প্লাটফর্মে প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীকে অভ্যর্থনা জানাতে পাটনা শহরের অসংখ্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা হাজির ছিলেন। ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি সমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, জেলা কমিশনার ভুবনমোহন চট্টোপাধ্যায়, পি.আর.দাসের জুনিয়র অ্যাডভোকেট শ্রীনবদ্বীপ ঘোষ ও আরো অনেক বিশিষ্ট জনও ।
পি.আর.দাস.মহাশয় একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির বাগানবাড়িতে সপার্ষদ প্রভুপাদের বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন । সেখান থেকে প্রতিদিন একটি বিশেষ মন্দিরে প্রভুপাদকে নিয়ে যাওয়া হত পাঠের জন্য । একদিন সবান্ধব এসে বেশ বিনয়ের সঙ্গে দাস মহাশয় বললেন, “প্রভু, শুনেছি যে ভাগবতের বস্ত্রহরণ লীলার প্রসঙ্গ সকলের সামনে নাকি আলোচনার উপযুক্ত নয়। একটু অশ্লীল ব্যাপার-স্যাপার ওতে আছে!” প্রভুপাদ মৃদু হাসলেন, মুখে কিছু বললেন না । সেদিন সন্ধ্যাতেই প্রবচনের সময় শ্রীকৃষ্ণের বস্ত্রহরণ লীলার আলোচনা শুরু করে দিলেন প্রভুপাদ। তাঁর অপূর্ব লীলাবর্ণন, অসাধারণ শাস্ত্রব্যাখ্যা , অকাট্য যুক্তির অবতরণ শ্রবণ করে সকলে এমন বিমোহিত ও বিস্মিত হলেন যে প্রত্যেকের মনে এই সত্যবোধ জাগ্রত হল যে, বস্ত্ররহরণ লীলার মত এমন শ্রেষ্ঠ শিক্ষণীয় আধ্যাত্বিক ঘটনা আর হতেই পারে না।
সেসময় প্রভুপাদের কথা শ্রবণের এক দুর্নিবার আকর্ষণে সকলে নিয়ম করে প্রতিদিন হাজির হয়ে যেতেন নির্ধারিত সময়ের আগে থাকতেই । একটা ছোট উদাহরণ দিলে পাঠক মহোদয়গণ, আপনারা বুঝতে পারবেন এই আকর্ষণের তীব্রতা কেমন ছিল। জেলা কমিশনার ভুবনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কর্মক্ষেত্র ধানবাদে ছিল । যে মানুষ কর্মব্যস্ততা ও কর্তব্যের খাতিরে একদিনও ছুটি নিতেন না সেই তিনিই কিনা সব ভুলে কোনমতে এক মাসের জন্য ছুটির ব্যবস্থা করে নিলেন । নিজের মাতৃদেবীকে নিয়ে পাটনায় চলে এলেন । কিসের জন্য, না, প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর পাঠ শুনবেন বলে । আর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কনিষ্ঠ ভ্রাতা এই পি. আর. দাসের ব্যাপারে তো কথা বলার অপেক্ষাই থাকে না । শুনুন তবে!
পাঠ শ্রবণ করার কয়েকদিনের মধ্যেই পি.আর. দাসের মনে এমন ভাবান্তর হল,যে ,সেই সাহেবি কায়দার কেতাদুরস্ত ব্যারিস্টার একদিন সকাল বেলায় উসকো খুসকো চুলে আনমনা ভাব নিয়ে অতি সাধারণ কাপড় জামা গায়ে খালি পায়ে এসে হাজির হলেন সেই বাগানবাড়িতে যেখানে প্রভুপাদ বাস করছিলেন । প্রভুপাদ তখন ভজনে ছিলেন । তাই বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রভুপাদের দর্শন পেলেন তিনি। পি.আর.দাসকে দেখে একটু অবাকই হলেন প্রভুপাদ । তিনি অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন ,”কি ব্যাপার গো, কি মনে করে এত সকালে এভাবে এসেছ হন্তদন্ত হয়ে ?”
পি.আর. দাস সরাসরি প্রসঙ্গে আসলেন, বললেন,”প্রভু, আমি দীক্ষা গ্রহণ করতে চাই আপনার থেকে।”
প্রভুপাদ—“তা ,এত তাড়াহুড়োর কি হল! দীক্ষা ওভাবে নিতে নেই। বুঝেশুনে গুরুকরণ করতে হয়।”
পি. আ.র দাস—“না প্রভু, আমার দেখা-বোঝা-শোনা সব হয়ে গেছে। আমি আপনার থেকেই দীক্ষা নেব। কবে নেব আর দীক্ষা নিতে কি কি করতে হবে বলে দিন। ”
প্রভুপাদ অনুধাবন করে ফেললেন যে, এই ব্যক্তি মনঃস্থির করে ফেলেছেন দীক্ষার বিষয়ে । এঁকে ফিরিয়ে দিয়ে নতুন কিছু হবার নেই। এঁর মত পরিবর্তন হবে না। তাই তিনি বললেন, “বেশ, আগামীকাল সকালেই চলে এসো তবে। কিন্তু হ্যাঁ, তোমার সাহেবি পোশাকে নয়, ধুতি পরে আসতে হবে।”
” আচ্ছা, প্রণামীতে আমি কি দেব দীক্ষার পরে আপনাকে? “—দাসবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
প্রভুপাদ উত্তর দিলেন,” কী আবার! একটা হরিতকী দিও।”
পরদিন সকালে যথারীতি এসে হাজির হলেন দাসবাবু। তিনি বেশ ঝকমকে বহু মূল্যবান ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রয়েছেন। প্রভুপাদ বললেন, “তুমি এই পোশাক কোথায় পেলে? অত্যন্ত সরলতার সাথে দাসবাবু হেসে বললেন,”প্রভু, এটা আমার বিয়ের জোর। ” মুখে কিছু বললেন না প্রভুপাদ, মনে মনে হাসলেন শুধু। পি.আর.দাস দীক্ষা শেষে প্রণামী স্বরূপ একটি হরিতকী তুলে দিলেন প্রভুপাদের হাতে।প্রভুপাদও পরম যত্নে পাওয়া ধনের মতই হরিতকীটি গ্রহণ করে নিজের জপের মালার থলিতে ভরে রাখলেন সেটি প্রসন্ন মনে।
প্রভুপাদ বললেন, “দেখো বাবা, তোমায় কিন্তু আজ থেকেই নিরামিষ আহার গ্রহণ করতে হবে আর সৎসঙ্গ করতে হবে, সদাচারী হতে হবে । কারণ, তোমায় যে শ্রীযুগলবিগ্রহ সেবা করতে হবে। কেন জানো?”
পি.আর.দাস—“কেন?”
প্রভুপাদ–“কারণ, তুমি তো আজ থেকে রাধাদাস্য পদ প্রাপ্ত হলে, তাই তোমায় নিজেকে শ্রীরাধার দাসী জ্ঞান করে বিগ্রহ সেবা করতে হবে। আবার জিজ্ঞাসা কর , কেন?”
পি.আর.দাস—“কেন?”
প্রভুপাদ—“কারণ, শ্রীবিগ্রহই হলেন সাক্ষাৎ শ্রীভগবৎস্বরূপ। দুইয়ে কোন পার্থক্য নেই। শ্রীবিগ্রহসেবা করার অর্থ হল তাই শ্রীভগবানের সেবা করা। তুমি যে আজ হতে সেবিকা হয়েছো । তাই সেবা করতে হবে তো! তাই না?”
পি.আর.দাস অতি উৎফুল্লতার সঙ্গে মাথা নেড়ে বাধ্য সন্তানের মত অঙ্গীকার করে নিলেন তাঁর শ্রীগুরুদেবের বাণীকে।
পাটনা থেকে কলকাতায় ফিরে আসার আগে পি. আর. দাসের ভবনে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ যুগলবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে দিলেন প্রভুপাদ। যে ব্যারিস্টার মহাশয় আমিষ মোগলাই খাবার ছাড়া আহার করতে পারতেন না, বাবুর্চির হাতে তৈরি রান্না ছাড়া অন্য কিছু তাঁর রুচতো না ,তিনি হলেন কিনা কেবল প্রসাদভোজী; ভাবা যায়!
পি. আর. দাসের ঘটনাটি তো কেবল একটি মাত্র উদাহরণ দিলাম। এমন কতসহস্রজনা যে পূর্ব ভারতে ও বাংলাদেশ সেসময় সদাচারী হয়েছেন প্রভুপাদের সান্নিধ্যে এসে, তা বলার নয় । বৃন্দাবনের সিদ্ধবাবাজী পন্ডিত ১০৮ শ্রীরামকৃষ্ণ দাস প্রভুপাদ সম্পর্কে এ বিষয়ে যা বলেগেছেন , তা তো এক মানপত্র স্বরপ। তিনি বলেছেন—“যে প্রভু পূর্ববঙ্গের লোককে মাছ ছাড়িয়ে অনুরাগে গৌরগোবিন্দ ভজন করাতে পারেন, তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ গোঁসাই তাতে কোন প্রকার সন্দেহের কারণ নেই।”
এবার আরও একটি আকর্ষণীয় প্রসঙ্গে আসি। এখন প্রভুপাদ কলকাতায়। একদিন তিনি যখন রাত তিনটের সময় উঠে ব্রাহ্ম-মুহূর্তে ভজন করছেন ,তখন হঠাৎ তাঁর সামনে সেই বদ্ধ ঘরে প্রকট হলেন বিশাল শকুনের ওপর উপবিষ্ট শ্রীশনি দেবতা। প্রথমটায় প্রভুপাদ শনিদেবকে বুঝে উঠতে পারেননি । অমন , ধুম্র বর্ণ , আশ্চর্যরূপী শনিদেবকে চিনতে পারেননি। এদিকে শনিদেব ও তাঁর বাহন শকুন একদৃষ্টে চেয়ে তাঁর দিকে। সম্বিৎ ফিরতেই প্রভুপাদ ভাবলেন, একি, শনিদেবের উপাসনা তো তিনি করেন না ! তিনি তো শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন ও শ্রীশ্রীনিতাই-গৌরের উপাসনা করেন। তাহলে শনিদেব কেন এভাবে এখন এই সময়ে প্রকট হলেন ! শনিদেবকে দেখে তাই প্রভুপাদ বিস্মিত হয়ে গেলেন যারপরনাই । অজানা এক ভাবের তরঙ্গও যেন খেলা করে গেল সে সময় তাঁর মধ্যে।
………..( ক্রমশঃ)
ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।