আশ্চর্য অলৌকিক লীলায় প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
528

পর্ব-১
এক সন্ধ্যায় অমৃতের বর্ষা হয়ে চলেছে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ফরিদপুরের পাঁচুরিয়া গ্রামে। সেখানে এক ভক্তিমতী রমণী শ্রীকৃষ্ণসম্বন্ধীয় একটি প্রাচীন পদ গাইছেন। আর, তাঁর সেই সঙ্গীতের সুর ও ভাব থেকে প্রেমামৃতের বর্ষণ হয়ে চলেছে। চতুর্দিককে প্লাবিত করে সেই প্রেমামৃত সকলের হৃদয়কে প্রেমে সিক্ত করে দিতে থাকলো। সঙ্গীতের সুর যেন এক দিব্য অনুরণন তুলতে থাকলো সেখানে । রমণীর হৃদয়ের ভাব সকলের হৃদয়ে অনুপ্রবেশ করতে থাকলো। উপস্থিত সকলে ভক্তিরসে অভিসিঞ্চিত হল । তিনি এমন করে শ্রীকৃষ্ণের রূপের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সেই পদের দ্বারা, মনে হচ্ছিল বুঝিবা রসময় , রসকূপ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সম্মুখেই সেখানে উদীয়মান রয়েছেন ,আর, ওই ভক্তিমতী রমণী তাঁকে দর্শন করছেন ও রূপবর্ণন করছেন তাঁর। এতটাই প্রাণবন্ত ও জাগ্রত ছিল সেই রূপের বর্ণন যে, সেই অপ্রাকৃত রূপের তরঙ্গ যেন শ্রোতাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল প্রাকৃত লোক থেকে এক অপ্রাকৃত লোকে।

এক ব্রজগোপী যমুনার তীরে কদম্ববৃক্ষ তলে বংশীবাদনরত ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করে এসে , অন্য এক ব্রজবালাকে শ্রীকৃষ্ণের মধুর মুরতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, “হে সখী, কী আর বলবো , শ্যামসুন্দরের রূপের কথা ! তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল , তিনি যেন প্রীতিরসের সার দিয়ে গঠিত নরম , শীতল তনু এক। ত্রিভুবনে সে রূপের কোন তুলনা হয় না। রূপবান, রসিকমোহন কানু কত রসময়! আহা! মনে হয় জগতের জীবকে রূপের মায়ায় মোহিত করবার জন্যই রূপের ফাঁদ পেতেছেন তিনি। নবজলধরের ন্যায় তনু থেকে তাঁর প্রেমরসের প্রসবণ বয়ে চলেছে। তাঁর প্রতিটি অঙ্গ অত্যন্ত লাবণ্যমন্ডিত। সেই মহালাবণ্যময় অঙ্গপ্রতঙ্গকে আরও মোহময় করতে তিনি স্বর্ণালঙ্কার ধারণ করেছেন। অথচ, জানো সখী, তাঁর এমনই রূপের মহিমা যে, সেই অলংকার সমূহ নিজেরাই তাঁর শ্রীঅঙ্গে স্থান পেয়ে লাবণ্যমন্ডিত হয়ে,শোভা পেয়েছে।”

ব্রজগোপিনী প্রগলভা হয়ে আরও বলে চলেছেন, “শ্রীকৃষ্ণের কন্ঠে মণি-মুক্তার হার। অপরূপ সাজে সজ্জিত শ্রীদেহ। তাঁর ভ্রূ-দুটি যেন কামদেবের কামান । তিনি তাঁর চঞ্চল নয়ন দ্বারা যখন কারোর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, তখন তাঁর সেই দৃষ্টি কামদেবের পঞ্চশরের ন্যায় বিদ্ধ‌ করে বিপরীতের মানুষটিকে। আর , যখন তিনি অধরের খুব কাছে মুরলীটিকে ধরে রেখে হেসে হেসে কারোর সাথে কথা বলেন, তখন তাঁর সেই মাধুর্য দেখে কী কারোর হৃদয় ঠিক থাকতে পারে, সখী! প্রাণ যে তখনই চুরি করে ফেলেন তিনি। কারোর সাধ্যি নেই সেই চঞ্চল চিত্চোরের থেকে নিজেকে বাঁচাবার!”—–এই ছিল সেই গায়িকা রমণীর সঙ্গীতের পদের বিষয়বস্তু।

ভক্তিমতী সেই রমণীর ভাব বিভোর সঙ্গীতটিতে বর্ণনা করা শ্রীকৃষ্ণের রূপ যেন শ্রবণকারীর প্রাণ আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছে ইহলোক থেকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে গোলকে। সঙ্গীতে রূপের বর্ণন শ্রবণেই যদি এ অবস্থা হয় , তবে যিনি সেই দিব্য রূপের অধিকারী শ্রীকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষভাবে একবার দর্শন করে নেবেন, তাঁর কী দশা হতে পারে! তিনি কি নিজেকে সামলাতে পারবেন কখনো ! পারবেন না। এই জন্যই তো করুণাময় শ্রীকৃষ্ণ কখনো সরাসরি এসে দর্শন দেন না । তিনি লুকিয়ে দর্শন দেন, আড়াল থেকে এসে ঝলক দেখিয়ে যান, স্বপ্নে বা ধ্যানে এসে দাঁড়ান। কারণ, তিনি জানেন যে , তাঁর রূপ দর্শন করে দর্শনকারী সে রূপের ভার সামলাতে পারবে না, শরীর ত্যাগ করবে তৎক্ষণাৎ । প্রত্যক্ষভাবে তাঁকে দর্শন করেও স্থির থাকবেন এমন ক্ষমতা কারোর নেই বললেই চলে ।
যখন রমণী এই গীত গাইছিলেন , তখন সে সময় সকলের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দশ ,এগারো বৎসরের একটি বালক । তিনি এমন বিভোর হয়ে ,বিস্ফারিত নেত্রে, বিবশ মনে, ক্রমশঃ বিকল হওয়া দেহে এই সঙ্গীত শ্রবণ করছিলেন, যে, শ্রবণ করতে করতে নওল কিশোর শ্রীশ্যামসুন্দরের হালকা এক ঝলক তাঁর দৃষ্টিপথে এল, আর অমনি, রূপ দর্শনের ভার সহ্য করতে না পেরে সেই বালক সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। অকস্মাৎ দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজনকে মূর্চ্ছা পেতে দেখে উপস্থিত সকলে তাঁকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন । কেউ ভাবলেন নিশ্চয় ভাবে বিভোলা হওয়ায় এভাবে জ্ঞান হারিয়েছেন, কেউ বা ভাবলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে শুনতে এমনটা হয়েছে, কেউ বা আবার তাঁকে কোন রোগগ্রস্ত ভেবে বসলেন। কিন্তু ,বাস্তবটি হল এই যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সেদিন নিজের এক ঝলক দর্শন দিয়েছিলেন। অনেকের অনেক ডাকাডাকিতেও যখন জ্ঞান ফিরলো না বালকের , তখন কীর্তনকারিনী সেই মহিলা নিজে এগিয়ে এসে বালকের মাথার কাছে বসে ওই সংগীতের পদটি বারংবার গাইতে থাকলেন। অনেকক্ষণ পর বালকের জ্ঞান ফিরলে তাঁকে স্নেহপূর্ণ কন্ঠে রমণী জিজ্ঞাসা করলেন “হ্যাঁ গো , বাছা! কি হয়েছিল তোমার ? কেন তুমি এমন করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে?” তখন বালক বললেন, “আপনি যে রূপের শ্রীকৃষ্ণের কথা বলছিলেন ,ঠিক তেমন রূপেই আমি দর্শন করলাম তাঁকে। এই তো এখানে…..।” একথা বলতে বলতেই সেই বালক আবার ক্রন্দন করতে থাকলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ক্রন্দন করছেন আর একটু একটু করে বলছেন। ভগবদেচ্ছায় ঠিক সেই সময় , সেই বয়স থেকেই বালকের মানসপটে শ্রীকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ রূপরাশি সদাসর্বদার জন্য অঙ্কিত হয়ে গেল।
এই যে অদ্ভুত কৃপাপ্রাপ্ত বালক , যিনি মাত্র দশ-এগারো বৎসরেই কৃষ্ণদর্শন লাভ করেছিলেন, তিনি হলেন প্রভু শ্রীনিত্যানন্দের একাদশতম বংশাবতংস ‘শ্রীল প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী’। তিনিই হলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সুবিখ্যাত শ্রেষ্ঠ ভাগবত ব্যাখ্যাতা । আবার , তিনিই হলেন, গৌরলীলাপালা কীর্তনের স্রষ্টা। অর্থাৎ , শ্রীগৌরাঙ্গের বিভিন্ন লীলাভিত্তিক কীর্তনের সূচনা প্রভুপাদের উদ্যোগেই প্রথম সাধিত হয়। এপ্রসঙ্গে ,পরে বিস্তারিত ভাবে জানবো আমরা।
তাঁর জ্ঞান ও ভগবৎ কথামৃতের অপূর্ব সুন্দর ব্যাখ্যা শ্রবণ করে ভারতবর্ষের পন্ডিত সমাজ তাঁকে ‘সিদ্ধান্তরত্ন’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘ভারত বিখ্যাত ভক্তিশাস্ত্র ব্যাখ্যাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তিনিই প্রখ্যাত ব্যরিস্টার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের জীবনে শ্রীহরিনামের উপদেষ্টা ও যুগল সেবার অনুপ্রেরক। দেশবন্ধুর ভ্রাতা পাটনা‌ হাইকোর্টের ব্যরিস্টার শ্রী পি. আর. দাশের মন্ত্রগুরু ছিলেন তিনি। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টৌপাধ্যায় তাঁর পাঠের গুণমুগ্ধ একনিষ্ঠ শ্রোতা ছিলেন।‌

প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজীর জন্ম পূর্ববাংলার ঢাকা জেলার বিতুনী গ্রামে। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর , কার্ত্তিকী কৃষ্ণা অষ্টমী তিথিতে বুধবার জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতার নাম শ্রীঅলোকমোহন গোস্বামী ও মাতার নাম শ্রীমতী সারদাসুন্দরী দেবী। বয়স যখন মাত্র সাত-আট, তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। মাতা সারদাসুন্দরীর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত অসঙ্গত ছিল। একারণে তাঁদের একজন ধনাঢ্য শিষ্য শ্রীহরেন্দ্র কুমার রায় প্রাণগোপাল প্রভুকে ফরিদপুর পাঁচুরিয়া গ্রামে নিয়ে যান , নিজের কাছে রেখে অধ্যয়ন করাবেন বলে। প্রভুপাদ প্রথম থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন । মাত্র দু-একবার দৃষ্টি বুলিয়েই গ্রন্থ মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন তিনি । গ্রন্থপাঠ ভিন্ন যেন অন্য কিছুই জানতেন না। গ্রন্থের মধ্যেই ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। এই গ্রামেতেই সংগীত শ্রবণ করে মূর্ছা গিয়েছিলেন তিনি । সহপাঠীরা তাঁকে ডেকেছিলেন পাশের ভবনটিতে বাঈজীর কীর্তন শ্রবণ করতে যাবার জন্য । কিন্তু, তিনি গ্রন্থ ত্যাগ করে যেতে রাজি হয়েছিলেন না। অথচ, যখন সেই ভক্তিমতী বাঈজীই দরদ ভরে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন, “কী রূপ হেরিনু , মধুর মুরতি, পীরিতি রসের সার”…. তখন সেই সঙ্গীতের সুরের টানেই পাঠ ছেড়ে ছুটে যান বালক প্রাণগোপাল। আর , তার পরের কথা তো জানলাম ওপরে।

পাচুরিয়ায় তিনি একটি টোলে পড়াশোনা করতেন । টোলের পাঠ সমাপ্ত করে খোলাবাড়ির শ্রীরজনীকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে দুই বৎসর মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন । ষোলো বৎসর বয়স পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে পড়াশোনা করেন। এরপর, উচ্চশিক্ষা লাভ করতে কলকাতায় চলে আসেন। হ্যারিসন রোডের কাছে শ্রীগোকুলচাঁদ গোস্বামীর তত্ত্বাবধানে কাব্য শিক্ষা ও ভাগবতাদি পাঠশিক্ষা শুরু করেন। এসময় তাঁর এত আর্থিক অনটন যে তিনি প্রদীপ পর্যন্ত জ্বালাতে পারতেন না। রাস্তার পাশের গ্যাসের আলোর নীচে বসে পড়াশোনা করতেন । অধ্যয়নে তাঁর অলৌকিক প্রভাব, আন্তরিক নিষ্ঠা-প্রচেষ্টা দেখে গোকুলচাঁদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন , “এই প্রাণগোপালই একদিন আমার নাম উজ্জ্বল করবে।” আর, বাস্তবে হয়েছিলও তাই। এরপর , শ্রীঅতুলকৃষ্ণ গোস্বামীর কাছেও ভাগবত শিক্ষা লাভ করে পূর্ববঙ্গে জননীর কাছে ফিরে যান প্রাণগোপাল গোস্বামীজী।

শ্রীভগবান যাকে যে কার্যের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখেন, উপযুক্ত সময় আর প্রেক্ষাপট এলে তাঁর সেই ভাগ্যনির্দিষ্ট কর্ম শুরু হয়ে যায় দুরন্ত, অবাধ গতিতে অতি স্বতঃস্ফূর্ততায় , সম্যক ভাবে। প্রভুপাদ প্রাণগোপালের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। অধ্যয়ন জীবন সমাপ্ত করে এবার তিনি ভাগবত পাঠ ও প্রবচন শুরু করে দিলেন। প্রথম পাঠ ময়মনসিংহ জেলার আবাদপুর গ্রামে। আর, এখান থেকেই পাঠে তাঁর ঈশ্বরপ্রদত্ত দৈবী প্রতিভার স্ফূরণ বা সার্বিক বিকাশ শুরু হয়ে গেল। সেখানে শ্রীআনন্দ কিশোর গোস্বামী তাঁকে দেখে, তাঁর প্রবচন শ্রবণ করে, তাঁর ব্যবহার লক্ষ্য করে এতখানি মুগ্ধ হন যে, তিনি নিজের কন্যাকে সমর্পণ করতে চান প্রভুপাদের হাতে। কিন্তু তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা বাধা দিলেন। কারণ—-প্রভুপাদের আর্থিক অনটন । জেনেশুনে এত দরিদ্র ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ কোনমতেই দেওয়া চলে না । কিন্তু, কারোর কথার কোন মান্যতা না দিয়ে প্রভুপাদের হাতেই কন্যা ‘সরোজিনী’-কে সম্প্রদান করেদিলেন আনন্দ কিশোর।

বিবাহের পরে প্রভুপাদ তাঁর মাতা ও পরিবারসহ চলে এলেন নবদ্বীপে। এখানে গানতলা রোডে বড় আখড়ায় তিনি ভাড়া বাড়িতে বাস করতে থাকলেন । নবদ্বীপের বড় আখড়াতেই সর্বপ্রথম প্রবচন দেওয়া শুরু করলেন। নিত্য ভাগবত পাঠ করেন সেখানে। পাঠের দরুণ যা পেতেন তাতে সংসার নির্বাহ হয়ে যেত। তাঁর পাঠ শ্রবণ করে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই সমৃদ্ধ ও সুখী হতে থাকলেন। অদ্ভুত এক আবেশ আর অমোঘ আকর্ষণ ছিল তাঁর পাঠে। যিনি একদিন পাঠ শ্রবণ করে ফেলবেন তিনি পরদিন আবার আসবেন শ্রবণ করতে। ক্রমে ক্রমে তাঁর পাঠের আসরে শ্রোতার সংখ্যা এমন বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছিল যে, যেন মনে হত গোটা নবদ্বীপ বুঝিবা হাজির সেখানে। ইতিপূর্বে , আপামর নবদ্বীপবাসীর হৃদয়ে পাঠ-প্রবচন শ্রবণের এমন উদ্বেলতা , আবিষ্টতা, আকর্ষণ কিন্তু ছিল না। মূলতঃ নামসঙ্কীর্তনের জোয়ারেই নবদ্বীপ নিমজ্জিত ছিল এতকাল। তাঁর অপূর্ব সিদ্ধান্তসমূহ এবং ভক্তিরস-প্রেমরসে জারিত ভাগবত ব্যাখ্যায় সকলে মুগ্ধাতিমুগ্ধ হয়ে যেতেন । সকলকে প্রেমে পাগল করে দিতেন তাঁর প্রেমময় কথায় তিনি । প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীকেই নবদ্বীপের প্রবলা-প্রবচন-মন্দাকিনীর ভগীরথ বলা যেতে পারে। তাঁর নবদ্বীপ আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ভাগবত পাঠ শ্রবণের আসক্তি নবদ্বীপবাসীর এতখানি ছিল না, বললে‌ অত্যুক্তি হয় না ।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদাস বাবাজী প্রাণগোপাল প্রভুর পাঠ নিত্য শ্রবণ করে ও তাঁর ভজন নিষ্ঠা-কুশলতার প্রমাণ পেয়ে এতখানি আপ্লুত হলেন যে , তিনি নিজের প্রাণধনকে অর্থাৎ সেবিত বিগ্রহ নয়নাভিরাম দর্শন শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনকে সমর্পণ করে দিলেন প্রভুপাদের কাছে। কেবল যে, বিগ্রহ অর্পণ করলেন তা নয় , বিগ্রহের নিবাস-মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন জমিজমাও লিখে দিলেন প্রভুপাদের নামে। আর, নিজে বরাবরের মতো চলে গেলেন‌ ব্রজধামে । কৃষ্ণচৈতন্য দাসজীর হৃদয়ে কতখানি নিশ্চিন্ততা এসেছিল প্রভুপাদের প্রতি যার দরুণ নিজের প্রাণারাম বিগ্রহ উপযুক্ত সেবকের কাছে যাচ্ছে জেনে তিনি অর্পণ করতে পেরেছিলেন , তা ভাবিত হলে বিস্মিত হতে হয়। প্রভুপাদের ভজন পারিপাট্যের সুসঙ্গতাও এ ঘটনায় পরিষ্কার অনুমেয় হয়।

তখন থেকে ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডে সেই গৃহমন্দিরেই নিবাস শুরু করলেন সপরিবার প্রভুপাদ। শ্রীমদ্ভাগবত প্রবচন দ্বারা আর্থিক সামর্থ্য বেশ স্বচ্ছল হতে থাকলো দিনকে দিন তাঁর । ভোগমন্দির , নাটমন্দির , মন্দির চত্বর ক্রমে নির্মিত হল। নিজেদের বসবাসের দালানবাড়ি, শিষ্য-ছাত্রদের বসবাসের ব্যবস্থা সব তৈরি হতে থাকল। তিনিও শ্রীরাধামদনমোহনদেবকে অন্তরের ধন করে, প্রাণঢেলে, প্রভূত প্রেমভাব নিয়ে সেবা করতে থাকলেন ।

শ্রীনিত্যানন্দ-বংশে নিজেদের ঘরের মধ্যে দীক্ষার প্রচলন । অর্থাৎ , পরিবারের মধ্যে গুরুজনদের থেকে দীক্ষা গ্রহণ প্রশস্ত ছিল। প্রভুপাদ প্রাণগোপাল দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন নিজের মাতৃদেবী শ্রীমতী সারদাসুন্দরী গোস্বামিনীর থেকে। তাঁর গুরুভক্তি, গুরুনিষ্ঠা অত্যন্ত উচ্চ ছিল। তিনি প্রতিদিন ত্রিসন্ধ্যা শ্রীগুরুদেবীকে পরিক্রমা করতেন, চরণামৃত গ্রহণ করতেন, দন্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করতেন। মাতৃদেবী তো মাতৃদেবী রূপে শ্রদ্ধাস্পদা ছিলেনই, কিন্তু তিনি অত্যন্ত ও অধিক পূজনীয়া ছিলেন শ্রীগুরুদেবী রূপে পুত্র প্রাণগোপালের কাছে। ওঁনার প্রতি নিষ্ঠা এতটুকুও কম ছিল না পুত্র প্রাণগোপালের। তাঁর শ্রীগুরুদেবীর কৃপায় যত দিন যেতে থাকলো, প্রবচনে প্রভুপাদের প্রতিপত্তি তত বৃদ্ধি পেতে থাকলো। আর , সেই সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকলো তাঁর ভজন প্রভাবের অত্যদ্ভুত গুণ।

একবার এক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। সেদিন তিনি পাঠ করছেন , কুমিল্লা জেলায় জমিদার কালাচাঁদ সাহা মহাশয়ের গৃহে। প্রভুপাদ আবেগমথিত হয়ে পাঠ করছেন , আর তাঁর পাঠের আবেগে আবিষ্ট হয়ে অনবরত অশ্রু বিসর্জন করছিলেন সকলে । এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন এক খ্যাতনামা উচ্চ পদবীধারী ব্যক্তি। তিনি অমন ভক্তিতে আপ্লুত পরিবেশ দেখে শুরু করলেন প্রশ্ন করা। এমন অর্থহীন ,অস্বস্তিকর প্রশ্ন করছিলেন যে উপস্থিত ভক্তেরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর প্রতি। কারণ, পাঠের ভাবরস আস্বাদনে বিঘ্ন হচ্ছিল প্রত্যেকের। তিনি অনর্থক তর্ক করছিলেন প্রভুপাদের কথার। ……….(ক্রমশঃ)

…… ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক