“এখনো পাচ্ছিস? ”
“হুম,বেশ পাচ্ছি।”
“কি জানি বাপু,আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“দ্যাখো না আরেকটু, খাটের তলাটা ভালো করে।”
“সে কি আর দেখিনি বলছিস? কাল তুই বলার পরই আজ সকালে পদ্মাকে দিয়ে ,নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, ঝাঁট দেওয়া করিয়েছি,তারপর আবার, ফিনাইল দিয়ে সব মুছেছে।”
“ওই জন্যই, পদ্মাদির কাজ তো, কেমন পরিষ্কার করেছে, বুঝতেই পারছি।”
“তা কি করব শুনি? আমি তো আর এই কোমড় নিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে পারি না।”
একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল করবী।মায়ের দিকে তাকিয়ে অমৃত বলল,
“ঠিক আছে,ছাড়ো,আমিই দেখছি।একটা আলো দাও কিছু।”
“দাঁড়া, তোর চার্জার লাইটটা আনি তিন্নির ঘর থেকে।কি যে গন্ধ গন্ধ বাতিক হয়েছে,জানিনা।আমরা তো কেউ পাচ্ছিনা।”
বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় করবী।অমৃত দুবার নাক টেনে দেখে,হুম আছে তো গন্ধটা,বেশ পচা পচা,ভ্যাপসা একটা গন্ধ।প্রথম পেয়েছিল গন্ধটা কাল অফিস থেকে ফিরেই ঘরে ঢুকে। কাল ফেরবার গাড়িটা একঘন্টা দেরি করেছিল।খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল।মাথাটাও ব্যথায় টনটন করছিল। তাই ঘরে ঢুকেই যখন দেখেছিল মা আর বাবা চা খাচ্ছে বসে,ও সোফায় ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে জুতো খুলতে খুলতে বলেছিল,
“মা,আমায় একটু চা দাও প্লিজ, খুব মাথা ধরেছে।”
বলেই সোফায় ধপ করে বাবার পাশটায় বসে পড়েছিল আর তখনই প্রথম গন্ধটা এসে ওর নাকে ধাক্কা মেরেছিল।ও একটু নাকটাকে কুঁচকে বলেছিল,”কেমন একটা পচা গন্ধ আসছে না? কোথা থেকে? ”
তিন্নি সঙ্গে সঙ্গে ওরই মতন নাক কুঁচকেই বলেছিল,
“আসছে তো, তোর গা থেকেই আসছে।”
বাবা বলেছিল,”না না, গা থেকে না মোজা থেকে,কদ্দিন ধুসনি? ”
মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিল,’ওই আমি ধুয়ে দিইনি,তাই আর হয়নি,এখনো মা পারছে তাই করছে,বৌ এসে করবে? আজকালকার মেয়ে সব।”
মায়ের বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের কাপটার দিকে এক পলক তাকিয়ে ও উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল,”না,রাখো আগে বরং ফ্রেশ হয়ে আসি।”
মা বলে উঠেছিল, ”
ওইতো,ওমনি রাগ হয়ে গেলো, আমার কিছু বলার উপায় নেই।খাটবো কিন্তু কিছু বলা যাবে না।”
না মায়ের কোন কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করেনি ও।কথায় কথা বাড়ে।
চানটা করে বরং বেশ ভালো লাগছিল। চা খেতে খেতে ম্যাঞ্চেস্টারের খেলা দেখছিল বসার ঘরে বসেই।তখন তো সব ঠিকই ছিল।কিন্তু গন্ধটা আবার পেলো রাতে শুতে যাবার সময় নিজের ঘরে ঢুকে।
সবে পুজো শেষ হয়েছে, এবারে পুজো একটু দেরীতে হয়েছে,তাই এখনই একটা শীতের শিরশিরে ভাব এসে গেছে।অমৃতের ঘরের সামনেই একটা বেশ বড়ো পুকুর আছে তাই বাতাস একটু বেশিই আসে।মা তাই ওর শোবার সময় জানলাগুলো বন্ধ করে।যায়,আসলে এইসময়ের হাওয়াটা একদম ভালো না।যদিও ঘরে পাখা চলে।অমৃত জানলাগুলো খুলে দিয়েছিল, বলা যায় না হয়তো গুমোট হবার কারনে গন্ধটা লাগছে,তেমন হলে রাতের দিকে উঠে জানলা বন্ধ করে দেবে।পুকুর থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে সত্যিই ঘরের গুমোট ভাবটা কেটে গিয়েছিল,রোজের মতন জুঁইয়ের সঙ্গে ফোনে কিছুক্ষন কথা বলেই অমৃতের ঘুম চলে এসেছিল।মাঝরাতে অবশ্য ওকে ঘুম থেকে উঠতেই হয়েছিল।না বাতাসের জন্য নয় বরং সেই গন্ধটার জন্য। তীব্র পচা গন্ধে অমৃত উঠে বসেছিল বিছানায়। ওর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল,কপালে ঘাম জমেছিল।অথচ জানলা দিয়ে দিব্যি বাতাস বইছিল।জলের বোতল খুলে গলায় ঢকঢক করে অনেকটা জল ঢেলেছিল।আশ্চর্য, গন্ধটা যেন বোতলের মধ্যে থেকেও আসছে,কে জানে কেউ হয়তো পরিষ্কারই করেনা বোতলটা।বাথরুমে গিয়ে ভাল করে চোখে মুখে জল দিয়ে এসেছিল ও।তখনই দেখেছিল বাবার ঘরে তখনো আলো জ্বলছে। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল,ওকে দেখে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।ওর বাবা একটা ছোট সাপ্তাহিক সংবাদপত্র চালায়, তার জন্যেই অনেক রাত অব্দি জেগে কাজ করে।মা বা ওরা সবাই অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ে।আজ ওকে উঠতে দেখে বাবা বেরিয়ে এসেছে।
“কি হল,শরীর খারাপ নাকি? ”
বাবার প্রশ্নে অমৃত বেশ বুঝতে পেরেছিল, ওর অস্বস্তিটা বাবার চোখেও পড়েছে।
ও ঘাড় নেড়েছিল,অবশ্য সেই ঘাড় নাড়ার অর্থ যে হ্যাঁ হয় নাকি না, তা নিজেও বোঝেনি।
“তাহলে? ”
বাবা আবার জানতে চেয়েছিল।
ও বলেছিল,”একটা পচা গন্ধ আসছে ঘরে।”
বাবা অবাক হয়ে বলেছিল,” গন্ধ? আবার? ”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল,”ভারি মুস্কিল তো।এককাজ কর,তুই বরং আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়,এখন তো আর কিছু দেখা যাবে না।নিশ্চিত ইঁদুর মরেছে।”
অমৃত একটু ইতস্তত করে বলেছিল,” তোমার কাজ? ”
“হয়ে গেছে,তুই যা আর রাত করিস না।”বলতে বলতে বাবা ঘরে চলে গিয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই বাবার এই কাজের ঘরটা খুব প্রিয় অমৃতের,কতরাত ও চুপ করে বসে একমনে বাবার কাজ দেখতো।ছোট্ট সাপ্তাহিকে বাবা একাই ছিল একশো। তখন কম্পিউটার ছিল না।হাতেই সব কাজ হতো। প্রচুর বই আর কাগজ মিলে একটা সুন্দর গন্ধ পেতো ও। তারপর কখন যে বড়ো হয়ে গেলো, ওর নিজের ঘর পেলো,নিজের জগৎ তৈরি হলো, বাবার এই ঘরে ঢোকাই বন্ধ হয়ে গেলো। আজ অনেকদিন বাদে ঢুকে দেখলো, না বদলাইনি কিছুই,সেই বইপত্তর,সেই কাগজের স্তূপ, শুধু এককোনে একটা কম্পিউটার হয়েছে।ওই ছোট্ট খাটটায় শুয়েই ওর ঘুম চলে এসেছিল,আর কোন গন্ধ পায়নি।
বাবা বোধহয় মাকে সব জানিয়েছিল,তাই সকালে অফিস যাবার সময়েই দেখছিল মা সব পরিষ্কারের তোড়জোড় শুরু করেছে।ও নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়ে গিয়েছিল। আসলে গন্ধটা এতো তীব্র যেন মনে হচ্ছে,একেবারে ওর নাকে ঢুকে পড়েছে।অফিসে কাজের ফাঁকেও বারবার সেই গন্ধের কথা মনে এলেই ওর যেন গা গুলিয়ে উঠছিল।
*****
ছাদে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল অমৃত,না,চার্সাজার আলো দিয়ে নিজে দেখেও ও কিছুই খুঁজে পায়নি, তাই বিরক্ত হয়েই ছাদে উঠে এসেছিল। বাড়ীতে ও কোনদিন সিগারেট খায় না,কিন্তু আজ আর পারছিল না।মাথাটাও ভারী হয়ে ছিল।তাই বাধ্সিয হয়েই একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। আকাশে আজ মেঘ আছে।হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি আসবে।আস্তে আস্তে ও সিগারেটের ধোঁয়াটাকে বাতাসে মিশিয়েদিচ্ছিল আর সেই ধোঁয়ার মধ্যে দিয়েই ক্রমে ওর চোখের সামনের ধোঁয়াটাও আস্তে আস্তে যেন কেটে যাচ্ছিল।
সেদিন অফিসে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল বিজনদা,ওদেরই সিনিয়ার সহকর্মী।ঐ ভদ্রলোকের একটা ফাইল অনেকদিন ধরে আঁটকে আছে,অমৃত জানিয়েছিল ফাইল পাস না হবার কারণগুলো ।ওনার প্রজেক্টে যে বেশ কিছু সমস্যা আছে বলেছিল।কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা হয়ে একই অনুরোধ বারবার করছিলেন,ফাইলটা যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।অমৃত বারবার ওনাকে বুঝিয়েও যখন কাজ হচ্ছিল না তখন একটু বিহ্বল্ভাবেই তাকিয়েছিল বিজনদার দিকে।বিজনদা ওকে চোখ টিপে ভদ্রলোককে ওর টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।ও নিশ্চিন্ত হয়েছিল।কিন্তু একটু পরেই ওর ডাক এসেছিল স্বয়ং প্রজেক্ট অফিসারের ঘর থেকে ফাইল সহ।তারপর ওনার সামনে বসেই ফাইলটা পাস করে ঐ ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিতে হয়েছিল অমৃতকে।কী আর করতে পারতো ও ? সবে তো ঢুকেছে চাকরীতে।বদলে টিফিনের সময় বিজনদা এসে হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল একটা সিগারেটের প্যাকেট।না তাতে সিগারেট ছিল না ,ছিল কিছু কড়কড়ে নোট।এটাই নাকি এই অফিসের দস্তুর।এতে উপর থেকে নীচেরমহল পর্যন্ত সবার ভাগ আছে।অমৃতর গা টা তখনই প্রথম গুলিয়ে উঠেছিল।।বিকালে জুঁইয়ের সঙ্গে দেখা করে সবটা জানিয়েছিল,আশ্চর্য জুঁই ওর কথা শুনে খুব খুশিই হয়েছিল,তখনই ওকে নিয়ে গিয়ে ঐ টাকা দিয়ে একটা দামী পারফিউম কিনেছিল।
টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ওর গায়ে এসে পড়ছে, অমৃতের মনে পড়ে যাচ্ছে,বাবা ওর পাশে বসে কাগজের কাজ করছে ,আস্তে আস্তে সাদা কাগজের গায়ে কালো অক্ষরগুলো ফুটিয়ে তুলছে একটা বাক্য-‘সত্যপক্ষ-সততাই মূলধন’ ওর ইচ্ছা করছিল একবার চিৎকার করে ও ডাকে ‘বা……বা’ কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বের হলো না।ঝমঝম করে নেমে আসা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অমৃত ভিজতে লাগল একা।।