দীপাবলির রাত সেদিন, দিল্লীর বাদশাহ ঔরঙ্গজেব গেলেন প্রাসাদের ছাদে। অমাবস্যার অন্ধকারময় রাতের আকাশে হিন্দুদের আতস বাজির রোশনাইয়ের দৌরাত্ম্য আজও তাঁর রাজত্বে কতখানি হয়, তা সরজমিন করাই উদ্দেশ্য। বাদশাহ দেখলেন, বৃন্দাবনের দিকের দক্ষিণের আকাশের অন্ধকার যেন একটু কম। আলোময় হয়ে রয়েছে আকাশ মনে হচ্ছে। কোন জোড়ালো আলো যদি জ্বালানো হয় , তার প্রভা যেমন তমসাচ্ছন্ন আকাশকে ঈষৎ লালচে করে ঠিক তেমন।
তাহলে কী সত্যই কোন আলো জ্বালানো হয়েছে কোথাও! ওই আলোর উৎস কী! তেমন জোড়ালো আলোর ব্যবস্থা কী ভাবেই বা সম্ভব হয়েছে! তিনি আদেশ দিলেন সেনাকে ঐ আলোর কারণ জানার জন্য। সঠিক সংবাদই এল। জানতে পারলেন, বৃন্দাবনে সাততলা উচ্চ যে সুবৃহৎ মন্দির আছে ,যার নাম শ্রীগোবিন্দ মন্দির , সেই মন্দিরের মাথায় আড়াই মণ ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো থাকে। সেই প্রদীপের আলোর প্রভাতেই দক্ষিণ আকাশ দীপ্তিমান।ঔরঙ্গজেবের ভ্রূ কুঁচকে উঠলো। চরম অসন্তুষ্ট হলেন তিনি। কে নির্মাণ করেছিলেন এত সুউচ্চ মন্দির ! উত্তর এল,জয়পুরের রাজপুত রাজা মানসিংহ, যিনি সম্রাট আকবরের সময়ে সেনাপতি ছিলেন। (মানসিংহের আমলে নাম ছিল অম্বর। রাজা জয়সিংহ রাজধানী পাহাড়ের নীচে স্থানান্তরিত করলে , সেসময় থেকে নাম হয় জয়পুর)সে কী, রাজপুত রাজা আগ্রার কাছে এসে নিজের যে কীর্তি স্হাপন করে গিয়েছিলেন , তা এখনও টিকে আছে! আকাশেও তার নমুনা ! এত বড় স্পর্ধা! ঔরঙ্গজেব আদেশ দিলেন পরদিনই যেন সে মন্দির ধ্বংসের কাজে মুঘল সেনারা রওনা হয়ে যায় । তিনি হিন্দুত্বের এত বড় আস্ফালন কোনমতেই মেনে নেবেন না ।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু আদেশ দিয়েছিলেন শ্রীরূপ-সনাতন দুই ভাইকে , বৃন্দাবনে গমন করে লুপ্ত বিগ্রহ ও লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার করতে। শ্রীরূপ এলেন , কিন্তু বনে-বনে, গ্রামে-গ্রামে, পথে-পথে ,ব্রজবাসীদের প্রতি গৃহে অনেক সন্ধান করেও কোথাও প্রাচীন বিগ্রহ পেলেন না। পরিশ্রান্ত দেহে, মলিন মনে ,চিন্তিত চিত্তে যমুনার তটে বসে রয়েছেন তিনি। এমন সময় এক অপূর্ব দর্শন পুরুষ এসে পাশে বসে কথাপ্রসঙ্গে জানতে চাইলেন শ্রীরূপের উদ্বিগ্নতার কারণ। অজ্ঞাত পরিচয় মানুষটির মধুমাখা কথায় শ্রীরূপের তাপিত চিত্ত যেন খানিক শান্তিবারি পেল। তিনি মহাপ্রভুর আদেশ আর নিজের ব্যর্থতার কথা সব জানালেন সৌম্য কলেবর পুরুষটিকে। সব শুনে পুরুষটি বললেন, ” একটি স্থান আছে আমি জানি, যেখানে প্রতিদিন গাভী এসে দুগ্ধ ক্ষরণ করে মৃত্তিকা সিক্ত করে দিয়ে যায়। আপনি চলুন আমার সাথে। আমি সেস্থান দেখিয়ে দিচ্ছি।তারপর আপনার যা ভালো মনে হয় করবেন।” শ্রীরূপ আর কোন কথা বলতে পারলেন না। যন্ত্রচালিত হয়ে যেন অনুসরণ করলেন পুরুষটিকে। এলেন গোমাটিলায়। স্থানটি চিহ্নিত করে দিয়েই পুরুষটি হনহন্ করে চলে গেলেন আর কোন কথা না বলে, কিছু শোনার অপেক্ষা না রেখে। শুধু যাবার আগে , এমন ইঙ্গিতপূর্ণ মিষ্টি হাসি হাসলেন , যা দেখেই শ্রীরূপ মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। পরে জ্ঞান ফিরতে অনুভব করলেন , সেই পুরুষটি আসলে কে। তিনি নিশ্চিত হলেন ঐ স্থানেই শ্রীগোবিন্দদেবের বিগ্রহ আছে। ব্রজবাসীদের নিয়ে মৃত্তিকা খনন করলেন গোমাটিলার। বাস্তবিক প্রাপ্ত হলেন শ্রীবিগ্রহ । আনন্দ আর ধরে না সকলের উদ্ধারিত বিগ্রহ পেয়ে। এই মূরতি শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র(নাতির পুত্র) ‘ব্রজনাভ’ নির্মাণ করিয়েছিলেন , যা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল।নাম শ্রীগোবিন্দদেব। শ্রীরূপ একটি ঝোপড়া তৈরী করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত করলেন।সেবাকার্য্য শুরু হল ।
শ্রীরূপ গোবিন্দদেবের সেবার ভার পরবর্তীতে অর্পণ করেছিলেন শ্রীমন্ মহাপ্রভুর অপর এক কৃপাপাত্র শ্রীরঘুনাথভট্ট গোস্বামীকে । রঘুনাথ ভট্টের অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য ছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ। বিবিধ মূল্যবান দানসামগ্রী ও বাস করার জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করিয়ে নিজের গুরুদেবকে প্রণামী দিতে চেয়েছিলেন মানসিংহ। কিন্তু, চরম বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি রঘুনাথ ভট্টজী কোন সম্পদই গ্রহণ করেননি। সব প্রত্যাখ্যান করেন।এতে রাজা মানসিংহ ব্যাথাতুর-বিষন্ন হন। তখন নিজ শিষ্যের মনঃকষ্ট দূর করার জন্য রঘুনাথ ভট্টজী বলেন, “তুমি এক কাজ কর। ঝড়-জলে-শৈত্যে আমার ভাঙা কুটীয়ায় শ্রীগোবিন্দদেব কষ্ট পান।এই গোবিন্দদেবের জন্য একটি মন্দির বরং নির্মাণ করে দাও।” শ্রীগুরুদেবের এমন আদেশ পেয়ে মানসিংহের মনের প্রফুল্লতা আর ধরে না। শুরু হল গোবিন্দমন্দির নির্মাণ কার্য্য।১৫৯০খ্রীষ্টাব্দে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হল। লালপাথরে অপরূপ কারুকার্য্যমন্ডিত সেই সাততলা মন্দির বৃন্দাবনের মহাসম্পদ হল।
গোবিন্দমন্দির আর অক্ষত অবস্থায় নেই বর্তমানে। বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের আদেশে গোবিন্দমন্দির ধ্বংসের কাজ শুরু হয়েছিল। মন্দির গুঁড়িয়ে দিতে শত-শত মুঘল সেনা নিযুক্ত হয়েছিল । কথায় আছে, জোর যার মুলুক তার। যাঁরা বাঁধা দিতে এসেছেন তাঁরাই প্রাণ হারিয়েছিলেন।নিরীহ বৃন্দাবনবাসীরা বুকে পাথর চেপে সাক্ষী থেকেছিলেন সেই ধ্বংস লীলার। সাততলা মন্দিরের চারতলা পর্যন্ত হাতুড়ি-ছেনি-শাবলের নির্মম আঘাতে ভাঙ্গা পড়ে গিয়েছিল। বাকী ছিল আর তিনটে তলা। এবার সেগুলিও ভাঙ্গা পড়বে।
এ কী ! এভাবে কাজ চালানো যায় নাকি! হঠাৎ এ কী বিপদ এলো! মুঘল সেনার ওপর নিত্য শুরু হল বৃন্দাবনের হনুমানদের অত্যাচার। কোথা থেকে হাজার হাজার হনুমানের উপদ্রবে কাজ চালানো অসাধ্য হয়ে উঠলো। হনুমানরা কামড়ে, হাঁচড়ে, দাঁড়ি-গোঁফ টেনে , ধাক্কা দিয়ে ওপর থেকে নীচে ফেলে প্রাণ রাখা দায় করলো মুঘল সেনাদের। এমনই ভীষণ , মারাত্মক, ভয়াবহ অবস্থা হল যে প্রাণভয়ে সেনারা সকলে মন্দির ছেড়ে পালাতে বাধ্য হল। শ্রীহনুমানদের দাপটে পরবর্তীতে আর শুরুই করা গেল না মন্দির ভাঙার কাজ।মুঘল সেনারা বৃন্দাবনে আসতে নারাজ একেবারেই। তারা সন্ত্রস্ত সকলে। অগত্যা ঔরঙ্গজেব বিরতি দিলেন তাঁর অত্যাচারের।অসমাপ্ত হয়ে পড়ে রইলো মন্দির ধ্বংসের অবশিষ্ট কাজ।
আজও বৃন্দাবনে লালপাথরের সেই সুবৃহৎ , অপূর্ব ,ভগ্ন তিনতলা মন্দির দর্শন হয় । ইতিহাসকে প্রতিটি পাথরের গায়ে জড়িয়ে রেখে স্বমহিমায় গোবিন্দমন্দির অবস্থান করছে।
প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী যবনরাজা কুখ্যাত কালাপাহাড়ের অত্যাচারের ভয়ে শ্রীগোবিন্দদেবের বিগ্রহকে লুকিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজস্থানের জয়পুরে ।রাজপুত রাজাদের সুরক্ষাভরা যত্নের সেবাতে গোবিন্দদেব সেখানেই রয়েগেছেন। আজও জয়পুরে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ভক্তদের সমাগম হয় শ্রীগোবিন্দদেবকে দর্শন করতে।
বর্তমানে বৃন্দাবনে দুটি গোবিন্দমন্দির। একটিকে বলা হয় পুরানো গোবিন্দমন্দির আর অপরটিকে নতুন গোবিন্দমন্দির। পুরানোটি হল এই লাল পাথরের মন্দিরটি । এখানে এখন বিরাজ করছেন শ্রীশ্রীনিতাই-গৌর্যএবং শ্রীজগন্নাথদেবের বিগ্রহ। আর নতুন মন্দিরটি নির্মাণ করেন পশ্চিমবঙ্গের ২৪পরগণা জেলার শ্রীনন্দকুমার বসু মহাশয়। এ মন্দিরে শ্রীগোবিন্দদেবের প্রতিভূ বিগ্রহ (replica) সেবা পান। নতুন মন্দিরটি প্রাচীন মন্দিরের অনতিদূরেই অবস্থিত। আর, হনুমানজীউদের দল গোবিন্দমন্দির রক্ষা করেছে বলে , তাদের কাউকে প্রহার করা হয় না বৃন্দাবনে। তারাই যেন বৃন্দাবনের সেনা হয়ে বৃন্দাবনকে পাহাড়া দিচ্ছে আজও।
সমাপ্ত