বৃন্দাবন যাত্রার সময় শ্রীমন্মহাপ্রভুর সঙ্গী ও লীলার সাক্ষী ‘শ্রীবলভদ্র ভট্টাচার্য’ : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
1007

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর বৃন্দাবন ভ্রমণের সকল বৃত্তান্ত আমরা জানতে পারি শ্রীবলভদ্র ভট্টাচার্য্যের কল্যাণে। কারণ তিনি ছিলেন মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রাপথের সঙ্গী-সেবক। তিনি নদীয়া নিবাসী ব্রাহ্মণ ছিলেন। মহাপ্রভু যখন সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে চলে আসেন, তখন বলভদ্রও তাঁর সাথে নীলাচলে পাড়ি দেন।বলা় হয় , শ্রীমতি রাধারাণীর সখি ‘মধুরেক্ষণা’ অবতীর্ণ হয়েছেন বলভদ্র ভট্টাচার্য্য রূপে এই যুগে।

“বলভদ্রাখ্যকো ভট্টাচার্য্যঃ শ্রীমধুরেক্ষণা”
(শ্রীগৌঃ গঃ দীঃ ১৭১ শ্লোক)

শ্রীক্ষেত্র থেকে বৃন্দাবন যাত্রা করবেন বলে যখন মহাপ্রভু দ্বিতীয়বারের জন্য মনস্থির করলেন ,সেসময় স্বরূপ দামোদর তাঁকে বললেন, ” প্রভু, তুমি একাকী যাবে !কেউ সাথে না থাকলে তো অসুবিধা হবে। তোমার সাথে বরং সাধু, স্নিগ্ধ স্বভাবের এই আর্য্য ব্রাহ্মণ বলভদ্র ভট্টাচার্য্য যাক। সে ভিক্ষা করে এনে রন্ধন করবে রোজ। আর, তোমার জলপাত্র, বহির্বাস, কৌপীন ইত্যাদি বহন করার জন্য অপর একজন ব্রাহ্মণ ভৃত্য সঙ্গে নাও। তাহলে তোমার নামস্মরণে কোন বিঘ্ন হবে না। বৃন্দাবন দর্শন-আস্বাদনও নিশ্চিন্তে করতে পারবে মনের সুখে। আর তাছাড়া, তুমি যখন সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে এসেছিলে তখন তো বলভদ্র ভট্টাচার্য্য তোমার সাথেই গৌড়দেশ থেকে এসেছিল। তাই তাকে নিতে আপত্তি কোথায়! তার বড় বাসনাও তীর্থ করার ।” মহাপ্রভু সব শুনে রাজী হলেন; বলভদ্রকে অঙ্গীকার করলেন সেবক রূপে তাঁর বৃন্দাবন যাত্রায়।
“তাঁহার বচন প্রভু অঙ্গীকার কৈল।
বলভদ্র ভট্টাচার্য্যেরে সঙ্গী করে নিল।।”
( চৈঃ চঃ ,মধ্য)
শ্রীবলভদ্র ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের গৌরের প্রতি সদা নিষ্ঠাপূর্ণ রতি-মতি ।তাই গৌরাঙ্গচরণ সেবা করার সৌভাগ্য মিলবে এ কথা ভেবে তিনি পরম উৎকণ্ঠিত হলেন, উল্লসিত হলেন। নিজের ভাগ্যকে মনে মনে প্রশংসা করলেন।
১৫১৪খ্রীষ্টাব্দের আশ্বিন মাসে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মহাপ্রভু ।ঝাড়িখন্ড পথ ধরে চলেছেন ।সঙ্গী হয়ে সেবা করতে থাকলেন বলভদ্র ভট্টাচার্য্য ।যখন বনপথে যান তখন গ্রাম থেকে ভিক্ষা করে আনা দুই-চার দিনের ভক্ষ্যদ্রব্য সাথে রাখতেন তিনি। রন্ধন করে প্রভুর সেবা দিতেন বনের মধ্যেই । আর যখন গ্রাম্য পথের ওপর দিয়ে যেতেন তখন কোন গৃহস্থের গৃহে ভিক্ষা নির্বাহ করতেন । বলভদ্র রন্ধন করে ভোগ লাগিয়ে মহাপ্রভুকে প্রসাদ পাওয়াতেন ।শুদ্ধ দাস্যভাব নিয়ে তিনি মহাপ্রভুর সেবা করতেন প্রতিদিন।
ঝাড়িখণ্ডের বনপথে গমন করার সময় প্রভুর কন্ঠের প্রেমমাখা কীর্তনের ধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে বনের হাতি, হরিণ,বাঘ ,ময়ূর প্রভৃতি প্রাণীরা পর্যন্ত আবেশে মহাপ্রভুকে অনুসরণ করতো। অবিশ্বাস্য ভাবে তারা কৃষ্ণপ্রেমে নৃত্য করতো কীর্তনের সাথে। পাশবিক ভেদভাব ভুলে একাত্মীয়তা পাতিয়েছিল যেন তারা।
” প্রভু কহে –কহ কৃষ্ণ, ব্যাঘ্র উঠিল ।
কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কহি ব্যাঘ্র নাচিতে লাগিল।।
( শ্রীচৈঃ চঃ,মধ্য)
সমস্ত বৃক্ষ ,লতা, গুল্ম পর্যন্ত প্রভুর কীর্তনে শিহরিত, আনন্দিত হয়ে হিল্লোলিত হত দ্বিগুণ উৎসাহে । মহাপ্রভুর এমন লীলাশক্তি দর্শন করে বলভদ্র আশ্চর্য হয়ে যেতেন। প্রভুর প্রভাব দর্শন করে তিনি চমৎকৃত হতেন ।আহা ! প্রকৃতই ভট্টাচার্য্য মহাশয় বড় ভাগ্যবানজন।না হলে, এমন পশু-পক্ষী ,বৃক্ষ-লতা-গুল্মকেও মহাপ্রভুর প্রেমদান লীলার সাক্ষী কেমন করেই বা হতেন!
আবার শ্রীকৃষ্ণবিরহবিধূরা শ্রীরাধার মত যখন মহাপ্রভু কৃষ্ণস্মৃতিতে অচেতন হয়ে যেতেন, তখন বলভদ্র ভট্টাচার্য্য প্রভুর কর্ণে কৃষ্ণনাম শ্রবণ করিয়ে তাঁর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেন।সুস্থির করতেন প্রভুকে।
একদিন বিনয়াবতার শ্রীমন্ মহাপ্রভু বিনয় করে বললেন ,”বলভদ্র, তোমার সেবায় আমি বলিহারী যাই ।তুমি সাথে না থাকলে এ দুর্গম পথে আমায় উপবাসে দিন কাটাতে হত। কৃষ্ণ কৃপা করে তোমাকে পাইয়াছেন। তোমার সেবায় সুখে যাত্রা করছি। তোমার প্রসাদে আমি নির্বিঘ্নে আছি।” এরপর, পরম সন্তুষ্ট প্রভু কৃপা-আলিঙ্গন দিলেন বলভদ্রকে। বলভদ্র বললেন, ” আমার মত পতিত কে আছে প্রভু এ সংসারে ! তুমি কৃপা করে আমায় সঙ্গে নিয়েছ, অঙ্গীকার করেছ, সেবা করার অধিকার দিয়েছ। আমার এ জীবন ধন্য ।তুমি স্বতন্ত্র ঈশ্বর বলেই না এমন অসম্ভব পতিত পাবন লীলা করেছ! ”

মহাপ্রভু তখন বৃন্দাবনে। জনকোলাহল উঠলো যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের উদয় হয়েছে । সেখানে কালিয়দহের জলে শ্রীকৃষ্ণ নাকি রাত্রি বেলায় প্রকট হন।।আর তাই মথুরার লোকেরা বৃন্দাবনে দলে দলে গমন করতে লাগলেন শ্রীকৃষ্ণকে দেখবেন বলে। পর পর তিন রাত্রি এমন কৃষ্ণ দর্শন পেলেন তাঁরা। বলভদ্র ভট্টাচার্য্যেরও বাসনা হল বৃন্দাবনে যাবার,কৃষ্ণদর্শন করার। আর তাই তিনি মহাপ্রভুর কাছে অনুমতি চাইলেন। মহাপ্রভু শোনামাত্র চাপড় মারলেন বলভদ্র ভট্টাচার্যের গালে। বললেন, ” জানো না কলিকালে কৃষ্ণ প্রকট হন না। মূর্খের বাক্য শুনে তুমিও মূর্খ হয়ে গেছ নাকি! বাতুল না হয়ে ঘরে বসে থাকো। আর যদি যেতেই হয় তবে কাল রাত্রে যেও, আজ নয়।”

” ভট্টাচার্য্য তবে কহে প্রভুর চরণে ।
আজ্ঞা দেহ যাত্রা করি কৃষ্ণ দর্শনে ।।
তবে তারে কহে প্রভু চাপড় মারিয়া।
মূর্খের বাক্যে মূর্খ হৈলা পণ্ডিত হইয়া।।
কৃষ্ণ কেন দরশন দিবে কলিকালে।
নিজভ্রমে মূর্খ লোক করে কোলাহলে।।”
(শ্রীচৈঃ চঃ,মধ্য)
পরদিন প্রভাতে কালিয়দহ থেকে এক ভব্য ব্যক্তি মহাপ্রভুর কাছে আসলেন।প্রভু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনিও কৃষ্ণকে দেখেছেন কিনা।তখন তিনি জানালেন, ” না,না ।কৃষ্ণ নয় ।ভ্রম হয়েছিল সকলের ।আসলে রাত্রিবেলায় দেউটি (প্রদীপ) জ্বালিয়ে নৌকায় করে কৈবর্ত্তরা (জেলেরা) কালিয়াদহের মাছ ধরে। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে দেখে সকলে ভেবেছে কালিয় নাগের শরীরের ওপর কৃষ্ণ নর্ত্তন করছেন। নৌকাকে কালিয়নাগ ,দেউটি কে নাগের মণি আর জেলেকে কৃষ্ণ ভেবেছে মূঢ় লোকেরা। শাখা-পল্লবহীন বৃক্ষকে যেমন দূর থেকে মানুষ মনে হয় তেমন জেলেকে ভ্রমেতে কৃষ্ণ ভেবে ফেলেছে।তবে হ্যাঁ,একথা সত্য যে বৃন্দাবনে আবার কৃষ্ণের উদয় হয়েছে ।আর ,মানুষ তাঁকে দর্শনও করছে। ” মহাপ্রভু বিস্ময়ে বললেন, “তাই বুঝি! তা, কোথায় হচ্ছে সেই কৃষ্ণদর্শন? ” ব্যক্তি উত্তর দিলেন, “আপনিই তো সেই সচল নারায়ণ। বৃন্দাবনে আপনিই স্বয়ং কৃষ্ণ অবতার।বর্তমানে আপনাকে দর্শন করেই তো সব লোক নিস্তার হচ্ছে ।” একথা শুনে তখন বলভদ্র ভট্টাচার্য্য ভীষণ লজ্জিত হলেন মনে মনে । নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষমা চাইলেন মহপ্রভুর কাছে। প্রভু হাসলেন ।
মথুরাবাসীরা সকলে মহাপ্রভুকে দর্শন করতে আসেন ,বলভদ্র ভট্টাচার্য্যের কাছে মহাপ্রভুর নিমন্ত্রণ দেন। প্রত্যেকেই চান মহাপ্রভুকে সেবা দিতে। এক-এক দিন তো এমন হয় দশ-বিশ জন এসে নিমন্ত্রণ দেন। বলভদ্র তাঁদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার অবসরও পান না‌।
একদিন অক্রুর ঘাটে বসে মহাপ্রভু চিন্তা করলেন ,এই ঘাটেই তো যমুনা নদীর জলের ভেতর অক্রুর বৈকুণ্ঠ দর্শন করেছিলেন। আবার ব্রজবাসীরা গোলক দর্শন করেছিলেন।—-একথা ভাবতে ভাবতে তিনি আবেশে জলে ঝাঁপ দিলেন। প্রেমে মূর্ছিত হয়ে গেলেন ।জলের ভেতর ডুবে রইলেন। নজরে আসায় রাজপুত শ্রীকৃষ্ণদাস চীৎকার করে কাঁদতে থাকলেন। বলভদ্র ভট্টাচার্য্য সেই চীৎকার শুনে তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন,জল থেকে ওঠালেন তাঁরা প্রভুকে। সে যাত্রায় বিপদ নামলো।
বলভদ্র চিন্তিত হলেন এই ভেবে যে,বৃন্দাবনে দিনে দিনে মহাপ্রভুর ভাবাবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ,রন্ধনের কার্য্যে এবং নিমন্ত্রণকারীদের সামলানোতে ব্যস্ত থাকার দরুণ তিনি সর্বক্ষণ প্রভুকে নজরে রাখতেও পারছেন না ।যদি কোন বিপদ হয় ,আবার যদি এমন অঘটন ঘটান মহাপ্রভু ! তাই , মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে যুক্তি করলেন বলভদ্র। মহাপ্রভুর কাছে নিবেদন করলেন এই বলে যে , বহু লোক সামলাতে তিনি এখন অপারগ ,বৃন্দাবনে থাকা দায় হয়েছে । অবিলম্বে বৃন্দাবন ত্যাগ করা উচিৎ। আবার মাঘ মাসের মকর সংক্রান্তির স্নানও সামনে। তাই প্রয়াগের দিকে রওনা হওয়াই ঠিক হবে। ইচ্ছা না থাকলেও বলভদ্র, ব্রাক্ষ্মণ আর কৃষ্ণদাসের পীড়াপীড়িতে শেষে বৃন্দাবন ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন প্রভু।সোরা ক্ষেত্র হয়ে প্রয়াগের পথে রওনা হলেন তাঁরা।
প্রয়াগে থাকাকালীন সময়ে , মহাপ্রভু বনের মধ্যে যে যে পথ ধরে, যে যে গ্রামের ভেতর দিয়ে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন, নদী-শৈলতে যেখানে যা লীলা করেছিলেন তা সব বলভদ্র ভট্টাচার্য্যের মুখে শুনে লিখে নিয়েছিলেন শ্রীসনাতন গোস্বামী ।মহাপ্রভুর আসা সেই পথ ধরেই পরবর্তীতে সনাতন শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছেছিলেন।
” যে পথে যে গ্রাম,নদী ,শৈল যাঁহা যেই লীলা।
বলভদ্রভট্ট স্থানে সব লিখি নিলা।।”
(শ্রীচৈঃ চঃ,অন্ত্য)

প্রয়াগ হয়ে পুনরায় শ্রীক্ষেত্রে ফিরে এসেছিলেন মহাপ্রভু । গৌরাঙ্গের গণ, পরম সৌভাগ্যশালী মহাজন ,যিনি মহাপ্রভুর দিব্য প্রেমপ্রদান লীলার সাক্ষী , যাঁর কৃপায় আমরা মহাপ্রভুর ব্রজযাত্রার সব ঘটনা জেনেছি ,সেই গৌরপ্রেমতনু বলভদ্র ভট্টাচার্য্যের শরণ গ্রহণ করে গৌরচরণ সেবাপ্রাপ্তির সৌভাগ্য প্রার্থনা করলাম।