তখন কলকাতা থেকে সরাসরি পুরি যাওয়া যেত না। জাহাজে করে যেতে হত কটক । কটক থেকে ট্রেনে পুরী। নবদ্বীপ সমাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতাচার্য্য সিদ্ধ শ্রীল রাধারমণ চরণদাসদেব ভক্তদের নিয়ে চলেছেন পুরীতে । সংখ্যায় তাঁরা ঊনিশ-কুড়ি মূর্তি। জাহাজে বসে একান্ত ভাবে নামাশ্রয়ী সেইসব ভক্তরা নামকীর্তন শুরু করে দিলেন–“ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম, জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম” । ভাবের ভিয়ানে কীর্তনের সুর-তাল নামানন্দের হাট বসালো। সকলে তখন নামে দারুণ ভাবে বিভোলা, মত্ত। জাহাজের অন্যান্য সকল যাত্রীদের মনও কীর্তনকারীদের কীর্তনে মজে ।
হঠাৎ, জাহাজের একজন কর্মচারী এসে বললেন, “আমাদের জাহাজের মালিক
আপনাদের অবিলম্বে এই শোরগোল , হৈ-হট্টগোল বন্ধ করতে বলেছেন। আপনারা গোলমাল না করে শান্ত হয়ে বসুন।”
বড়বাবা অর্থাৎ রাধারমণ চরণদাসদেব বললেন, “আমরা গোলমাল কোথায় করছি, বাবা! তুমি উনাকে গিয়ে বলো ,আমরা তো ভগবানের মঙ্গলময় নাম নিচ্ছি কেবল। কীর্তন করছি।” কর্মচারী একথা জাহাজের সেই মালিককে গিয়ে জানালেন। মালিক অহিন্দু ছিলেন। তাঁর কাছে এই সঙ্কীর্তন অসহ্য বোধ হচ্ছিল আর অস্বস্তির উদ্রেক করছিল। তিনি নিজেই চলে এলেন এবার । এসে বেশ কর্কশ ভাষা প্রয়োগ করেই কীর্তন থামিয়ে দিলেন। সকলে চুপ।
ইতিমধ্যেই শুরু হল সমুদ্রে বিশাল ঝড়, উত্তাল হল তরঙ্গ । এমন ভয়ানক উঁচু উঁচু তরঙ্গ যে জাহাজের মধ্যে আছড়ে পড়ে বসে থাকা যাত্রীদেরও ভিজিয়ে দিচ্ছিল তা। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস ক্রমেই বাড়তে থাকল। মনে হতে লাগলো এইবার বুঝি জাহাজ ডুবলো বলে । আর রক্ষে নেই। স্বভাবতঃই যাত্রীরা সকলে প্রাণভয়ে ভীত হচ্ছিলেন। নির্ভয়ে ছিলেন কেবল বড়বাবা আর তাঁর সাথীরা। কারণ , ভগবানের যাঁরা একান্ত অনুরাগী ভক্ত হন, তাঁরা সকল বিপদকেও ভগবানের দান বলে মনে করেন। তাঁরা জানেন যে , শরণাগত তিনি যাঁর প্রতি, তাঁরই দায় তাঁকে রক্ষা করার বা না করার। অতএব, তিনি যেমন ইচ্ছে তেমন করে রাখুন এবার। তাঁরা কেবল ভগবানের নামকে নির্ভয়ে ,নিশ্চিন্তে , সর্ব সমর্পনের ভাব নিয়ে আশ্রয় করে থাকেন।
যখনই এক-একটা বিরাট জলোচ্ছ্বাস জাহাজের ওপর পড়ে জাহাজ ডোবার উপক্রম হচ্ছিল বড়বাবা অমনি ‘জয় নিত্যানন্দ’ বলে হুঙ্কার করছিলেন । তাঁর শিষ্য-সাথী ভক্তেরাও সমবেত ভাবে ‘জয় নিত্যানন্দ’ বলছিলেন তখন তাঁর সাথে । আর ,অমনি যেন তরঙ্গের আস্ফালন কমছিল একটু। সমুদ্র যেন শান্ত হচ্ছিল । সে বারের মত জাহাজ ডুবছিল না ।
জাহাজের মালিক এবং জাহাজের অন্য যাত্রীরা সকলেই খেয়াল করলেন এই অদ্ভুত ব্যাপার। জাহাজের মালিক তাঁর কর্মচারীকে দিয়ে খবর পাঠালেন যেন আবার কীর্তন শুরু করে দেওয়া হয়। বড়বাবা বললেন, “কেন ,এবার কীর্তনকে গোলমাল বলে মনে হবে না তোমাদের মালিকের !” কর্মচারী গিয়ে সেকথাই জানালেন। মালিক নিজেই আর দেরী না করে হন্তদন্ত হয়ে এলেন । তিনি বেশ বিনয়ের সুরেই বললেন, “বাবাজী, আপনি আবার কীর্তন শুরু করুন। আমি না বুঝে ভালোমন্দ বলে কষ্ট দিয়েছি আপনাদের মনে। আমার কথা মনে না রেখে এই বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় ভাবুন বাবা। দয়া করে কীর্তন শুরু করুন। আর সময় নষ্ট করার সময় নেই যে। আমি ভুল করেছি স্বীকার করছি। ঝড় থেমে গেলে আমি আবার এসে দেখা করবো আপনার সাথে।”
বড়বাবা আবার কীর্তন শুরু করলেন। সকল ভক্তমন্ডলী তো গাইছিলেনই , সাথে জাহাজে অন্য সকল জাতির বা অন্য সম্প্রদায়ের যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও কন্ঠ মিলিয়ে “ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম” গাইতে থাকলেন। যেমনই বাইরে ভয়ানক সমুদ্র ঝড়ের উন্মাদনা , তেমনই ভিতরে সঙ্কীর্তনের উন্মত্ততা জাহাজে তখন।
দীর্ঘ চার ঘন্টা ধরে নাম চললো অবিরাম ভাবে। সমুদ্র শান্ত হল যেন একটু একটু করে সেই কীর্তন শ্রবণ করে । এই চার ঘন্টায় একটা আজব ব্যাপার ঘটলো সেদিন।আর তা হল, সেদিন সমুদ্রের জল এত পরিমাণে জাহাজে ঢুকেছিল যে যাত্রীদের গোড়ালি, হাঁটু,কোমর হয়ে কন্ঠ পর্যন্ত ক্রমে জলে ডুবে গিয়েছিল। অথচ, জাহাজ ডোবেনি। এও কখনো সম্ভব ! অথচ, ঘটেছে। সকলে ভেবেছিল এই বোধহয় এবার জাহাজ ডুবে সলিল সমাধি ঘটে গেল তাঁদের। কিন্তু, বড়বাবার নামের প্রতি অগাধ বিশ্বাস , শ্রদ্ধার পরাকাষ্ঠা জাহাজকে ডুবতে দেয়নি। নামী অর্থাৎ ভগবান যেমন তাঁর ভক্তকে রক্ষা করেন, তেমন নামকে আশ্রয় করলে নামও রক্ষা করবে-এই সুদৃঢ় আস্থা ছিল তাঁর নামের প্রতি। না হলে যে, ‘নাম-নামী এক, অভিন্ন’—এই শাস্ত্রবাক্য মিথ্যা হয়ে যায়। আর, তা তো হতে পারেনা!
জাহাজ এসে ভিড়ল কটকে। বড়বাবা ও তাঁর শিষ্যভক্তরা নেমে গেলেন । তাঁরা এবার কটক থেকে ট্রেনে চেপে রওনা দেবেন পুরীর পথে। জাহাজের মালিক এসে দেখা করে চরণে পড়লেন বড়বাবার। তিনি স্বীকার করলেন যে, সেদিন বোধহয় তাঁকে শাস্তি দিতে , তাঁকে নামের মহিমা শিক্ষা দিতেই ঈশ্বর অমন দুর্যোগের সৃষ্টি করেছিলেন। কীর্তন করা যে শোরগোল বা গোলমাল নয় কোন ,তা সাক্ষাৎ ভগবানকে শব্দব্রক্ষ্ম রূপে অবতরণ করানো তা তিনি সেদিন রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝেছিলেন। সেদিন নিজের ভুল বুঝতে পারা অনুতপ্ত জাহাজের মালিককে দয়াল বড়বাবা অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন ,বলেছিলেন,নাম করতে নিত্য; শিখিয়েছিলেন নাম করা মানে, যিনি যে ইষ্টদেবকে মানেন—দূর্গা, কালি, মহাদেব ,কৃষ্ণ,মহম্মদ, যীশু যাই হোক না কেন , তাঁর নামকেই দৃঢ়ভাবে আশ্রয় করে বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে,প্রেমের সঙ্গে প্রতিদিন অনুক্ষণ নেওয়া।
অধমা রাধাবিনোদিনী দাসীর কবে আর অমন অনুরাগ নামের প্রতি হবে , প্রভু!
কৃপা কর।
—–নম্রানতা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।