মহিলা ঢাকির ঝাঁঝ (ধারাবাহিক উপন্যাস; দ্বিতীয় পর্ব) :: দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
610

ইতিমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ঢাক কাঁধে নিয়ে শিবু বায়েনের ছোট মেয়ে খেমটীর উদয় । সায়নের বাবার সামনে ম্রিয়মান হয়ে খেমটি বললো, “কাকাবাবু, বাবার ভীষণ জ্বর । জ্বরের এতই তীব্রতা যার জন্য বাবা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না । বাবাকে নিয়ে আমি স্থানীয় হাসপাতালে গিয়েছিলাম । ডাক্তার বাবু ঔষধ দেওয়ার পরিবর্তে কতকগুলি রক্ত পরীক্ষা দিয়েছেন । ডাক্তার বাবুর ধারণা, এটা একটা ভাইরাল ফিভার । তাই রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে তিনি রোগের ধরণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হবেন । ডাক্তার বাবুর আরও ধারণা, জ্বর টাইফয়েডে মোড় নিতে পারে । এছাড়া ডাক্তার বাবুর মতে, বাবার হার্টের অবস্থা ভীষণ দুর্বল । একেবারেই ভাল না । সেই কারণে ডাক্তার বাবু বাবাকে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরিতে নিষেধ করেছেন । “এমনকি ঢাক না বাজাতে” ডাক্তার বাবুর কড়া নির্দেশ । সেই কারণে একরকম বাধ্য হয়ে আপনাদের বাড়ির মানত করা কালী পূজায় ঢাক বাজাতে ছুটে এলাম ।
সায়নের বাবা চিন্তান্বিতভাবে মাথা চুলকালেন । তারপর খেমটির দিকে তাকিয়ে সায়নের বাবা বললেন, “তাহলে তোমার ঢাক কে বাজাবে ? ঢাকি কোথায় ? পূজোতে ঢাকের বাদ্যি দরকার !”
ঢাক আমি বাজাবো কাকাবাবু ।
তুমি কী ঢাক বাজাতে পারবে ?
হ্যাঁ কাকাবাবু । আমি খুব ভাল ঢাক বাজাতে জানি । সুতরাং আমিই মায়ের পূজোতে ঢাক বাজাবো ।
তুমি ঢাক বাজানোর ব্যাপারে এত বড়াই করছো, তাহলে তুমি ঢাক বাজানো শিখলে কিভাবে ?
ছোটবেলায় বাবার সাথে বিভিন্ন পূজা মন্ডপে ঢাকের সাথে কাঁসি বাজাতে যেতাম । সেই সময় একনাগাড়ে ঢাক বাজানো থেকে বাবাকে বিরতি দেওয়ার জন্য আমি তখন ঢাক কাঁধে তুলে নিয়ে বাজাতাম । তাছাড়া বাবাও আমাকে বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে ঢাক বাজানো শেখাতেন । বলতে পারেন এইভাবেই ছোটবেলা থেকে ঢাক বাজানো শিখেছি ।
সায়নের বাবা খেমটির কথায় আস্বস্ত হয়ে বললেন, “পূজোয় ঢাক বাজানোর ব্যাপারে তুমি যখন এতটাই নিশ্চিত, তাহলে শিগ্‌গির চলো পূজা মন্ডপে । কেননা ঢাক বাজনা ছাড়া পুরোহিত ঠাকুর মশায় মায়ের পূজা শুরু করতে পারছেন না ।“
সায়ন ও কুহক উভয়েই খেমটির পেছন পেছন পূজা মন্ডপে উপস্থিত । খেমটির কাঁধে ঢাক দেখতে পেয়ে পুরোহিত মশায় হাতের ইশারায় তাঁর কাছে ঢাক নিয়ে যেতে বললেন । কিন্তু ঢাকিকে দেখতে না পেয়ে পুরোহিত মশায় মাসিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঢাক কে বাজাবে ?”
সেই মুহূর্তে খেমটির সপ্রতিভ উত্তর, “কেন ! ঢাক আমিই বাজাবো ।“
“মহিলারা পূজোতে ঢাক বাজায় না । ঢাক বাজানোর জন্য তুমি বরং তোমার বাবাকে পাঠিয়ে দাও ।“
“বাবা ভীষণ অসুস্থ । প্রচন্ড জ্বরের কারণে তার বিছানা ছেড়ে নড়ার ক্ষমতা নেই । এছাড়া হার্টেরও ব্যামো রয়েছে । ডাক্তার বাবু বাবাকে ঢাক বাজাতে নিষেধ করেছেন । তার পক্ষে এখানে এসে ঢাক বাজানো অসম্ভব ! সুতরাং আমিই মায়ের পূজোতে ঢাক বাজাবো । মেয়ে হলেও আমি ঢাক বাজাতে ভীষণ পারদর্শী । একবার ঢাক বাজানো শুনলেই বুঝতে পারবেন, আমার ঢাক বাজানোর মাধুর্য কতো উন্নত !”
ঢাক বাজানো মহিলাদের কাজ নয় । আর তাছাড়া ………।
“আর তাছাড়া কী ঠাকুর মশায় ?” খেমটি জিজ্ঞাসা করলো ।
“মহিলারা কখনও পূজা-অর্চনায় ঢাক-ঢোল বাজায় না । তুমি কী কখনও কোথাও কোনো পূজোতে মেয়েদের ঢাক বাজাতে দেখেছো ? আমি কিন্তু কোথাও দেখিনি ।“ মুখটা গম্ভীর করে পুরোহিত ঠাকুর মশায় কটমট করে খেমটির দিকে তাকালেন ।
বুদ্ধিমান মেয়ে খেমটি । সে ভাবলো, অহেতুক তর্কাতর্কিতে গিয়ে লাভ নেই । তাই অযথা সময় নষ্ট না করে, খেমটি তার বা-কাঁধে ঢাক তুলে নিয়ে ঢাকের কাঠি দিয়ে বাজাতে শুরু করলো । বাজানোর কায়দাও অভিনব । ঢাকের বাজনার আওয়াজে মা-কালীর পূজোর মন্ডপ জমজমাট । উপস্থিত দুই-একজন গ্রামবাসী ঢাক বাজানো প্রশংসা করে বললেন, “বাজনাটা ভীষণ মিষ্টি ।“
খেমটি ছোটবেলায় বাবার ঢাক বাজানোর সাথে কাঁসি বাজাতো । তখন থেকেই তার ঢাক বাজনার তালিম । শিবু বায়েনও তেমনি, মনের আনন্দে মেয়েকে ঢাক বাজানো শেখাতো । সে মনে প্রাণে চাইতো তার মেয়েরা পিতৃ-পুরুষের বাজনাটা ধরে রাখুক । ছোট মেয়ের আগ্রহ দেখে শিবু বায়েন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেয়েকে ঢাকের বোল, তাল, ইত্যাদি শেখাতো । ফলে ঢাক বাজনার তাল, বোল খেমটির নখদর্পণে । ঢাক বাজনা শেখার আগ্রহের নিরিখে খেমটির নিরলস প্রচেষ্টায় অনায়াসে এবং খুব দ্রুত সে ঢাক বাজানো করায়ত্ব করে নিয়েছিলো । ঢাক বাজানোতে কোনোরকম ভুল চোখে পড়লে তার বাবা সেই ভুল শুধরে দিতো । বাবার কাছ থেকেই খেমটি ঢাকের বাজনার বোল, তাল পুরোটাই শিখেছে । বাবার কাছে শিক্ষার ফলে খেমটি এমনকি ঢোল বাজানোতেও ভীষণ পারদর্শী । বাবার দেওয়া প্রশিক্ষণের ফলেই আজ খেমটির ঢাকের বাজনা পুরোটাই করতলগত এবং পূজোর মন্ডপে ঢাক বাজানোতে তার আত্মবিশ্বাস ষোলোআনা ।
খেমটি কলেজে ফাইনাল ইয়ার । বাংলায় সাম্মানিক কোর্সে পাঠরত । এই পর্যন্ত পড়াশুনায় তার রেকর্ড ভাল । তাই সে বড় হয়ে লোকসংস্কৃতির উপর পি-এইচ-ডি করতে চায় । যার জন্য তার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ও পি-এইচ-ডি করার ভীষণ ইচ্ছা । খেমটির নিজের উপর প্রচন্ড আস্থা । শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে ঢাকের বোল, তাল রপ্ত করা তার পক্ষে অনায়াসসাধ্য সম্ভব হয়েছে ।
এই ঢাক পিটিয়ে তৈরি হয় একখানা “বোল বোলা” যন্ত্র । যে ঢাকের মধ্যে গচ্ছিত থাকবে অসংখ্য “জরাপী” বা হাতের জীবন্ত কারুকাজ । “জরাপ” হল ঢাক বাজনার প্রধান অলংকার । যেমন “কুররর কুর” শব্দ । প্রতিটি বাজনা ১৬টি মাত্রায় বাঁধা থাকে । ঢাক বাদ্যে বিভিন্ন দেবদেবীর আনুষ্ঠানিক রকমের ও রাগের উল্লেখ পাওয়া অন্যরকম । কয়েকটি বিখ্যাত বোলের নাম চৌতাল, একতাল, ঘিতাং ঘি, পঞ্চমসোয়ারি, কুয়ালি, ইত্যাদি । পূজোর সময় (দুর্গা, কালী, টুসু, ইত্যাদি) যে তাল বাজানো হয়, বলির সময় আরেক রকম তাল, দেবীর মহাস্নানের প্রাক্কালে বাজানো হয় ললিত রাগ, দেবীর নির্ঝরের সময় বরাড়ী রাগ । ঠাকুর ভোগের সময় বাজানো হয় “বেরাগ” । অপরদিকে বিসর্জনের বোল যেমন ধীর লয়ে তেমনি গম্ভীর । সাধারণত বিসর্জনের পরে ঢাকিদের ঘরে ফেরার পালা । বিশেষ করে শারদোৎসব শেষে বিসর্জনের সময় ঢাকির বোল বাজাতে গিয়ে খেমটির বাবার চোখে জল এসে যেতো । সেই বাজনাও তার করায়ত্ত । তার মধ্যে অন্যতম ঃ
ঢ্যা, ঢ্যানা ঢ্যাগ
ঢ্যা, ঢ্যানা, ঢ্যাগ
ঢ্যা-ঢ্যা-ঢ্যা —– ঢ্যাগ ঢ্যাগ
ঢিনি না কিতা
ঢিনি না কি তা
কুররর ………
পেটে বিদ্যা থাকার সুবাদে খেমটির ঢাক বাজনার তাল বা বোল একদম নিখুঁত । ঢাক বাজানোতে স্বচ্ছন্দ ও যথেষ্ট সাবলীল ।
কিছুক্ষণ ঢাকের বাজনা বাজানোর পর খেমটি বাথরুমে ছুটলো হাত-মুখ-পা ধুতে । মা কালীর পূজোর মন্ডপে ঢাক বাজানো, সুতরাং পরিস্কার পরচ্ছন্ন থাকাটা বাঞ্ছনীয় ।
সায়নের বাবা ঢাকের বাজনা শুনে খুবই খুশী এবং খেমটির উপর ভীষণ প্রীতো । সায়ন ও কুহক ঢাকের বাজনা শুনে স্পষ্টতই উৎফুল্ল । ঠিক সময়ে ঢাকি এসে পৌঁছানোর জন্য তাদের উৎকন্ঠার অবসান । তাদের একটিই চিন্তা, ঢাকের বাজনার সাথে কাঁসি কে বাজাবে ? সেইজন্য সায়ন চিন্তিত, কাঁসি বাজানোর জন্য কাকে নির্ধারিত করা যায় । যদিও সায়ন তাদের গাঁয়ের পরীক্ষিত মালোকে বলে রেখেছে কাঁসি বাজানোর জন্য । তবে তাকে কিছু দক্ষিণা দিতে হবে । কেননা পরীক্ষিত মালো গাঁয়ে অপরের চাষের জমিতে কাজকর্ম করে কোনোরকমে সংসার চালায় । সুতরাং কিছু পয়সা দিলে সেই বেচারা খুশী । গাঁয়ের পরীক্ষিত মালো রাজী হওয়ায় ঢাকের বাজনার সাথে কাঁসি বাজানোর দুশ্চিন্তা সায়নের আপাতত মিটলো ।
সন্ধ্যারাত্রিতে মায়ের পূজোতে বসার সময় যতো এগিয়ে আসছে ততোই সায়নদের বাড়িতে গাঁয়ের আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা বাড়ছে । বেলডাঙ্গার চৌরাস্তা থেকে ত্রিমোহিনী বা আমতলার দিকে এক কিলোমিটার গেলেই সায়নদের গ্রামে যাওয়ার রাস্তার মোড় । মোড় থেকে সোজা দক্ষিণ বরাবর সায়নদের গ্রাম । বর্ধিষ্ণু চাষি পরিবারের বসবাস । গ্রামের শেষ দিকে মুসলমান পাড়া । সায়নদের গাঁয়ের চাষিরা আধুনিক পদ্ধতিতে চাষবাসে অভ্যস্ত । আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে তাঁরা সিদ্ধহস্ত । নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে জমিতে উন্নত মানের চাষের ফলন । সায়নদের নিজেদেরও মাঠে অনেক জমি জায়গা । বলা চলে গাঁয়ের বড় চাষি । তাই সায়নদের বাড়িতে মানত করা কালী পূজোতে গাঁয়ের সমস্ত গ্রামবাসীরা আমন্ত্রিত । এমনকি মুসলমাস পাড়ার বেশ কিছু ঘরও আমন্ত্রিত ।
বাড়ির উঠোনে গাঁয়ের মানুষের উপচে পড়া ভিড় । তাছাড়া রয়েছে বাইরের আত্নীয় স্বজন । মানুষের সমাগমে পুরো বাড়িটাই জমজমাট । পূজো একদিকে আর অন্যদিকে আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত । তাছাড়া খাওয়া-দাওয়া সমানে চলছে । রাত্রি ৯টা । পুরোহিত ব্রাম্মন পূজোয় বসার আগে তাঁর ভীষণ গোসা । তাঁর মুখ গোমড়া । মহিলা ঢাকি পুরোহিত ঠাকুরের একেবারেই না-পসন্দ ! সায়নের মাসিমাকে পুরোহিত ঠাকুর তাঁর অভিযোগের কথা জানিয়েছেন । কিন্তু মাসিমাকে জানানোর পর তাঁর কথায় কাজ হচ্ছে না অবলোকন করে পুরোহিত ঠাকুর সায়নের বাবাকে ডাকলেন ।
“আমাকে ডাক ছিলেন ঠাকুর মশায় ?” সায়নের বাবা খুব দ্রুত পূজা মন্ডপে এসে বিনীতভাবে কড়জোড়ে পুরোহিত ঠাকুর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলেন ।
হ্যাঁ । আপনি আমার পাশে বসুন ।
ঠিক সেই সময় সায়নের মাসিমা হন্তদন্ত হয়ে পূজা মন্ডপে পৌঁছেই কাজের মাসিকে হাঁকলেন । তারপর কাজের মাসি, দীপাকে বললেন, “ঢাকি মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আয় । অনেকক্ষণ আগে বাথরুমে গেছে, এখনও ফিরবার নাম নেই । শিগগির ডাক । পুরোহিত মহাশয় ডাকছেন ।“
সর্বক্ষণের কাজের মাসি, নাম তার দীপা । সে খুব দ্রুতগতিতে বাথরুমে গিয়ে বুঝতে পারলো, প্রাকৃতিক কারণে ঢাকি মেয়েটা অসুস্থ, রজঃস্বলা । তাই তৈরি হতে সময় লাগছে । ব্যাপারটা বোঝার পর একরকম ছুটে এসে দীপা সায়নের মাসির কানে কানে খেমটির শারীরিক পরিস্থিতির কথা জানালো ।
কাজের মাসি দীপার দেওয়া খবরে সায়নের মাসি দৃশ্যতই ক্ষেপে লাল । মহিলা ঢাকির শারীরিক খবরে তিনি যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন । পুরোহিত ঠাকুরের সামনে বসা সায়নের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মেয়েটাকে দিয়ে কিছুতেই ঢাক বাজানো সম্ভব না । প্রাকৃতিক কারণে মেয়েটা এই মুহূর্তে অপবিত্র, অশুচি । সুতরাং অশুচি অবস্থায় কিভাবে বায়েনদের মেয়েটা মায়ের পূজোর ঢাক বাজাবে ! তাকে দিয়ে ঢাক বাজালে সেটা হবে অনাচার ।“
সায়নের মাসির কথা শুনে সায়নের বাবা স্বয়ং ধন্দে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ? ভ্যাবাচ্যাকার ন্যায় এদিক ওদিক তাকাতে থাকলেন । সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর গড়িমসি ?
পুরোহিত ঠাকুর মহাশয় এই সুযোগে সায়নের বাবাকে জোর দিয়ে বললেন, “এই অনাচার মায়ের পূজোতে কখনই কাম্য নয় । পুরুষ মানুষই একমাত্র ঢাকের বাদ্য বাজায় । মেয়েদের দিয়ে পূজোতে ঢাক বাজানো আমি কখনও দেখিনি । আপনি বরং অন্য ঢাকির বন্দোবস্ত করুন । নতুবা আমি পূজোয় বসতে পারছি না । ঘোর অনাচার স্বয়ং মা কালী বরদাস্ত করবেন না । তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা । শান্তির সংসারে সেধে অমঙ্গল ডেকে আনা । আমার অনুরোধ, আপনি সত্বর অন্য ঢাকির ব্যবস্থা করুন ।“
“কিন্তু ঠাকুর মশায়, এত রাত্রিতে আমি অন্য ঢাকি কোথায় পাবো ?” সায়নের বাবা তাঁর অসহায় পরিস্থিতির কথা ব্যক্ত করলেন ।
“তাই বলে অশুচি মেয়েকে দিয়ে তুই আরাধ্য দেবী কালী মায়ের পূজায় ঢাক বাজাবি ?” সায়নের মাসিমা রাগান্বিত সুরে আরও বললেন, “ একেই অজাত-কুজাত । তার উপর ঋতুমতী মহিলা !”
সায়ন খানিকটা ধমকের সুরে বললো, “মাসিমা ! আপনি আবোল-তাবোল কিসব ভুল-ভাল বক্‌ছেন । খেমটি এযুগের শিক্ষিত মেয়ে !”
“রাখ্‌ তোর শিক্ষিত মেয়ে । ভুলে যাস্‌ না, সে নীচু জাতের বায়েনদের মেয়ে । তার উপর রজঃস্বলা । ঘোর অমঙ্গল । যেটা বুঝিস না, সেখানে নাক গলাবি না ।“
উল্টে মাসির ধমকে সায়ন একদম চুপ !
পূজা মন্ডপের ভিতর বাগ্‌বিতন্ডার শোরগোল শুনে আগত আমন্ত্রিত অতিথিরা মন্ডপের সম্মুখে জড়ো হলেন । তাঁদের কৌতুহল, শোরগোলের হেতু কী ?
ততক্ষণে খেমটি বাথ রুমের কাজ সেরে পূজা মন্ডপে এসে তার ঢাক কাঁধে নিয়ে পুরোহিত ঠাকুরের নির্দেশের অপেক্ষায় !
ব্রাম্মণ পুরোহিত চোখ গরম করে খেমটিকে শাসিয়ে বললেন, “তোমার ঢাক বাজানো চলবে না । তোমার বাজানো ঢাকে মায়ের পূজা অসম্ভব । মা কালী স্বয়ং তোমার ঢাকের বাজনার সঙ্গে আমার নৈবেদ্য গ্রহণ করবেন না ।
“পুরোহিত মশায় আপনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে । আমি মায়ের পূজোর ঢাকের বোল জানি । তাছাড়া ঢাক বাজানো আমাদের জীবিকা । আমি ঢাক বাজাতে ভীষন পারদর্শী । আপনার পূজোর সঙ্গে ঢাক বাজানোতে আমার এতটুকু ত্রুটি থাকবে না । ঢাকের তাল ও বোল সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল । সুতরাং “আমি ঢাক বাজালে আপনার পূজোর নৈবেদ্য স্বয়ং মা গ্রহণ করবেন না” এটা ঠিক নয় ।“ খুব অনুনয় বিনয় করে কথাগুলি পুরোহিত মহাশয়কে বললো খেমটি ।
ঢাক বাজানোটা সমস্যা নয় !
“তবে সমস্যাটা কী, একটু খোলসা করে খুলে বলুন প্লীজ ?”
“সেটা বাড়ির কর্তা বলবেন, আমার বলাটা যুক্তিসঙ্গত নয় । কেননা ঢাক বায়না করেছেন বাড়ির কর্তা । সুতরাং তাঁর ডাকে তোমার ঢাক বাজাতে আসা, যা বলার তিনিই বলবেন ।“ পুরোহিত মশায় খেমটিকে আড় চোখে জানালেন ।
খেমটি বুঝতে পারছে, তার ঢাক বাজানোকে কেন্দ্র করে পূজার বাড়িতে ভীষণ অশান্তি এবং অশান্তির মূলে সায়নের একগুঁয়ে মাসিমা । তাঁর সঙ্গে জুটেছেন মায়ের পূজোর পুরোহিত ঠাকুর মশায় ।
এতক্ষণ কুহক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হৈ-হট্টগোল লক্ষ্য করছিলো । তার অবিচল ধারণা, সমস্ত গন্ডগোলের মূলে ঐ পুরোহিত ঠাকুর । তিনি ইচ্ছা করে মায়ের পূজো শুরু করছেন না, আবার অন্যদিকে মহিলা ঢাকিকে তাড়ানোর জন্য মরিয়া । পুরোহিত ঠাকুরের সঙ্গে নেতিবাচক তালে তাল দিচ্ছেন সায়নের মাসিমা স্বয়ং । পুরো ব্যাপারটাই কুহকের কাছে দৃষ্টিকটু । আধুনিক যুগের ধ্যান ধারণায় বেড়ে ওঠা কুহক আর চুপ থাকতে পারলো না । কুহক আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারলো, তার বন্ধু সায়ন সবটা জেনে বুঝেও সম্পূর্ণরুপে নীরব । মহিলা ঢাকির ঢাক বাজানো সঠিক জেনেও, একটি কথাও খেমটির স্বপক্ষে তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না । আজকের ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে এরকম একটা অবাস্তব রজঃস্বলা নারীর শুচি-অশুচি’র কথা অনর্গল সায়নের মাসিমা আওড়ে যাচ্ছেন, সেটা এক কথায় নিন্দনীয় । নিন্দনীয় জেনেও সায়নের মতো ডাক্তারি পড়া সিনিয়র ছাত্র চুপচাপ । গাঁয়ের মানুষগুলি আবার সায়নের মাসিমার দলে । গাঁয়ের মানূষের মতে, যেখানে পুরোহিত ঠাকুর ঢাক বাজানোর ক্ষেত্রে গররাজী, সেখানে ঢাকি মেয়েটার উচিৎ ঢাক বাজানো থেকে বিরত থাকা । কয়েকজন বয়স্কা মহিলা সায়নের মাসিমার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলছেন, “ঢাকি মেয়েটা এই মুহূর্তে অপবিত্র । সুতরাং মায়ের পূজোতে অশুচি মহিলার ঢাক বাজানো পবিত্র পূজাচারে যারপরনাই অমঙ্গলেরই ইঙ্গিত ! মেয়েটার উচিৎ, ঢাক বাজানো বন্ধ রেখে পবিত্র পূজার স্থান থেকে বিদায় নেওয়া !” কুহক দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনার সাক্ষী থেকে যেটা বুঝতে পারছে, খেমটী মেয়েটাই বরং সাহসী । নিজের সিদ্ধান্তে অটল ।
হৈ-হট্টগোল, জল্পনা-কল্পনার মাঝখানে খেমটি কিন্তু ঢাক বাজানো শুরু করে দিয়েছে । তার ঢাক বাজানো সমানে চলছে । তবুও পূজারীর পূজো শুরুতে অনিহা । নিন্দনীয় অথচ নেতিবাচক ঘটনার পরস্পর গতিবিধি অবলোকন করে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে কুহক ব্রাম্মণ পুরোহিত ঠাকুর মশায়কে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কোন্‌ শাস্ত্রের বিধান মোতাবেক মহিলা ঢাকিকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন ? একটু আমাদের বুঝিয়ে বলবেন ?”
আমতা আমতা করে পুরোহিত ঠাকুর মশায় বললেন, “আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি না । মায়ের পূজোতে অপবিত্র মেয়ের ঢাক বাজানো অনুচিত । এটা এক ধরণের অনাচার !”
“অপবিত্র মেয়ে ! আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না । তাকে কিভাবে আপনি অপবিত্র বানাচ্ছেন !” কুহক কৌতুহলি দৃষ্টিতে পুরোহিত ঠাকুরের দিকে তাকালো ।
সঙ্গে সঙ্গে সায়নের মাসিমার গর্জন । তিনি রাগান্বিত সুরে কুহককে লক্ষ্য করে বললেন, “তুমি মেয়েদের ব্যাপারে কতোটুকু বোঝো ? তোমরা শিক্ষিত ছেলেপুলে, এসব তোমাদের বোঝার কথা নয় । ঢাকি মেয়েটা অসুস্থ, ঋতুমতী । তাই অপবিত্র । সে কিভাবে মায়ের পূজোতে ঢাক বাজাবে ? তাই তাকে ঢাক বাজাতে নিষেধ করা হচ্ছে । তাছাড়া আমাদের গ্রামেগঞ্জে মহিলাদের ঢাক বাজানোর প্রথা চালু নেই । বলা চলে পুজা-অর্চনায় পুরুষ ঢাকির ঢাক বাজানো একমাত্র স্বীকৃত ।“
রাত্রিবেলায় বাড়িতে উপস্থিত বাড়ি ভর্তি মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা । কানাঘুষো, ফিসফিসানি । মহিলা ঢাকির কপালে কী ধরণের শনিরদশা সেটা দেখার জন্য মানুষের মধ্যে মৃদু উন্মাদনা । তাই ঘটনার পরিস্থিতির উপর আমন্ত্রিতদের শ্যেনচক্ষু ! গ্রামের মানুষদের ঔৎসুক্য, তাঁরাও দেখতে চান ব্রাম্মণ পুরোহিতের বিধান্‌ কিভাবে কায়েতরা ভাঙ্গে ? গ্রামবাসীরা অতোশতো গভীরে ঢুকতে চান না । তাঁরা পুরোহিত ঠাকুরকে গুরুদেবের মতো ভক্তি করেন । তাই তাঁরা মনে করেন, “মহিলা ঢাকিকে মায়ের পূজোতে ঢাক বাজানোতে নিষেধাজ্ঞা করা শাস্ত্রসম্মত, এটা পুরোহিত ঠাকুরের বিধান্‌ ! সুতরাং সায়নের বাবাকে সেই বিধান মানতে হবে । এযাবৎকাল গ্রামের সমস্ত পূজা-অর্চনায় পুরোহিত ঠাকুর যেভাবে বিধান দিয়েছেন সেভাবেই সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে । সায়নের বাবা পুরোহিতদের বিধান সম্বন্ধে বিলক্ষণ জানেন । সমস্ত কিছু জানা সত্বেও সায়নের বাবা এখন চুপ কেন ? তিনি কী সিদ্ধান্ত নিতে দুর্বল ! সায়নের বাবা তো ব্রাম্মণ নন, কায়েত সম্প্রদায়ের । সুতরাং ব্রাম্মণ পূজারী দিয়ে মায়ের পূজা করাতে তিনি বাধ্য । তাহলে পুরোহিত ঠাকুরের নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে তাঁর এত গড়িমসি কেন ? তিনি কী ঐ অশুচি, অপবিত্র মেয়েকে দিয়েই ঢাক বাজাতে চান ? তাই যদি হয় গ্রামবাসীরাও সায়নের বাবাকে ছেড়ে কথা বলবেন না । এতৎপূর্বে যেটা চলে এসেছে, সেটা সমাজে পরম্পরা । এই পরম্পরাকে সায়নের বাবাকে মান্যতা দিতে হবে । নচেৎ সায়নের বাবাকে পুরোহিতের বিধান ভঙ্গ করার খেসারত গুণতে হবে । সমাজের কাছে মাথা নীচু করে জবাবদিহি করতে হবে ।
তারপর কুহক আরও দেখতে পাচ্ছে, মাসিমার কথার অবাধ্য সায়নের বাবা কিছুতেই হতে পারছেন না । কুহকের স্পষ্ট ধারনা, সায়নের বাবার বুকে সাহস খুব কম । সমস্ত জল্পনার অবসান কাটিয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষের উদ্দেশ্যে কিছুতেই বলতে পারছেন না, “মহিলা ঢাকিই ঢাক বাজাবে । আজকের দিনে ঐসব শুচি-অশুচি- অপবিত্র কথাবার্তা অযৌতিক । কুসংস্কারের নামান্তর । সুতরাং পূজোতে খেমটির ঢাক বাজানো সকল অর্থে যুক্তিযুক্ত, বাঞ্ছনীয় এবং কাম্য ।“
তাই কুহক মাথা উঁচু করে মাসিমাকে উদ্দেশ্যে করে বললো, “আমি ঢাক বাজালে আপনাদের আপত্তি আছে কী ?”
দাঁত বের করে মাসিমার তাচ্ছিল্যভাবে উত্তর, “তুমি কী যে বলো বাছা ! তুমি কেন ঢাক বাজাবে ? তুমি সায়নের বন্ধু । এই বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ অতিথি । তাছাড়া তুমি তো আর বায়েন সম্প্রদায়ের নও !”
“আপনারা মহিলা ঢাকিকে ঢাক বাজাতে না দিলে মায়ের পূজোতে আমিই ঢাক বাজাবো । আমি যে সম্প্রদায়ের হই না কেন, পুরুষ ঢাকি হিসাবে আমার ঢাক বাজানোতে আপনাদের আপত্তি থাকার কথা নয় ?” ঢাক বাজানো প্রসঙ্গে কুহক মাসিমা ও পুরোহিত ঠাকুর মশায়কে উল্টে চাপ দিলো ।
তারপর ………!
তারপর কুহক একরকম খেমটির কাছ থেকে ঢাক ছিনিয়ে নিয়ে বাজাতে শুরু করলো । নীচে শতরঞ্চির উপর ঢাকটা রেখে, দাঁড়িয়ে ঢাকের উপর দিকটা তার পায়ের উপর সাপোর্ট রেখে কাঠি দিয়ে ঢাক বাজাতে শুরু করলো কুহক । সে ঢাকের তাল, বোল কিছুই বোঝে না । ঢাকের কাঠি দিয়ে মনের আনন্দে ঢাক বাজাচ্ছে কুহক । খেমটি প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও ধাতস্থ হয়ে কুহকের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । সে কাকে দেখছে ? তাহলে ঈশ্বরই কী কুহককে তার ত্রাতা হিসাবে পাঠিয়েছে ? কুহক ঢাক বাজানো শুরু না করলে এখানকার গাঁয়ের মানুষ তাকে পূজোর আসর থেকে তাড়িয়ে ছাড়তো । তার অপরাধ — “নীচু ঘরে এবং মেয়ে হয়ে জন্মানো” ! খেমটির ভাবতেই অবাক লাগছে, যেখানে মানুষ জাত-ধর্মের উর্ধে উঠে নিজস্ব গুণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে চাঁদে প্রবেশ করছেন সেখানে এই গ্রামের বর্ধিষ্ণু চাষি মানুষেরা আজও মান্ধাতা আমলেই পড়ে রয়েছেন । কুসংস্কারের আবর্তনের বিপজ্জনক জালে আবন্ধ । সবটাই এখন খেমটির কাছে অদৃষ্ট । এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেনো তার দুচোখ বেয়ে জলের ফোটা নীচে গড়িয়ে পড়লো ।
খেমটির চোখে জল দেখে কুহক বললো, “আর টেনশন নেবেন না । আপনি নির্ভয়ে থাকুন । আপনার অমর্যাদা আমি কিছুতেই হতে দেবো না । গাঁয়ের মানুষের কথায় আপনি ঘাবড়াবেন না । দিন পাল্টাচ্ছে । চারিদিকে সামাজিক পরিবর্তনের ঘনঘটা । অথচ এখানকার গাঁয়ের মানুষ এমনকি পুরোহিত ঠাকুর নিজেদের জেদ বজায় রাখার জন্য আপনার মতো শিক্ষিত মেয়ের উপর অনৈতিক ও অযৌতিক চাপ সৃষ্টি করছেন । এটা নিঃসন্দেহে দৃষ্টিকটু, নিন্দনীয় ও গর্হিত ।“
হাত দুটি জড়ো করে কুহককে ছলছল চোখে খেমটি বললো, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।“
কুহক এগিয়ে গিয়ে খেমটির কাঁধে ঢাক তুলে দিলো ।
খেমটি ঢাক কাঁধে নিয়ে ঢাক বাজাতে শুরু করে দিয়েছে । নেচে নেচে ঢাক বাজিয়ে বোল তুলছে ঃ –

“দাদা বাবু নমস্কার”
“দাদা বাবু নমস্কার”
মহাসমারোহে পূজো চলছে । চারিদিকে শঙ্খধ্বনি, কাঁসর ঘন্টা, মহিলাদের উলু ধ্বনি, পুরোহিত ঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণ, সবমিলিয়ে ভাবগম্ভীর পরিবেশ ।
খেমটির ঢাক বাজানো আর কুহকের কাঁসি বাজানো একটা অভূতপূর্ব মেলবন্ধন । এই দৃশ্য দেখে সায়ন কুহকের দিকে এগিয়ে এসে বললো, “তুই উপস্থিত থাকায় একটা ভদ্রস্থ মীমাংসা ঘটলো । খেমটির উন্নত মানের ঢাকের বাদ্য শুনে প্রতিবাদী মুখ এই মুহূর্তে চুপ ! নতুবা অবস্থা কোথায় দাঁড়াতো একমাত্র ঈশ্বরই জানেন ।“
সায়নের কথা শুনে কুহক হাসলো । তারপর কাঁসি বাজানো ক্ষণিকের জন্য বন্ধ রেখে সায়নকে বললো, “এখনও কিন্তু খেমটির ঢাক বাজানোর ফয়সালা হয়নি । খেমটি মহিলা ঢাকি হিসেবে পূজোতে ঢাক বাজানোর মান্যতা এখনও পায়নি । সুতরাং উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই । শুধু ঘটনা পরম্পরা দেখতে থাক্‌ ।“
সায়নের মাসিমা ঠাকুর মশায়ের পূজোর পাশে বসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগান দিচ্ছেন । বেল-তুলসী পাতা-ধান-দুর্ব্বা, ফল-মিষ্টি-মন্ডা, মায়ের পূজোর কাপড়, আরও অনেক সরঞ্জাম । রাত্রি তখন দুটো । গাঁয়ের মানুষের ভিড় প্রায় শেষ । বাড়ির মানুষগুলি পূজা মন্ডপে বসা । প্রায় প্রত্যেকের চোখে ঘুমের ঝিমুনি । এবার যজ্ঞের পালা । পুরোহিত মশায় যজ্ঞ করার জন্য দশকর্মার দোকানের জিনিসপত্র চেয়ে নিলেন । ঘিয়ের শিশিতে ঘি কম দেখে পুরোহিত ঠাকুরের উস্মা ! আরও পাঁচ শত গ্রাম ঘি দরকার ? অন্যদিকে সায়নের বাবা অতো রাত্রিতে ঘি কোথায় পাবে, সেই চিন্তায় অস্থির ।
হঠাৎ সায়নের মা ঘি পাওয়ার হদিশ দিয়ে বললেন, “গাঁয়ের মুসলমান পাড়ার সেলিম আলির মনোহারি দোকানে ঘি থাকে । সেখানে পাওয়া যেতে পারে ।“
“কিন্তু মা, এত রাত্রিতে সেলিম চাচা কী ঘুম থেকে উঠবেন ?” সায়ন তার মায়ের কাছে জানতে চাইলো ।
তুই গিয়ে পূজোর কথা বললে নিশ্চয়ই সে দোকান খুলে তোকে ঘি দেবে । আর তাছাড়া সন্ধ্যারাত্রিতে সেলিম পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে পূজোর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে এসেছিলো ।
আবার কুহক ও সায়ন মোটর বাইকে ছুটলো সেলিম চাচার দোকান থেকে ঘি কিনে আনতে । তারপর পাঁচশ গ্রামের ঘি কিনে তারা পুরোহিত ঠাকুরকে ধরিয়ে দিলো ।
যজ্ঞ চলছে । যজ্ঞের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে ।
ঠিক ভোর তিনটের সময় মায়ের পূজো শেষ ।
এবার প্রসাদ বিতরণের পালা ।
পুরোহিত ঠাকুর মশায় বললেন, যেহেতু এটা মানসিক কালী পূজা তাই পরেরদিন শাস্ত্রমতে বেলা বারোটার আগে প্রতিমা বিসর্জন দিতে হবে ।
কুহক ঠোটকাটার ন্যায় পুরোহিত ঠাকুর মশায়ের মুখের উপর বলেই ফেললো, “এটা কোন্‌ শাস্ত্রের বিধান, পরেরদিন বিসর্জন দেওয়ার ? মানসিক কালী পূজা রাত্রিতেই পূজা শেষ করে সূর্য উঠার আগেই বিসর্জন দেওয়ার নিয়ম । অথচ আপনি পরেরদিন বেলা বারোটার আগে ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার কথা বলছেন । কোনটা শাস্ত্রসম্মত আর কোনটা মনগড়া প্লীজ বলবেন ?”
পুরোহিত ঠাকুর কুহকের কথা শুনে নীরব রইলেন ।
সারা রাত কুহকের খাওয়া নেই । অন্যদিকে খেমটির খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না । কেননা খেমটি খেতে বসলে গাঁয়ের কেউ তার জাত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে এই ভয়ে খেতে যায়নি । যার জন্য সারা রাত্রি তার না খাওয়া । ভোর চারটের সময় পূজোর প্রসাদের দু-টুকরো ফল খেয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি ।
পূজা শেষ । প্রসাদ বিতরণও শেষ । তখন ভোর চারটে ।
এখন সবাই শুতে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত । পুরোহিত মশায় পূজোর সমস্ত নৈবেদ্য, ফলমূল আর যতোসব নেওয়ার মতো পূজো মন্ডপে ছিলো সবটাই একটা চটের বস্তায় ঢোকালো । তারপর এক গ্লাস দইয়ের সরবত খেয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি । খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন সায়নের বাবার জন্য । তখনও পূজা করা বাবদ দক্ষিণা হাতে এসে পৌঁছায়নি । পরে সায়নের বাবা এসে পুরোহিত মশায়কে কতো টাকা দিলেন সেটা বোঝা যায়নি । তবে ঐ টাকায় পুরোহিত মশায় যে সন্তুষ্ট নন সেটা স্পষ্ট বোঝা গেলো । যার জন্য সায়নের বাবা পুনরায় ঘর থেকে টাকা এনে পুরোহিত মশায়কে দিলেন । ব্রাম্মণ পুরোহিত কড়ায় গন্ডায় নিজের দক্ষিণা বুঝে নিয়ে তাঁর স্কুটির সামনে বস্তাটা রেখে স্থান ত্যাগ করলেন । তারপর যে যার মতো অবশিষ্ট রাত্রি যাপনের জন্য শয়নকক্ষে শুতে গেলেন ।
কুহকের জন্য চিলে-কোঠার ঘরটা বরাদ্দ । সায়নের শোওয়ার অর্থাৎ পড়ার ঘর আলাদা । কুহক শোওয়ার ঘরে পৌঁছে দেখে তার জন্য বিছানা পরিপাটিভাবে সাজানো-গোছানো । পাশের টেবিলে এক গ্লাস জল রাখা । ঘরে লাইট জ্বলছে । পরনের জামা কাপড় খুলতে যাবে এমন সময় কুহকের খেমটির কথা মনে পড়লো । খেমটির কথা মনে পড়তেই কুহক ভাবলো বেচারা ঠিকমতো শোওয়ার জায়গা পেলো কিনা তার খোঁজ নেওয়া দরকার !
নীচে নেমে কুহক সোজা মন্ডপে । মায়ের মন্ডপের সামনের দিক্‌ কাপড় দিয়ে ঢাকা । পাশে মন্ডপ ঘেঁষে নীচে খবরের কাগজ পেতে খেমটি কাঁসির উপরে মাথা রেখে চোখ বুজে রয়েছে আর তার ওড়না দিয়ে পায়ে এবং শরীরের অন্যত্র মশা তাড়াচ্ছে । চারিদিকে সুনসান । উঠোন ফাঁকা । বাড়ির বাইরের লাইট বন্ধ । প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার । একমাত্র মন্ডপের ভিতরে টুনি লাইট জ্বলছে । কিছুক্ষণ আগে যেখানে প্রচুর মানুষের জটলা, সেখানে এখন ভুতুরে বাড়ির ন্যায় অন্ধকার । গা ছমছম অবস্থা । নিরালা, নীরব, নিস্তব্দ অন্ধকারের মধ্যে এক কোনে মন্ডপের পাশে শুয়ে খেমটি চোখ বুজে রয়েছে । তার ঐ করুণ দৃশ্য দেখে কুহক বিচলিত । একটা শিক্ষিত মেয়ে অসহায়ের মতো অন্ধকারের মধ্যে ঘুমোচ্ছে । বায়েনদের মেয়ে হলেও সে একজন মানুষ । সমাজে আর পাঁচটা মেয়ের মতো খেমটিও শিক্ষিত নারী । অথচ প্রাপ্য সম্মান দূরে থাক্‌, অন্তত ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা তার প্রতি থাকা উচিৎ । সায়নদের এইরুপ খেমটির প্রতি নির্দয় আচরণ কুহককে ভীষণভাবে পীড়া দিলো ।
বেচারা তার অসুস্থ বাবার দেওয়া কথার রক্ষার্থে ঢাক কাঁধে নিয়ে সোজা মায়ের পূজোতে ঢাক বাজাতে ছুটে এসেছে । বাড়িতে অসুস্থ বাবার জন্য তার দুশ্চিন্তা অনবরত । তার উপর সায়নদের বাড়িতে তাকে নিয়ে অশান্তির চূড়ান্ত । এইসব কারণে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । অথচ ঠাকুর বিসর্জন পর্যন্ত তাকে থাকতে হবে এবং ঢাক বাজাতে হবে । কেননা ঢাক বাজাবার জন্য শিবু বায়েন বায়না নিয়ে সায়নের বাবার সঙ্গে অগ্রিম চুক্তিবদ্ধ । সুতরাং এই চুক্তি খন্ডানো অসম্ভব । খেমটি তার বাবার দেওয়া কথার মর্যাদা রাখতে ঢাক বাজাতে হাজির । সন্তান হিসাবে খেমটির দায়িত্বের প্রতি কুহক শ্রদ্ধাশীল । অথচ জাত-পাতের জটিল সমস্যার মধ্যে সে আজ যাচ্ছেতাইভাবে নাকানি-চোবানি খেলো । যেটা খুব ধিক্কারজনক ! গ্রামের মানুষের বিশেষ করে মাসিমার নেতিবাচক ন্যক্কারজনক ব্যবহার ইতিপূর্বে খেমটি তার জীবনে পেয়েছে কিনা সেবিষয়ে কুহক রীতিমতো ধন্দে !
কুহক যতোটুকু বুঝেছে তাতে মেয়েটা ভীষণ সোজা ও সরল । তার আচার আচরণ কথাবার্তা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয় । সে যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । কেউ পরিচয় করিয়ে না দিলে, সকলেই তাকে “বড় ঘরের মেয়ে” বলে ভুল করবে ।
“এই খেমটি, ওঠো ।“ আলতো করে খেমটির ঘাড়ে হাত দিয়ে কুহক ডাকলো ।
অন্ধকারে কুহকের ডাকে খেমটি আচমকা হকচকিয়ে গেলো । তারপর চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে দেখে কুহক তার সামনে দাঁড়িয়ে । “আপনি ! ঘুমোতে যাননি ?” খেমটি কুহককে উদ্দেশ্যে করে বললো ।
আমার কথা ছাড়ুন । উঠুন, এবার উঠুন ।
“কেন ? উঠে কোথায় যাবো ?” খেমটি জানতে চাইলো কুহকের কাছে ।
“আপনি আগে উঠুন ।“ জোর দেয় কুহক ।
আমি এখানেই ভাল আছি । অন্য কোথাও গেলে আমাকে নিয়ে আবার আপনার অশান্তি বাড়বে !
অশান্তি বাড়ে বাড়ুক । অশান্তি হতে দিন । এবার দয়া করে উঠুন ।
আচ্ছা মুশকিল ! বলবেন তো, কোথায় ?
“বেশী প্রশ্ন করবেন না । যা বলছি, শুনুন ।“ বলেই কুহক খেমটির ডান হাত ধরে টেনে তুলে তাকে দাঁড় করিয়ে বললো, “এবার চলুন ।“
কোথায় যাবো, সেটা বলবেন তো ?
উপরের ঘরে গিয়ে ঘুমোবেন ।
“আমাকে মাফ্‌ করবেন কুহকদা । ঘরে গিয়ে আমার পক্ষে ঘুমানো অসম্ভব ! এখানেই বাকী রাতটুকু দিব্যি কাটিয়ে দেবো । আপনি খামোকা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ছেন !” খেমটি অনুনয় বিনয় করে কুহককে বোঝাতে চেষ্টা করলো ।
কোনো কথা না শুনে খেমটিকে একরকম জোর করে চিলে-কোঠায় তার জন্য নির্ধারিত শোওয়ার ঘরে নিয়ে কুহক বললো, “এখানে শুয়ে পড়ুন ।“
আমি শুলে আপনি কোথায় ঘুমোবেন ?
আমাকে নিয়ে অতো না ভেবে এবার দয়া করে আপনি ঘুমোন ।
তাই বললে হয় । আপনি সায়নদার বন্ধু । এই বাড়ির বিশেষ মর্যাদার অতিথি । তার ঘুমোবার জায়গা আমি দখল করলে আমার উপর আবার খড়্গহস্ত বর্ষণ হবে ।
দরকার হলে আমি সায়নের ঘরে গিয়ে বাকী রাতটুকু কাটিয়ে দিচ্ছি । এবার কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ুন । আমি এখান থেকে চললাম । আপনি কিন্তু বড্ড ক্লান্ত ।
তারপর দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কুহক লক্ষ্য করলো দরজার সামনে সায়নের মাসিমা দাঁড়িয়ে । আড়ি পেতে তাদের কথোপকথন শুনছিলেন । চোখটা তাঁর বড় বড় । ভীষণ গম্ভীর মুখ । কুহকের দিকে রোষদৃষ্টি । ক্রোধে অগ্নিমূর্তি । চটে লাল । তাঁর শারীরিক ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে, কুহক বিশাল গর্হিত কাজ করেছে ।
“কী ব্যাপার কুহক ?” ধমকের সুরে সায়নের মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন ।
“কোথায়, কী ব্যাপার মাসিমা ?” পাল্টা প্রশ্ন মাসিমাকে ছুড়ে দিলো কুহক ।
বয়স্থা মেয়েকে ঘরে ডেকে এনে ফষ্টিনষ্টি, এসবের অর্থ কী ?
মাসিমা, আপনার বয়স হয়েছে । ছেলের সমতুল্য সায়নের বন্ধুকে কিসব আজেবাজে কথা বলছেন সেটা আপনি অনুধাবন করতে পারছেন তো ?
আমি কী চোখে ভুল দেখলাম ? মেয়েটার হাত ধরে টানাটানি, এটা কী ধরণের অসভ্যতামি ?
মহিলা ঢাকিকে শোওয়ার জন্য কোনো জায়গা দেননি, তাই তাকে ডেকে এনে আমার ঘরে শুতে বললাম ।
অর্থাৎ বয়স্থা মেয়েটা তোমার সঙ্গে শোবে ? ছি ছি । তার প্রতি এতই যখন দরদ, তাহলে আমাদের কাউকে ডেকে তার শোওয়ার বন্দোবস্ত করতে বললে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো ? সেটা করলে তো একসঙ্গে শোওয়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতো, তাই না ?
আপনি আমার মায়ের মতো । দয়া করে খেমটির গায়ে কাদা মাখাবেন না । আপনাদের আন্তরিকতার উপর আমার আস্থা নেই বলে তাকে এই ঘরে ঘুমোতে ডেকেছি ।
আমি এতসব বুঝি না । সায়নের বাবাকে ডাকছি । অজাত-কুজাত মেয়ের সঙ্গে একঘরে শুয়ে ফষ্টিনষ্টি করার সাহস তোমার কোথা থেকে এসেছে, সেটা আমি আজ ভোরবেলাতেই হেস্তনেস্ত করছি । এইসব বন্ধু-বান্ধবদের ঠাঁই দেওয়ার আগে এদের নৈতিক চরিত্র যাচাই করার দরকার ছিলো । নতুবা সমস্ত বদনামটার দায়িত্ব সায়নের বাবার ঘাড়ে বর্তাতো ! কী সর্বনেশে ব্যাপার !
কুহক চিৎকার করে আওয়াজ বাড়িয়ে বললো, “মাসিমা, আপনি আপনার মর্যাদার সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন । আপনার মতো মানুষ এত কুরুচিপূর্ণ হতে পারে আমার ক্ষুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতার বাইরে ! নেহাৎ আপনি সায়নের মাসিমা, নতুবা এর যোগ্য জবাব পেতেন ।
কী করতে বাছা ! এ তো দেখছি চোরের মায়ের বড় গলা !
কী করতাম, প্রয়োজন হলে তার জিভ্‌টা টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম, যাতে জীবনে ভুল করে কাউকে অপমান করার সুযোগ না পায় ।
আমাকে অপমান ! এবার দেখবে কতো ধানে কতো চাল । যুবতি মেয়েকে ডেকে এনে নিজের ঘরে ফূর্তি !
ইতিমধ্যে সায়নের মাসিমার আওয়াজে সায়নের মা কুহকের ঘরে এসে উপস্থিত । কুহকের দিকে তাকিয়ে সায়নের মা শান্ত গলায় জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে বাবা ?”
সায়নের মায়ের প্রশ্নের জবাবে কুহক সমস্ত ঘটনা খুলে বললো, “খেমটি ঐ অন্ধকারে পূজা মন্ডপের পাশে কাঁসির উপর মাথা রেখে ভয়ে চোখ বুজেছিলো । আমি তাকে সেখান থেকে ডেকে এনে আমার ঘরে ঘুমোতে বলে ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছিলাম । এবার বলুন তো আপনি, এতে আমার অপরাধটা কোথায় ? অথচ মাসিমা তিলকে তাল করছেন । আর ……।
আর কী বাবা ?
অরুচিকর কথবার্তা বলছেন, যেটা আমাদের মুখ দিয়ে কস্মিন্‌কালেও বের হবে না । মাসিমার অশ্লীলাত্বক ভাষায় আমি যারপরনাই ব্যথিত ।
তুমি ঠিক কাজ করেছো বাবা ।
সায়নের মায়ের কথা শুনে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে লাফিয়ে উঠেন মাসিমা ! তারপর তার কী তড়পানি ! বাড়িতে আর কোনো লোক ছিলো না নির্লজ্জ বেহায়া বেজাতের মহিলা ঢাকিকে ডেকে আনার । অসৎ উদ্দেশ্যে ছোকড়াটা বয়স্থা মেয়েটাকে নিজের ঘরে ডেকে এনে শোওয়াচ্ছিলো । আসলে ছোকড়ার কুমতলব ধরা পড়ে গেছে, এইজন্য নিজের সাফাই গাইছে । পাছে যাতে ফষ্টিনষ্টিতে বিঘ্ন না ঘটে এইজন্য নিজের বন্ধু সায়নকেও সঙ্গে নেয়নি । এবার সায়নের মায়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিনি আরও বললেন, “এসব বেশরম ছেলে-ছোকড়াদের আমার চেনা আছে । নেহাত তোর ছেলের বন্ধু, নতুবা দুটোকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম ।“
সায়নের মা বিস্মিতভাবে বললেন, “দিদি, তোমার মাথার কী ঠিক আছে ? তুমি কী বলছো সে হুঁশ আছে ?”
ততোক্ষণে গোটা বাড়ির লোকজনের ঘুম ভেঙ্গে গেছে । বাড়ির লোকজন মাসিমার তড়পানি শুনতে চিলে-কোঠার ঘরে এসে উপস্থিত । প্রত্যেকেই ঘটনাটাতে বেশ মজা পাচ্ছিলেন । বিরূপ পরস্থিতি অবলোকন করে সায়ন বিনীত গলায় তার মাকে বললো, “মা তুমি মাসিমাকে নিয়ে ঘরে যাও । নতুবা মাসিমা আরও চিল্লাবেন ! তাতে অশান্তি বাড়বে বই কমবে না ।“
সায়নের কথায় তার মাসিমা সেখান থেকে অন্যত্র বিদায় নিলেন । তারপর উপস্থিত সকলে যে-যার গন্তব্যস্থলে ফিরে গেলেন । এবার সায়ন কুহকের পিঠে হাত দিয়ে বললো, “তুই কিছু মনে করিস্‌ না । মাসিমা সেকেলের মানুষ, তাই অনেক কিছু ভাবছেন । আর তাছাড়া অল্প বয়সে মেসোকে হারানোর জন্য সামান্য কারণে রেগে গিয়ে বেশী বকাঝকার তাঁর বাতিক রয়েছে ।“
“সেকেলের মানুষ বলে তাঁর ক্ষেত্রে সাত খুন মাফ্‌ ! তিনি কিছুতেই বাস্তবটা বুঝতে চান না । প্রচন্ড একগুঁয়ে । তিনি নিজের জেদ বাস্তবায়নে সর্বদা অটল । পরিস্থিতির পর্যালোচনা তাঁর ধাঁচে নেই । ভাল ঘরের মানুষ হওয়া সত্বেও তাঁদের মন কেন এত নীচু ও কুৎসিত, সেটা আমার জানা নেই । প্রতি কথায় খেমটির জাত নিয়ে খোঁটা ! একটা আশ্চর্যের ব্যাপার, মায়ের পূজার সময় তোর মাসিমার নিন্দনীয় আচরণে প্রত্যেক মানুষ চুপ । তাঁদের মুখে কুলুপও আঁটা । অথচ একটা শিক্ষিত মেয়ে তার বাবার কঠিন অসুখের চিন্তায় বিপর্যস্ত । তবুও মায়ের পূজোতে ঢাক বাজনার দায়বদ্ধতার কথা ভেবে কাঁধে ঢাক নিয়ে ছুটে এসেছে । এটা একটা দায়িত্বপরায়নতার নিদর্শন । এটা কেউ ভাবলো না । অথচ অন্যদিকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়মে খেমটি অসুস্থ । অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে তাকে অপবিত্রতার তকমা দেওয়া হোলো ।“
“সায়ন আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস্‌, কেউ একবারও ভেবে দেখলো না, আজকের যুগে মেয়েরা অনেক এগিয়ে । চিন্তা-ভাবনায় অনেক আধুনিক । তাছাড়া মা কালী স্বয়ং নারীজাতির । তাই তাকে অপবিত্র তকমা দেওয়াটা ঠিক নয় । তোর মাসিমাকে বোঝাস্‌, এখনকার শিক্ষিত মেয়েরা হেলাফেলার নয় । তারাও সমাজে সমভাবে মর্যাদাসম্পূর্ণ । জন্মেছে নীচু ঘরে, তাই বলে তার জন্মানোটা কী অপরাধ ?” কথাগুলি একনাগাড়ে বলে কুহক থামলো ।
সায়ন এবার কুহকের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “প্লীজ তুই এবার চুপ কর্‌ । তুই শান্ত হলে সমস্যা মিটে যাবে । বরং বলা চলে ঢাক বাজানোর সমস্যা মিটে গেছে । বাকীটাও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে ।“
সমস্যা কিভাবে ঠিক হবে আমার মাথায় ঢুকছে না । অপমানজনক কথা হজম করে আমার আর তোদের বাড়ি থাকতে ইচ্ছা করছে না । অপ্রিয় হলেও একটা সত্যি কথা বলি কিছু মনে করিস না, “তোর মাসিমার নির্লজ্জ কথাবার্তার সময় তোরা একদম ভেজা বেড়াল হয়ে থাকলি, অন্যায় বুঝেও মুখ ফুটে কিছু বললি না ।“
খেমটি তখন বলে উঠলো, “কুহকদা প্লীজ, আমাকে ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবেন না । দরকার হলে আমি আপনার সঙ্গে ফিরবো । বিসর্জনের বাজনা বাজানো পর্যন্ত আপনি আমার সঙ্গে থাকুন । তারপর দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবো ।“ (চলবে )
———————০——————-
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী, নদীয়া-৭৪১২৩৫ / মো- ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪