আমার কাছে বিজন নামটা শুধু মাত্র অতীত কোন স্মৃতি কথা নয়,বরং অমৃত ব্যথা!আমার কাছে বিজন মানে,অতি চেনা মনে পড়া আজকের লেখা গল্প কথা! আমার তখন বয়স কত ছিল জানি না।আজো স্মৃতির সাথে হিসেব কষেও সঠিক করে বলতে পারব না।
আর সে সময়ে বিজন দাদাকে আামার ছোট্ট চোখে অনেক বড় মন হত।এখন অবশ্য আন্দাজ করে এবং পরিবার থেকে শোনা গল্প থেকে বলতে পারি,বিজন দাদার বয়স চোদ্দ বছরের মত ছিল।ফর্সা ছিপছিপে লম্বাটে গড়নের ছিলো। আজো চোখে আঁকা আছে,সে ভাবেই।বিজন দাদারা অনেক ভাই-বোন ছিল।
বিজন দাদার বাবাকে আমরা সবাই কালাচাঁদ মামা আর বিজনদার মাকে টুকু মাসি বলে ডাকতাম।
প্রতিদিন বিকেলে বাড়ির সামনের প্রকাণ্ড মাঠের মধ্যে পাড়ার অনেক ছেলেমেয়েরা মিলে খেলা খেলতো। একে একে হরেক রকমের খেলা খেলত।চি বুড়ী, গোল্লাছুট, বউ চোর, রুমাল চোর, খটাস,ইচিং বিচিং, কুমির কুমির,যুদ্ধ যুদ্ধ ইত্যাদি। আমি বন্ধ ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ছোট চোখে অবাক করা বড়দের খেলা দেখতাম।আামার মা” ভয় দিয়ে বলতো, বড়দের সাথে খেলতে গিয়ে আমি ব্যথা পাব, নয়তো বাহিরে গেলে ছেলধরা ধরে নিয়ে যাবে।সেই ভয়ে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে বাহির দেখা আর সারাবেলা মা”য়ের শাড়ির আঁচল ধরে ঘুরঘুর করা।এভাবেই সময় কাটতো আমার। তবে আমি সব সময় সব কিছুই উৎসুক মনে নিখুঁত চোখে ধরে রাখতাম।
আমার দিদিরা আর বিজন দাদের সবাইকে স্কুলে যেতে দেখতাম।আমি ভাবতাম বড় হওয়ার কত মজা।বড় হলে কত কিছু করা যায়।আজ অবশ্য বড় হওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করি।আজ বুঝতে পারি বড় হয়ে যাওয়া মানে দুরে সরে যাওয়া আর দুরে সরে যাওয়া মানে পর হয়ে, হারিয়ে কাঁদা!
এমন অবাক আনন্দের অনুভূতির মধ্যেই দিন কাটছিল।প্রতিদিন ঘুম ভাঙতেই আমি বিস্ময়ের একটা করে দারুণ দিন উপহার পেতাম।রাত দিনের রংবেরঙের বিস্ময়ের রহস্যে আমি মুগ্ধমনের দিন কাটাতাম।
হঠাৎ এক সকালে জেগে উঠে দেখি, কেউ স্কুলে যায়নি। কেউ খেলছে না,কেউ হাসছে না।সেদিন নতুন অবাক করা দিন ছিল। বাড়ির সবার মন ভারী। বিজনদাদারা সবাই কাঁদছিল।বড়দের এমন ছবি দেখে,কিছু না বুঝেও আমিও কাঁদতে শুরু করলাম।ছোট বুদ্ধিতে বুঝতে চেষ্টা করে বুঝলাম যে, বড়রা হয়ত ভয় পেয়েছে। সেদিন প্রথম অবাক মনে, নতুন করে বুঝলাম যে,অবাক হরেক রকমের হয়।
নতুন দিনের অবাক করা ভয়ে ভীত চোখে আমি কাঁপতে থাকলাম।বাড়ির সবাই বলতে থাকলো কালাচাঁদ মামার নামে দেশ ছাড়ার উড়ো চিঠি এসেছে। কেউ কেউ বল্ল আজকে সন্ধ্যার মধ্যে দেশ ছাড়ার হুমকির চিঠি এসেছে। তখন আমি সত্যিই দেশ ছাড়ার হুমকি না বুঝলেও উড়ো চিঠির বিষয়টি নিজ মনে সাজিয়ে নিয়ে বুঝেছিলাম.. নিজের মনের মত করে।যেমন আকাশ থেকে উড়ে হয়ত কোন চিল পাখি উড়ে এসে কালাচাঁদ মামাকে ভয় দিয়ে গেছে ,তাকেই হয়ত উড়ো চিঠি বলে।কারণ আমার মা” প্রায়ই বলতো আকাশের দিকে তাকাবে না।তাহলে চিল এসে চোখ তুলে নিয়ে যাবে!এখন অবশ্য সবটা পরিস্কার মিলিয়ে নিতে পারি খুব সহজেই।
এখন হুমকি,ধামকি, ছলনা,কলা,ঘৃণা, চোখর শাসন, নেংরামি সব কিছুই বুঝতে পারি।আসলে বড় হয়ে গেলে চোখটাও যেন অচেনা নোংরাতে ভরে৷ ওঠে।
সেই রাতে আমাদের ঘরে সারি সারি খাবার সাজিয়ে মা” সবাইকে খেতে ডাকছিল। দারুণ মজা হবে, সবাই এক সাথে খাব ভেবে। এমন সময় কালাচাঁদ মামা বুক চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।ভাতের থালা গুলির দিকে তাকিয়ে বল্ল, দেশের ভাতের বরাত উঠে গেছে দিদি।রিক্সা এসে গেছে বিজন, বিমান,ধীমান, বিধান,লাকী, পাখি তোমার সবাই রিক্সাতে উঠে বস।আমাদের রাতের মধ্যেই ওপার যেতে হবে। অর্থাৎ ভারত যাওরার কথা বল ছিল মামা।বাড়ির সবাই মুখ চেপে ধরে কাঁদছিল।যেন কেউ শুনতে না পায়।বিজন দাদা রিকশাতে উঠে বসতেই,কি মনে করে যেন আবার রিক্সা থেকে নেমে, দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।সবাই বিজনদার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলো।
বিজনদা দৌড়ে গিয়ে তার ঘরের পাশে থাকা চুনের বালতিতে বারুন ডুবিয়ে যে ঘরটাতে থাকত, সেই ঘরের দেয়ালে বড় বড় সব অক্ষর লিখে, পুনরায় রিক্সায় গিয়ে বসল।সবাই বলতে লাগলো বিজন নিজের নাম লিখে, স্মৃতি রেখে গেল দেয়াল জুড়ে ।আমার বিস্ময়ে ভাবনা ভাবতে থাকে, এই আঁকিবুঁকির অক্ষর গুলো কিভাবে বিজন দাদা হতে পারে?সেদিন কিছুই আবিষ্কার করতে পারি নাই।
এরপরে রিক্সা গুলি চলতেই টুকুমাসি টুক করে নিচে পড়ে গেল।সবাই কাছে গিয়ে বল্লো, দাঁত লেগে গেছে তাই চোখে মুখে জল দিতে হবে। কালাচাঁদ মামা বল্লো, জলের দরকার নাই। কারণ হাতে সময় খুব কম।হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বল্ল, উড়ো চিঠির নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ত্যাগ করতেই হবে।তাই অজ্ঞান অবস্থাতেই টেনে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলো।অন্ধকারে রিক্সা মিলিয়ে যেতেই আমি শব্দ করে মা”কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলান।জানি না সেদিন ভয়ে নাকি স্বজন হারানোর ব্যথায় কেঁদেছিলাম ।তবে আজ মনে হয় পরম আত্মীয় হারানোর যন্ত্রণাতেই কেঁদেছিলাম।কখনো মন হয় নাই বা আজো মন হয় না যে,তারা আমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিল। আপন পরের হিসাবের সম্পর্ক ছিল না।আত্মার আত্মীয় ছিল সবাই।
বিজন দাদাদের বিদায়ের পরদিন আমি ” বিজন ” লেখা দেয়ালটার কাছে খুঁজতে থাকি তাদের সবাইকে।আমি তখনো জোড়া শব্দ শিখি নাই অথচ কয়েক দিনের ব্যবধানে আমি ” বিজন ” শব্দটা শিখে নিলাম।এটা ছিল আামার বিস্ময়কর আবিস্কারের বিশাল বিজয়!
এরপর সময়ে সাথে হাত মিলিয়ে আমি বড় হতে লাগলাম। একসময় আমি কিশোরী রং মেখে কিশোরী হলাম।আমি কিশোরী হতেই ” বিজন” দাদাদের ঘরে কয়েকবার নতুন ভাড়াটিয়া এলো এবং গেলো।এদিকে দেওয়াটা ঢেকে দেওয়ার শেওলার জোর চেষ্টা চলছিল।আমার মেয়ে বেলার মনের পরিবর্তনও জোর গতিতে পরিবর্তীত হচ্ছিল। আমার রং বদলের রদবদলের ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছিলাম ঠিকই কিন্তু “বিজন” দাদাদের কাউকেই তখনও ভুলি নাই বা আজো ভুলি নাই।
আমি প্রায়ই শেওলা-ছাতার ঢাকা দেওয়ালের ” বিজন” লেখা আবছায়া নামটার দিকে তাকিয়ে কালাচাঁদ মামা,টুকু মাসিদের সবাইকে দেখতে পেতাম।
এরপর একদিন নতুন ভাড়াটিয়া আসবে বলে পুরাতন দেয়াল রং করার দরকার। তাই বাবা রং মিস্ত্রি ডেকে দেয়াল রং করাতে ব্যস্ত।আমিও বাবার সাথে সাথে রং করা তদারকি করছিলাম। সারা দেয়াল রং করা শেষে ” বিজন ” নাম লেখা অক্ষরটার কাছে মিস্ত্রি আসতেই, আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম।বাবা অবাক হয়ে আমার হঠাৎ কান্নার কারণ জানতে চাইলো।আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, বাবা ” বিজন ” দাদা মুছে যাবে! সেদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা কি বুঝেছিল জানি না।তবে বাবা রং মিস্ত্রিকে বলেছিল,আর দেয়াল রং না করতে। বরং ” বিজন ” নামের অক্ষর গুলি নতুন করে রং তুলি দিয়ে স্পষ্ট করে লিখে দিল।
আজ বহু বছর পড়ে ব্যস্ততার মাঝেও অনেক লেখার ভীড়ে মনে পড়ে গেলো সেই ” বিজন দাদাদের”! যদিও আমার লেখা গল্প, উপন্যাস বা কবিতায়, বিজন,বিমান, ধীমান, বিধান,লাকী, পাখি নামে অনেক চরিত্রের নাম রেখে থাকি,তাদেরকে মনে করে।
জানি না এই জীবনে আার দেখা হবে কি না। তবে সেই ছোট্ট রানু নামের শিশুটিকে হয়ত মনে করে ধরে রেখেছে নয়তো বিস্মৃতিতেই হারিয়ে ফেলেছে। যদিও মনে পড়ে বা মনের কোণে স্মৃতিকণা মত কিছু অকস্মাৎ থেকে থাকে, তবুও কোন মনে পড়ার গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কোন চরিত্র নই।কেবলই স্মৃতির গল্পের হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু মুখের স্মৃতি চিহ্নের ছবি চরিত্র মাত্র।
কেউ কখনোই জানবে না,সেই শিশু মনের অন্তরের অনুভূতি গুলো ছিল,অনক বড়দের থেকেও অনেক বেশি বিস্তৃত।
যে স্মৃতি কথা অমৃত ব্যথা মনে.. আজও বহন করে চলেছে ” সুরভি জাহাঙ্গীর ” নামে।
( ঢাকা / বাংলাদেশে)