বড় গূঢ় নিত্যানন্দ এই অবতারে(পর্ব-২) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
514

শিশুকাল থেকেই কুবের সুস্থির, সুবুদ্ধি পরায়ণ ও পরম গুণবান। কোটি কন্দর্পের লাবণ্যকেও তাঁর লাবণ্যের সীমার কাছে পরাজিত হতে হয় , এমনই দিব্য , মনোহর অঙ্গসৌষ্ঠব কুবেরের। যখন থেকে তাঁর আবির্ভাব হয়েছে এই একচক্রায় তখন থেকেই সেখানে সর্বদিকে সুমঙ্গল সব চিহ্ন। দুর্ভিক্ষ , খরা আর হয় না , সব যেন অপহৃত হয়ে গেছে কোন অজানা দৈবী শক্তির অলৌকিক অঙ্গুলীহেলনে । দারিদ্রতা দূরীভূত হল। গৃহে গৃহে অদ্ভুত এক শান্তির, সুখময় বাতাবরণ। স্বভাবতঃই গ্রামবাসীর মনে আনন্দের অনুরণন । প্রশান্তির পারাবারের উচ্ছ্বাস। উৎসবের কলকাকলি।

যেদিন নবদ্বীপ ধামে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু অবতীর্ণ হলেন সেদিন অর্থাৎ ১৪৮৬খ্রিষ্টাব্দের ১৮ইফেব্রুয়ারী, শনিবার, সন্ধ্যা প্রায় ছ’টা নাগাদ রাঢ়ের একচক্রা থেকে কুবের প্রচন্ড এক হুঙ্কার করে উঠেছিলেন । সে হুঙ্কারের তীব্রতা, প্রাবল্য এমনই জোড়ালো ছিল যে সমগ্র ব্রহ্মান্ডকে ব্যপ্ত করেছিল তা যেন । ত্রিলোক সে হুঙ্কারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে সমাচ্ছন্ন হয়েছিল। সমগ্র সংসার যেন মূর্ছা যাওয়ার মত কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কতজন ভাবলেন বুঝিবা বজ্রপাত হয়েছে কোথাও। কত লোক অকস্মাৎ ঘটা কোন উৎপাত ভাবলেন। একচক্রায় কেউ কেউ আবার অনুমান করে নিলেন যে নিশ্চয় গৌড়েশ্বর গোসাঞির গর্জন এ। এভাবে নানান লোক নানান কথা কইতে থাকলেন। কিন্তু, কেউ এটা বুঝলেন না যে, তাঁদের নয়ননিধি কুবেরের কান্ড ছিল তা। কেবল তাঁর পিতামাতা হাড়াই ওঝা আর পদ্মাবতীদেবী আশ্চর্য হয়েছিলেন পুত্রের অমন অদ্ভুত আচরণে। কুবের যে কোন সাধারণ বালক নন তা কারোর মাথাতেই এল না। মায়ার খেলা দ্বারা নিজের ভগবত্তাকে গোপন করে রাখলেন নিত্যানন্দ।

স্বয়ং বললাম অবতীর্ণ হয়েছেন অবনী মাঝে, অতএব তাঁর যা কিছু ব্যবহারিক লীলা সব যে আর পাঁচজন সাধারণের মত হবে না , হবে অন্যরকম, অন্য মাত্রার , অন্য অলৌকিক , অপার্থিব ঘরাণার–তাতে আর আশ্চর্য কী! আর তাইতো, শিশুকালের যা কিছু শিশুসুলভ আচরণ কুবেরের সেগুলিও ছিল অবাক করার মতন, অবিশ্বাস্য। অদ্ভুত সব খেলা খেলতেন কুবের। শিশুরা যেসব খেলা সাধারণতঃ খেলে সেগুলো কিন্তু খেলতেন না কখনোই। কখনো অন্য সব শিশুদের নিয়ে দেবসভা করতেন। পুঁথি নিয়ে কখনো নদীর ধারে সকলে মিলিত হতেন। তারপর স্ততি পাঠ করতেন আর কোন একজন শিশু সেই স্তুতিতে তুষ্ট হয়ে আড়াল থেকে বলতেন, এবার আমি জন্ম নিতে চলেছি মথুরা-গোকুলে। কোনদিন সন্ধ্যাকালে সকল শিশুবন্ধুদের নিয়ে বসুদেব-দৈবকীর বিবাহ লীলা খেলা খেলতেন। তারপর তাদেরকে বন্দী করিয়ে কৃষ্ণজন্ম করাতেন মিথ্যা কারাগারের মধ্যে। দেবী মহামায়া কংসের সঙ্গে যে মায়াচারণ করেছিলেন সেটিরও অভিনয় করতেন। কখনো বা কোন শিশু পুতনা হতেন। শিশু শ্রীকৃষ্ণ যেভাবে পুতনার বক্ষের ওপর পড়ে বধ করেছিলেন তাঁকে সেসব খেলাচ্ছলে অভিনয় করতেন কুবের তাঁর বান্ধবদের সঙ্গে। আবার কখনো শকট দ্বারা তৃণাবর্তাসুর বধলীলা, কখনো অঘাসুর বধলীলা, কখনো বকাসুর বধলীলা বা গোপসখাদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মাখনচুরি লীলা, তালবনে ধেনুকাসুর বধলীলা ইত্যাদি সব কৃষ্ণলীলা নিজের খেলার বিষয় করতেন। কখনো পাতার সর্প বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কালিয়দমন লীলা করতেন। শিশুবান্ধবদের নিয়ে গোষ্ঠে গমন করে শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলাও করতেন। আবার বিকেল হলে শিঙ্গা বাজাতে বাজাতে গোষ্ঠ থেকে গৃহে ফেরৎ আসার লীলাও চলতো । কোনদিন শ্রীকৃষ্ণের এক আঙ্গুলে গোবর্দ্ধন ধারণ লীলা খেলতেন। মাঝে মধ্যে গোপিনীদের বস্ত্রহরণ লীলাও হত। যজ্ঞপত্নীদের থেকে অন্ন চেয়ে আনবার লীলা, কংসের নির্দেশে অক্রুর দ্বারা কৃষ্ণ-বলরামকে মথুরা নিয়ে যাবার লীলা—ইত্যাদি সব ব্রজলীলা খেলাচ্ছলে করতেন কুবের তাঁর শিশু বন্ধুদের নিয়ে। যখন গোপীভাব নিয়ে কুবের ক্রন্দন করতেন তখন তাঁর ক্রন্দনের জলে নদী বয়ে যেত। অন্যান্য শিশুরা তা দেখতেন , কিন্তু , বিষ্ণুমায়ায় মোহিত হয়ে বুঝে উঠতে পারতেন না যে কী হয়ে চলেছে। তাঁরা মহানন্দে বিহার করতেন কুবেরের সাথে। আবার , মধুপুরী বানিয়ে শিশুদের নিয়ে ভ্রমণ করতেন কুবের। কেউ হতেন মালী , তাঁর থেকে মালা নিয়ে কেউ পরতেন, কেউ বা কুব্জা বেশ ধরে সুগন্ধী-চন্দন পরিয়ে দিতেন অপরকে। কখনো ধনুক ভঙ্গ করে গর্জন করে কুবলয় , চানুর-মুষ্টিক বধলীলা করতেন ক্রীড়াচ্ছলে । আবার কখনো একজন শিশু , অপর শিশুর কেশ আকর্ষণ করে ভূমিতে ফেলে কংসবধ অভিনয় করতেন। তখন অন্য শিশুরা কংস বধ হবার দরুণ আনন্দে নৃত্য করতে থাকতেন । আর , তাঁদের সেসব রঙ্গ দেখে গ্রামের বড়রা হাসতেন। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ অবতারে, শ্রীরাম অবতারে, বামন অবতারে , নৃসিংহ অবতারে ইত্যাদি সবে যত যত লীলা সব অভিনয় করে খেলা করতেন কুবের ও তাঁর সাথীরা। গুরুজনরা সকলে বিস্মিত হয়ে যেতেন এটা ভেবে যে এইটুক শিশুরা এত এত পুরাণ লীলা জানলো কেমন করে, কোথা থেকে ! আশ্চর্য! কখনো তো তাঁরা এসব পুরাণ কাহিনী গল্পচ্ছলে বলেননি তাঁদের সন্তানকে বা কোথাও কোন যাত্রাপালাতেও এমন করে অভিনীত হয়নি। আর , হলেও বা, এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে রাখা সম্ভব নাকি এটুকু শিশুবালকদের ! তাই তাঁরা জানতে চাইতেন নিজেদের সন্তানের কাছে যে এমন সব খেলা কোথায় শিখলো তারা। শিশুরা সকলেই উত্তর দিতেন একবাক্যে যে , কুবেরই শিখিয়েছেন এসব খেলা।

দিন কাটতে থাকলো। একরাতে এক সন্ন্যাসী স্বপ্ন দেখলেন যে শ্রীবলরাম তাঁকে বলছেন– “আমি একচক্রায় হাড়াই পন্ডিতের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার নাম কুবের এখন। তুমি তার গৃহে যাও। তোমায় একটা মন্ত্র বলে দিচ্ছি। তুমি দীক্ষা প্রদানের ছলে সেই মন্ত্রই আমার কানে দেবে আর সন্ন্যাসের প্রদানের পরে আমার নাম রাখবে নিত্যানন্দ অবধূত।” নিদ্রাভঙ্গ হল সন্ন্যাসীর । অনুধাবন করতে অসুবিধা হল না যে, এ নিছক এক স্বপ্ন নয়। প্রকৃতই দৈবাদেশ। পরদিনই তিনি রওনা হয়ে গেলেন রাঢ়বঙ্গের লালমাটির দেশ বীরভূমের উদ্দেশ্যে।
একচক্রা গ্রাম। একচক্রা জেলা বীরভূমে। বর্তমান নাম বীরচন্দ্রপুর। একালে একচক্রায় যেতে হলে হাওড়া অথবা ব্যান্ডেল অথবা আসানসোল মেইন লাইনে খানা জংশন প্রথমে ‌। তারপর খানা-নলহাটী রেলপথে আহম্মদপুর নলহাটির মধ্যবর্তী সাঁইথিয়া বা রামপুরহাট ষ্টেশন দুটির যে কোনটিতে নেমে বাসে সেখান থেকে বীরচন্দ্রপুর এসে ৪/৫ মিনিটের হাঁটা পথ এলেই নিত্যানন্দ জন্মস্থানে পৌঁছানো যায়।
একচক্রায় এসে লোকমুখে হাড়াই ওঝার গৃহের সন্ধান করে বের করলেন সন্ন্যাসী। দ্বারে এসে দাঁড়াতেই তাঁকে দর্শন করে হাড়াই ওঝা পরম সমাদরে আসন গ্রহণ করালেন। চরণ ধৌত করিয়ে দিলেন। আর তারপর অনুরোধ করলেন যেন সেদিন মধ্যাহ্নে তাঁর গৃহেই ভিক্ষা নির্বাহন করেন সন্ন্যাসী। সেই উদ্দেশ্যেই তো আসা সেখানে সন্ন্যাসীর । তাই এককথাতেই ভিক্ষা অঙ্গীকার করলেন তিনি।হাড়াই ওঝার অতিথি হলেন। হাড়াই ওঝা ও তাঁর পত্নী পদ্মাবতী সন্ন্যাসীর যথাসাধ্য সেবা করলেন। সেরাত্রে সেখানেই বাস করে পরদিন প্রভাতে বিদায় বেলায় সন্ন্যাসী পূর্বপরিকল্পিত মতন বলে বসলেন, “এবার আমায় ভিক্ষা প্রদান করো। আমি ভিক্ষা গ্রহণ করে গমন করি এখান থেকে। ”
হাড়াই ওঝা–“হ্যাঁ, বাবা বলেন, কী ভিক্ষা প্রদান করবো আপনাকে ? কী পেলে আপনি প্রসন্ন হবেন?”
সন্ন্যাসী–” বেশ, তবে যা চাইবো তাই দেবে তো?”
হাড়াই ওঝা–” হ্যাঁ, বাবা । অবশ্যই । যদি আমার সে বস্তু দেবার মত ক্ষমতা থেকে থাকে , আমি আপনাকে বিমুখ করবো না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।”
সন্ন্যাসী–“বেশ। খুশি হলাম তোমার সেবাপরায়ণ মনোভাব দেখে। আমি তাহলে তোমার এই জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকেই ভিক্ষারূপে চেয়ে নিচ্ছি। ভারততীর্থ ভ্রমণে বের হব আমি। একজন সঙ্গী-সেবক প্রয়োজন। বয়স হচ্ছে দেখে আর একা বের হতে সাহস পাচ্ছি না। তোমার পুত্রকে তাই চেয়ে নিচ্ছি।”
হাড়াই ওঝার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল অকস্মাৎ। হায় ! হায়! তাঁর প্রাণও যদি সেসময় ভিক্ষায় চাইতেন সন্ন্যাসী তাতেও বোধকরি আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কিন্তু, প্রাণনিধি পুত্র কুবেরকে ছেড়ে বাঁচবেন কেমন করে তিনি! একথা শোনার পূর্বে তাঁর প্রাণ কেন চলে গেল না ! নিঃশ্বাস কেন থেমে গেল না! এত নিষ্ঠুর বিধি! না,না, পুত্র কুবেরকে তিনি কোনমতেই সমর্পন করে দিতে পারবেন না ! কিছুতেই নয়!

——(ক্রমশঃ)
ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক