রাজরাণীর মতো লাগছিল মিতিল কে! অপলকে দেখছিলেন নীলিমেশ। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে। অবশ্য রাজরাণীদের কেমন দেখতে হতো বা হয় সে সম্বন্ধে খুব যে জানেন নীলিমেশ তা নয়। কারণ তিনি কখনো কোনো রাজরাণীকে স্বচক্ষে দেখেননি!দেখার কথাও ছিল না! কিন্তু গল্প , উপন্যাস পড়তে গিয়ে দেখেছেন ওই উপমাটা খুব ব্যবহার হয় এই রকম ধরণের সৌন্দর্য কে বর্ণনা করতে গিয়ে।
কণের সাজে মিতিল । একটা লাল বেনারসি আর মানানসই গয়না আর সাজে যেন অপার্থিব লাগছিলো এতো দিনের চেনা মেয়েটাকে।একটু আড়ালেই দাঁড়িয়েছিলেন নীলিমেশ । মিতিল যেন তাঁকে দেখতে না পায় এরকম একটা জায়গা করে। কারণ দেখতে পেলেই মেয়েটা কাছে ডাকছিলো তাঁকে । আর সেই কাছে যাওয়া টুকুতেই বড়ো সঙ্কোচ নীলিমেশের।
মিতিল, যার পোশাকি নাম সুধন্যা , নীলিমেশের ভাগ্নি। না, নিজের ভাগ্নি নয়। নীলিমেশের খুড়তুতো বোন অপরুপার মেয়ে মিতিল।অপরুপা বছর কয়েকের ছোটো প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই নীলিমেশের চেয়ে।
নীলিমেশের বাবারা ছিলেন তিন ভাই।নীলিমেশের বাবা ছিলেন মেজো।আর অপরুপার বাবা বীতশোক ছিলেন ছোটো । স্ত্রী, তিন ছেলে আর দুই মেয়ে কে রেখে অনেক অনেক দিন আগেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন বীতশোক । স্ত্রী সূধা ও গেছেন বেশ কয়েক বছর । বীতশোকের তিন ছেলে এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। বিশাল ব্যবসা তাদের । এবং হাজার টানাপোড়েনের পরেও তারা তিন ভাই একসাথেই থাকে। এবং দুই বোন শতরুপা আর অপরুপার সাথে খুব মিলমিশ তাদের দাদা_ ভাইদের।
নীলিমেশের বাবা ছিলেন খুব সাধারণ একজন সরকারী চাকুরে। তাঁর ছেলেরা ও কেউই কেউকেটা কিছু হয়নি। কোনো রকমে চলে যায় তাদের দুই ভাইয়ের।
খুব ছোটো একটা ঘটনা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়েছিল নীলিমেশের সঙ্গে তাঁর খুড়তুতো ভাইদের । আস্তে আস্তে ফাটল আরো বেড়েছে ভুল বোঝাবুঝির। চিরকাল ই কিছু মানুষ থাকে আমাদের চারপাশে যারা এইসব ঘটনা কে বড়ো সুস্বাদু ভেবে তাড়িয়ে , তাড়িয়ে চেটেপুটে উপভোগ করে। এবং ইন্ধন ও জোগায় তারা সুযোগ পেলেই।তারা তাদের নিজেদের কাজ টুকু খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করায় নীলিমেশ আর অপরুপার তিন দাদার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়ে যায় একসময় । চাকরির সূত্রে বাইরে থাকেন নীলিমেশ। তাই খুড়তুতো ভাইদের সাথে ভুল বোঝাবুঝির কথা ছিল না নীলিমেশের।কারণ তারা থাকেন নীলিমিশের জন্মভিটেতে, তার গ্রামেতে। নীলিমেশের বড়ো দাদা সুকেশের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক তাদের । মানে , যেমনটা থাকার কথা আর কি!
অপরুপা তার স্বামী অনিত কে নিয়ে গিয়েছিল নীলিমেশের রাজপুরের ভাড়া বাড়িতে। অপরুপার সাথে চিরকাল ই ভালো যোগাযোগ ছিল নীলিমেশের এবং তার স্বামী অনিত ও বরাবরই সম্মান করে এসেছে নীলিমেশ কে । অনিত হয়তো বয়সে দু তিন বছরের বড়ো ই হবে নীলিমেশের থেকে কিন্তু সম্পর্কের খাতিরে তাকে ‘ ছোড়দা’ বলেই ডাকে । যেমনটা অপরুপা ও ডাকে। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে গিয়ে অনিত সোজাসুজি বলেছিল
” দেখুন ছোড়দা এটা আমার মেয়ের বিয়ে আর আমার সাথে আপনার কোনো দিন কোনো বিরোধ ছিল না। আমার বৌয়ের দাদাদের সাথে আমাকে কেন গুলিয়ে ফেলছেন? ”
একটু আপত্তির সুর তুলতে গিয়েছিলেন নীলিমেশ । কিন্তু তাঁকে থামিয়ে আবার ও বলে উঠেছিল অনিত ।
” আর তাছাড়া এটা মিতিলের বিয়ে । সেই মিতিল যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসে । নিজের মামারা আপনাকে একদম ই দেখতে পারেনা জেনেও সেই ভালোবাসা টুকুর প্রকাশ দেখাতে যে কখনো পিছপা হয়নি।”
” অনিত ঠিক বলেছে ছোড়দা । আমি বা অনিত হয়তো কখনো কখনো তোকে এড়িয়ে গেছি , তোর সাথে ভালো করে কথা বলিনি।পাছে বড়দা ছোড়দা বা বিশু রাগ করে সেই ভয়ে। কিন্তু মিতিল! সে তো কখনো তার ভালো মামা কে এড়িয়ে যায়নি ছোড়দা । কখনো না। ”
স্বামীর কথার সুর ধরে বলেছিল অপরুপা।
খুব সুদৃশ্য কার্ড টা নীলিমেশের হাতে তুলে দিয়েছিল অনিত আর বলেছিল ।
“শেষ সিদ্ধান্ত টা একদম আপনার হাতেই ছোড়দা । আপনাকে ই ঠিক করতে হবে যে এই সব বড়োদের লড়াইয়ের মধ্যে আপনি আপনার স্নেহের মিতিল কে টানবেন কিনা! বল আপনার কোর্টে”
খুব টানাপোড়েনের মধ্যে কটা দিন কাটিয়েছেন নীলিমেশ । স্ত্রী তৃণা ও ঠিক অনিতের সুরেই কথা বলেছিল । বলেছিল যারা তোমার সাথে আদৌ কথা বলেনা , দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় সেখানে তুমি যাবে কিনা সে সিদ্ধান্ত একান্তই তোমার । তবে এটাও ঠিক যে মিতিল তোমাকে খুব ভালোবাসে। এইসব লড়াইয়ের শিকার কি ওকেও হতে দেবে তুমি ?
ছেলে শাক্য যে যাবে না সেটা ঠিক ছিল । তৃণার যাবার ইচ্ছা থাকলেও শরীর খারাপ থাকায় সে ও যেতে পারলো না । মনের মধ্যে থাকা একরাশ দ্বিধা দ্বন্দ্ব সরিয়ে শেষ পর্যন্ত বাসে চেপেই বসলেন নীলিমেশ। মিতিলের বিয়েতে যাবার জন্য।
এবং যাবার ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ই নীলিমেশের মনে হচ্ছিল যে তাঁর আসাটা ঠিক হয়নি ।খুড়তুতো দাদা বা ভাইরা কথা বলছে ই না প্রায় । বৌরাও না বলার ই মতো। এমন কি অনেক ছোটো ভাইপো _ ভাইঝি রাও তাঁকে দেখে সপাটে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। মেয়ের বিয়ের দিনে যতোটা সময় দেওয়া যায় দিচ্ছিলো অনিত আর অপরুপা। মিতিল কে এসে থেকে দেখতে পাননি নীলিমেশ। পার্লার থেকে সাজাতে এসেছে তাকে ।
বিকেল থেকেই লোকের আনাগোনা বাড়তে লাগলো আর তার সঙ্গে নীলিমেশের বিড়ম্বনা ও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে । কারণ নিয়ন্ত্রিত রা বেশিরভাগ ই তাঁর অচেনা । যারা চেনা তারা এড়িয়ে যাচ্ছে ! নিজের দাদা , বৌদি আর ভাইপো ই শুধু সম্বল তখন নীলিমেশের।
সাজিয়ে গুজিয়ে বিরাট একটা সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল মিতিল কে। অপলকে মেয়েটাকে দেখছিলেন নীলিমেশ । এতোদিনের চেনা মেয়েটাকে অচেনা লাগছিলো তাঁর।এই সেই মিতিল! ছোটো বেলায় তাঁর সাইকেল চাপলে আর নামতে চাইতো না। ইংরেজি তে tense ব্যাপারটা নিয়ে বরাবরই ঝামেলায় থাকতো মিতিল আর মামার বাড়িতে এলেই ” ভালো মামার” আশ্রয় নিতো।
” ভালো মামা” ! এই নামেই বরাবর নীলিমেশ কে ডেকেছে মিতিল । আরেকটু বড়ো হয়ে প্রায় ই জানতে চাইতো
” ভালো মামা , এর মধ্যে কি ভালো কিছু পড়লে ? প্লিজ , একটু আপডেট দাও। তোমার ওই ইন্দুবালা ভাতের হোটেল টা অসাধারন ছিল । বহুদিন অমন লেখা পড়িনি।”
মাঝে মাঝে ই অভিযোগ ও করতো মিতিল
” ভালো মামা, তোমার মূল সমস্যা টা কি জানো? তুমি সবার কাছে ভালো থাকতে চাও আর সেটা করতে গিয়ে কারোর কাছে ই ভালো থাকতে পারো না। সবাই ভুল বোঝে তোমাকে । আমার একদম ভালো লাগে না”
একবার ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন নীলিমেশ । তাঁকে দেখে আলো ঝলমলে হয়ে উঠলো মেয়ের মুখ।
” শেষ পর্যন্ত এলাম রে মিতিল । তোর বিয়েতে”
” তুমি আসবে আমি জানতাম ভালো মামা ”
তারপরেই বললো
” আমার জন্য কি এনেছো গিফট ?দাও দেখি।”
একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিলেন নীলিমেশ । তা আগেই তুলে দিয়েছিলেন অপরুপার হাতে। কিন্তু এখন মিতিল যে কি গিফট চাইছে তাও জানতেন তিনি।ব্যাগ থেকে বার করলেন তা।
এক টানে মোড়ক ছিঁড়ে ভিতরের জিনিস দুটো বার করে ফেললো মিতিল
উচ্ছ্বাসে এ একটা হাত চেপে ধরলো নীলিমেশের ।
” এই জন্য ই তুমি ভালো মামা । উফফফফ কোজাগর আর মাধুকরী ! কতোদিন ধরে পড়ার ইচ্ছা ছিল আমার!”
আরো একটু কথা বলে সরে এলেন নীলিমেশ। যদিও মিতিল ছাড়তে চাইছিল না।
বিয়ে মিটলো ভালো ভাবে । সকালেই বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু অনিত আটকালো বললো ,
” ছোড়দা মেয়েটা বেরোলে তবেই বেরোবেন । তার পর আপনাকে আটকাবো না। ”
কথাটা ফেলতে পারলেন না নীলিমেশ।
আশির্বাদ এর পর্ব চলছিল মিতিলের । একের পর এক তার নিজের লোকেরা আশির্বাদ করছিলো আর চোখের জলে ভাসছিল মেয়েটা । আর তার মধ্যেও দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নীলিমেশ কে বার বার হাত নেড়ে ডাকছিলো । খুব কষ্ট হচ্ছিল নীলিমেশের । খুব। কিন্তু তিনি এও জানতেন মিতিলের মামা_ মামীরা একদম ই ভালো ভাবে নেবে না ব্যাপারটা । নিচ্ছে ও না।
কিন্তু এড়াতে পারলেন না নীলিমেশ। অপরুপা টেনে আনলো তাঁকে আশির্বাদ করবার জন্য । বসলেন নীলিমেশ । দুহাতে তাকে আঁকড়ে ধরলো মিতিল । কোনো রকমে ধান দুর্বা তুলে নতূন জামাইয়ের কপালে ছোয়ালেন নীলিমেশ। তার পর মিতিলের মাথায়। হাত কাঁপছিলো তাঁর। কেউ পছন্দ করছে না জেনেও তার ” ভালো মামার” আশির্বাদ টুকু পেতে চাইছিল মেয়েটা । ওর চাওয়ার চাপেই অপরুপা তাঁকে টেনে আনলো জানতেন নীলিমেশ ।
দুটো হাত মাথায় রেখে প্রাণ ভরে মিতিলকে আশির্বাদ করছিলেন নীলিমেশ। জীবনের পরীক্ষা গুলোর সব কটাতেই ডাহা ফেল করা নীলিমেশ সারা জীবন শুধু অসম্মান আর অপমান বয়েছেন । চাকরিটাও নিজে পাননি । বাবা রিটায়ার করার আগেই মারা গিয়েছিলেন বলে পেয়েছিলেন।সেই জন্য ও সারাজীবন কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে।
আজ তার থেকে অনেক ছোটো একটা মেয়ে নিজের মানুষদের চাপ কে উপেক্ষা করে খুব বড়ো একটা সম্মান দিলো তাঁকে । এমনটাই মনে হচ্ছিল নীলিমেশের।
আর জীবনের সব যুদ্ধেই হেরে যাওয়া মানুষটার সব আশির্বাদ আর শুভকামনা ঝরে পড়ছিল মিতিলের জন্য।