মানবসভ্যতার কবিতা : তৈমুর খান।।।

0
555

‘মৃত্যুর দরজা ঠেলে'(প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২১) কবি শুভঙ্কর দাসের কাব্যগ্রন্থটি সম্প্রতি হাতে এসে পৌঁছেছে। মোট ৫৬ টি কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি কবির এক নতুন ভাবনার দিগন্ত স্পর্শ করেছে। মৃত্যুময় নশ্বর পৃথিবীতে কবি যে সভ্যতার অন্বেষণ করেছেন তা প্রবহমান মানবিক সভ্যতা। কারণ মানবিক বোধ সভ্যতাকে রক্ষা করে, কিন্তু যুদ্ধ সভ্যতাকে ধ্বংস করে। মানবিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় দিক হলো শস্য উৎপাদন। কাব্যের প্রথম কবিতাতেই কবি উল্লেখ করেছেন:
“যদি বানাতে পারে অফুরন্ত এক শস্যগোলা
ঘরের ভেতর ঘরে
আমার সব খিদে মিটে যেত
জন্ম-জন্মান্তরে…”
শস্যগোলা বানানোর সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তরের খিদে মেটানোর সম্পর্ক থেকেই অনুমিত হয় প্রবহমান এই মানবসভ্যতার কথা। আর তখনই স্পর্ধা জাগে মৃত্যুর দরজা ঠেলে অগ্রসর হওয়ার। বিংশ শতাব্দীর আমেরিকান লেখক জোয়েল সালাতিন বলেছেন:
“You can’t have a healthy civilization without healthy soil. You can’t have junk food and have healthy people.”(Joel Salatin)
অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর মাটি ছাড়া কখনোই একটি সুস্থ সভ্যতা থাকতে পারে না। শুধুূ জাঙ্ক ফুডের দ্বারা কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। শুভঙ্করের ‘সব খিদে’র সঙ্গে জোয়েল সালাতিনের healthy civilization এর গভীর সম্পর্ক। সমগ্র কাব্যের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি এই মানবসভ্যতার কবিতা।
শুভঙ্কর দাস সেই সভ্যতারই অন্বেষণ করেছেন, যে সভ্যতা আমাদের অন্নবস্ত্র বাসস্থান আর সম্পর্কের মহাযজ্ঞে আত্মস্থ হবার পর্যাপ্ত সংগ্রাম শিখিয়েছে। এই সংগ্রামই ইতিহাস, মহাকাব্য পুরাণের অধ্যায়। কুরুক্ষেত্র থেকে শস্যক্ষেত। মানুষ থেকে ঈশ্বর। রূপকথা থেকে নুনভাতের গল্প। নামাজ থেকে পূজার ঘণ্টাধ্বনি সবই শামিল হয়েছে। সভ্যতা বহুমুখী অন্বয়ের বহুমুখী প্রত্যয় নিয়ে মহাকালের মহাসমারোহে আমাদের অবগাহন করিয়েছে। সেই শাশ্বত জীবনেরই পারম্পর্যকে তুলে এনেছেন কবিতায়। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা আর উত্তাপে সমূহ মানবযাত্রার উচ্ছ্বাসকে ধারণ করেছেন। মহাজীবনের মহাযজ্ঞে এভাবেই কবি প্রবেশ করেছেন। তার মানবিক চেতনায় যেমন ঈশ্বর বাস করেন, তেমনি ঐশ্বরিক চেতনায় মানুষের মুখ দেখা যায়। যে মানুষ আবহমান, যে ঈশ্বর সর্ববোধির নিয়ন্ত্রক কল্যাণময় এক মহাশক্তি সমগ্রের রূপ:
“ঈশ্বর আর জাতচাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

মাঠে নামলে নিজেই মাটি হয়ে ওঠে শিকড়শুদ্ধ
ফসলে ফসলে ভরে যায় ঘরদুয়ার,
এসো অভাব, এসো ক্ষুধা
সবুজ-কলজেতে হাত দাও, মুখোমুখি দাঁড়াবার।”

নারীও তাঁর কাব্যে ‘বসুধা’। সমগ্র সৃষ্টি রহস্যের আধার। তখন ধর্ষণ হলে বসুধারই হয়। বসুধার পরিচয় আমরা এভাবেই পাই তাঁর কবিতায়:
“দগ্ধ সারমেয়সময়ের চিৎকারে
নিজের সঙ্গে নিজের একটিবার হয়ে যায় দেখা।
তখন পৃথিবী হয়ে ওঠে পাণ্ডুলিপি, পাতার পর পাতা
জেগে ওঠে পুরাণ, সামুদ্রিক রেখা।

মহাকালের নিত্য-নতুন সুর ও স্বর।”
‘মহাকাল’ শব্দটা সভ্যতারই পরিচয় দেয়। অখণ্ড থেকে খণ্ড খণ্ড সম্পর্ক বিন্যাসে যা গড়ে ওঠে। টি এস এলিয়ট যেমন জীবনকে এক একটা নদীর প্রবাহে এবং মহাজীবনকে এক একটা সমুদ্রের প্রবাহে মিলিত হওয়াকে বুঝিয়েছিলেন। তেমনি মৃত্যুও নবজন্মের আভাস নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। প্রাকৃতিক জীবনের অভ্যাসগুলি মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি সকলের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়েছে। মৃত্যু অতি পুরাতন ঘুম, জীবন এই ঘুম থেকেই তার জাগরণ টের পায়। তখন বুঝতে পারে:
“রক্তমাংসের রোদ হেঁটে চলেছে
চোখের নিচে জমে ওঠা মেঘের কাছে, এবারের বৃষ্টিপাত
মাটিতে ব্যর্থ হতে দেবে না অনুতাপ।”
বীজধানের বাঁশি বাজা শুনে তখন মাথায়ও সর্প নাচে। মিলনের চাবি নিয়ে জন্মের জাদুকরী আলো জ্বলে ওঠে। শস্যঘ্রাণের নতুন পৃথিবী ফিরে আসে। কবি রক্তমাংসের শরীরকে ঈশ্বর করে নেন। এই ঈশ্বরই নবজন্মের ধারক ও বাহক। আশ্চর্য ক্রিয়াপদ তার। বসুধা তখনই পূর্ণতা পায়। মুক্তির পায়ে আঁকা হয় তখন রক্তমাংসের আলপনা।
শুভঙ্কর চিরন্তন জীবনবেগকে কবিতায় রূপান্তরিত করেন যা সভ্যতার সহযোগী এক শক্তি। যা সব কিছুকে বিশল্যকরণী করে দেয়। মৃত্যু তখন খেলনার মতোই মনে হয়। মাটি হয়ে মাটিকে প্রণাম করার মধ্য দিয়েই শস্যস্মৃতির ফুটিফাটা জমি সসাগরা পৃথিবী হতে পারে। আমেরিকান ইতিহাসবিদ দার্শনিক উইল ডুরান্ট বলেছেন: “Civilization begins with order, grows with liberty, and dies with chaos”.(— Will Durant) অর্থাৎ সভ্যতা চাহিদা অনুযায়ী শুরু হয়, স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি পায় এবং বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়। অর্থাৎ আগুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সভ্যতার উত্থান আবার এই আগুনের অসৎ ব্যবহারে তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। শুভঙ্কর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের বাণী উদ্ধৃত করে বলেছেন: “সব শালার চৈতন্য হোক।” এই চৈতন্যই মৃত্যুর দরজা ঠেলে শাশ্বত পৃথিবীতে পৌঁছে দিতে পারে মানবসভ্যতাকে।

# মৃত্যুর দরজা ঠেলে: শুভঙ্কর দাস, দি সী বুক এজেন্সি, কলকাতা – ৭০০০০৭, মূল্য:৮০ টাকা, প্রচ্ছদ দেবাশিস সাহা।