অনিবার্য : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
605

শশাচর থেকে উঠে এলেই বড় রাস্তা । বড় রাস্তাটা সোজা চলে গেছে রেল স্টেশন বরাবর ও বাস স্ট্যান্ডের দিকে । শশাচর গাঁ থেকে উঠে বড় রাস্তার মোড়ে কয়েকটা দোকান । তার মধ্যে একটি সাটাই মিঞার মুদির দোকান । দোকানটা এলাকায় খুব চালু । প্রায় সমস্ত জিনিসপত্র পাওয়া যায় । তার পাশে হিন্দুদের আরও বড় দুটি দোকান । একটা দোকান সেখানে চাষের জমির সার, কীটনাশক, ইত্যাদিসহ কৃষি সরঞ্জাম এবং সব ধরনের ফসলের বীজ পাওয়া যায় । তার পাশের দোকানে আটা-চাকি । গম ভাঙ্গানো ছাড়া সেখানে সব ধরনের মসলার গুঁড়ো, চালের গুঁড়ো করা হয় । গাঁয়ের নিতাইয়ের সেখানে টেলারিং দোকান । আর আছে জগজিতের চায়ের দোকান । এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় চায়ের দোকান । ভোর পাঁচটা থেকে চায়ের দোকানে খরিদ্দারদের জটলা । বেশির ভাগ খরিদ্দার শশাচর গ্রামের । তবে অন্যান্য গাঁয়ের খরিদ্দারও জগজিতের চায়ের দোকানে ভিড় করেন । জগজিতের চায়ের দোকান অনেকটা বড় । খরিদ্দারদের জন্য বসার চারটি বেঞ্চ । কিন্তু খবরের কাগজ মাত্র একটি । সকাল বেলায় ঐ একটি খবরের কাগজ পড়ার জন্য খরিদ্দারদের মধ্যে হুলস্থুল ।
কিন্তু জগজিত তার জীবনের বেসামাল পরিস্থিতির চাপে চায়ের দোকান খুলতে বাধ্য হয়েছে । সংসার বাঁচাতে চায়ের দোকান খোলা ছাড়া তার অন্য উপায় ছিলো না । জগজিত জগদ্দলের “অন্নপূর্ণা জুট মিলে” কাজ করতো । তিনটে শিফটে জুট মিল । জুট মিলে চাকরির সামান্য টাকায় দুই ভাইকে পড়িয়ে মানুষ করেছে । দুটো বোনের বিয়ে দিয়েছে । নিজে বিয়ে করেছে । ওপার বাংলার তাড়া খেয়ে ছিন্নমূল হয়ে এপার বাংলায় এসে নিঃস্ব অবস্থায় জগজিতের বাবা শশাচরে বাড়ি বানান । পরের চাষের জমিতে মুনিষ (জন) খেটে একটা সময় তাদের সংসার চলতো । তারপর জগজিতের জুট মিলে চাকরি । কিছুদিন পর তার বাবা ইহলোক থেকে বিদায় নিলেন । সেই থেকে পুরো পরিবারের বিশাল দায়িত্ব তার স্কন্ধে । জুট মিলে চাকরির উপর শশাচরে তাদের সংসার । মাঠে জমি জায়গা একফোঁটা নেই । ফলে ভীষণ কষ্ট করে সংসারটাকে ধরে রেখেছে জগজিত । বোন দুটির বিয়ে দিতে অনেক ধার-বাকী । ঋনদাতারা মাঝে মধ্যেই তাগাদা দেন । তার মধ্যে সে এখন দুটো সন্তানের জনক । দুটোই মেয়ে । দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়টার বেঙ্গল পুলিশে সদ্য কন্সেটেবলের চাকরি জুটলো । চাকরিটা পেতেও কিছু টাকার গচ্ছা । সেটাও জগজিতকে জোগাতে হয়েছে । ছোট ভাইটা সদ্য গ্রাজুয়েট । জগজিতের দুটি বাচ্চা । অথচ তাদের মুখে দুধ তুলে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই । পকেট শূন্য । জগদ্দলের জুট মিলে চাকরি করার জন্য তাকে জুট মিলের লাগোয়া একটা ছোট ঘরে থেকে নিজে রান্না করে খেতে হোতো । কোনো রকমে তার দিনাতিপাত । ভাই-বোনদের মানুষ ও বোনদের বিয়ে দিতে গিয়ে সে জেরবার ।
সংসারের জন্য জগজিতের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দেখে তার মা বাড়িতে দুটো গাই গরু পোষা শুরু করলেন । গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারে কিছুটা সুরাহা । আর বাচ্চা দুটির জন্য অন্তত দুবেলা দুধ জোটানো । ইতিমধ্যে জগজিতের মেজ ভাই চাকরিতে যোগ দিয়ে পাটুলির একটা মেয়েকে বিয়ে করে বৌকে নিয়ে চাকরিস্থল কুচবিহারে ঘাঁটি গাড়লো । ছোট ভাই খায়, আর ঘুমায় । সংসারের ভাল-মন্দে হেলদোল নেই । গোবর-গনেশ ধরনের । টিউশনি পড়িয়ে নিজের খরচাটা অন্তত রোজগার করতে পারে, সেদিকে বাবুর হুঁশ নেই । টাকার দরকার, বড়দার কাছে হাত পাতা । “টাকা ঠিকমতো না পেলে ভাই-বোনদের প্রতি বড়দার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন হচ্ছে না” বোঝাতে এতটুকু তার বিবেকে বাধে না ।
জুট্মিলের স্টোরে প্রচুর গড়মিল । জগজিতের এখন স্টোরে ডিউটি । উপরের বড় সাহেবের যোগসাজসে অনেক টাকার গড়মিল । গড়মিলের খুটিনাটি ভিজিল্যান্সের লোক হাতেনাতে ধরে ফেললেন । জুট মিল কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগের উপর ভিত্তি করে স্টোরকিপারকে থানার পুলিশ অ্যারেস্ট করলো । সেই সময় হঠাৎ উপরের বড় সাহেব জগজিতকে ডেকে পাঠালেন । তারপর তিনি জগজিতকে কয়েকটা কাগজে সই করতে বললেন । বড় সাহেবের মুখের উপর জগজিত “না” বলতে পারলো না । শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করলো, “আমি কিসের কাগজে সই করছি, জানতে পারলে খুশী হতাম“ ? বড় সাহেব বললেন,”স্টোরকিপার আমাদের সহকর্মী । তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে । তাকে বাঁচাতে হবে । সেইজন্য একটা আবেদন ও সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র” । জগজিত আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে এবং চিঠির মর্মার্থ না বুঝে, চোখ বুজে সই করে দিলো ।
পরেরদিন স্টোর থেকে মাল পাচারের অভিযোগে থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলো । উপরের সাহেব নিজেকে বাঁচিয়ে জগজিতের সই নিয়ে তাকে ঘোর বিপদের মধ্যে ফেলে দিলেন । দশ দিন জেল খাটার পর জগজিত জামিনে মুক্তি পেলো । ততদিনে জুট মিলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে । একেই অভাবের মধ্যে তার টানাটানির সংসার । মেয়ে দুটি ছোট । ইতিমধ্যে ছোট ভাই বড়লোক মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই । মা তার বড় ছেলের করুণ ঘটনা শুনে মুষড়ে পরলেন । চারিদিকে চাউর হয়ে গেলো, স্টোর থেকে মাল পাচার চক্রে জগজিত সরাসরি জড়িত । অনেক টাকা আত্মসাৎ করে এখন ধোয়া তুলসী পাতা সাজতে চাইছে । পরিস্থিতি এমন, চেনাজানা কোনো মানুষ জগজিত যে “সৎ” একথাটা বিশ্বাস করতে চাইছেন না । এমনকি তার শশাচর গ্রামের মানুষও তাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন । এমনকি উল্টে জগজিতকে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে উল্টোপাল্টা বদমান রটাচ্ছেন । ভেঙ্গে পড়লো জগজিত । জীবনে অনেক কষ্ট করেছে, কিন্তু কখনও অসৎ পথে উপার্জনের কথা ঘূণাক্ষরেও মাথায় আনেনি । শশাচরে ফিরে এসে তার মায়ের কাছে কী কান্না ! মা ও জগজিতের স্ত্রীর সান্ত্বনায় তার কান্না থামছে না । ডুকরে ডুকরে কেঁদে তার একটাই কথা, “সে এবারে কিভাবে বাঁচবে” ?
বড় ভাইয়ের বিপদের কথা শুনে মেজ ও ছোট ভাই বাড়ি এসে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলো না, আর্থিক সহায়তা বা সহানুভূতি দূরে থাক্‌ । জগজিত বুঝতে পারলো সারা জীবন সংসারকে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েই গেছে, কিন্তু তার বিপদের সময় তাকে দেখার সংসারের আর কেউ নেই । তাই অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে পরবর্তীতে কিভাবে বাঁচবে সেই চিন্তায় জগজিত মশগুল । মেয়ে দুটিকে কিভাবে মানুষ করবে সেই চিন্তায় অস্থির । চোখ থেকে তার ঘুম উধাও ।
হঠাৎ বেনেপাড়ার ফকির দয়ালের সঙ্গে দেখা । জগজিতের চেয়ে বয়সে ছোট । তবে শিক্ষিত হওয়ার কারণে পাড়ার লোকে তাকে মান্যতা দেয় । ভাল চাকরি করে । আসানসোলে পোস্টিং । ফকির দয়ালের ভাই শশাচরের বাসিন্দা এবং অনেক জমি জায়গার মালিক । স্টেশন বাজারে ফকির দয়াল জগজিতকে দেখা মাত্রই বললো, “তোমার জীবনের অবিশ্বাস্য খবর আমি জানি । তুমি বরং বিকেল বেলায় আমার সঙ্গে মোড়ের মাথায় দেখা করো । আমি তখন তোমাকে কয়েকটা পরামর্শ দেবো” ।
জগজিত বললো, “ফকির ভাই, বিকেলে কেন ? এখন বলুন । চলুন, চায়ের দোকানে বসে আমার প্রসঙ্গে বিস্তারে আলোচনা করা যাবে” ।
“আমার তো আপত্তি নেই” । বলেই বাজার ছাড়িয়ে খোদাবক্সের চায়ের দোকানে বসলো । ফকির দয়াল শুরু করলো, “তুমি তোমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোর্টে কেস করো । তোমার সততা প্রায় সকলেই জানে । এখন যেটা তোমাকে করতে হবে, হাই কোর্টের বড় উকিল ধরতে হবে । তুমি অবশ্যই জিতবে । উকিলের খরচাটা আমি এখন মিটিয়ে দেবো, কিন্তু একটা শর্তে” ?
আপনি বলুন ফকির ভাই । আপনার কথা আমার ভীষণ মনে ধরেছে । আপনার পরামর্শমতো আমি ন্যায্য বিচার পেতে দরকার হলে হাই কোর্টের স্মরণাপন্ন হতেও রাজী ।
“উকিলের ফি বাবদ টাকাটা আমাকে ফেরত দিতে পারবে না” । বলেই ফকির দয়াল জগজিতের দিকে তাকালো । তারপর আবার বললো, “মোড়ের মাথায় আমার নামে পাঁচ কাঠা জমি রয়েছে । কোনো কাজে লাগছে না । আমি সেই জমি তোমার নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে চাই । সেখানে তুমি চায়ের দোকান খোলো । চায়ের দোকান খুলতে বেশী পূজির দরকার নেই । প্রথমে পাট কাঠির বেড়া ও খড়ের ছাউনির চালা দিয়ে দোকান শুরু করো । আমার বিশ্বাস, আস্তে আস্তে তোমার চায়ের দোকানের জনপ্রিয়তা বাড়বে” ।
ফকির দয়াল বললো, “আগামীকালই উকিল বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছি । তারপর পিটিশন ফাইল । যেসব কাগজপত্র, ডকুমেন্টস্‌ দরকার পরে সবগুলি তোমাকে দিয়ে আসতে হবে” । আর একটা কথা, “যে জায়গার কথা আলোচনা করলাম, সেটা এর মধ্যেই রেজিস্ট্রি করে দিতে চাই । কেননা আমাকে সত্বর অফিসে যোগ দিতে হবে, সুতরাং পরে সময় পাওয়া যাবে না । তাই আগেভাগে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে চাই” ।
হাই কোর্টের উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ে দোতলায় উকিল বাবু বসেন । ফকির দয়াল ফোন করেই এসেছে । দুপুর বারোটায় তিনি সময় দিয়েছেন । যদিও তারা বারোটার অনেক আগেই পৌছে গেছে । উকিল সেনশর্মা বাবু কেসটা হাতে নিলেন । জুট মিলের কাজ কর্মের ব্যাপারে সেনশর্মা বাবু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাঁ প্রইয়োজনীয় তথ্য বুঝে নিলেন । তিনি আরও জানতে চাইলেন, তাকে সাসপেন্ড করেছিলো কিনা ? বরখাস্ত করার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছিলো কিনা ? সাসপেন্ড করলে সেই সাসপেনশন অর্ডার আছে কিনা ? এই গড়মিলের ব্যাপারে বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে কিনা ? স্টোরকিপারের কাজের সাথে কোন্‌ কোন্‌ কর্মী নিয়োজিত ।
কেস ফাইল করার এক মাসের মধ্যে একটা হিয়ারিং সম্পন্ন হোলো । তাতে জগজিত নিশ্চিত, এবার আসল দোষীরা ধরা পড়তে বাধ্য ।
তারপর …………?
তারপর পাট কাঠির বেড়া দিয়ে খড়ের ছাউনির চালা বানিয়ে শুরু হোলো জগজিতের চায়ের দোকান । শশাচরের মোড়ে ইদানীং লোকজনের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো । সেখান দিয়ে এখন অনেকগুলি বাস চলে । একটা টোটো স্ট্যান্ড । টোটো হওয়ায় রিক্সার কদর কম । সেখান থেকে সরাসরি স্টেশনে যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত । ফলে শশাচরের মোড়ে স্টেশনগামী মানুষদের জটলা ক্রমশ বাড়ছে । তাছাড়া কয়েকখানা দূরপাল্লার বাস ঐ রাস্তায় যাতায়াত । ফলে জগজিতের চায়ের দোকান খোলার সাথে সাথে খরিদ্দারের আশাতীত ভিড় । কিছুদিনের মধ্যে জগজিতের চায়ের দোকানের চায়ের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো ।
মেয়ে দুটি বড় হচ্ছে । মোহানা ও রোহানা । ছোট মেয়ে রোহানা সময় সুযোগ পেলেই বাবার চায়ের দোকানে বসছে । চা তৈরীতে বাবার কাছে হাতে খড়ি । বড় মেয়ে মোহানা ক্লাস টেন পাশ করার পরেই নিকটবর্তী ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের পরামর্শমতো সুইপারের কাজে নিয়োজিত । তবে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবু জগজিতকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, এখন তার বড় মেয়ে পার্ট টাইম সুইপার হিসাবে ঢুকলো ঠিকই ভবিষ্যতে তার চাকরিটা ফুল টাইম হয়ে যাবে । বরং মেয়েটা পড়াশুনা চালিয়ে যাক্‌ । ডিগ্রি থাকলে ব্যাঙ্কের বিভিন্ন পদের প্রমোশনে বসার সুযোগ ঘটলে, সেইক্ষেত্রে প্রমোশনে বসতে পারবে । ভবিষ্যতে উন্নতির কথা ভেবে জগজিত কিছুটা অল্প মাইনের সুইপারের চাকরিতে বড় মেয়েকে ঢোকালো । আর চাকরিটা ছিলো ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের হাতে এবং ক্ষমতায় । তাই সুযোগটা কিছুতেই হাতছাড়া করলো না জগজিত । অন্যদিকে ছোট মেয়ে রোহানা স্কুলে নিয়মিত যাচ্ছে । কিন্তু সংসারে ভীষণ অভাব । অভাবের কারণে তাদের সখ আহ্লাদের জলাঞ্জলি । প্রকট দরিদ্রতার মধ্যে তাদের পড়াশুনা । বেড়ে ওঠা । তবুও জগজিতের আপ্রাণ চেষ্টা, মেয়ে দুটিকে মানুষ করার । ওদের নিজের পায়ে দাঁড় করাবার । বড়টাকে মোটামোটি একটা জায়গায় গুঁজে দেওয়া হয়েছে । এখন ছোটটাকে নিয়ে চিন্তা ।
তারপর তখনও ঘড়িতে ভোর পাঁচটা বাজেনি । শশাচরের গদাধর তামলি চায়ের দোকানে এসে হাঁকলেন, “এক কাপ চা দাও গো জগজিত” ।
“গদাধর কাকা একটু বসুন । সবে উনুনে আগুন জ্বালিয়েছি, কয়লাটা ধরুক” । জগজিত উত্তরে গদাধর তামলিকে বললো ।
“চা বানাতে দেরী যখন পেপারটা দাও, একটু পড়ি । তোমার দোকানে এলে খবরের কাগজে চোখ বুলাতে পারি । একটু বেলায় এলে খবরের কাগজ নিয়ে খরিদ্দারের মধ্যে এত হুটোপাটি, সেখানে আমি পেপার পড়ার সুযোগ পাই না । তাই আজ সকাল সকাল চলে এলুম । তোমার কাকীমা যদিও বলেছিলেন, এত সকালে কী জগজিত চায়ের দোকান খুলেছে ? আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, “জগজিতের কাছে চায়ের দোকান ঠাকুরের মন্দিরের মতো । সে খুব সকালে উঠে দোকান খোলে । তা না হলে শশাচরের মানুষেরা লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যাওয়ার আগে চা খাওয়ার সুযোগ পাবে না । “চায়ের দোকান পরে খোলা” কক্ষণোই জগজিতের মনের অভিপ্রায় নয় । সে সবাইকে চা খাইয়ে যা তৃপ্তি পায় সেটা কেউ না জানলেও আমি জানি । তার ভিতরে কাজ করার ঈপ্সা সাংঘাতিক” । এরপর জগজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি কী কিছু বেঠিক বলেছি জগজিত” ?
জগজিত মাথা নেড়ে উত্তর দিয়ে বললো, “আপনি একদম সঠিক বলেছেন গদাধর কাকা । আমি কাজ ভালবাসি । তাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকি” । তারপর এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে খবরের কাগজ নিয়ে গদাধর তামলিকে দিয়ে জগজিত বললো, “গদাধর কাকা, আপনার চা” ।
“পেপার এখানে এত সকালে কিভাবে আসে” ? জগজিতকে প্রশ্নটা করলো গদাধর কাকা ।
প্রথম ট্রেন ঢোকে চারটে কুড়িতে । সেই ট্রেনটা হাওড়া থেকে আসে । ঐ ট্রেনেই আমাদের এলাকার হকারদের পেপার আসে । পেপার গুছিয়ে হকার আবার সাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছোটে । সুতরাং সেই হকারের পক্ষে খবরের কাগজ নিয়ে আমার দোকানে পৌঁছাতে স্বাভাবিকভাবেই দেরী হয় । তাই আমি নিজে প্রতিদিন দোকানে ঢোকার আগে স্টেশনে গিয়ে পেপার নিয়ে ঢুকি । আমি জানি, কিছু চায়ের খরিদ্দার পেপার দেখার নেশায় আমার দোকানে আসেন । তাঁরা এসে খবরের কাগজ পড়তে না পারলে তাঁদের মনটা খবরের কাগজে চোখ বোলানোর জন্য ছটফট করে ।
গদাধর তামিল চায়ের কাপ বা-পাশে রেখে বিস্কুট মুখে দিয়ে মনের সুখে খবরের কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরলেন । তারপর কিছুক্ষণ বাদে বিরক্তির সুরে জগজিতের উদ্দেশ্যে বললেন, “ধুর ! পেপারে কিছু নেই । আছে শুধু মারামারি, খুনোখুনি, পার্টির ক্যাডারের সাথে অন্য পার্টির ক্যাডারের মারামারি, ইত্যাদি । এগুলো কী খবর হোলো ! দিনকে দিন শিক্ষা সংস্কৃতি ধূলোয় মিশে যাচ্ছে । মানুষের মধ্যে থেকে মানবিক বোধ উঠে যাচ্ছে । আমরা এখন কোন্‌ সমাজে বাস করছি, যেখানে আজকের প্রজন্ম শিক্ষণীয় কিছুই পাচ্ছে না । সত্যিই দিনকাল দ্রুত পাল্টাচ্ছে । ফলে সমাজেও পরিবর্তন ঘটছে । জানো তো জগজিত, অবক্ষয় হচ্ছে পতনের মূল” । তারপর পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন ও দু-টাকার একটা কয়েন জগজিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এবার আসি” ।
গদাধর কাকা বের হওয়ার সাথে সাথে শশাচরের চারটি জোয়ান ছেলে ও তিনটি মেয়ে এসে দোকানে ঢুকলো । তারা যাবে মিলিটারিতে লাইন দিতে । চাকরির জন্য । মেয়ে তিনটি তাদের সঙ্গী । জগজিত তাই মনে মনে ভাবলো, গদাধর কাকার কথাই ঠিক । দিনকাল দ্রুত পাল্টাচ্ছে । চারটি জোয়ান মরদ ছেলে মিলিটারি চাকরির জন্য লাইন দিতে যাচ্ছে, অথচ সেখানে তাদের মেয়ে বন্ধুকেও যাওয়া চাই । ইত্যবসরে রোহানা এসে হাজির । বাবাকে বললো, “বাবা, তোমাকে বাড়িতে যেতে হবে । সেখানে ফকির দয়াল কাকা এসে বসে আছেন । তাঁর তোমার সঙ্গে দরকার” ।
“জগজিত, হাই কোর্টের উকিল আগামীকাল তোমাকে দেখা করতে বলেছেন । যার জন্য আমি বাড়িতে এসেছি । কাল ফাইনাল শুনানী । তোমাকে সকাল দশটার মধ্যে বিচারকের এজলাসে পৌঁছাতে হবে” । ফকির দয়াল তারপর জগজিতকে ডকুমেন্টস্‌ ও কী কী নিতে হবে সেটা ভালভাবে বুঝিয়ে দিলো । পরের দিন ভোর চারটের ট্রেনে জগজিত হাওড়া হয়ে গঙ্গায় খেয়া নৌকা পার হয়ে বাকী পথ হেঁটে হাই কোর্টে গিয়ে পৌঁছালো ।
“বিচারক ডকুমেন্টস্‌, সাক্ষী, ও জুট মিলের দেওয়া চিঠির আদান প্রদানের উপর নির্ভর করে চূড়ান্ত রায় দিলেন, “জগজিত নির্দোষ । তাকে ফাসানো হয়েছে” । তারপর জুট মিল কর্তৃপক্ষকে মহামান্য উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেন জগজিতকে পুরানো জায়গায় বহাল রাখতে । আর বিনা অপরাধে জগজিতকে জেল খাটানোর জন্য জুট মিল কর্তৃপক্ষের উপর জরিমানা দুই লক্ষ টাকা ।
কোর্ট অর্ডার নিয়ে জগজিত সোজা জুট্মিলে ।
জগজিতের পুনর্বহালে সর্বত্র কানাঘুষো, “সত্যের জয় অনিবার্য” ।
এদিকে চায়ের দোকানে রোহানা । এলাকায় রব উঠলো শশাচরের মোড়ে মহিলা টী স্টল । চায়ের দোকান ঘর এখন পাকা দালান । দোকান ঘর পরিপাটিভাবে সাজানো । চায়ের সাথে আরও খাবারের সরঞ্জাম যোগ হয়েছে । পাউরুটি ঘুগনি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কেক, বিস্কুট, ডিম সেদ্ধ, ইত্যাদি । রোহানা খরিদ্দার সামাল দিতে একাই একশো । এছাড়া মোড়টা এখন অনেক বেশী জমজমাট । দোকানের সংখ্যা বেড়েছে । সপ্তাহে দুদিন হাট বসছে । মোড়ের সন্নিকট একটি জুনিয়র হাই স্কুল সম্প্রতি চালু হোলো । রোহানার দিদির চাকরিতে পদোন্নতি হয়ে সে এখন ব্যাঙ্কে ফুল টাইম সুইপার । জগজিত খুব খুশী, তার দুটি মেয়ে নিজের পায়ে অন্তত দাঁড়াতে পেরেছে ।
তারপর মোহামা ও রোহামা দুজনের বাবার কাছে জোর আবদার, “তাদের বিয়ে তাদের মনমতো ও তাদের নির্বাচনমতো পাত্রের কাছে দিতে হবে” ।
পাত্র কারা আগে শুনি ?
ফকির দয়ালের ছোট ভাইয়ের ছেলে পদ্মনাভ । সে পঞ্চায়েত অফিসে কর্মরত । মোহামার সাথে তার দীর্ঘদিনের ভাব-ভালবাসা । আর স্টেশন বাজারের সর্খেল মুদির দোকানদারের ছেলে ভোম্বল । ভোম্বল পাশের গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার । তার সাথে চায়ের দোকান থেকেই রোহানার সাথে সম্পর্কের গভীরতা ।
মেয়েদের কথা শুনে জগজিত কিছু ভাববার আগে দুই মেয়ে তার দুই ঘাড়ে ভর দিয়ে বললো, “আপত্তি করো না প্লীজ” ।
————-০—————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)