পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ ডিসেম্বর ১৯৪০,বরিশাল জেলায়। পড়াশুনো কলকাতাতেই। রোহিণীকান্ত মুখোপাধ্যায় ও যোগমায়া দেবীর কৃতি সন্তান পবিত্র মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করার পর বিদ্যানগর কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি কবিতার প্রতি ছিল প্রচণ্ড ভালোবাসা। তাঁর কবিপত্রের কথা কে না জানে! বাংলা কবিতার ইতিহাসে ষাটের দশক মানে আন্দোলনের দশক। হাংরি আন্দোলন, শ্রুতি আন্দোলন, ধ্বংস কালীন কবিতা আন্দোলন এবং আরো কত কত আন্দোলন! এসবের মধ্যেও একক ও স্বতন্ত্র কবি পত্র ও তাঁর স্রষ্টা কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়।
ষাটের দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই কবির কাব্যগ্রন্থগুলি হল :
দরপণে অনেক মুখ(১৯৬০),
শবযাত্রা (১৯৬২),হেমন্তের সনেট(১৯৬৩),আগুনের বারান্দা(১৯৬৬),ইবলিশের আত্মদরশন(১৯৬৯),অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সংক্রান্ত(১৯৭০),বিয়ুক্তির স্বেদরক্ত(১৯৭২),দ্রোহহীন আমার দিনগুলি(১৯৮২),অলকে’র উপাখ্যান (১৯৮২),পশুপক্ষী সিরিজ(১৯৮২),ভারবাহীদের গান(১৯৮৩),আমি তোমাদের সঙ্গে আছি (১৯৮৫),আছি প্রেমে বিষাদে বিপ্লবে(১৯৮৭),কাব্যসংগ্রহ ১ম,২য়,৩য় (১৯৮৯,১৯৯২,১৯৯৭)
আরোগ্যভূমির দিকে(১৯৯৪),বিষ নয় উঠেছে অমৃত (১৯৯৯),সন্ধিক্ষনে আছি (২০০১),শোনো স্বপ্নভুক,শোনো (২০০৫), নির্বাচিত কবিতা ১ম খন্ড(২০০৫),আমি ভুতগ্রস্থ কবি(২০০৭),আগুনে সন্ন্যাসে আছি (২০০৮),নির্বাচিত কবিতা ২য় খন্ড(২০০৮)চেনা পথ অন্ধকার (২০১০),সচেতন স্বপ্নবাড়ী(২০১১) ইত্যাদি এছাড়াও রয়েছে প্রবন্ধ সংগ্রহ (২০০৬)
খুব দুঃখজনক করোনা আক্রন্ত আমাদের প্রিয় কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়কে হারানো। পবিত্র মুখোপাধ্যায় তখন ষাটের দশকের অন্যতম উজ্জ্বল কবি। তাঁর ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’ এর কথা পাঠকদের মুখে মুখে ঘুরত। প্রাবন্ধিক, এবং চলচ্চিত্র-বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধের বই প্রকাশ করেছিলেন এই কাব্যগ্রন্থটির উপর।
পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিপত্র’ পত্রিকা দীর্ঘকাল ধরে তরুণ কবি ও গল্পকারদের আত্মপ্রকাশের প্লাটফর্ম।
অসাধারণ পরিশ্রমী ও কবিতায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। অনেক পুরানো কথা মনে পড়ে, কতকথা, গল্প আলোচনায় কেটেছে আমার মত আনকোরা অনেক তরুনের। খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন তিনি।
অনুজদের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো।পরম স্নেহে গ্রহন করতেন সকলেই।
তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে সবাই মর্মাহত।
মেজাজের দিক থেকে কবি পত্র ছিল প্রাতিষ্ঠানিকতা বিমুখ এবং সামাজিক দায়বোধ অগ্রণী। সর্বোপরি কবিতাসহ গল্প-প্রবন্ধ চিত্রকলা সবকিছু মিলিয়ে একটা নব্যতর আন্দোলনে প্রয়াসী। প্রায় সমস্ত ধরনের কবিতা এই পত্রিকার ছাপা হয়েছে।কবিতা প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম একটা প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে এই লিটিল ম্যাগাজিন। পবিত্র মুখোপাধ্যায় এর ব্যক্তিগত চেষ্টায় ও নানারকম প্রতিবন্ধকতায় বন্ধুদের সাহায্যে কবিপত্র নিজেই একটা ইতিহাসের আকর যেখানে রাম বসু, মনীন্দ্র রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পাশে দেখা গেছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় শঙ্খ ঘোষ কিংবা অলক রঞ্জন দাসগুপ্ত, কালীকৃষ্ণ গুহ,নাসের হোসেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, রফিক উল ইসলাম, রত্নেশ্বর দাশগুপ্ত প্রমুখ বিশিষ্টদের।
পবিত্র মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ কবিতা চর্চায় নানান বাঁকবদলের মধ্য দিয়ে পৌঁছেছেন প্রাজ্ঞতায়। ষাট দশকের পরিসরেই তার খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা আর প্রশংসা প্রায় কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রবাদপ্রতিম ইবলিশের আত্মদর্শনে লিখেছেন-
“সময়ে সকল পাতা ঝরে যায়
সময়ে সমস্ত ঢেউ স্থির হয়ে আসে
ধ্যানের স্তব্ধতা নামে অজস্র কথার সমাধিতে
সব ঘর জতুগৃহ, অদাহ্য অক্ষয় বলে গৃহ নেই কোন
কোথায় পালাবে? ক্ষয় সুড়ঙ্গের মুখে
পিঠ চেপে বসে সূর্য আগুন পোহায়”
তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে সম্মানিত। তিনি এমন একজন কবি তাঁর কবিতায় তিনি নিজেই বলছেন- হারিয়ে যাওয়ার জন্য আসিনি, এসেছি তোমাদের পরিশ্রান্ত শরীরের উপরে ছড়িয়ে ডালপালা ছায়া দেবো বলে।
সত্যিই তো তিনি এমন একজন কবি আমার মতো প্রায় সব তরুণ কবিদের তিনি সর্বদাই ছায়া দিয়ে এসেছেন।
“ছিলাম এখনো রয়েছি কবে একদিন আর থাকবো না ”
আপনি আছেন আপনি থাকবেন অসংখ্য-অগণিত কবিতাপ্রেমী পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যেই।
লেখক তরুন কবি ও গবেষক।