বিদায় কবিতার ঈশ্বর শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১) : লিটন রাকিব।

0
1210

আমার মতো তরুণ একজন, পাহাড়প্রমাণ পাণ্ডিত্য প্রবীণ প্রথিতযশা কবি সম্পর্কে কি আর লিখব!

খবরটি এখনও ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা। দুঃস্বপ্ন; যদি সত্যিই দুঃস্বপ্ন হতো তাহলে কতই না ভালো হতো!

এই কঠিন অন্ধকারময় সময়ে যে তাঁর বড়ই প্রয়োজন ছিল।
নতুন বছরের শুরু থেকেই চলছিল কবির অন্তহিন লড়াই। বট পাকুড় এর ফেনার মতোই একসময় শান্ত নিথর হয়ে পড়তে হয়, তা কখনোই আবহমানকাল ধরে থাকে না। সবকিছর শেষ আছে জীবনে; জীবনে শুধু স্মৃতির কোন শেষ নেই।
কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে এক পৃথিবী স্মৃতি রয়েছে যা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে গহীন হৃদয়ে।

কবিকে কখনো দুর থেকে কখনো বা কাছ থেকে দেখেছি। প্রাণ ভরে দেখেছি, দুচোখ ভরে দেখেছি। সারা জীবনটা ধরে তিনি একটি আদর্শ নিয়ে বেঁচে ছিলেন, কখনো মাথা নত করেননি কোনো অশুভ শক্তির কাছে। সে কারণেই আমার মত অনেকেই তাঁর সৃষ্টির কাছে আজন্ম নতজানু।

তরুন প্রজন্মের দুই কবি-ভাইবোনের(লিটন রাকিব ও আরফিনা) সঙ্গে প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ।

স্নেহ-মমতায় তিনি আমাকে এবং আমার বোনকে যে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেই বটবৃক্ষের প্রয়াণে যেন পিতৃশোক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ক্রমশ। হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে পবিত্র সংযমের মাসেও নিজেকে যেন ঠিক ধরে রাখতে পারছি না। আসলে তিনি ছিলেন জাতির বিবেক। সত্যিকারের অভিভাবক। ওর মধ্যে অসম্ভব ধরনের গুনছিল নারী-পুরুষের সংমিশ্রণে বিনির্মিত। সে কারণেই বোধহয় সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন মুহূর্তের মধ্যেই।

তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন তার সঙ্গে যে কিছুটা সময় কাটিয়েছেন তিনি কখনো ভুলতে পারেবেন না। আসলে তিনি ভুলতে দেন না ;তিনি ভালোবাসায় ধরে রাখেন।

খুব মনে পড়ছে করোনার আগেই এইতো সেদিন কবির বাড়িতে গিয়েছিলাম কবি’র আতিথেয়তা আপ্যায়নের কোন তুলনাই নেই খাওয়া-দাওয়া তো ছিলই প্রবন্ধ,কবিতা, যাদবপুর, বর্তমান সময় পরিস্থিতি সবই আলোচনার মধ্যেই ছিল কিন্তু চলে আসার সময় কবি আমাকে আমার বোন আরফিনা কে চোখের জলে বিদায় দিয়েছিলেন। কবি কাঁদছিলেন আমরাও কাঁদছিলাম। শুধু এখানেই শেষ নয়, অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি আমাদের এগিয়ে দিতে এলেন দরজা পর্যন্ত যতক্ষণ না আমি জুতো পড়লাম ততক্ষণ কবি দাঁড়িয়ে রইলেন।সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। বললেন তুমি জুতো পড়ো তারপর আমি যাবো। এহেন আন্তরিকতা কখনো ভোলার নয়।

প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েও অহংকার তাকে কখনও স্পর্শ করেনি।

দুবাংলায় তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। ওপার বাংলাই ছিল কবির জন্মস্থান। জন্মভূমিকে কখনো ভোলেননি তাই তিনি পরবর্তীতে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কাটানোই শৈশব তাঁকে তার পরবর্তী জীবন কে নির্মাণ করেদিয়েছিল।

প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন।অবসর নেন যাদবপুর থেকেই। তাই যাদবপুরের প্রতি ছিল আলাদা রকমের দুর্বলতা। সেকারনেই বোধহয় আমার কাছে খবর নিতেন তাঁর পুরানো কর্মস্থলের।

সৃষ্টি ও উদ্ভাসঃ

১. দিনগুলি রাতগুলি (১৯৫৬)
২. এখন সময় নয় (১৯৬৭)
৩. নিহিত পাতালছায়া (১৯৬৭)
৪. শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০)
৫. আদিম লতাগুল্মময় (১৯৭২)
৬. মূর্খ বড় সামাজিক নয় (১৯৭৪)
৭. বাবরের প্রার্থনা (১৯৭৬)
৮. মিনিবুক (১৯৭৮)
৯. তুমি তেমন গৌরী নও (১৯৭৮)
১০. পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ (১৯৮০)
১১.কবিতাসংগ্রহ -১ (১৯৮০)
১২. প্রহরজোড়া ত্রিতাল (১৯৮২)
১৩.মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (১৯৮৪)
১৪.বন্ধুরা মাতি তরজায় (১৯৮৪)
১৫. ধুম লেগেছে হৃদকমলে (১৯৮৪)
১৬. কবিতাসংগ্রহ – ২ (১৯৯১)
১৭. লাইনেই ছিলাম বাবা (১৯৯৩)
১৮. গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ (১৯৯৪)
১৯. শঙ্খ ঘোষের নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (১৯৯৪)
২০. মিনি কবিতার বই (১৯৯৪)
২১. শবের উপরে শামিয়ানা (১৯৯৬)
২২. ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার (১৯৯৯)
২৩.জলই পাষাণ হয়ে আছে (২০০৪)
২৪. সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি (২০০৭)
২৫. মাটিখোঁড়া পুরোনো করোটি (২০০৯)
২৬. গোটাদেশজোড়া জউঘর (২০১০)
২৭. হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ (২০১১)
২৮. প্রতি প্রশ্নে জেগে ওঠে ভিটে (২০১২)
২৯. প্রিয় ২৫ : কবিতা সংকলন (২০১২)
৩০. বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে (২০১৪)
৩১. প্রেমের কবিতা (২০১৪)
৩২. শঙ্খ ঘোষের কবিতাসংগ্রহ (২০১৫)
৩৩.শুনি নীরব চিৎকার (২০১৫)
৩৪. এও এক ব্যথা উপশম (২০১৭)

গদ্যগ্রন্থ

১. কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক (১৯৬৯)
২. নিঃশব্দের তর্জনী (১৯৭১)
৩. ছন্দের বারান্দা (১৯৭২)
৪. এ আমির আবরণ (১৯৮০)
৫. উর্বশীর হাসি (১৯৮১)
৬. শব্দ আর সত্য (১৯৮২)
৭. নির্মাণ আর সৃষ্টি (১৯৮২)
৮.কল্পনার হিস্টোরিয়া (১৯৮৪)
৯. জার্নাল (১৯৮৫)
১০. ঘুমিয়ে পড়া এলবাম (১৯৮৬)
১১. কবিতার মুহূর্ত (১৯৮৭)
১২. কবিতালেখা কবিতাপড়া (১৯৮৮)
১৩. ঐতিহ্যের বিস্তার (১৯৮৯)
১৪. ছন্দময় জীবন (১৯৯৩)
১৫. কবির অভিপ্রায় (১৯৯৪)
১৬. এখন সব অলীক ক১৯৯৪)
১৭. বইয়ের ঘর (১৯৯৬)
১৮. সময়ের জলছবি (১৯৯৮)
১৯. কবির মর্ম (১৯৯৮)
২০. ইশারা অবিরত (১৯৯৯)
২১. এই শহর রাখাল (২০০০)
২২. ইচ্ছামতির মশা : ভ্রমণ (২০০২)
২৩. দামিনির গান (২০০২)
২৪. গদ্যসংগ্রহ ১-৬ (২০০২)
২৫. অবিশ্বাসের বাস্তব (২০০৩)
২৬. গদ্যসংগ্রহ – ৭ (২০০৩)
২৭. সামান্য অসামান্য (২০০৬)
২৮. প্রেম পদাবলী (২০০৬)
২৯. ছেঁড়া ক্যামবিসের ব্যাগ (২০০৭)
৩০. সময়পটে শঙ্খ ঘোষ : কবিতা সংকলন (২০০৮)
৩১. ভিন্ন রুচির অন্ধকার (২০০৯)
৩২. আরোপ আর উদ্ভাবন (২০১১)
৩৩. বট পাকুড়ের ফেনা (২০১১)
৩৪. গদ্যসংগ্রহ – ৮ (২০১৩)
৩৫. দেখার দৃষ্টি (২০১৪)
৩৬. আয়ওয়ার ডায়েরি (২০১৪)
৩৭. নির্বাচিত প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথ (২০১৪)
৩৮. নির্বাচিত প্রবন্ধ : নানা প্রসঙ্গ (২০১৪)
৩৯. নির্বাচিত গদ্যলেখা (২০১৫)
৪০. গদ্যসংগ্রহ – ৯ (২০১৫)
৪১. হে মহাজীবন : রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (২০১৬)
৪২. বেড়াতে যাবার সিঁড়ি (২০১৬)
৪৩. অল্প স্বল্প কথা (২০১৬)
৪৪. নিরহং শিল্পী (২০১৭)
৪৮.গদ্যসংগ্রহ-১০ (২০১৮)
৪৬. লেখা যখন হয় না (২০১৯)
৪৭.পরম বন্ধু প্রদ্যুমন (২০১৯)
৪৮. সন্ধ্যানদীর জলে : সংকলন (২০১৯)

ছোট ও কিশোরদের জন্যে লেখা

১. বিদ্যাসাগর (১৯৫৬)
২.সকালবেলার আলো (১৯৭২)
৩.শব্দ নিয়ে খেলা : বানান বিষয়ক বই {কুন্তক ছদ্মনামে লেখা }(১৯৮০)
৪. রাগ করো না রাগুনী (১৯৮৩)
৫. সব কিছুতেই খেলনা হয় (১৯৮৭)
৬. সুপারিবনের সারি (১৯৯০)
৭. আমন ধানের ছড়া (১৯৯১)
৮.কথা নিয়ে খেলা (১৯৯৩)
৯. সেরা ছড়া (১৯৯৪)
১০. আমন যাবে লাট্টু পাহাড় (১৯৯৬)
১১.ছোট্ট একটা স্কুল (১৯৯৮)
১২. বড় হওয়া খুব ভুল (২০০২)
১৩.ওরে ও বায়নাবতী (২০০৩)
১৪. বল তো দেখি কেমন হত (২০০৫)
১৫. অল্পবয়স কল্পবয়স (২০০৭)
১৬. আমায় তুমি লক্ষ্মী বল (২০০৭)
১৭. শহরপথের ধুলো (২০১০)
১৮. সুর সোহাগী (২০১০)
১৯. ছড়া সংগ্রহ (২০১০)
২০. ছোটদের ছড়া কবিতা (২০১১)
২১. ইচ্ছে প্রদীপ (২০১৪)
২২.ছোটদের গদ্য (২০১৭)
২৩. আজকে আমার পরীক্ষা নেই (২০১৮)

বক্তৃতা / সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সংকলন

১. অন্ধের স্পর্শের মতো (২০০৭)
২.এক বক্তার বৈঠক : শম্ভু মিত্র (২০০৮)
৩. কথার পিঠে কথা (২০১১)
৪. জানার বোধ (২০১৩)
৫.হওয়ার দুঃখ (২০১৪)

অগ্রন্থিত রচনা সংকলন

১. মুখজোড়া লাবণ্য (২০০৯)
২.অগ্রন্থিত শঙ্খ ঘোষ (২০১৭)

দেশভাগের সময় গর্জে উঠেছিল কবির কলম। তারপর বাংলা যখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে তখনও থেমে থাকেননি তাঁর লেখনি। তাঁর কলম বরবরই উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব।একটার পর একটা কালজয়ী কবিতা উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। মধ্যবিত্ত বাঙালির মনন তাঁর মতো করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সাধারণের নিজেকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, আলো-অন্ধকারে ঘেরা জীবন, প্রবঞ্চনা-ভালোবাসার চেনা ছকই অচেনা হয়ে ধরা দিত তাঁর সৃষ্টিতে।

কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখতেন তিনি। আসলে গদ্য হোক বা পদ্য, শঙ্খ ঘোষের প্রতিটি রচনায় থকাত এক অনন্য রসবোধ, বৈদগ্ধতার পরিচয়। যা পাঠকের মনকে শান্ত করে। নতুন করে ভাবতে শেখায়। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান তিনি ১৯৭৭-এ। ১৯৯৯ কন্নড় ভাষায় নাটক অনুবাদের জন্য দ্বিতীয়বারের সাহিত্য একাডেমি পান। ওই বছরই দেশিকোত্তম সম্মানে সম্মানিত হন কবি।
‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পান নরসিংহ দাস পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য শঙ্খবাবুর হাতে তুলে দেওয়া হয় রবীন্দ্র পুরস্কার, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর জন্য পেয়েছিলেন সরস্বতী পুরস্কর। ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও ২০১১-য় ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত হন শঙ্খ ঘোষ।

তিনি যখন সবিনয় নিবেদন কবিতায় বলেন, তখন বোঝা যায় তিনি কতখানি সমাজ সচেতন আর প্রতিবাদ মুখর কবি –

“আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা।
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা।
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।”

“এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও”

সেই পঞ্চাশ দশক থেকে অতি নীরবে রাজনীতির সঙ্গে, জনজীবনের সঙ্গে কবিতার সাঁকো বাঁধার কাজটা করেছিলেন তিনি। তাঁর কবিতা জীবন ছুঁয়ে থেকেছে কিন্তু কখনও স্লোগান হয়ে যায়নি।তাঁর কবিতা আসলে শেখায় প্রেম ও প্রতিবাদের ভাষা! সে কারণেই বোধহয় কবি অনায়াসেই উচ্চারণ করতে পারেন- “মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে”

শেষের দিকে কথা বলতে পারতেন না, হাত কাঁপতো লিখতে ভীষণ অসুবিধা হতো, তবুও কিন্তু আমাদের মতো তরুণ কবিদের নতুন প্রজন্মকে সাহিত্যের কাজে উৎসাহ জুগিয়েছেন নিরন্তন। তাঁর চলে যাওয়াটা অপ্রত্যাশিত। তিনি চলে গেলেন ঠিকই কিন্তু রেখে গেলেন তার অপার সৃষ্টি।

শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ ;সারা জীবনের শুন্যতা…