আজ আমরা এক অপূর্ব ঘটনা জানবো—- নিত্যানন্দ বংশাবতংস দুই প্রভুপাদ শ্রীলোচনানন্দ ও শ্রীনবকিশোর গোস্বামীর জীবনকাহিনীর এক বড়ই সুমধুর উপাখ্যান । পরস্পর যেমন দুই ভ্রাতা তাঁরা , তেমনই আবার সম্পর্কে গুরু-শিষ্যও। নবকিশোর গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন লোচনানন্দ। লোচনানন্দের পূর্বপুরুষের ক্রমটি এমন—>
নিত্যানন্দ—>বীরচন্দ্র—>রামচন্দ্র—> রাধামাধব—>রাজেন্দ্র—>হরগোবিন্দ—->সর্বেশ্বর—>লক্ষ্মীকান্ত—>কৃষ্ণকিশোর, নবকিশোর, লোচনানন্দ ও আর ও ছয় জন।
অর্থাৎ, লক্ষ্মীকান্তের নয় পুত্র । জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণকিশোর। কৃষ্ণকিশোরের পরবর্তী ভ্রাতা নবকিশোর। আবার , নবকিশোরের পরবর্তী ভ্রাতা লোচনানন্দ ছিলেন। জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণকিশোর তাঁর পিতার থেকে দীক্ষা নেন। কৃষ্ণকিশোরের থেকে নবকিশোর দীক্ষা নেন। আবার নবকিশোরের থেকে দীক্ষা নেন লোচনানন্দ। অতএব , পরমার্থে নবকিশোর ও লোচনানন্দ গুরু-শিষ্য , আর ব্যবহারে তাঁরা দুই ভ্রাতা। উভয়েই ষড়দর্শনাচার্য , পণ্ডিত প্রধান। প্রবল ভজনানুরাগী তাঁরা। মহাবৈরাগ্যবান হওয়ায় আজীবন ব্রহ্মচারী থেকেছেন দু’জনেই।
একনিষ্ঠ ভজনের তীব্রতম অভিলাষ নিয়ে একদিন সংসার ত্যাগ করে ব্রজে গমন করলেন নবকিশোর ও লোচনদাস । গোবর্দ্ধনে সিদ্ধ কৃষ্ণদাস বাবার থেকে ভজন শিক্ষা করবেন বলে তাঁরা শরণ গ্রহণ করলেন তাঁর। কিন্তু , নিজেদের গোস্বামী পরিচয় গোপন করলেন। বৃন্দাবনবাসীরা তাঁদের প্রভু সন্তান রূপে জানতে পারলেই পূজা করবেন, সম্মান করবেন, ফলে পূজা-প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অহঙ্কার আসবে তাঁদের মনে—-এই আশঙ্কা থেকেই তাঁরা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ব্রজে কাউকে জানতে দিলেন না। এমনকি সেকথা বলেননি সিদ্ধ কৃষ্ণদাস বাবাকেও। এদিকে তাঁদের তীব্র ভজন ইচ্ছা , অপরূপ রূপ, তেজ, গুণ দেখে বাবার মন তাঁদের প্রতি স্নেহকৃপায় ভরে গেল। তিনি পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা বললেন হাড়ি-কুলে (শূদ্র) জন্ম তাঁদের। বাবা ভাবলেন হীনকুলে দুই পুরুষরতন জন্ম নিয়েছে তবে! তিনি অঙ্গীকার করলেন তাঁদেরকে । পুত্রসম যত্ন করে ভজন মুদ্রা শিক্ষা দিতে থাকলেন।
বাদ্ধর্ক্যাবস্থায় বাবার তখন বেশ শরীর খারাপ করেছে। নবকিশোর ও লোচনদাস পরম যত্নে বাবার সেবা করছেন। মলমূত্র পরিষ্কার, উচ্ছিষ্ট ওঠানো থেকে শুরু করে যাবতীয় সেবা-শুশ্রুষা করেন। তাঁদের সেবায় বাবার কাল কাটতে থাকল।
দৈবেচ্ছায় তাঁদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ব্রজে এলেন একদিন। তিনি সকলের কাছে নবকিশোর ও লোচনানন্দের সন্ধান জানতে চাইলেন। কিন্তু , কেউই জানেন না। অবশেষে গোবর্দ্ধনে সিদ্ধ বাবার কাছেও এলেন। আত্মপরিচয় দিয়ে ভ্রাতাদের কথা জানালেন। সব শুনে বাবার বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে , তাঁর সেবক-শিষ্য নবকিশোর ও লোচনানন্দই হলেন আসলে নিত্যানন্দ বংশাবতংস সেই দুইজন প্রভুপাদ । তিনি মনে মনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। সেসময় দুই ভ্রাতা গিয়েছিলেন মানসী গঙ্গায় স্নান সারতে । তাঁরা ফিরতেই দূর থেকে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন এবার একটা অঘটন কিছু ঘটতে চলেছে।
আরক্ত লোচন বাবা ভীষণ অসন্তুষ্ট তাঁদের প্রতি এখন । তিনি বললেন – “ভজন মুদ্রাদি তোমাদের তো জন্মসূত্রেই জানা। তোমাদেরই ধন সেসব । তোমরা প্রভু-সন্তান । তবে কেন প্রবঞ্চনা করলে আমার সাথে ?” নবকিশোর ও লোচনানন্দ আর্তিভরে নিজেদের কথা জানালেন – “বাবা , আমরা জন্মে জন্মের অপরাধী। তাই উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করে ভাগ্যবিড়ম্বনায় পড়েছি। লাভ-পূজা-প্রতিষ্ঠাতেই জীবন ধারণ করতে হয় এই প্রভু সন্তান হয়ে পরিচিতি হওয়ায় । কিন্তু , পূজা-প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির আশা তো শূকরের বিষ্ঠার সম জ্ঞান করে ত্যাগ করতে হয়। এদিকে ভজন তো সুদুর্লভ বস্তু। অনধিকারী কখনো ভজন করতে পারে না। আমরা পরম অকিঞ্চন , অভাজন , তাই এত প্রতিষ্ঠা আমাদের ! কিন্তু , প্রতিষ্ঠার আসনে আসীন থেকে ভজন করবো কেমন করে! মহৎ কৃপা বিনা তো সম্ভব নয়। তাই , আপনার মত মহতের কৃপা পেতে আমরা সত্য গোপন করেছি। এ ব্যতীত আর কোন অভিপ্রায় আমাদের নেই বাবা!”
সিদ্ধ কৃষ্ণদাস বাবা সব শুনে অন্তরে প্রসন্ন হলেও বাইরে ক্রোধ প্রকাশ করলেন। বললেন , “ বেশ, এবার তবে এক কাজ করতে হবে তোমাদের । নিজের হাতে নিজেদের চরণ ধৌত করো। তারপর সেই চরণ ধৌত জল আমায় পান করতে দাও। এই তোমাদের দন্ড দিলাম।” এমন আজ্ঞায় মহা ফাঁপরে পড়লেন নবকিশোর ও লোচনানন্দ । কিন্তু , মহাপুরুষের ক্রোধ শান্ত করতে, তাঁর আদেশ পালন বিনা অপর কোন পথ নেই। অগত্যা আজ্ঞা অনুরূপ কার্য করলেন। চরণামৃত পান করে বাবা তৃপ্ত হলেন অবশেষে। বললেন , “কৃষ্ণ বড় কৃপাময় । তাইতো তোমাদের মত মহতের সঙ্গ আমায় করিয়েছেন। আর কখনো আমার সঙ্গে কোন বঞ্চনা করার চেষ্টা করো না। তোমাদের মত দৈন্য,ভক্তি আর কারো নেই। প্রতিষ্ঠার আসনে আসীন থেকেও তোমরা স্বচ্ছন্দে ভজনমুদ্রা যাজন করার অধিকারী, জানবে । বরং তোমাদের সঙ্গে ভজনমুদ্রা সংক্রান্ত আলোচনায় আমার জীবন সধন্য হল এতকাল!”
লোচনানন্দ প্রভুর জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছে। তাঁর কাছে স্বয়ং কালভৈরব ও বিসূচীকাদেবী দীক্ষা নিয়েছিলেন। তবে সেসব এ প্রবন্ধের এই স্বল্প পরিসরে নয় , অামার ‘মহাপ্রভু ও তাঁর পার্ষদকথা’ গ্রন্থে প্রদত্ত হয়েছে।
নবকিশোর ও লোচনানন্দ গোস্বামীর অন্তর্ধান লীলাও বড় অদ্ভুত।রথযাত্রা দর্শন করতে এসেছেন প্রভুদ্বয়। জগন্নাথের পান্ডুবিজয় দর্শন করার পরই নবকিশোর প্রভু অকস্মাৎ জীবন ত্যাগ করলেন। তখন ছোট ভ্রাতা লোচনানন্দ নিদারুণ আক্ষেপে বলতে থাকলেন , “ প্রভুদাদা গো, এ তোমার কেমন ব্যবহার! চিরটাকাল আমরা একসাথে থেকেছি । জ্ঞান হওয়া থেকে তোমার সেবক রূপে আছি। আর, আজ, আমায় না নিয়ে একা চলে গেলে! তোমার সেবককেও তোমার সঙ্গে নিতে হবে তোমায়, এই আমার নিবেদন!”—–এই আক্ষেপ করতে করতেই লোচনানন্দ প্রভুও হঠাৎ-ই জীবন ত্যাগ করলেন। সকলে বিস্মিত হলেন দুইভ্রাতা তথা গুরু-শিষ্যের এমন আশ্চর্য মিলন দেখে। নরেন্দ্র সরোবরের তীরে তাঁদের সমাধি দেওয়া হল। আর , তাঁদের সেবিত বিগ্রহের সেবার দায়িত্ব নিলেন নাথ বংশের জমিদারদের ব্রাহ্মণেরা। নীলাচলে এখনও সে বিগ্রহের দর্শন লাভ হয়।
দুই প্রভুপাদের শ্রীচরণে প্রণতি নিবেদন পূর্বক এই অধমা ভজনহীনা রাধাবিনোদিনীর প্রার্থনা, যাতে লাভ-পূজা-প্রতিষ্ঠার আশা না রেখে নিষ্কাম ভাবে আমার নিতাই-গৌরের কথা, ভক্তকথা প্রচার করতে পারি। যেন আপনাদের মত ভক্ত পাঠককুলকে আমার লেখনীর মাধ্যমে নির্মল আনন্দের আস্বাদন করাতে পারি। এভাবে ভক্তের আনন্দবিধান করা আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হোক।
—–ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক