আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস, ষষ্ট পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
538

ইমলি ভাবলো, স্টাফদের জন্য বিকেলে চায়ের সাথে কিছু একটা মুখরোচক খাবার বানিয়ে তাঁদের খাওয়ানো যাক । সেই কথা ভেবে ননী বাবুকে দিয়ে কিছু পিঁয়াজ, ব্যাসন ও মুড়ি আনালো ইমলি । প্রথমে ব্যাসনটা ভাল করে জল দিয়ে মাখিয়ে তাতে কুচি কুচি করে কাটা পিঁয়াজ মিশালো । তারপর ব্যাসনে মাখানো কুচি কুচি কাটা পিঁয়াজ পেঁয়াজির আকারে হাতের মধ্যে তুলে কড়াইতে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে পেঁয়াজি ভাজলো । মুড়ির সাথে গরম পিঁয়াজি পেয়ে ব্রাঞ্চের স্টাফেরা খুশীতে টগবগ । তার পর পরেই চা । চেম্বার থেকে ম্যানেজার বাবু বের হয়ে পেঁয়াজি ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি চিবোতে চিবোতে বললেন, “আজ বৈকালীন চা খাওয়াটা জমজমাট” ।
তারপর ব্যাঙ্ক বাবুরা ঠিক সাড়ে ছ-টায় ব্রাঞ্চ বন্ধ করলেন ।
পেছনের বারান্দায় ঢুকে ইমলি দেখে, অনেকক্ষণ আগেই ইতাস ডেরায় ঢুকে গেছে । সরষের তেলের টিন কেটে রান্নার জন্য উনুন বানাচ্ছে । বাজার থেকে হাঁড়ি-কড়াই-থালা-হাতা-খুন্তি কেনা ছাড়াও রান্নার জন্য চাল, ডাল, সরষের তেল, লবন, হলুদ, জিড়ের গুড়ো, শুকনো ও কাঁচা লঙ্কা, আলু, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, আর দুটো ডিম কিনে এনেছে । রান্নার জিনিসপত্র দেখে ইমলি দৃশ্যত খুব খুশী । সেই সময় ইমলিকে উদ্দেশ্য করে ইতাস বললো, “দুদিনের লাভের টাকা থেকে কিনে আনলাম । হাঁড়ি ও কড়াই, দুটো থালা, হাতা-খুন্তির দামটা দুদিন পরে দিলেই চলবে । গদাই পুলিনের দোকান থেকে ধারে কিনে দিলো । সুতরাং আজ থেকে আমরা বাড়িতেই রান্না চালু করতে চাই” ।
সেটা আর বলতে ! উনুন বানানো শেষ । সুতরাং তুমি হাত-মুখ ধুয়ে এসো, ততক্ষণে ডিমের ঝোল ভাত হয়ে যাবে । ইমলি মনের আনন্দে রান্না শুরু করলো । অনেকদিন পর গেরস্থ বাড়ির মতো সে রান্নায় হাত লাগালো । ইমলির মনে খুব আনন্দ, তারা আজ নিজেরা রান্না করে খাওয়া-দাওয়া সারবে । দীর্ঘদিন ভবঘুরের মতো এখানে সেখানে ঘোরাঘুরির জন্য রান্না করে খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলো । বলা চলে তাদের সুযোগ ঘটেনি । তারপর ইমলি উনান ধরাতে গিয়ে দেশলাই খুঁজে পাচ্ছে না । এতদিন দেশলাইয়ের প্রয়োজন পরেনি, যার জন্য ইতাস বাজার থেকে দেশলাই আনতে ভুলে গেছে । দেশলাই আনতে ইমলি ছুটলো ব্যাঙ্কের সামনের পান-বিড়ির দোকানে ।
দোকানে গিয়ে আর এক বিপদ ! কেষ্টদার পান-বিড়ির দোকান । দেশলাই দেওয়ার আগে তার কতো প্রশ্ন ? আপনাদের ব্যাঙ্কের ভিতরে থাকতে পারমিশন কে দিলো ? রাতে ব্যাঙ্কের প্রিমেসেসে আপনাদের থাকার অধিকার আছে কী ? কেউ থানায় নালিশ জানালে, আপনাদের বিপদ অনিবার্য ?
ইমলি আইনের ছাত্রী । অল্প কথায় সে বুঝতে পারে কথাবার্তার মোটিভ কী ? কেষ্টাদার অযাচিত প্রশ্নে সে নিজেই অনুধাবন করতে পারলো, আশপাশের দোকানদাররা চায় না আমরা ব্যাঙ্কের পেছনের বারান্দায় থাকি ! তাই তার এতগুলি প্রশ্ন ? কেষ্টদার কোনো কথার জবাব না দিয়ে শুধুমাত্র বললো, “আমি ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনে কাজ করি । দয়া করে দেশলাইটা দিন । নতুবা আমাকে অন্য দোকানে ছুটতে হবে” ।
দেশলাইটা দিয়ে কেষ্টাদা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি আমার কথার উত্তর কিন্তু দিলেন না” ।
“উত্তর আমি দিয়েছি । কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, সেই উত্তর আপনি বুঝতে পারেন নি । আমি এখন আসছি” । বলেই এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ইমলি ছুটলো । তাকে সত্বর রান্না বসাতে হবে । ইতাস সারাদিন কী খেয়েছে সেটাও জানা হয়নি । তার এখন ভুখা পেট । হাত মুখ ধুয়ে এসে খাবার চাইলে ইমলি অস্বস্তিতে পড়ে যাবে । তাই তড়িঘড়ি ডেরায় পৌঁছে উনুনে প্রথমেই হাঁড়িতে ভাত বসালো ।
বাথরুমের সমস্যার জন্য ইতাসকে দূরে ছুটতে হচ্ছে । ইমলি ব্যাঙ্কের ভিতরের বাথরুম ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়ায় সে শারীরিকভাবে স্বচ্ছন্দ ।
ডিমের ঝোল ভাত পরম তৃপ্তিতে খেয়ে তারা দুজনে ভীষণ প্রীত । ইমলি খাওয়ার বাসন মেজে ঘরে এসে ইতাসের পাশে বসলো । ইতাস পেটে হাত দিয়ে ইমলিকে বললো, আজ খুব আনন্দ মনে শান্তিতে ভাত খেলাম । সেই কবে দেশের বাড়িতে থালায় ভাত খেয়েছি, মনে হচ্ছে সেটাও একযুগ হয়ে গেছে । খেয়ে-না-খেয়ে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কিভাবে এতদিন কাটালাম ভাবতেই অবাক লাগে ! এবার ইমলির দিকে তাকিয়ে ইতাস জিজ্ঞাসা করলো, “ব্রাঞ্চের কাজে আজ তোমার কেমন কাটলো, আমাকে শোনাও” ?
ইমলির চোখে জল !
“তুমি কাঁদছো কেন ? কোনো খারাপ খবর ?” উদ্বিগ্ন ইতাস ইমলিকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো । আবার বললো, “সেরকম হলে আমরা এই জায়গা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে থাকবো । কিন্তু কারও কাছে মাথা নুইয়ে আমরা বাঁচতে পারবো না । আমরা পরিশ্রম করতে জানি, সুতরাং পরিশ্রম করলে এক মুঠো ভাত ঠিক জুটবেই ! আমরা জানি, জীবনটা কঠিন । কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় ।”
ইতাসের মুখে হাত দিয়ে ইমলি বললো, “তুমি একটু চুপ করো । কোনো সমস্যা হয়নি । বরং আমি ব্যাঙ্কের বাবুদের অমায়িক ব্যবহারে উচ্ছ্বসিত । ব্যাঙ্কের স্টাফেরা খুব ভদ্র । তাঁদের ষোলোআনা সহানুভূতি আমাদের উপরে রয়েছে । আগামীকাল থেকে বদলী স্যুঈপার (Sweeper) হিসাবে এক সপ্তাহ কাজ করতে হবে । সেখান থেকে কিছু পারিশ্রমিক আসবে । ক্যান্টিনে কাজ করার সুবাদে অল্প কিছু মাসোহারা পাবো । উপরন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া ফ্রী । প্রত্যেকটা স্টাফ, ভাইয়ের মতো । সকলের সাথে মধুর সম্পর্ক । সুতরাং ব্যাঙ্কের বাবুদের ব্যবহারের জন্য আমি গর্বিত ।
তাহলে সমস্যা কোথায় ? কাঁদছো কেন ?
কাঁদছি অন্য কারণে । দুপুরে ক্যান্টিনে খেতে বসে বারবার তোমার ক্ষুধার্ত মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো । আমি পেট পুরে এক থালা ভাত খাবো, আর তুমি না খেয়ে পেয়ারার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাসের প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে পেয়ারা বিক্রি করবে সেটা ভেবেই আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো । তাই খেতে বসে কেঁদে দিয়েছিলাম । আমার কান্নার দৃশ্য দেখে ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার বাবু কী বললেন জানো ?
কী বললেন ?
আপনার স্বামীকে সোনালী মাসির দোকান থেকে পেট ভরে খেতে বলবেন । খাওয়ার বিল আমি ব্যক্তিগতভাবে মেটাবো । তাহলে বুঝতে পারছো, ব্যাঙ্কের মানুষ কতোটা সহৃদয় ! আমি দুপুর বেলায় ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনে বসে থালা থেকে এক গ্রাস ভাত খাওয়ার পর আর খেতে পারিনি । তারপর খাবারের থালায় জল ঢেলে দিয়েছিলাম । আর এখন দুজনে একসঙ্গে পাশাপাশি বসে ভাত খেয়ে আমি পরম তৃপ্ত । তাই আমার চোখে জল ।
ইতাস ইমলির মাথায় হাত রেখে বললো, “এবার থেকে ক্যান্টিনে পেট পুরে ভাত খাবে । আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না । আমি ঠিক কোথাও খেয়ে নেবো । তবুও তুমি আমার জন্য অহেতুক উতলা হবে না । ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবু উদার মনের মানুষ । আমাদের আর্থিক দুর্দশার কথা ভেবে, তিনি তোমাকে কাজও দেখে দিয়েছেন । সুতরাং তুমি কাজের জায়গায় দায়িত্ববান থাকবে । তাহলে কাজের জন্য যথাযথ মর্যাদা অবশ্যই পাবে । আমরা কাজ করে খেতে চাই । কাজই আমাদের জীবন । আমাদের কাছে কাজই ধর্ম” । সততা নিয়ে কাজের জায়গায় ঠিক থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তোমার পাশে থাকতে বাধ্য ।
“একটা কথা বলছি” ? ইতাস ইমলিকে বললো ।
বলো, কী বলবে ?
কাল থেকে সকালে পেয়ারা বিক্রি করি এবং বিকালে ফুচকা নিয়ে বাজারে ঘুরি । ফুচকার বাজার মোটামোটি ভাল । ফুচকা বাড়িতে তৈরী করে বাজারে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করলে লাভটা ভাল হবে । মন্তেশ্বরে যাওয়ার রাস্তার মোড়ে ফুচকা নিয়ে দাঁড়ালে বিক্রিবাট্টা ভাল হওয়ার কথা । স্কুল ছুটির সময় গার্লস স্কুলের গেটে দাঁড়ালে ফুচকার বিক্রি বাড়বে । আরও একটা কথা ভাবছি …?
আবার কী কথা ?
সকালবেলায় পেয়ারা নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে রইলাম, একটু বেলা বাড়লে পেয়ারার ঝুড়ি নিয়ে স্কুলে স্কুলে ঘুরলে পেয়ারা বেশী পরিমানে বিক্রি হওয়ার কথা । কেননা স্কুলের ছেলেমেয়েদের পেয়ারা কেটে ঝাল ঝাল করে মাখিয়ে দিলে তারা খুব খুশী মনে খাবে । তাছাড়া মেয়েরা কামরাঙা ভীষণ পছন্দ করে । তাই পেয়ারার সাথে কামরাঙা রাখা চলে । এইভাবে অভিনব কায়দায় ব্যবসা বাড়াতে পারলে খাবার খরচা বাদ দিয়েও কিছু সঞ্চয় করা সম্ভব । বর্তমান ম্যানেজার বাবু সহৃদয় মানুষ । তাই আমাদের থাকার ব্যাপারে তিনি কোনোদিন আপত্তি করবেন না । কিন্তু এই ম্যানেজার বাবু বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেলে নতুন ম্যানেজার বাবু আমাদের থাকার ব্যাপারে কী রণমূর্তি ধারণ করবেন সেটা আগাম বলা মুসকিল । তাই আমাদের সচেষ্ট থাকা খুব দরকার, নিজেদের থাকার বাসস্থানের ব্যবস্থা নিজেদের করার জন্য । তারপর ইতাস ঘুমে ঢলে পড়ছে । এত কথার পর ইতাস আর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারছে না । সটান শুয়ে পড়লো ।
কিন্তু ইমলির চোখে তখন ঘুম নেই । ইতাসের প্লানগুলি নিয়ে ভাবছিলো । ইতাস ব্যবসা বাড়ানো নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত । তার ব্যবসার হালহকিকৎ নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল । কিভাবে অল্প পূজিতে ব্যবসা করা যায় এবং তার থেকে কিভাবে লাভ রাখা যায়, সেটাই তার ধ্যান জ্ঞান । লাইটের স্যুইচ অফ করেনি ইমলি । ঘরে আলো জ্বলছে । ইতাসের দিকে তাকিয়ে দেখে বেচারা সারাদিনের খাটুনির পর অঘোরে ঘুমোচ্ছে । ইতাসের জন্য ইমলির খুব কষ্ট । যে কোনোদিন বাড়ির কাজে কুটোটি নাড়েনি, সে কিনা পেয়ারা বিক্রি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাঁচার জন্য অর্থ উপার্জন করছে । সত্যিই একেই বলে কপাল ! নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস । শুধুমাত্র কতকগুলি মানুষের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ধর্মের কারণে দেশ বিভাজন, তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে হিন্দুদের । তাঁদের বংশ পরম্পরার ভিটেমাটি থেকে সমূলে উৎপাটন করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলো নিজের দেশের আপন মানুষজনেরা । কী নির্দয়, অমানবিক অত্যাচার ! নিরপরাধ মানুষগুলো কোথায় যাবে, কিভাবে বাঁচবে, তাতে রাষ্ট্র প্রধানদের মাথা ব্যথা নেই । মাথা ব্যথা তাঁদের, যাঁদেরকে দেশ থেকে তাড়ানো হচ্ছে । ইমলি আর ভাবতে চায় না । এখন তাদের একটাই ভাবনা, “বেঁচে থাকার ভাবনা” । ঘরের লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়লো ইমলি ।
পান-বিড়ির দোকানদার কেষ্টাদা ভোরবেলায় ফাঁড়ির পুলিশ নিয়ে তাদের ডেরায় হাজির । ইমলিদের দেখিয়ে পুলিশ আধিকারিককে কেষ্টাদা বললেন, “দেখুন স্যার, বিনা অনুমতিতে সরকারি ব্যাঙ্কের প্রেমিসেসের মধ্যে দুটো লোক বহাল তবিয়তে শুয়ে রয়েছে, যাদের কিনা এদেশে কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই । রেশন কার্ড, দলিল দস্তাবেজ কিছুই নেই । চুরি করে পালালে এদের ধরার উপায় নেই । ব্যাঙ্কের বারান্দায় শুয়ে শুয়ে তাদের অন্তর্নিহিত অভিসন্ধি বোঝা দায় ! আশেপাশে আমাদের দোকান স্যার । কবে শুনবো এইসব উটকো বজ্জাত লোকেরা আমাদের দোকানে চুরি করে পালিয়েছে । আপনারা এদের একটা শাস্তিমূলক বিহিত না করলে আমরাই কিন্তু এদের পিটিয়ে এখান থেকে তুলে দেবো” ।
পুলিশ আধিকারিক চোখ গরম করে কেষ্টাদার দিকে তাকালেন । তারপর তিনি বললেন, “আমরা পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতলব আঁটছেন কেন ? আমাদের সামনে আপনি পারবেন, এদের পিটিয়ে তুলে দিতে ? যদি সে কাজটা করতে যান, আপনি নিজে কিন্তু জেলের ঘানি টানবেন । সুতরাং চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন । আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন” ।
“সরি স্যার” ! কেষ্টাদা সরি বলে খালাস পেয়ে গেলো । ইমলি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছে, কেষ্টাদা রাজনৈতিক পার্টির লোক । সক্রিয়ভাবে পার্টির কাজে জড়িত । পার্টির আশ্রয়ে থাকার জন্য অনেক অকাজ-কুকাজ করে বেড়ায় । অন্ধকার জগতের মানুষের সাথে তাঁর ওঠাবসা । সেই কারণে মেয়েদের শ্লীলতাহানির মতো জঘন্য কাজ করতে তাঁর বিবেকে বাঁধে না । ইমলি আরও জানতে পেরেছে, কেষ্টাদা নারী পাচারকরী দলের একজন বরিষ্ঠ সাগরেদ । সন্ধ্যাবেলায় দেশলাই কেনার সময় তাঁকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য বাবুর গোসা চরমে । তাই সরাসরি পুলিশ নিয়ে হাজির তাদের ডেরায় ! ইমলি অসহায়ের মতো মনে মনে ভাবছে, তাদের হয়েছে জ্বালা । সুযোগ পেলেই কিছু উটকো মানুষের দাপট তাদের উপরে বাড়ে । অথচ ইমলিদের মতো অসহায় মানুষদের প্রতি তাঁদের সহযোগিতার হাত কার্পণ্যে ভরা ।
“ব্যাঙ্কের অনুমতি না নিয়ে আপনারা এখানে কোন্‌ অধিকারে শুয়ে আছেন” ? পুলিশ আধিকারিক ইতাসকে জিজ্ঞাসা করলেন ।
ইমলি চটজলদি উত্তর দিয়ে বললো, “স্যার, আমি ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনে কাজ করি । সেই সুবাদে ব্যাঙ্কের শাখা কর্তৃপক্ষ আমাদের এখানে মৌখিকভাবে থাকতে অনুমতি দিয়েছেন” ।
“আপনি বললেন, আপনি ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনে কাজ করেন । তার লিখিত রিপোর্ট দেখান প্লিজ” ?
“যদি সম্ভব হয় আপনি একবার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবু, রিতম বাবুর সঙ্গে কথা বলুন স্যার । তিনি সবিস্তারে আপনাকে বোঝাতে পারবেন” । ইমলি পুলিশ আধিকারিককে অনুরোধ করলো ।
পুলিশ কেষ্টাদাকে ইশারা করে বললেন, “আপনি নিজে গিয়ে ম্যানেজার বাবুকে ডেকে নিয়ে স্পটে আসুন । তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলবো । আপনার নালিশের জবাব তখন আপনি পেয়ে যাবেন” ।
কেষ্টাদা মোটর বাইকে রিতম বাবুকে ব্রাঞ্চে নিয়ে এলেন ।
পুলিশ আধিকারিককে দেখে রিতম বাবু রীতিমতোভাবে বিস্মিত ! তিনি উদ্বেগের সাথে বললেন, “কী ব্যাপার বড় বাবু । আমি তো আপনাদের ডাকিনি বা অভিযোগ জানাইনি । যেহেতু ব্রাঞ্চ প্রেমিসেসের ভিতরে পুলিশি তল্লাশি, সেহেতু ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ছাড়া আপনারা কিভাবে, কার নির্দেশে তদন্তে এলেন আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না । ব্যাপারটা খোলসা করে বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ” ?
অভিযোগ একটা পেয়েছি । কিন্তু সেটা আপনাদের কাছ থেকে নয় ।
অভিযোগ যেহেতু ব্যাঙ্ক সম্পর্কিত, প্লিজ অভিযোগটা দেখাবেন ?
মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি ?
রিতম বাবু একটু হেসে বিস্ময় সহকারে পুনরায় বললেন, “এতদিন জানতাম থানা সাধারণত লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের স্বার্থে স্পট ভিজিট করেন, আজ দেখছি তার উল্টো । এবার দয়া করে বলবেন অভিযোগটা কে করেছেন” ?
কেষ্টাদাকে দেখিয়ে পুলিশ আধিকারিক বললেন, “কেষ্টা বাবু” ।
কে কেষ্টা ? কেষ্টা কী সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, যে তাঁর কথা শুনেই আপনারা চলে এলেন ?
পুলিশ আধিকারিক মাথা চুলকিয়ে বুঝতে পারলেন, কেষ্টার কথায় তিনি অবাঞ্ছিত সওয়ালের সম্মুখীন হচ্ছেন । তাই তিনি কেষ্টাকে পরামর্শ দিতে চাইলেন, তাঁর অভিযোগ লিখিত আকারে দিতে । তাহলে তাঁদের পক্ষে ম্যানেজার বাবুর সাথে আইনিভাবে কথা বলা নিয়মের মধ্যে পড়বে । সেই কারণে লিখিত অভিযোগ চাইতে কেষ্টার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন, “কেষ্টা স্পট থেকে উধাও” । তাজ্জব বনে গেলেন পুলিশ আধিকারিক । তিনি নিজেও একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন । পুলিশ আধিকারিকের অস্বস্তিকর অবস্থা অবলোকন করে রিতম বাবু এগিয়ে এসে বললেন, “চলুন, ঘরে বসা যাক” । অফিস খুলে ম্যানেজারের চেম্বারে নিয়ে পুলিশ সাহেবদের বসালেন । ইতিমধ্যে ইমলিকে সকলের চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করতে বললেন । চা খেতে খেতে রিতম বাবু বললেন, “এইসব টানাপোড়েন হবে ভেবে আমরা ইমলি ম্যাডামকে ক্যান্টিনের কাজে ঢুকিয়েছি । তাছাড়া ইমলি ম্যাডাম বদলী ঝাড়ুদার হিসাবেও কাজ করছেন । সাময়িক তারা থাকার জায়গা পাচ্ছিলো না, সেই কারণে কয়েকদিন পেছনের বারান্দায় তাদের থাকতে বলেছি । মানবিকতার আর একটা দিকও আছে, ইমলি ম্যাডাম অন্তঃসত্ত্বা । এই অবস্থায় যেখানে সেখানে রাত্রি যাপন তার পক্ষে মোটেই ভাল না” । পুলিশ আধিকারিকের দিকে পুনরায় তাকিয়ে রিতম বাবু বললেন, “দুজনেই ঐদেশের যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ । ইতাস বাবু ভাল চাকরি করতেন । ইমলি ম্যাডাম আইনের ডিগ্রিধারী । তিনি ফরিদপুর জেলা আদালতে আইনি ব্যবসা করতেন । এদেশে তারা তাদের শিক্ষার কোনো দাম পায়নি বলে আজ ভিখারীর ন্যায় অবস্থা । ভাল বংশের মানুষ হওয়া সত্বেও আজ তারা নিঃস্ব । সবটাই তাদের কপাল । এমতাবস্থায় আমরা তাদের কিছুটা হেল্প করছি বলতে পারেন । এতে আমাদের অন্যায় কোথায়, এটাই বুঝতে পারছি না” ।
পুলিশ সাহেব ম্যানেজার বাবুকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে বললেন, “আমরা এবার চলি । পরে আর একদিন এসে আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করা যাবে । আজকের কান্ডকারখানার জন্য আমরা দুঃখিত” । তারপর পুলিশ সাহেবেরা স্থান ত্যাগ করলেন ।
রিতম বাবু ইতাসকে বললেন, “ডরাবেন না । আমরা আপনাদের পাশে আছি । কেষ্টা দোকানদারকে পরে আমি দেখছি । তার অনধিকার চর্চার যোগ্য জবাব পাওয়া উচিত । তার সাহস কিভাবে হোলো পুলিশ নিয়ে সোজা ব্যাঙ্কে এসে হুজ্জুতি” ! ম্যানেজার বাবু ঘরে চলে গেলেন ।
ইমলি ইতাসকে কানে কানে বললো, “এখানে অর্থাৎ ব্যাঙ্ক প্রেমিসেসে থাকা কতোদিন সম্ভব হবে, বোঝা যাচ্ছে না । বরং আমাদের অন্যত্র থাকার প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে” ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইতাস বললো, “রাতারাতি কোনো কিছু সম্ভব না । সময় লাগবে । কর্ম করে যাচ্ছি । দেখা যাক কতোদূর কী করা যায়” । তারপর চা-মুড়ি খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো ইতাস । সাড়ে সাতটার মধ্যে বাস স্ট্যান্ডে ঢুকতে পারলে এক্সপ্রেস বাসের প্যাসেঞ্জার পাওয়া সহজ হয় । এক্সপ্রেস বাস ঢুকলে ইতাসের পেয়ারা বিক্রিবাট্টা বাড়ে । অনেক প্যাসেঞ্জার বাড়ির জন্য বেশী সংখ্যায় পেয়ারা কেনেন । তাই ইতাস বাড়ি থেকে সকাল সকাল বের হওয়ার চেষ্টা করে । সকালে বাড়ি থেকে বের হতে পারলে দুই ঝুড়ি পেয়ারা অবধারিতভাবে বিক্রি হবেই । তখন লাভটা আশানুরূপ হয় । তখন ইতাসের মুখে হাসি ফোটে ।
ইতাস এবার পেয়ারা ছেড়ে কিছুদিন পাকা কলার হকারির ব্যবসা করে বাজারের পরিস্থিতি যাচাই বা অনুধাবন করতে চাইছে । তার ধারণা পাকা কলারও বিক্রিবাট্টা সমানভাবে হবে, বরং আরও ভাল হবে । যেমনি কথা তেমনি কাজ । পাকা কলা বিক্রির ক্ষেত্রেও ইতাস সফল । বরং পাকা কলা বিক্রিতে লাভ বেশী । ইতাস সকালে পাকা কলা ও বিকালে ফুচকা বিক্রি শুরু করলো । ইদানীং ফুচকা বিক্রি করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ইতাসের রাত হচ্ছে । তবুও ইতাসের পরিশ্রমে ক্লান্তি নেই । খাটতে তার ভালই লাগে । ভবিষ্যতের কথা ভেবে ইতাস রাত-দিন খাটছে । তাদের যেভাবে হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । সংসারের বাঁধন শক্ত করতে হবে । সামনে তাদের মধ্যে নতুন অতিথির আগমন । নতুন অতিথির আগমনের আগেই ইতাস চাইছে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাতে । তার জন্য ইতাসের নিরলস পরিশ্রম ।
ভাবনা এক, আর তার বাস্তবায়ন আলাদা । ভাবনার বাস্তবায়ন যে কতো কষ্টকর সেটা ইতাস ও ইমলি হাড়ে হাড়ে এখন টের পাচ্ছে ।
কলার ঝুড়িটা বাস স্ট্যান্ডে প্যাসেঞ্জারদের বসার বেঞ্চের উপর রেখে ইতাস টয়লেটে গেলো । টয়লেটে যাওয়া ও আসা এবং টয়লেট করা নিয়ে সর্বসাকুল্যে দশ মিনিটের মামলা । ফিরে এসে ইতাস কলার ঝুড়ির অবস্থা দেখে হতবাক ! সে কাঁদবে না হাসবে, বুঝে উঠতে পারছে না । বেঞ্চের উপরে ঝুড়ির দুপাশে দুটো হনুমান বসে মনের সুখে কলা খাচ্ছে । চারিপাশে মানুষজন আয়েশ করে সেই দৃশ্য দেখছেন । কলাওয়ালার সর্বনাশ হচ্ছে জেনেও কেউ কিন্তু হনুমান তাড়ানোর নাম করছেন না । বরং হনুমানের কলা খাওয়াটায় মজা পাচ্ছেন । “পড়ি-কী-মরি” অবস্থায় ছুটে এসে ইতাস হনুমান তাড়ায় । প্রায় ঝুড়ির অর্দ্ধেক কলা শেষ । ইতাসের মাথায় হাত । অবশিষ্ট কলায় লাভ দূরে থাক ফলবিক্রেতা গোবর্ধন কলিতার টাকাটা পরিশোধ করতে পারলেও রক্ষে । নতুবা লোকসান হলে তার খুব বিপদ ! কলিতা দাদার টাকা শোধ করতে না পারলে পরের দিন ধার-বাকীতে তার কাছ থেকে ফল কেনাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ! চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ ! ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ইতাস কলা বিক্রিতে পুনরায় মনোযোগ দিলো ।
পরের দিন ইতাস পেয়ারা বা কলা, কোনো ফলের দিকেই হাঁটলো না । ঝাল চানাচুর, বাদাম ভাজা, ছোলা ভাজা, চিরে ভাজা, ডালমুট, ভুজিয়া, ছোট ছোট প্যাকেট বানিয়ে বাসে উঠে বিক্রি করতে লাগলো । মুখরোচক ভাজা বিক্রি করতে গিয়ে ইতাসকে অন্যান্য হকারদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হোলো । কেননা আরও তিনজন হকার নিয়মিত এই লাইনে চানাচুর, বাদাম ভাজার হকারির ব্যবসা করে । তাদের মধ্যে অতিরিক্ত আর একজন হকার বাসে বাসে বিক্রি করলে তাদের বিক্রিবাট্টা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা । তাই অন্যান্য হকারেরা ইতাসকে চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলো,”হকারি ব্যবসায় নামার আগে সে হকারি ইউনিয়নের খাতায় নাম লিখিয়েছে কিনা ? হকারি ইউনিয়নের অনুমতি ছাড়া যখন খুশী, যেভাবে খুশী মালপত্র নিয়ে হকারি করা যায় না” । হকারদের আবার মধ্যমণি পান-বিড়ির দোকানের কেষ্টাদা । অগত্যা ইতাসকে বাধ্য হয়ে হকারি ইউনিয়নের খাতায় নাম নথীভুক্ত করতে হোলো । নতুবা অন্যান্য হকারেরা তাকে বিশ্রিভাবে জ্বালাতন করছিলো । ইতাস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, তাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে দস্তুরমতো হিম্মত থাকা দরকার । নতুবা অযাচিতভাবে কেষ্টাদার মতো কিছু উজবুক মানুষের লাঞ্ছনা অবধারিত । এড়িয়ে যেতে চাইলেও সেটা সম্ভব না । তাই ইতাস হকারি ইউনিয়নের খাতায় নাম লেখালো । মাসে চাঁদা দু-টাকা ।
চানাচুর, ভুজিয়া, বাদাম, ছোলা ভাজা, ডালমুট, ইত্যাদি মালপত্র মহাজনের ঘর থেকে পাইকারি দরে কিনে এনে বাড়িতে রাত জেগে তার প্যাকেটিং । পরের দিন ভোরবেলায় সেগুলি বিক্রির উদ্দেশ্যে বাস স্ট্যান্ডে ছোটা । মহাজন প্রথমে ধার দিতে রাজী হননি । গদাই গ্যারান্টর হওয়ায় মেমারী বাজারের মহাজন, আগরওয়াল-জী বাকীতে ইতাসকে মাল দিতে রাজী হলেন । তাঁর একটাই শর্ত, প্রতিদিন মাল তুলে সেই মাল বিক্রির পর আগের টাকা ফেরৎ দেওয়া বাধ্যতামূলক । আগের বকেয়া মেটানোর পর আবার বাকীতে মাল তুলতে পারবেন । নচেৎ আগের টাকা বাকি পড়লে পুনরায় মাল দেওয়া সম্ভব না । আগরওয়ালের শর্তে ইতাস রাজী ।
আগরওয়াল-জীর মাল যথেষ্ট স্ট্যান্ডার্ড । উন্নত মানের । বাদামগুলি ভীষণ ঝাড়াই-বাছাই । তাঁর বাদাম আসে হুগলীর আরামবাগ অঞ্চল থেকে । চাষে বাদামের ফলন ভাল হলে বাদামগুলি পুষ্ট হয় । পুষ্ট বাদাম দিয়ে বাদাম ভাজা হলে সেই বাদাম ভাজার টেস্ট আলাদা । সেই ক্ষেত্রে গ্রাহকদের মুখ থেকে অনেক প্রশংসার বাণী শোনা যায় । আগরওয়ালের কারখানায় চানাচুর খুব যত্ন নিয়ে ভাজে । আগরওয়ালের মুখরোচক খাবারগুলি এলাকায় প্রশংসনীয় ।
ইতাস শিক্ষিত মানুষ । মুখরোচক খাবারগুলি বিক্রি করার ক্ষেত্রে কিভাবে মানুষের মন জয় করা যায় সেই মার্কেটিং ফরমুলা তার সহজাত প্রতিভা । যার জন্য তার চানাচুরের, বাদামের, ভুজিয়ার প্যাকেট খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায় ।
সেদিন বুধবার । বাড়ি থেকে খুব ভোরবেলায় বের হওয়ার সময় ইমলিকে বলে গেলো তার ফিরতে দেরী হবে । কেননা সে মালডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে মাল বিক্রি করতে যাচ্ছে । ইদানীং মালডাঙ্গায় তার অনেক খরিদ্দার । যতোবার মালডাঙ্গা মাল বিক্রির জন্য গেছে ততোবার তার বিক্রিবাট্টা ভাল হয়েছে । তাই আজ সে আজ মালডাঙ্গায় চললো মুখরোচক খাবারগুলি বিক্রি করতে ।
কুসুমগ্রাম বাস স্ট্যান্ড থেকে সকাল ৬টার বাস ধরে প্রথমে মন্তেশ্বরে নামলো । সেখানে পরপর দুটো-তিনটে বাসে ইতাস চানাচুর, বাদাম বিক্রি করার জন্য উঠা-নামা করলো বটে, কিন্তু বিক্রিবাট্টা সেরকম হোলো না । সকালের দিকে ভাজা জাতীয় খাবারের চেয়ে বাসের প্যাসেঞ্জারেদের বেশী চা-কফি পছন্দ । হকারি করতে গিয়ে ইতাসের এটা অভিজ্ঞতার নিরিখে ধারণা । তারপর ভোরের সকালের বাসে বিক্রি বাট্টা আশানুরূপ না হওয়ার জন্য ইতাস পুনরায় অন্য একটা লোকাল বাস ধরে সোজা মালডাঙ্গা ।
মালডাঙ্গায় পৌঁছে প্রথমে বাজারটা ঘুরলো । বাজারটা ঘুরে টুকটাক বিক্রি হোলো । তারপর তার ভীষণ জল তেষ্টা । তাই ভাবলো জল খেয়ে এক কাপ চা খাওয়া যাক । মালডাঙ্গায় দয়াময়ের চায়ের দোকান জনপ্রিয় । তাছাড়া দয়াময়ের হাতে বানানো চা এলাকায় ভীষণ সুস্বাদু । ইতিপূর্বে একদিন সে দয়াময়ের দোকানে চা খেয়েছে, যার জন্য চায়ের গুণমান সম্বন্ধে তার জানা । রাস্তার পারের টিউবওয়েল থেকে ঢকঢক করে এক পেট জল খেয়ে কাঁধের ব্যাগে হাতের চানাচুরের, বাদামের প্যাকেটগুলি ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে দয়াময়ের চায়ের দোকানে গিয়ে বেঞ্চে বসলো ।
দাদা এক কাপ চা দেবেন প্লিজ ?
“চায়ে চিনি চলবে তো দাদা” ? চায়ের দোকানদার, দয়াময় জিজ্ঞাসা করলো ।
হ্যাঁ দাদা । চিনি, দুধ সবকিছুই দেবেন । তার আগে আমাকে একটা পাউরুটি মাঝখানে কেটে উনুনে সেঁকে দেবেন । পাউরুটি দিয়ে চা খাবো ।
“খাবার জল দেবো দাদা” ?
না । একটু আগে টিউবওয়েল থেকে জল খেলাম ।
“ ঠিক আছে । একটু বসুন । আমি পাউরুটি সেঁকে আনছি” । দয়াময় পাউরুটি সেঁকতে উনুনের পাশে গেলো ।
একটি ছোট থালায় সেঁকা পাউরুটি ও মাটির বড় ভাঁড়ে চা দিয়ে গেলো দয়াময় ।
দোকানের এক কোনে বসে খুব তৃপ্তি করে ইতাস চা ও পাউরুটি খাচ্ছে । এমন সময় একজন ভদ্রমহিলা তার সামনে এসে দাঁড়ালেন । ভাঁড়ের অর্দ্ধেক চা খাওয়া শেষ । মাথা তুলে ভদ্রমহিলাকে ইতাস বলতে যাবে ম্যাডাম একটু পাশে দাঁড়ান, তার আগেই ম্যাডাম ইতাসের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো ? আপনাকে খুব চেনা লাগছে” ।
ইতাস অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়লো ! ম্যাডাম বলে কী ? আমাকে কোথা থেকে দেখবে ? সে তো ভিন্‌ দেশের মানুষ । তারপর ইতাস হেসে বললো, “ম্যাডাম, আপনি হয় তো অন্য কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন” ।
“না, আমি গুলিয়ে ফেলছি না । আপনাকে কোথাও দেখেছি । সেটা আমি আমার স্মৃতিতে আনতে পারছি না । এবার দয়া করে বলবেন, এখানে কোথায় থাকেন” ? ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন ।
বড্ড সমস্যায় পড়া গেলো । তার এখন মাল বিক্রি করার সময় । ভদ্রমহিলার সাথে বকবক করলে তার ব্যবসার ক্ষতি । ইতাস ভদ্রমহিলাকে বললো, “দেখুন ম্যাডাম, আমি হকারি করে খাই । থাকি আপাতত কুসুমগ্রামে । এবার আমাকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে হবে । লাইনের বাসগুলি মালডাঙ্গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে । আমার চানাচুর বিক্রির ব্যাঘাত ঘটছে । বিক্রিবাট্টা করে দোকান থেকে চাল কিনে বাড়ি গেলে তবেই বৌ-টা রান্না বসাতে পারবে । আমি আসছি ম্যাডাম” ।
“উঁহু, পালালে চলবে না । আমার এখন মনে পড়েছে । কুসুমগ্রামের বাসস্ট্যান্ডে আপনি পেয়ারা বিক্রি করছিলেন । আপনার কাছ থেকে সেদিন এক গুচ্ছ পেয়ারা কিনেছিলাম । বারুইপুরের পেয়ারা । এবার বলুন, আপনার পেয়ারার ঝুড়ি কোথায় ? আমি আজও বেশ কিছু পেয়ারা কিনতে চাই” ।
“পেয়ারা বিক্রি ছেড়ে দিয়েছি । এখন চানাচুর, বাদাম, ভুজিয়া, ডালমুট, ইত্যাদি মুখরোচক খাবার বিক্রি করি” ।
“সেটাই বের করুন । আমি বাদাম কিনবো” ।
অগত্যা, চানাচুরের-বাদামের প্যাকেট বের করলো ইতাস । ইতাস প্যাকেট বের করলো বটে, কিন্তু তার মনের ভিতর কেমন যেনো ভয় ভয় করছে । এই ভদ্রমহিলা তাকে কোনো বিপদে ফেলে দেবে না তো ? এদেশের মেয়েদের সাথে মেলামেশার সুযোগ ঘটেনি । তাই আমতা আমতা করে ম্যাডামকে ইতাস বললো, “বাদামের প্যাকেট কটা দেবো ম্যাডাম” ।
“উহুঁ ! ম্যাডাম নয়, আমি দীপালি । আমাকে দীপালি নামে ডাকবেন ? এবার দয়া করে বলবেন, আপনার নামটা কী” ?
সর্বনাশ ! ভদ্রমহিলা তার নাম জানতে চাইছে । ইতাস না পারছে পালাতে, না পারছে ভদ্রমহিলাকে এড়াতে । যতোটুকু বোঝা যাচ্ছে, ভদ্রমহিলা তার সম-বয়সী । শ্যামলা বর্ণের হলেও শরীরের গঠন আঁটোসাটো । মিষ্টি চেহারা । চেহারা যেমন মিষ্টি তেমনি তার হাসিটাও আকর্ষণীয় । বোঝাই যাচ্ছে মহিলা তার সঙ্গে আলাপ জমাতে ভীষণ আগ্রহী ।
“ম্যাডাম, আমার নাম ইতাস । এবার আমি আসি ম্যাডাম” ।
“পালালে আমার বাদাম কে দেবে” ? দীপালি ম্যাডাম কড়া চোখে তাকালো ।
কটা প্যাকেট দেবো ।
দশটা । সঙ্গে চানাচুরও দশ প্যাকেট ।
দাম দিতে গিয়ে দীপালি ম্যাডাম বললেন, “আমার সঙ্গে একটু বাইরে যেতে হবে । আমি মানি ব্যাগ আনতে ভুলে গেছি” ।
দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে একশ টাকার নোট বের করে দীপালি ম্যাডাম বললেন, “দামটা রাখুন” ।
কিন্তু ম্যাডাম, আমার কাছে অতো খুচরা নেই ।
ধমক দিয়ে ম্যাডাম বললেন, “আপনাকে “ম্যাডাম” সম্মোধনে ডাকতে না করলাম । শুধুমাত্র দীপালি নামে আমাকে ডাকবেন । আর শুনুন, কাল এখানে মাল বিক্রি করতে এসে আমার বাকী পয়সা দিয়ে দেবেন” ।
ফিরে যাওয়ার সময় দীপালি ম্যাডাম সুন্দর একটা হাসি দিলেন । ইতাসের পরিশ্রান্ত শরীরে ম্যাডামের হাসির মাহাত্ম বুঝতে গেলে বেচাকেনা বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে হবে । কিন্তু দীপালি ম্যাডামের শারীরিক ভাষার উচ্ছ্বাসে ইতাস মোহিতো ।
দীপালি ম্যাডামের এক ঝলক হাসিতে সেদিন ইতাসের বিক্রি করার দিকে ঝোঁক কমে গেলো । তখন বেলা তিনটে । দুপুরের খাবার খাওয়া হয় নি । বাস স্ট্যান্ডের সন্নিকট একটা ভাতের হোটেল । সেই সময় অনেকেই হোটেলে ভাত খাচ্ছেন । ইতাস ডাল ও ওমলেট দিয়ে পেট পুরে ভাত খেলো । তার খুব খিদে পেয়েছিলো । উপরন্তু দীপালি ম্যাডামের সঙ্গে বকবকানিতে খিদেটা বরং বেড়েই গিয়েছিলো ।
খাওয়া দাওয়ার পর বাস স্ট্যান্ডে এসে দেখে অনেক প্যাসেঞ্জার । মেমারী যাওয়ার প্যাসেঞ্জার সংখ্যায় বেশী । অনেকক্ষণ মালডাঙ্গায় বাস ঢুকছে না । উতলা মানুষগুলি হাতের কাছে মুখরোচক ভাজাগুলি পেয়ে খুব খুশী । কয়েক মিনিটের মধ্যে তার সমস্ত চানাচুর, বাদাম, ভুজিয়া, চিরে ভাজা, দেরাদুন চাল ভাজা, ডালমুট, কচু ভাজা, সব কটা প্যাকেট শেষ । তার ভান্ডার খালি ।
ইতাসের বিক্রি শেষ, অথচ বাসের দেখা নেই । কানাঘুষো ইতাস জানতে পারলো, দাঁইহাট ও মালডাঙ্গার মাঝখানে লরি উল্টে যাওয়ায় বাস রাস্তা বন্ধ । যতক্ষন লরি সরাতে না পারছে, ততক্ষণ দাঁইহাট থেকে বাস আসা আপাতত বন্ধ । তবে বর্দ্ধমান থেকে মালডাঙ্গার লোকাল বাস মালডাঙ্গায় ঢুকেছে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অতো লোক কিভাবে যাবে ? আর তাছাড়া এই বাসটা কুসুমগ্রাম থেকে ডান হাতে সোজা বর্দ্ধমান । তাহলে মেমারির প্যাসেঞ্জারের কী হবে ?
এইরকম একটা বাসস্ট্যান্ডের পরিস্থিতি । প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা চরমে । বাড়ি ফেরার চিন্তায় তাঁদের শুকনো মুখ ! অন্যদিকে পশ্চিমাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা । আকাশ জুড়ে কালো মেঘ ঘনীভূত । বিকেল পাঁচটা । অথচ নিমেষের মধ্যে মালডাঙ্গা বাজার এলাকায় অন্ধকার নেমে এলো । ঝড় বৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা । আকাশে যেভাবে মেঘ উড়ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড় বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল । দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলো ইতাসকে । কিভাবে বাড়ি পৌঁছাবে সে চিন্তায় অস্থির । অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টিতে ইমলি একা কিভাবে কাটাবে সেটাও ভাবনার বিষয় ! ঝড় বৃষ্টিতে বিশেষ করে ঝড়ে ইমলি ভীষণ ভয় পায় । চিন্তায় ইতাসের কপালে ভাঁজ !
 ( চলবে )