আগের লেখাটিতে লিখেছিলাম যে—- শ্রীগৌরীদাস পন্ডিতের প্রহার থেকে বাঁচতে পূর্বে শ্রীহৃদয়চৈতন্যের শ্রীদেহে স্বয়ং শ্রীশ্রীনিতাই-গৌর প্রবেশ করেছেন একবার । সেই ঘটনাও বড় চিত্তহারী। প্রভু কৃপা করলে আগামী সংখ্যায় জানবো আমরা।
হ্যাঁ, আসুন , আজ এই সংখ্যায় আমরা আস্বাদন করি সেই অপূর্ব প্রসঙ্গ।
কালনায় মহাপ্রভুর বাড়িতে শ্রীশ্রীনিমাই-নিতাই বিগ্রহের জন্মোৎসব শুরু হতে চলেছে আর কিছুদিনের মধ্যেই। সামনে অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব, অনেক ভক্তকে নিমন্ত্রণ—–সে বিশাল ব্যাপার। শ্রীগৌরীদাস পন্ডিত শিষ্যদের গৃহ থেকে উৎসবের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনতে গেলেন তাই । বেশ কিছুদিন সময় লাগবে ফিরে আসতে। তিনি শিষ্য হৃদয়ানন্দকে (তখন তাঁর নাম হৃদয়চৈতন্য হয়নি ) বললেন, “চিন্তা করবে না, আমি ঠিক সময়ে ফিরে আসবো। তুমি যত্ন করে সেবা দিও আমার নিতাই-গৌরকে। শীঘ্রই চলে আসবো আমি।”
আনন্দমনে গৌরীদাস বেড়োলেন। আর, হৃদয়ানন্দ দায়িত্ববান সেবক হয়ে সেবার কার্য সামলাতে থাকলেন। গৌরীদাস প্রিয়জনদের নিয়ে গৌরপ্রেমে মজে রসোল্লাসে নির্জনে ভ্রমণ করতে লাগলেন। দিন অতিক্রান্ত হতে লাগলো। এদিকে চিন্তায় পড়ে গেলেন হৃদয়ানন্দ। কারণ, উৎসবের মাত্র দু-দিন বাকী। অথচ, এখনও ফিরলেন না গৌরীদাস। সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছেন যেন হৃদয়ানন্দ। কারণ, কী করবেন, কী করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। আর কবে নিমন্ত্রণ করা হবে সকলকে! বড় চিন্তার ব্যাপার এসে দাঁড়ালো তো ! শ্রীগুরুদেবের ফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছে সেটাও ভাবার বিষয়। তিনি কুশলে আছেন তো ! এদিকে, আর দেরী করলে যে জন্মোৎসবটাই এবছর বন্ধ হয়ে যাবে, পালন করা যাবে না যে!
অবশেষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হৃদয়ানন্দ ভাবলেন, শ্রীগুরুদেবের চরণপদ্ম স্মরণ করে উৎসবের আয়োজনে লেগে পরি বরং! তিনি তো বলেইছেন যে ঠিক সময় মতো ফিরে আসবেন। আমি তাহলে পত্রী পাঠিয়ে আগামীকাল নিমন্ত্রণটা সেরে ফেলি। উৎসবের একদিন আগে হলেও অন্ততঃ আমন্ত্রণটা পাক ভক্তরা।” তাই উৎসবের আগের-আগের দিন অর্থাৎ এক দিন হাতে থাকতে পত্রী পাঠিয়ে দিলেন হৃদয়ানন্দ চারিদিকে। না হলে, আর তো দিন নেই অপেক্ষা করার মতো!
এদিকে পরদিন, অর্থাৎ উৎসবের আগের দিন গৌরীদাস ফিরে এলেন শ্রীপাটে। তিনি এসে হৃদয়ান্দের মুখে শুনলেন যে পত্রী পাঠিয়ে গৌরীদাসের নাম করে নিমন্ত্রণ করে ফেলা হয়েছে সব স্থানে। মনে মনে ভীষণ আনন্দ পেলেন গৌরীদাস শিষ্যের এহেন বিচক্ষণতায়। কিন্তু, বাইরে একটু ছদ্ম অভিনয় করলেন ক্রোধ প্রকাশের। বললেন, “আমি তো এখনও মরিনি। আমি থাকতেই তুমি এমন স্বতন্ত্র আচরণ করে ফেললে! না অনুমতি নিয়েই আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে দিলে! এত স্বতন্ত্র ভাব তোমার! নাহ্, তুমি আর এখানে থাকার যোগ্য নও। তুমি এখন যখন উপযুক্ত হয়েই গেছ, তখন বেড়িয়ে যাও মন্দির ছেড়ে এখান থেকে। স্বতন্ত্র উৎসব করো গে যাও ! তোমার আর প্রয়োজন নেই এ উৎসবের। ”
শ্রীগুরু-আজ্ঞা শিরোধার্য করে মাথা নীচু করে হৃদয়ানন্দ বেড়িয়ে গেলেন গুরুদেবের চরণ বন্দনা করে। গুরুর আদেশ তো অবশ্য প্রতিপাল্য, কোন প্রতিবাক্য চলে না সেখানে। তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন চেষ্টাও করতে নেই যে !
হৃদয়ানন্দ গঙ্গাতীরে এক বৃক্ষের তলায় বসে আঁখিনীরে ভাসছেন আর নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য ব্যথাতুর ,বেদনাহত হচ্ছেন। এমন সময়ে নৌকা এসে থামলো। সে নৌকায় বোঝাই করে এসেছে উৎসবের প্রয়োজন সামগ্রী, যার ব্যবস্থা গৌরীদাস করতে গিয়েছিলেন। হৃদয়ানন্দ লোক মারফৎ পথ নির্দেশ করে সেসব সামগ্রী পাঠিয়ে দিলেন গৌরীদাসের গৃহ মন্দিরে। কিন্তু, গৌরী দাস যখন জানলেন যে হৃদয়ান্দই পথ বলে গঙ্গাতীর থেকে পাঠিয়েছেন, তখন সক্রোধে বললেন, “যে পাঠিয়েছে পথ বলে, তার কাছেই ফিরে যাও তোমরা এসব সামগ্রী নিয়ে। আর বলো যে, আমি বলেছি গঙ্গাতীরে ওখানেই সে স্বতন্ত্র উৎসব করুক এসব দিয়ে। আমার এখানে ওসবের প্রয়োজন নেই।
হৃদয়ানন্দ যখন জানলেন যে, তাঁর গুরুদেব এমন আদেশ দিয়েছেন, তখন গুরুর কথা রাখতে গঙ্গাতীরেই ওখানে উৎসবের আয়োজন করলেন। মহা-মহোৎসব হচ্ছে। বহু বৈষ্ণবের সমাগম হল সেখানে। প্রেমানন্দে সংকীর্তন হচ্ছে। জগমন মোহিত হচ্ছে সে সংকীর্তন ধ্বনিতে। এমনকী স্বয়ং নিতাই-গৌর পর্যন্ত সেখানে আবির্ভূত হয়ে নৃত্য করছেন সে আসরে। হৃদয়ানন্দ আবেগে, আনন্দে, আবার গুরুদেবের বিরহে আকুল হয়ে কেঁদে কীর্তন করছেন। দু-নয়ন হতে প্রেমধারা নির্গত হচ্ছে তাঁর।
এদিকে গৌরীদাসও উৎসব করছেন শ্রীমন্দিরে। বৈষ্ণবদের সঙ্গে মত্ত হয়ে কীর্তন করছেন। তিনি জানতে পেরেছেন গঙ্গাতীরে হৃদয়ানন্দের আয়োজিত উৎসব হচ্ছে। সেখানেও মহানন্দের হাট বসেছে নাকি। মধ্যাহ্নকালে সেবক বড়ু গঙ্গাদাসকে ডেকে বললেন ভোগ অর্পণ করতে। গঙ্গাদাস ভোগের থালি নিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতেই দেখেন সিংহাসন শূন্য। নিতাই-গৌর নেই। ‘হায়, হায়’ করে দৌড়ে গিয়ে গৌরীদাসকে বললেন গঙ্গাদাস। শোনামাত্র চমৎকৃত হলেন গৌরীদাস। তাঁর নিতাই- গৌর যে প্রেমবশ্য! তিনি জানেন প্রেমেতে বশীভূত হয়ে গেলে যে কোন জায়গায় চলে যান তাঁরা! নিশ্চয়ই তবে হৃদয়ানন্দের সংকীর্তন উৎসবে চলে গেছেন ! তাঁর নিমাই-নিতাইয়ের এহেন লীলার কথা ভেবে প্রেমবিহ্বল হলেন গৌরীদাস। হৃদয়ে যেন প্রেমবাদ্য বাজতে থাকলো। আনন্দে আত্মহারা হবার অবস্থা। নিজেকে সংযত করলেন গৌরীদাস। আরও একটু রঙ্গ করার জন্য হাতে তুলে নিলেন এক যষ্টি অর্থাৎ একটি লাঠি। লাঠির ঘা বসাবেন তিনি আজ নিতাই-গৌরকে। তিনি মনে মনে বলছেন, “এত বড় সাহস, মন্দির ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছে! যে ডাকবে, তার কাছেই যেতে হবে! এত প্রেমের কাঙাল তোমরা! দেখাচ্ছি মজা! এত ভালোবাসা আমার, তাও কাঙালিপনা যায় না তোমাদের !”
গৌরীদাস হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন গঙ্গাতীরে হৃদয়ানন্দের উৎসবের আসরের দিকে। হাতে তাঁর যষ্টি। তিনি দূর থেকেই দেখতে পেলেন আসরের মাঝখানে দু-বাহু তুলে নৃত্য করছেন মহানন্দে তাঁর নিতাই-গৌর। অদূরে হৃদয়ানন্দও রয়েছে। এদিকে নিতাই-গৌরও সেই একই সময়ে দেখে ফেললেন যে হাতে যষ্টি নিয়ে ক্রোধিত গৌরীদাস এগিয়ে আসছে। তাঁদের বুঝতে দেরী হল না যে, এবার কী ব্যাপার ঘটতে চলেছে। নির্ঘাৎ যষ্টির প্রহার পরবে পিঠে। গৌরীদাস যে তাঁদের দ্বাপর লীলার প্রিয় সখা সুবল ! আর তাই, নিজেদেরকে বাঁচাতে সখা গৌরীদাসের প্রহারের ভয়ে নিতাই-গৌর করলেন কী টুপ করে হৃদয়ানন্দের দেহের ভিতর প্রবেশ করে গেলেন। স্থির দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে তাকিয়েই এদিক পানে ধেঁয়ে আসছিলেন গৌরীদাস। অতএব, তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পরে গেল হৃদয়ানন্দের মধ্যে নিতাই-গৌরের প্রবেশের সেই দৃশ্য। তিনি এসে হাতের যষ্টিখানা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন হৃদয়ানন্দকে। বললেন, “তুমি এত সৌভাগ্যবান হৃদয়ানন্দ! এত তোমার প্রেমগুণ! তোমার অন্তরে নিতাই-চৈতন্য প্রবেশ করলেন! যে জনার হৃদয়ে চৈতন্য প্রবেশ করে সে তো হৃদয়চৈতন্য। তোমার নতুন নাম আজ থেকে হৃদয়ানন্দ নয়, হৃদয়চৈতন্য হোক। তোমার নামের মধ্য দিয়ে এ লীলা জগৎবাসী জানবে। তুমি ধন্য হৃদয়চৈতন্য! ধন্য!”
গুরুশিষ্য নয়নজলে ভেসে আত্মহারা, আবেগমথিত হলেন। হৃদয়চৈতন্য গুরুদেবের চরণে পড়তে গেলেন, গৌরীদাস তুলে নিলেন তাঁকে নিজবক্ষে আবার। এরপর, হৃদয়চৈতন্যকে নিয়ে মন্দিরে ফিরলেন গৌরীদাস। নিতাই-গৌরাঙ্গ পুনরায় সিংহাসনে বিরাজিত হয়েছেন দেখা গেল। প্রেমানন্দে মহোৎসব সম্পন্ন হল। বিগ্রহসেবা সমর্পণ করলেন হৃদয়চৈতন্যকে গৌরীদাস আবার।
যোগ্য গুরুর যোগ্য শিষ্য এহেন হৃদয়চৈতন্যকে প্রাণের প্রণতি নিবেদন করে শ্রীশ্রীনিতাই-গৌরের প্রতি ঠিক এমন তাঁর মতন করেই প্রেমসেবা প্রার্থনা করলাম । যেন, তাঁর মতন করেই এই দুই ভ্রাতাকে নিজের অন্তরের অন্তরতম প্রকোষ্ঠে সযত্নে লালন করতে পারি প্রেমভরে। যেন তাঁদের ও তাঁদের ভক্তদের প্রতি নিষ্কাম সেবা ভিন্ন আর কোন জাগতিক ইচ্ছা এ হৃদয়ে স্থান না পায়।
প্রসঙ্গতঃ বলি, গৌরীদাস পন্ডিত আবার যেভাবে নিতাই-নিমাইকে কালনায় নিজের গৃহে প্রেমবন্ধনে আটকে রেখেছেন , সেও বড় আনন্দদায়ক ও আশ্চর্য উপাখ্যান। প্রভু কৃপা করলে আগামী সংখ্যায় জানবো আমরা।