আজ মুখ্যচন্দ্র জৈষ্ঠ্য ও গৌণচন্দ্র আষাঢ় কৃষ্ণা তৃতীয়া তিথি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব জগতের এক মহানক্ষত্র, মহাপ্রাণ , মহামনিষী, ভারতবিখ্যাত ভক্তিশাস্ত্র ব্যাখ্যাতা তথা শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর ১১তম বংশাবতংস শ্রীল প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী সিদ্ধান্তরত্ন মহোদয়ের ৮০তম তিরোভাব জয়ন্তী এই তিথিতেই। আর তাই শ্রীশ্রীহরিভক্তি প্রচারিণী সভার সকল কেন্দ্রে ও শ্রীশ্রীরাধাকুন্ডে শ্রীল প্রভুপাদের স্মরণোমহোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠানের প্রাচুর্য ও সমারোহ অনেকাংশেই খর্ব করা হয়েছে। নবদ্বীপে ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডের শ্রীশ্রীমদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গণ তথা প্রভুপাদের গৃহমন্দিরে তাঁর প্রখ্যাত প্রপৌত্রগণ প্রভুপাদ শ্রীনিত্যগোপাল গোস্বামী ও প্রভুপাদ শ্রীপ্রেমগোপাল গোস্বামী তাঁর স্মৃতিতে আয়োজন করেছেন মানবসেবার । যাঁরা তুলসী মালা গাঁথেন, শ্রীবিগ্রহের জন্য বস্ত্র বানান—এমন পরিবারদের হাতে ত্রাণ বিতরণ করে প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর লোককল্যাণমূলক আদর্শ ও কর্মধারাকে আরও খানিকটা প্রশস্ত করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। যদিও তাঁদের এমন ধারার লোকহিত-কর্মযজ্ঞ সারা বৎসরব্যাপীই পালিত হয়।
আজ এই প্রবন্ধে আমরা প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর গ্রন্থকর্তা রূপে ভূমিকাটি জানবো।
উনবিংশ শতকের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ইতিহাসের এক সুবৃহৎ স্থান স্বমহিমায় অধিকতর উজ্জ্বল করে রেখেছেন শ্রীল প্রভুপাদ।পান্ডিত্যপ্রকর্ষ, বুদ্ধিপ্রাখর্য, জ্ঞানবৈভব , একাধিক প্রশংসনীয় প্রতিভা, দেশপ্রেম, অন্যায়ের সঙ্গে আপোষহীনতা ও সর্বোপরি ভগবদ্ প্রেমভক্তি পরাকাষ্ঠার এক অলোকজ্জ্বল স্তম্ভ স্বরূপ হলেন এই দার্শনিক মহামানব। ধ্রুবতারা যেভাবে আকাশের দিকনির্দেশ করে ঠিক তেমনভাবেই তিনি আজও যেন মহাকান্ডারী হয়ে অযুত কোটি ভক্তজনাকে সেই সাধন-ভজন রাজ্যের সঠিক পথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চলেছেন। তিনি সশরীরে নেই, রয়েছেন অলক্ষ্যে। তাঁর পিক-বিনিন্দি কন্ঠের সুরসালো , সুসিদ্ধান্তপূর্ণ, সপ্রেম শ্রীমদ্ভাগবত কথামৃত পরিবেশন আজ হয়তো আমরা প্রতক্ষ্য ভাবে শ্রবণ করতে পারছি না , কিন্তু তাঁর লিখিত , সম্পাদিত গ্রন্থরাজিতে, রচিত পদে তিনি নিজেকে চিরকালীন প্রকট করে রেখে গেছেন, যেগুলি পাঠ করলে আমরা সেই মহাপ্রেমিক ভজনানন্দীর মনের , সিদ্ধান্তের , আদর্শের , চিন্তাধারার তথা ভজনোপদেশের সাথে পরিচিত হতে পারবো । আর ,এ তো অমোঘ সত্য যে, যত রকম কীর্তি হয় তার মধ্যে গ্রন্থ প্রণয়নই হল সর্বোত্তম মাধ্যম যার মধ্যে গ্রন্থকার নিজের ভাব-ভাবনা-মতামত-আদর্শকে অমর করে রেখে যান তাঁর লেখনীর প্রতি ছত্রে-ছত্রে , পদে-পদে অক্ষর বিন্যাসের বুননে আর সুসিদ্ধান্তের সম্মিলনে।
একজন গ্রন্থকার রূপে প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর অবদান গৌড়ীয় বৈষ্ণব জগতে চিরস্মরণীয় ও পূজনীয় হয়ে থাকবে। কারণ , তিনি এমন সব সুকঠিন মহাজনী গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন যা আমার মত মূর্খজনাও আস্বাদন করার মত সাহস পায় , আগ্রহী হয় । গোস্বামীবৃন্দের সিদ্ধান্তপূর্ণ সংস্কৃত গ্রন্থগুলির অসাধারণ ব্যাখ্যা ও অনুবাদ এমন সহজ সরল অথচ প্রাঞ্জল ভাবে করেছেন যে মনোযোগী নিষ্ঠাপ্রাণ পাঠক তাঁর কৃপায় বৈষ্ণবীয় দর্শনের ভাবালোকে উদ্ভাসিত হতে পারবেন অতি সহজেই ।
শ্রীজীব গোস্বামীপাদের ‘ষট্ সন্দর্ভ’-এর বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা , শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীপাদের ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু বিন্দু’, ‘উজ্জ্বল নীলমণি কিরণ’ , ‘ভাগবতামৃত কণা’ , ‘রাগবর্ত্মচন্দ্রিকা’ ও ‘মাধুর্য কাদম্বিনী’— এই পঞ্চ গ্রন্থরত্নের বঙ্গানুবাদ করেন প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী। শ্রীল চক্রবর্তীপাদ লিখিত ‘প্রেমসম্পূট’ নামক মহাপ্রেমের গ্রন্থের তাৎপর্য সহ বঙ্গানুবাদ প্রভুপাদ এমন মধুরাতি মধুর প্রেমময় ভাষা ও ভাবে করেছেন যে ,যা পাঠ করলে পাঠকচিত্ত সেই অপ্রাকৃত ভগবদ্ প্রেমরাজ্যের অলোকসুন্দর আবহে অনুপ্রবেশ করে অন্তর্লীন হয়ে যায় প্রেমরসাস্বাদনে।
শ্রীমদ্ ভাগবতের মহাহৃদয়স্পর্শী প্রসঙ্গ ‘উদ্ধব সংবাদ’-এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা প্রভুপাদ এমন সযত্নে ও সুললিত ভাবানুময়তাসহ করেছেন যে পাঠক শ্রীশ্রীযুগলকিশোরের মহাবিরহপ্রেমার্তিতে অনুভবী ও অশ্রুময় হয়ে পড়েন। শুধু কী তাই! ভক্তজনার আদরেরনিধি-গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’-র শ্লোকসমূহের অন্বয় ও সরল বঙ্গানুবাদ করেছেন তাঁর ‘কৃপাকণা প্রকাশিনী’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থ স্বয়ং নিতাইচাঁদই লিখিয়েছেন কৃপা করে । তাইতো প্রভুপাদ গ্রন্থের নামকরণ এমন করেছিলেন। আর , একথা তিনি নিজমুখে জানিয়েছেন।
গ্রন্থকর্তা প্রভুপাদ শ্রীল প্রাণগোপাল গোস্বামীপাদের শ্রীচরণে পরম ভক্তিপূর্ণ প্রণতি নিবেদন করে এই প্রার্থনা জানাই , ওহে আমার মহামহিম পরমেষ্ঠী শ্রীগুরুদেব—-আপনি আমায় কৃপা করুন যাতে আপনার রচিত এসকল গ্রন্থরাজি আস্বাদন ও আত্মস্থ করে ভজনপথে অগ্রসর হতে পারি। শ্রীশ্রীনিতাই-গৌরের, তাঁদের পার্ষদদের ও তাঁদের ভক্তদের মহা মহিমামূলক কথার যেন প্রচার-প্রসার করতে পারি বিশ্বজুড়ে। তাঁদের কথার আস্বাদন করিয়ে যেন ভক্তসেবা করতে পারি প্রতি জন্মে-জন্মে।
কৃপাপ্রার্থিনী
ভজনহীনা, প্রেমহীনা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।