উডল্যান্ডসে ভর্তি রয়েছে বিভাসের বাবা | কিডনি বিকল| ডায়ালিসিস চলছে | আমি, কিংশুক, প্রবাল পালা করে বিভাসের সাথে হসপিটাল ডিউটি দিচ্ছি | তা প্রায় মাস ঘুরতে যাচ্ছে | তবে হাসপাতালের বিল বাড়ছে |আশা কমছে | বোধহয় আর বেশি দিন এই ব্যস্ততা আর থাকবে না | কাল বিভাসের টেম্পােরচর হয়েছিল |অফিস ফেরত হাসপাতালে আসতে ভিজেছিল | টেম্পােরচর হয়তো সেই কারণেই এসেছে| তবে এই প্যান্ডামিক সিচ্যুয়েশনে ভয় হয় | বিভাস কে আমরা তিন বন্ধুরা বারণ করেছি তিনদিন না আসতে| প্রবাল বলেছে তিন দিন আইসোলেশনে থাক| পরে টেস্টের ব্যবস্থা করা যাবে| প্রবাল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ| আমি সুতনু স্কুল টিচার | আর কিংশুক আই. টি সেক্টরে কাজ করে |ওর পার্মানেন্ট নাইট ডিউটি | ব্যাটা নিজের ইচ্ছেমতো অপশন দিয়েছে | ঐ স্বখাত সলিলে ডুবে মরা যাকে বলে| আজ বুঝছে না, যখন গ্যাসট্রিক আলসার হবে বুঝবে | তার ওপরে রাতে ডিউটি করতে করতে চার প্যাকেট উইলস ফিল্টার পোড়ায় | যেমন ফিল্ম স্টারের মতো চেহারা, তেমনি তার কেতা| উত্তম কুমারের সমসাময়িক হলে তার পেটের ভাত মারত| সুতনু নামটা আমার না হয়ে ওর হলেই ভালো হতো |কিংশুকের বৌটাও তেমনি ল্যাদা ক্যাবলা| পতি প্রাণা| যদি বলি “পলাশ প্রিয়া, তুমি ওর চাকরিটা ছাড়াতে পারো না?এতো নাইট ডিউটি! ”
ডাগর আঁখি দুটিতে টলটলে ব্যাথা, ” সুতনু দা, আপনি বলুন না প্লিজ | আমাকে তো ধমক দেয় | ওর মুখের উপর কথা বলি কি করে? বড্ড ভয় করে যে|” মনে মনে বলি, ন্যাকা, কচি খুকি একেবারে | মনের কথা মুখে বললে সম্পর্ক নষ্ট হবে | মুখে বলি, Secloওষুধ টা বাড়িতে রেখো| অবশ্য একবার ডাক্তারের সাজেশন নিয়ে নিও| পলাশ প্রিয়া উদ্বিগ্নতা চাপতে পারে না,” জানেন দাদা, আজকাল প্রায়ই বলে নাভির কাছে ব্যাথা | খিদে কম| ” “কি আর করা যাবে, ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করতে হবে | বিভাসের বাবার ব্যাপারে দুপুরে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে | রেস্ট বেশি পাচ্ছে না | লাঞ্চ করে ছুটতে হচ্ছে উডল্যান্ডসে | যাক গে, খাওয়াতে ভাজাভুজি দিও না, রান্নায় তেল- মশলা কমাও| দেখি ওকে বলে শিফট যদি চেঞ্জ করে | এই মাগ্গি গন্ডার বাজারে নতুন চাকরি…. নেক্সট টু ইমপসিবল|” পলাশ প্রিয়ার মনের ভার যায় না | ওকে স্বাভাবিক করতে বলি,” আবার ঘরে ঝুল জমেছে | কাল এসে যেন দেখি না.|” আমাদের মধ্যে কিংশুক প্রথম বিয়ে করেছে | পাশের পাড়ার প্রেম | তাই পলাশ প্রিয়া আমাদের সবার প্রিয় | আমি করি ওর ওপর গার্জেনগিরি| কিংশুকের মা- বাবা গত| ভাইবোন বিবাহিত |
তাই সংসারের ব্যাপারে টিপস দেয়া আমার মহৎ দায়িত্ব বলে আমি মনে করি | বিভাস, প্রবাল, এমনকি কিংশুক আমার নতুন নামকরণ করেছে জ্যাঠা মশাই | আমি চোখ ছোট্ট করে বাঁকা দৃষ্টি দিলে, ওরা হাসে আর আমাকে শান্ত করতে বলে, পলাশ প্রিয়া আসার পর বুঝলাম, সত্যি তুই সাংসারিক বুদ্ধিতে আমাদের চেয়ে অনেক দড়| তোর বৌয়ের কোন অসুবিধা হবে না | এহেন প্রশংসায় আপ্লুত আমি বলি, তোদের বোধোদয় হল, তবে অনেক দেরিতে | ভাবনার চটক ভাঙে পলাশ প্রিয়ার বিভাসের বাবার শারীরিক অবস্থা জানার ইচ্ছায় | দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, দীর্ঘদিনের রোগ| ডায়ালিসিস করতে করতে শরীর আগেই ঝাঁঝরা| বিভাস দের ভালো ব্যবসা, তাই টানতে পারছে| আমার বাবার এই একই রোগ হয়েছিল | লোন করেছিলাম| কিন্তু সে কতটুকু আর! শেষের দিকে হাল ছাড়তে হলো| মায়ের গয়না গুলো স্যাকরার ঘরে পড়ে রয়েছে আজো| বিক্রি করিনি, একদিন ছাড়াতে পারব এই আশায় বন্ধক দিয়েছিলাম| সে তো এখন সুদে আসলে অনেক টাকা | তবে সবই ভগবানের খেলা | বিভাস তো জলের মতো টাকা খরচ করছে, কাকাবাবু বাঁচবেন কিনা কে জানে! সান্ত্বনা এই, চিকিৎসার কার্পণ্য হচ্ছে না |পলাশ প্রিয়ার মুখ বড়ো ম্লান | মেয়েটার বড়ো নরম মন|
“আসি বোন, বিভাস কে দেখে যাই, জ্বর কমল কিনা?” পলাশ প্রিয়া সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আমায় বিদায় দেয় | কিংশুকের ফেরার সময় হয় নি | জানি কিংশুক ওর আসার আগে আমার ফেরার হওয়া নিয়ে পরে অভিমান করবে| অন্যদিন ব্রেকফাস্ট করে এ বাড়ি থেকে পত্রপাঠ বিদায় হই| আজ বিভাসের খবর নেব, মা বাজার যাওয়ার কথা বলে রেখেছে| তারপর স্কুল আছে |
[30/06, 11:57 PM] Asoka Roy: সেদিন কি স্কুল যাওয়া হয়েছিল? না হয় নি | শুধু বিভাসের খবর নেয়া হয়েছে | ফিরতি পথে বাড়ির গলির মোড়ে পার্কের সামনে এমন একজনের সাথে দেখা, যাকে দেখে ইচ্ছে হয়েছে অ্যাভয়েড করি, পারিনি | যে আর কোনদিনই এ্যাভেলেবল নয়, তাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় কোন গোমূর্খ? অথচ তার কন্ঠস্বরের রিনিঝিনিতে তনু বাদ দিয়ে শুধু সু ডাক এড়াই কি করে?শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন? ” কেমন আছো?” সেই মুহূর্তে তো নিজের মনকে বোঝাই, ” হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, এ শুধু পরিচিতার কুশল জানার সৌজন্য| মনকে আঁখি ঠারা প্রমাণ হয়েছে, যখন সে বলেছে,” পার্কের আমাদের সেই বেঞ্চে চল না একটু বসি| কাঁচপোকার টান| দুজনে পাশাপাশি | আগের মতো নয় | দুরত্ব একটু বেশি | তবে এতটাও নয় যে, তার দামি পারফিউমের গন্ধ আমার নাকে আসবে না | গন্ধটার সাথে আমার পরিচয় নেই | তবে তার গায়ের গন্ধ আমার চেনা, অনেক দিনের জানা.
[01/07, 10:12 AM] Asoka Roy: কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ | নীরবতা ভেঙেছি আমি | পুরুষ মানুষ না! পৃথিবীর সব কিছু গোলমাল সহজ করার দায়িত্ব বোধহয় পুরুষদের নিতে হয় | অবশ্যই এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত |আর আমি এক ইনট্রোভাট পুরুষ, মনের কথা মনেই থাকে, মুখে নির্লিপ্ততার মুখোশ পরা থাকে | তাই তো মা যেদিন আমার আজকে পাশে বসা মেয়ের বাড়িতে উপযাচিকা হয়ে আমার সাথে তার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গিয়ে শুনেছে, আপনার ছেলে তো সামান্য স্কুল মাস্টার| আমরা মেয়ের জন্য আই. এস, আই পি. এস খুঁজছি.. ” তার ওপর সুতনুর ঘাড়ে দু দুটো আই বুড়ো বোনের দায়িত্ব |”
মা একপ্রকার পালিয়ে এসেছে | নিজের ভাগ্যকে গঞ্জনা দিয়েছে, “আমার ছেলেটা ভালোবাসলো তো ভালোবাসলো এমন একজনকে,যে নিজের ভালোবাসা পেতে লড়াই করতে জানে না | আজ অনু যদি আমাদের পাশে দাঁড়াতো, তবে ওদের ছোট্ট বেলার মেলামেশা আজ পরিণতি পেত | মাকে সেদিন বলতে পারিনি, কি করে অনুত্তমা লড়াই করবে? ও যে নিজেও আমার মতোই ইনট্রোভাট | তাইতো বাবা – মায়ের পছন্দের আই পি এস পাত্রের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে তাকে চলে যেতে হয়েছে সল্টলেক আজ থেকে ঠিক একমাস আগে| নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম সপরিবারে| কিন্তু মায়ের সপাট নির্দেশ, কেউ যাবে না এই বিয়েতে | অনুত্তমার বিয়ের দিন কাউকে বুঝতে দিইনি বুকের মধ্যে ঝড়ো হাওয়ায় নোঙর ছেঁড়ার বেদনা| কাজকর্ম স্বাভাবিক| রাতে পাশবালিশে এপাশ- ওপাশ| না পড়ে নি চোখের জল| পুরুষ মানুষ আমি, ছিঁচকাঁদুনে হবো কেন? তবে সকালে প্রবাল একটা চিঠি এনে দিয়েছে, অনুতপ্ত অনুত্তমার চিঠি| চিঠি পড়ে বুকে মোচড়.. এটুকুই শুধু জানা থাক, বিষয় বস্তু যে একান্ত ব্যক্তিগত| স্যরি শেয়ার করতে পারলাম না | এ আমার স্বর্নচাঁপার স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরদিন | অনুত্তমাকে বোধহয় আমি ক্ষমা করে দিয়েছি |
আজ যে অনুত্তমাকে প্রথমে এ্যাভয়েড করতে চেয়েছি, সেটা ওর দুই পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্যে| প্রত্যাখানের বা প্রবঞ্চনার জ্বালায় নয়| অনুত্তমার প্রতি আমার ভালোবাসা চিরন্তন| ধরবে না কোনদিন ফাটল | তাই তো মা কে নিরস্ত করেছি আমার জন্য পাত্রী দেখতে |
আড়চোখে দেখে নিয়েছি, অনুত্তমার পরণে আনার রঙা শাড়ি |আমার প্রিয় রঙ| পানপাতা মুখে চিবুকের কালো তিলটা অন্যমনস্ক | ঐ তিলের প্রতি আমার প্যাশনের কথা অনুত্তমার জানা| বলেছিলাম, ফুলশয্যার রাত থেকে আমার টার্গেট হবে ঐ চিবুকের তিল | থাক, পরস্ত্রী সম্পর্কে এ কথা ভাবাও পাপ | কিন্তু কি বলব অনুত্তমাকে? আজ যেন আমরা প্রস্তরযুগের দুই মানব – মানবী | এসে পড়েছি নতুন যুগে | বদলাতে হবে আমাদের ভাষা, আমাদের আচরণ| কারণ আমাদের ভালোবাসা যে চলে গেছে উইংসের আড়ালে | জানি না অনুত্তমার অনুভব, তবে সুতনু নামে এই আমি সংযমে আস্হা রাখি | নীরবতা ভেঙেছি |জিজ্ঞেস করেছি, ” কেমন আছো? নতুন শ্বশুর বাড়িতে নিশ্চয়ই এ্যাডজাস্টমেন্ট হয়েছে?” বরের সাথে মিলেমিশের কথা জানতে বাধো বাধো ঠেকেছে |
[01/07, 11:17 AM] Asoka Roy: অনুত্তমা দেখছিল,আজকের শীতের সকালের বেলা দশটাতে আড়মোড়া ভাঙা | পৌষের হাওয়ার আলস্যে আবেগকে আড়াল করতে চেয়েছে অনুত্তমা |চটি খুলে পায়ের নখে ঘাসের আগার শিশির গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে, নিজের শরীরের শিরশিরানি কে বাগ মানাতে| নীচু গলায় বলে, ” কেন বেশ তো ভালো |” আর আমার কানে তার ছেঁড়ার আওয়াজ | আমার মনে হয়, অনুত্তমার সিঁথির সিঁদুরে আশা ভঙ্গের গান | তবে কি সুখী নয় অনুত্তমার জীবন? অনুত্তমার সুখই যে আমার সুখ| তবে কেন অনুত্তমা সেদিন বলেছিল, ” মা- বাবা যা চাইছে, সেটাই হোক না? ভালোবাসার জন্য প্রতিবাদ সেদিন সে কি করতে পারত না? ” অনুত্তমা কি এই দুমাসে টেলিপ্যাথি শিখে গেল? আমি কি ভাবছি, বুঝল কি করে? উদারায় জবাব এলো,” বাবা বলেছিলেন, তোমাকে বিয়ে করলে তোমার স্কুলের চাকরি যাবে | জানো তো বাবা তোমাদের স্কুলের প্রেসিডেন্ট | যদিও তোমার সরকারি চাকরি, তবু মিথ্যে অপবাদের ষড়যন্ত্র করতে যত অর্থ আর প্রতিপত্তি লাগে, তা বাবার আছে |” আমি নিথর | অনুত্তমার সেই চিঠিতে এব্যাপারে কোন ইঙ্গিত ছিল না | আজ প্রথম জানলাম | কিন্তু হাতের তীর বাইরে | কি দরকার আর নোংরা ঘাঁটাঘাঁটির? অনুত্তমার মনটা বড়ো সংবেদনশীল | তারই ফায়দা তোলা হয়েছে | মন বড়ো খারাপ হয়ে যায় | আমার মন খারাপ সারাবার অব্যর্থ্য টোটকা অনুত্তমার গান | রবীন্দ্র ভারতীর সঙ্গীত বিভাগ থেকে এম. এ পাশ করেছে ও| অনুত্তমা গুনগুন করে শুরু প্রায় ফাঁকা পার্কে… তারপর স্বাভাবিক স্কেলে “আমি জেনে শুনে বিষ করেছি প্রাণ
প্রাণেরও আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ যতই দেখি তারে ততই দহি, আপন মন জ্বালা নীরবে সহি.
তবুও পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি.
লই গো বুক পেতে অনল বাণ|” কই মনটা তো ভালো হলো না | বরং বেশি ভারি হয়ে গেল | দুজনের দীর্ঘশ্বাস সম্ভবত বাতাস কে ভারি করে তুলল| অনুত্তমা বলে,” ইমলি, ঝিমলির বিয়ের ব্যবস্থা করলে? “” নাঃ চেষ্টা চলছে, হচ্ছে আর কই? কনে পছন্দ তো বর পণে পেছোনো|” বলি,” চল তোমাকে এগিয়ে দিই| বাড়ি ফিরে বাজারে যেতে হবে | মায়ের শরীর ভালো নয় | একটু তে টেনশন | অনুত্তমা আর আমি গেটের দিকে এগোই| আধা লক ডাউনে সামনেই একটা হলুদ ট্যাক্সি | অনুত্তমা ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভার কে বলে একটু পর স্টার্ট করতে |হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা কার্ড আমার হাতে গুঁজে দেয় | জিজ্ঞেস করি “কি এটা? ” ম্লান হাসি ওর মুখে, “আগের মতো প্রেম পত্র নিশ্চয়ই নয় |ও হো, তোমাকে তো বলাই হয় নি সু পরশু ফিরে যাচ্ছি দার্জিলিং | আর একটা প্রশ্ন করি, আমাদের ফেলে আসা দিনের কিছুই কি নেই বাকি? ” রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন আমি.. ” দিনের সব তারা আছে রাতের গভীরে |”
[01/07, 12:17 PM] Asoka Roy: কেটেছে আরও কিছু বছর বিরহ বেলার যন্ত্রণা বুকে চেপে | স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর দিনগুলোকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে | মন খারাপ একটা অসুখ এখন | হয়তো কোন মনোরোগবিশেষজ্ঞের পরামর্শে উপশম হতো | কিন্তু এ যে আমার মনোরঞ্জনের উপকরণ | দুঃখ কে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে মন খারাপ কে জিইয়ে রাখতে চাই যে আমি |
আজ অলস বিকেলে বড়ো একলা আমি এই একলা বাড়িতে | মায়ের প্রচুর প্রচেষ্টায় বিয়ে হয়েছে দু বোনের | মা গত হওয়ার আগে হাতে পায়ে ধরেছে আমার, বিয়ের জন্য | ভীষ্মের প্রতিজ্ঞায় টোল খায় নি একটুও | মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মায়ের আমার জন্য একরাশ চিন্তা… “কি হবে তোর?” “কি আবার আর পাঁচটা ব্যাচেলরের যা অবস্থা হয় |” মৃত্যুর পর মানুষের জন্য মানুষের বোধহয় আর চিন্তা থাকে না | তাই মনে হয় মা আমার চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছে |
আজ জানলার ধারে বসে দেখি, পেঁজা মেঘেদের ভাঁজে লজ্জা ছড়ানো আলো| আয়না কাঁচের বাক্সে অনু, তোমার গোধূলির
রঙ ছড়ানো পানপাতার মুখ আর সেই চিবুকের তিল | জানলার বাইরে সবুজ মাঠ বলে, “চলো যাই দার্জিলিং |” ” সবুজ মাঠ, তুমি যাবে আমার সাথে?” ” চা বাগানে পাবে আমাকে অন্য রূপে|” অনুত্তমা বড়ো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে | আমি আসছি দার্জিলিং |
লক ডাউনে ট্রেনের টিকিটের চাহিদা কম| পরের দিনের রাতের ট্রেন অন্ধকার চিরে চলেছে নিউজলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে | দার্জিলিং এর আগে বেশ কয়েকবার এসেছি প্রবাল, বিভাস, কিংশুক আর আমি মিলে | এমনকি কিংশুক আর পলাশ প্রিয়ার হানিমুনেও কাবাব মে হাড্ডি হয়েছিলাম ওদের জ্বালাব বলে | বিভাস বলেছিল, ” টোনাটুনির দাম্পত্যের আবার হানিমুন কি? খালি বাড়িতে তো নিত্য হানিমুন |” পলাশ প্রিয়ার মুখে আন্তরিক আনন্দ | আর কিংশুকের ঢোঁক গেলা সম্মতি.. ” কি করা করা যাবে! ট্যাঁকে করে নিয়ে যেতেই হবে, যা বায়না তোরা জুড়েছিস!”
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেছি একা| শেয়ারের ট্যাক্সিতে আমি আরো তিনজনের সাথে | করোনেশন ব্রিজ এল | তিস্তার ছলোছলো আবেগ আমার বুকে এই বৃদ্ধ বয়সে অনুত্তমা | সে তো শুধু একঝলক তোমাকে দেখে ফিরে যাব বলে | পাকদন্ডী বেয়ে দক্ষ ড্রাইভারের হাতের স্টিয়ারিং আমায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছে তোমার কাছে|তোমার দেয়া তোমার ভিজিটিং কার্ডের ঠিকানা আমার এতোদিনে মুখস্থ… নর্থ পয়েন্ট স্কুলের কাছাকাছি কোথাও | দার্জিলিং বদলেছে অনেক, কিন্তু একেবারে অচেনা তো নয়? পাহাড় ঘেরা আকাশে আজ মেঘ পালকের নরম হাওয়া| তবুও কেন যে আমার মন খারাপ, বুঝি না |
পেয়ে গেছি তোমার বাড়ি অনুত্তমা | ঐ তো বেতের চেয়ারে তুমি | হাতে উলের কাঠি, বিঘত খানেক বোনা সোয়েটারের পিঠ| তোমার বাগানের পাইন গাছের পাতার আড়ালে আমি| কিন্তু একি চেহারা তোমার! লোল চর্ম এক বৃদ্ধা | পানপাতার মুখে ডবল চিন! চিবুকের তিলকে আঁতিপাতি করে খুঁজি, মুখের চামড়ার কোন ভাঁজে লুকিয়েছে, কে জানে!
এক বৃদ্ধ বাগানের কোন প্রান্ত থেকে টুকরিতে কিছু কমলা নিয়ে ঢুকলেন, বুঝলাম না | বাগানটা যে অনেক বড়ো| তোমাকে বললেন, অনু চা হবে? আমি স্তম্ভিত | আমার গোপনে দেয়া নামে আজ অন্য পুরুষের অধিকার! বুঝলাম সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে ভালোবাসার রঙ |উলের গোলা গড়ায় সিঁড়িতে| নিশ্চয়ই তুমি এবার উঠবে | চোখাচুখি হবে দুজনের | চিনবে নিশ্চয়ই | তবে বলার কিছু থাকবে না | তার চেয়ে আমি তোমার অজান্তে পালাই|তুমি থাক আমার কাঁচের হাতবাক্সের আয়নায় | আমি এবার থেকে সেগুলো নাড়বো চাড়বো| আমার আনন্দ আমি নিজেই একা কুড়িয়ে নেব| আর আমার মন খারাপ হবে না |