সুভাষ চন্দ্র দাশ , ক্যানিং –প্রয়াণের দীর্ঘ ৪১ তম বছর পার হবার পর ও উত্তম উন্মাদনায় বাংলা ছায়া ছবি তাঁরই আধিপত্য কাজ করে চলেছে । যৌবনের উচ্ছলতা,রোমান্সের আনন্দ-অনুভুতি এবং চরিত্র চিত্রণে অসামান্য প্রতিভা ছিল উত্তম কুমারের। আর তাঁর অভিনয় নৈপূণ্যে মহানায়ক আজ ও সজীবতার জীবনতীর্থে বিচরণ করেন ২৪ জুলাই।
আধুনিক যুগের অগ্রগতির জোয়ারে জীর্ণ-পুরানো বিসর্জিত হয়ে নবীন সৃষ্ট সম্পদ গুলি বর্ণোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের মহানায়কের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে তার বিপরীত দিকটাই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তৎকালীন সময়ে দুর্বল প্রযুক্তি,ভাঙা ক্যামেরা,অনুন্নত সাউন্ড,তার উপর নড়বড়ে প্রযোজনা স্বত্তেও সিনেমা হল গুলিতে “হাউসফুল” বোর্ড হামেশাই দেখা যেত। কিন্তু আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বাংলা ছবি। আশ্চর্য হলেও সত্যি কথা বাংলা ছবির শুটিং করতে পরিচালকরা পাড়ি দিচ্ছেন সূদূর দেশ-বিদেশ সহ লন্ডন আমেরিকায়। কিন্তু ছবিগুলি বিশাল অঙ্কের বাজেটের হওয়া স্বত্তেও এক,দুই অথবা সর্বোচ্চ সপ্তাহ তিনেক চলে বটে!দর্শকের সংখ্যা এতটাই কম যে,“হাউসফুল” শব্দটি বাংলা ছবির ক্ষেত্রে বিলুপ্তী হয়ে অজানা হয়ে গেছে। কিন্তু মহানায়কের সময়কার অনুজ্জ্বল সাদা-কালো ছবি দেখতে দর্শক ছুটে যেতেন প্রেক্ষাগৃহ গুলিতে। বাডির গৃহিণীরাও তড়িঘড়ি রান্নাবান্না সেরে রিক্সায় বসে পান চিবোতে চিবোতে তাঁদের মহানায়ক কে দেখতে যেতেন। সে সব ঘটনা আজ অতীত এবং বিরলতম ইতিহাস।
আসলে উত্তম কুমারের সাদামাটা বাঙালি চেহারার অন্তরালে একটা কোমল আকর্ষণীয় যে ব্যক্তিস্বত্বাটি ছিল তার মাধ্যমে জয় করেছিলেন বাঙালির হৃদয় কে। মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাওয়া অভূতপূর্ব হাসি,সাদা কালো ছবিতে তাঁর রঙিন উপস্থিতি দর্শকদের কে বারে বারে আকর্ষিত করে তুলে মোহিত করেছিল। প্রয়াণের ৪১ টি বছর অতিক্রম করলে ও তাঁর সেই জনপ্রিয়তার বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতা সম্পন্ন সুঠাম সৌন্দর্য্যের মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনীত কোন কোন ছবি দর্শকদের দশবার দেখা থাকলে ও ,সেই ছবিটি পুনঃরায় টিভির পর্দায় প্রদর্শিত হলে ১১ বারের মাথাতেও সেই সিনেমাটি দেখতে দর্শকরা কুন্ঠাবোধ করেন না। তাঁর অভিনীত ছবিগুলি এভারগ্রিন হয়ে রয়েছে দর্শকদের মনে।
অরুন চ্যাটার্জী থেকে উত্তমকুমারে উত্তরণ এটা কিন্তু একদিনের ব্যাপার নয়,দীর্ঘ সময়ের। প্রথম দিকে ’কামনা’ ’মর্যাদা’ ’ওরে যাত্রী’ ’সহযাত্রী’ ’সঞ্জীবনী’ সহ একগুচ্ছ ফ্লপ ছবির পাহাড় অতিক্রম করে অবশেষে পায়ের তলায় মাটি ফিরে পেয়েছিলেন নির্মল দে পরিচালিত “বসু পরিবার” ছবিতে। অভিনয় জীবনের প্রাথমিক লগ্নে একের পর এক ছবি ফ্লপ করায় তাঁকে নিয়ে কাজ করার ভরসা পাননি একাধিক পরিচালক। বাঙালী প্রিয় মহানায়ক উত্তম কুমার কিন্তু বহু অপমান , অবহেলা,বিদ্রূপ সহ্য করেছিলেন। আস্থা রেখেছিলেন নিজের কাজ ও দক্ষতার প্রতি। ভেঙে পড়েননি কিংবা তার স্থির লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। যার ফলাফল “অগ্নি পরীক্ষা, সাগরিকা, হারানো সুর, সপ্তপদী,ইন্দ্রাণী,এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি,দেয়া নেয়া,নায়ক,অগ্নীশ্বর এর মতো কালজয়ী ছবি গুলো দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে।
মহানায়কের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন যে সমস্ত সঙ্গীত শিল্পীরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,মান্না দে, শ্যামল মিত্র এবং অবশ্যই কিশোর কুমার । মহানায়কের লিপে সর্বোচ্চ মান্না দে’র গান থাকলে ও উত্তম কুমারের লিপে হেমন্ত মুখার্জী’র গান যেন বৃষ্টিস্নাত নীল অাকাশে সাতরঙা রামধনু। হেমন্ত মুখার্জী এবং উত্তম কুমার বলতে গেলেই একই পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। বাস্তবিক ক্ষেত্রেও উত্তম কুমার এবং হেমন্ত মুখার্জী’র কন্ঠস্বরের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল ছিল। “হারানো সুর” প্রসঙ্গে একটা কথা বলা যায় – অজয় কর পরিচালিত এই প্রথম ছবির সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখার্জী। ছবিতে ব্যাক রাউন্ড মিউজিক দেওয়ার সময় হেমন্ত বাবুর হঠাৎ মনে হল নায়িকার নাম ধরে নায়ক এর কন্ঠে কয়েক বার ডাক থাকলে খুবই ভালো হত। এবং সেটা মিউজিক নেবার সাথে সাথেই করা উচিৎ। কিন্তু শেষমুহুর্তে উত্তম কুমার কে পাবেন কোথায়?? শেষটাই “রমা রমা রমা” ——— বলে ডাক টা হেমন্ত বাবু নিজেই দিলেন। ছবি রিলিজের পর কেউ ধরতেই পারলো না ডাক টি উত্তম কুমারের না হেমন্ত বাবুর। এরকম বহু ছবিতে কিছু কিছু সংলাপে উত্তম কুমারের বদলে হেমন্ত মুখার্জী নিজেই দিয়েছেন বলে শোনা যায় ।
দিন টা ছিল ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই।ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত ৯ টা ৩২ মিনিট হয়ে ২৬ সেকেন্ড। স্থান বেলভিউ নার্সিংহোম। সমগ্র বাঙালী জাতির কাছে এই দিন টি তাদের বড় কাছের মানুষটি কে চিরতরের জন্য হারানোর দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। আজ প্রায় দীর্ঘ ৪১ বছরেও বাংলা চলচিত্রে তাঁর অভাব পূর্ণ হয়নি। বহু তাবড় তাবড় অভিনেতা বা নায়ক বাংলা আছেন বটে,কিন্তু তাঁরই শূণ্য সিংহাসন টি আজও পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারেননি। তাই আজ ও উত্তম প্রাসঙ্গিক । তিনি আমাদের তথা সমগ্র বাঙালীর অন্তরাত্মা চিরদিনের এবং চিহৃদয়ে থাকা স্বপ্নের মহানতম মহানায়ক উ- ত্ত-ম-কু-মা-র।আর সেই কারণেই মৃত্যুর ৪১ টা বছর পর ও উত্তম আজও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।