স্টেপ মম : শতাব্দী মজুমদার।

0
707

ঠিকানাটা বদলে গেলো আমার । বাবার বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম।আগে অবশ্য কয়েকবার এসেছিলাম এই বাড়িতে কিন্তু একদম স্থায়ী ভাবেই আমাকে যে এখানে এসে উঠতে হবে কখনোই আমি ভাবিনি কিন্তু আমাদের সমস্ত ভাবনা চিন্তার বাইরে তো কত কিছু ঘটে , তেমনই বোধহয় আমার কোনো ভাবনা চিন্তার সঙ্গেই মিললো না আমার এই সতেরো বছরের জীবনের হিসেব নিকেশ।

আঁশটে গন্ধটা আমার নাকের কাছে ছড়িয়ে পড়তেই গা টা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল ,ছুটলাম বেসিনের দিকে।জল জল বমি হলো একটু ,চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বেসিনের আয়নার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম আন্টি এসে পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাকে আর তখনই সেই স্বচ্ছ আয়নায় স্পষ্ট দেখলাম আন্টির চোখের দৃষ্টি ,উফঃ যেন ঠিক মরা মাছের মতো। এরকম চোখ হয় না কি কারোর !মাথাটা একটু টলে গেল যেন , বোধহয় পড়েই যাচ্ছিলাম,আন্টি ঠিক তখনই ধরে ফেলে সামলে দিল আমাকে।

-এই জিনি ,তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
এই কথাটাই কানে এসেছিল।

-শোনো জিনি ,এই টুকু মেয়ে এরকম মাথা ঘুরবে কেন!খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করতে হবে তো ,এ খাবো না তা খাবো না এসব করবে না একদম।

আন্টি নিজে শপে গিয়ে আমার জন্য হেলথ ড্রিংক,ফল,ক্যাটবেরি, জুস এনে ফ্রিজ ভর্তি করলো।যেমন টা ঠিক আমার মা করতো।

মা যে কেন এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে চলে গেল !বেশতো ছিলাম আমি মায়ের সঙ্গে, মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গেও দেখা হতো।তবে মায়ের কথা ভাবলেই ভীষণ কান্না পেয়ে যায় আমার।মা যে খুব দুঃখী ছিল তা বড় হতে হতে একটু একটু করে বুঝতে পারছিলাম ।আমি আরও বুঝতে পারছিলাম এই আন্টি ,আন্টিই মায়ের দুঃখের একমাত্র কারণ ,আমাদের জীবনের সবটুকু সুখ কেড়ে নেওয়ার কারণ।আমি কখনো এই আন্টিকে পছন্দ করিনা , দেখা হলে আন্টি যতই আমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো আমার তখন ততই বিরক্ত লাগতো, রাগ হতো। আর এখন কি না আমাকে সেই আন্টির সঙ্গেই এক বাড়িতে থাকতে হচ্ছে সারাদিন রাত ,চব্বিশ ঘন্টা।

এখানে আসার পর পরই একটা কান্ড ঘটিয়েছিলাম ,না কেউ টের পায় নি ,বুঝতেই পারে নি।আসলে আন্টির পছন্দের জিনিসগুলোই আমার টার্গেট।পছন্দের জিনিসগুলো নষ্ট করে দিলে আন্টির কতটা কষ্ট হতে পারে এই ভেবেই আমার আনন্দ । না আমি কিছুতেই ওই আন্টিকে ভালো থাকতে দেব না ।

আন্টি আমাকে অবশ্য খুব যত্ন করে ,ভাবে বোধহয় আমার মা হয়ে উঠবে ।বিশেষ করে সেদিন মাথাটা ঘুরে যাওয়ার পর থেকে আমাকে যেন আরও বেশি যত্নে মুড়ে রেখেছে।আন্টির কোনো বাচ্চা নেই।সারাদিন রান্নাবান্না,সেলাই,গাছপালা ,মাছের একোরিয়াম এসব নিয়ে থাকে।আগে নাকি বাবার অফিসেই চাকরি করতো ।সেখান থেকেই বোধহয় বাবার সঙ্গে পরিচয়।আর তখন থেকেই আমাদের জীবনের ওলট পালট হওয়া শুরু।

তখন বোধহয় আমার ক্লাস ফোর , একদিন সকালে দেখেছিলাম বাবা তার নিজের সব জামাকাপড়,ল্যাপটপ ,বইপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম এবার বোধহয় বাবার অফিসের অনেক বড় ট্যুর।যাবার সময় আমাকে আদর করে বাবা বলেছিল, ” মাঝে মাঝে আমরা দেখা করবো কেমন,ফোন করো”।তারপর অনেক দিন হয়ে গেছে বাবা আর ফেরেনি আমাদের বাড়িতে।মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে বাইরে আবার বাবার বাড়িতেও নিয়ে এসেছে কখনো,সেখানেই আন্টিকে দেখেছিলাম প্রথম।বাবা মম ডাকতে বলেছিল কিন্তু আমি আন্টিই বলেছিলাম।বাবার সঙ্গে ওই আন্টিকে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগেনি।

আন্টি আমার কাছাকাছি এলেই ওই আঁশটে গন্ধটা নাকে আসে ।আচ্ছা ওর গায়ে মাছের গন্ধ কেন !বেশ তো ফিটফাট থাকে সবসময় তাও এরকম গন্ধ কেন ! আমি বেশির ভাগ সময় আন্টির থেকে দূরে থাকি। নিজের ঘরের বাইরে একদম বেরোই না ।আন্টি এসে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলে বা পড়াশুনার খোঁজ নিতে এলে একদমই পাত্তা দিই না।সেদিন বাবাকে বলতে শুনলাম,
“থাক না ওকে ওর মতো থাকতে দাও না,ঘরে বসে বই পত্র পড়ে গান শোনে আর এখন ওর পড়ার চাপও তো অনেক।তাছাড়া জিনির মায়ের জন্য একটা কষ্ট তো আছেই”।

হ্যাঁ, মায়ের জন্য খুব খুব কষ্ট হয় আমার। যখন দেখি আন্টিকে এতো ভালো থাকতে ।বাবাকে যত্ন করে টিফিন গুছিয়ে দিতে,বাবার জামা কাপড় সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতে ,বাবার সঙ্গে ডিনার টেবিলে হেসে হেসে গল্প করতে ,বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতে। তখন আমার আরও বেশি করে মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবা মা কে আমি ঝগড়া করতে দেখেছি,মা কে কত কাঁদতে দেখেছি ।এই মহিলা বাবা কে কেড়ে না নিলে আমার মা তো এভাবেই ভালো থাকতে পারতো!

না আন্টিকে আমি কিছুতেই ভালো থাকতে দেব না।

এই বাড়িটা আন্টি তার পছন্দে খুব সুন্দর সাজিয়ে রেখেছে ড্রয়িং রুমের কোনায় ওই সুন্দর একোরিয়ামটি ঘরের সৌন্দর্য যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে।রঙিন আলোয় রঙিন মাছের খেলা দেখে আন্টি আনমনে।ওই মাছ গুলো যেন তার সন্তান সম, ওদের মাঝেই আন্টি ভালো থাকে।কিন্তু আমি তো আন্টিকে ভালো থাকতে দেব না।

সেদিন আন্টির শরীর খারাপ ছিল খুব, সারাদিন প্রায় তার ঘরে শুয়েই ছিল।বাবা ট্যুরে গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য।মোক্ষম সুযোগ আমার ,ভাবলাম আন্টির শখের গাছ গুলোকে মেরে ফেলি কিন্তু কি দিয়ে মারবো ওদের !হাতের কাছে তো এসিড ফ্যাসিড কিছু নেই।মাছ,হ্যাঁ মাছ গুলোকে মারা যেতেই পারে ।আন্টি আমাকে বলেছিল মাছেদের যেন দু বেলা করে খাবারের দানা জলে ছড়িয়ে দিই।দিয়েছিলাম খাবার একবার,ঝাঁক বেঁধে এসে ওরা খাবার খাচ্ছিল যখন তখন ই প্ল্যানটা ছকে ফেললাম।প্ল্যাগ থেকে কর্ড টা একদম আলগা করে দিলাম ব্যাস ,জলের ভিতরে অক্সিজেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।পরদিন লক্ষ করলাম একে একে একোরিয়ামের জলে মরা মাছ ভেসে উঠছে।আন্টি কে সেকথা জানানোর আগে আমি আবার কর্ড টা প্ল্যাগের সঙ্গে ঠিক মতো জুড়ে দিয়েছিলাম।অসুস্থ শরীর নিয়ে আন্টি একতলার ড্রয়িং রুমে ছুটে এসেছিলো ।তারপর,তারপর প্রচন্ড কষ্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল।

এই ঘটনার পর থেকেই আমি আন্টির শরীরে মাছের আঁশটে গন্ধ পাই।আর সেদিন তো আন্টির চোখটাও মরা মাছের চোখ মনে হলো।

মনে আমার প্ল্যান যাই থাকুক না কেন আমি আন্টির সঙ্গে ওপরে অন্তত খুব খারাপ ব্যবহার করতাম না।

মনে মনে আমি আন্টির মৃত্যু কামনা করি।আমার মা মরে না গিয়ে এই আন্টি মরলেই তো ভালো হতো।যাইহোক যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে এখন অন্তত এই মহিলাকে বাবা এবং আমার জীবন থেকে সরানো দরকার।কিন্তু কি ভাবে !কিভাবে একে মারবো আমি !কোনো উপায় ই ঠিক মনে ধরলো না ,ধরা পড়ে যাওয়ার চান্স প্রবল।বাবা নিশ্চই সব বুঝে যাবে আর বাবা তো আমার থেকেও বেশি আন্টিকে ভালোবাসে ,না হলে শুধু মাকে তো নয় আমাকেও ছেড়ে চলে এসেছিল আন্টির সঙ্গে থাকবে বলে।

সেদিন দুপুর থেকে হঠাৎ আমার জ্বর এসেছিল ।কিছুক্ষন পরে হাতের আঙ্গুলের ডগায় শিরশিরানী শুরু হলো ,কেমন যেন অস্বস্তি দায়ক, ক্রমেই দেখলাম দুহাতের আঙুলের চামড়ার ওপর আরেকটা শক্ত আবরণ তৈরি হলো ।চিনতে অসুবিধে হলো না । এতো মাছের গায়ের আঁশের মতো ।শীতকালেও ঘামছি আমি প্রচন্ড ,একি !এরকম কেন হবে! এ কি ধরনের স্কিন ডিজিজ!না না আমি ভুল ভাবছি।হয়তো এরকম কোনো স্কিন ডিজিজ হয় যা আমি জানিনা।আন্টিকে দেখাবো কি!না বাবা কে বলবো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে !না কাউকেই বলবো না ।বলা যাবে না ,গ্লাভস দিয়ে দুহাতের আঙ্গুল ঢেকে ফেললাম আমি।

এক দুই তিন দিনে ওগুলো আরও ছড়িয়েছে ,আঙ্গুল ছাড়িয়ে এবার হাতের মধ্যে।একটু চিরবির চিরবির করে তারপর ঠিক হয়ে যায়। আমার অসুস্থতায় আন্টির যত্ন আরো বেড়ে গেছে আর আমি ওই আঁশটে গন্ধের সঙ্গে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

চতুর্থ দিন জ্বর একটু কমেছে কিন্তু মাছের আশের মতো র‍্যাশ গুলো দু হাত ভর্তি হয়ে পায়েও শুরু হয়েছে।আমার বেশ ভয় ভয় করছে ।বাবা এবারও ট্যুরে ,ফিরে এলেই ডাক্তার কে দেখিয়ে নিতে হবে।

জ্বর কমে গেলেও শরীর বেশ দুর্বল সঙ্গে ওগুলো মুখ বাদ দিয়ে ক্রমেই সারা শরীরে ।আমার সর্বাঙ্গ ঢাকাই থাকে। রাতেই বাবা এসে যাবে।

সন্ধ্যে থেকে হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে চাপ চাপ লাগছে ,দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে ।কেন যে নিশ্বাস নিতে পারছি না বুঝতে পারছি না।ভীষণ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার, উফঃ আর যে পারছি না।ছটফট করছি আমি।আন্টি ,আন্টি কে ডাকতেই হবে এবার ।
বাঁচাও আমাকে আন্টি ….
মরে যাচ্ছি আমি আন্টি …
দম বন্ধ হয়ে আসছে আন্টি….
হাসপাতালে নিয়ে চলো আন্টি….

অন্ধকার ঘরে আন্টির উপস্থিতি টের পেলাম ।বালিশটা আমার নাকে চেপে ধরার আগে আন্টির গায়ের স্টোল টা সরে যেতেই আন্টির হাতের এবং গলার চামড়ার ওপর স্পষ্ট চকচকে মাছের আঁশ দেখতে পেলাম কিন্তু ওই আঁশটে গন্ধটা আর পেলাম না।
সমাপ্ত