নাম দীপান্বিতা । কিন্তু কর্তা তাঁকে দীপা নামে ডাকতেন । আদরের ডাক । সেটাও একটা ইতিহাস । মনে মনে ভাবছেন আর নিজের মনেই হাসছেন । উভয় পক্ষের বাবা-মা’র পছন্দমতো তাঁদের বিয়ে । বিয়ে হওয়ার পর বাড়ি ভর্তি লোকের মাঝে দীপান্বিতাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কর্তা বললেন, আমি কিন্তু তোমাকে অত বড় নামে ডাকতে পারব না ।
ঘোমটা দেওয়া নতুন বৌ । কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না । সদ্য কলেজের চৌকাঠ পেরোনো একুশের কাছাকাছি ডাগর-ডোগর তরুণী । ছেলে বন্ধুদের সাথে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কথা বলার তাঁর সৌভাগ্য হয়নি । কেননা বাবার ও দাদার কঠোর শাসনের মানুষ । তাই ভয়ে ভয়ে ঠোট দুটি নেড়ে দীপান্বিতা উত্তরে বলেছিলেন, “তাহলে উপায় ?”
“উপায় একটাই । আমি তোমার নাম ছোট করে “দীপা” নামে ডাকব । তুমি রাজি তো ?”
সেদিন কর্তার আবদারে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন । একগাল হাসি হেসে সোজাসুজি তাঁর নির্ভেজাল উত্তর । আজও তাঁর মনের গহন গাঙে সেই উজ্জ্বল স্মৃতি উজ্জীবিত ।
বাড়ি থেকে বারাণসী আসার সময় কী সাংঘাতিক তাড়াহুড়ো ! যার জন্য দীপা মাত্র গোটা বিশেক ফটো সঙ্গে আনতে পেরেছিলেন । সেই ফটোগুলি দেখছেন, আর পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করছেন ।
ঘরের টেবিল-ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখেন সন্ধ্যা ছ’টা । বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গা পুজো দেওয়ার সময় । একটু আগে না বেরোতে পারলে সামনের দিকে বসার জায়গা পাওয়া কঠিন । কিন্তু ফটোগুলি ছেড়ে তাঁর কিছুতেই নড়তে ইচ্ছা করছিল না । ইতিমধ্যে পাশের ঘরের ডোনাদিদি দশাশ্বমেধ ঘাটে যাওয়ার জন্য তাঁকে ডেকে গেলেন । ফটোগুলি তাঁর পুরানো স্মৃতি বারংবার উস্কে দিচ্ছে ।
তাঁর কর্তা অনেকদিন আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন । তিনি নিজে শেষ প্রহরের কাছাকাছি । চুরাশি পার হয়ে পচাশি চলছে । একমাত্র ছেলেকে তাঁরা অনেক কষ্টে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়িয়েছিলেন । তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার ডিগ্রি । এখন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্লাস ওয়ান অফিসার । ভাল বেতন । কর্তা তাঁর অবসরকালীন সমস্ত টাকা দিয়ে শহরে সুন্দর একটি বাড়ি বানিয়েছেন । হাইস্কুলের শিক্ষক । মাঝখানে ছেলের পড়ার খরচার জন্য প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা তুলে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে গায়ে-গতরে খেটে শহরের বাড়িটা । গিন্নির তীব্র আপত্তি ছিল, জমানো টাকা খরচ না করতে । কিন্তু কর্তা বুক ফুলিয়ে সেদিন বলেছিলেন, অংশুমান তাঁদের আদর্শে মানুষ । সুতরাং ছেলে কোনোদিন তাঁদের জলে ফেলে দিতে পারবে না ।
তারপর বাড়িটাতে বসবাস শুরু হওয়ার পর ছেলে তার নিজের পছন্দমতো গোয়ালজান কলোনীর মেয়েকে বিয়ে করল । কর্তা বললেন, “ছেলের পছন্দ । সুতরাং আমাদের পছন্দ । দীপাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, তুমি বিয়েতে অমত করো না ।“ তারপর ধুমধাম করে অংশুমানের বিয়ে সম্পন্ন হল ।
বিয়ের পর অংশুমান নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে বেরিয়ে যায় । দীপাকে সংসারের সমস্ত কাজ কর্ম নিজের হাতে গুছিয়ে করতে হয় । কেননা বৌমার প্রাইভেট ব্যাঙ্কে করণিক পদে চাকরি । তাকেও ছেলের পেছনে পেছনে বের হতে হয় । সকালে উঠে তাদের অফিসের রান্না, অফিসের টিফিন করে দেওয়া । ঠিকা কাজের মাসী কোনোরকমে দায়সারা ঘরদোর সাফ করে উধাও । সংসারের যাবতীয় কাজ দীপাকে নিজের হাতে সামলাতে হয় । তাই কর্তা একদিন ছেলেকে বড় মুখ করে বলেছিলেন, “বাবা । তোমার মায়ের পক্ষে এত বড় সংসারের সমস্ত কাজ নিজের হাতে গুছিয়ে করা বড্ড কষ্ট ।“ বৌমা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে ঝটপট উত্তরদিয়ে বলেছিল, “শুধুমাত্র দুবেলা রান্না । রান্না ছাড়া সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকা । এর জন্য ছেলেকে নালিশ করার কী হল ?” ছলছল করে উঠল কর্তার চোখটা ! দীপাকে শুধু বলেছিলেন, “এখন বুঝতে পারছি লোকে কেন ছেলে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় ভাল বংশ খোঁজ করেন ।“
কর্তা নাতিকে দেখে যেতে পারেননি । তবে বৌমা সন্তান সম্ভবা জেনে গেছেন ।
দুইজনেই অফিসের কাজে ব্যস্ত । যার জন্য নাতির উপর তারা ঠিকমত মনোযোগ দিতে পারেনি । তারই ফলশ্রুতি, নাতি হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষায় পাশ করার পর জয়েন্টে আই.আই.টি. চান্স পেল না । তারপর বৌমা ঠিক করল ছেলেকে নিয়ে রাজস্থানের কোটায় থাকবে । সেখানকার কোচিং সেন্টারগুলিতে কোচিং নিলে আই.আই.টি.তে ভর্তির সুযোগ অবধারিত । তাই বৌমা অফিস থেকে বিনা বেতনে ছুটিতে থাকার পারমিশন গ্র্যান্ট করিয়ে নিল ।
অংশুমান মাকে ডেকে বলল, “তোমার বৌমা নাতিকে নিয়ে রাজস্থানের কোটায় যাচ্ছে এক বছরের জন্য । আমার অসমের তিনসুকিয়া শহরে বদলীর অর্ডার । বাড়িতে তোমার পক্ষে একা থাকা সম্ভব না । একটা বছর কাশীর বৃদ্ধাশ্রমে তোমাকে থাকতে হবে । তারপর বৌমা ফিরে এলে আমি তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসব ।“
তবুও দীপা জোর দিয়ে ছেলে অংশুমানকে বলেছিলেন, “আমি দিব্যি একা বাড়িতে থাকতে পারব বাবা । আমার জন্য তোদের উতলা হতে হবে না ।“
“না মা, তা হয় না । তুমি গুছিয়ে নাও । কাল ভোরবেলায় ট্রেন ।“ ছেলে পুনরায় তাগাদা দিল । দীপা যেটা বুঝতে পারলেন, মাকে কাশী-বারাণসীর বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর মানসিক প্রস্তুতি অংশুমানের আগেই নেওয়া ছিল । শুধুমাত্র পাঠানোর অপেক্ষা !
অংশুমান আবার বলল, হাওড়া স্টেশন থেকে কালীপ্রসন্ন ভাদুরী নামে এক ভদ্রলোক তোমাকে বারাণসীর বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে । আমি কাশী-বারাণসী পর্যন্ত যাচ্ছি না ।
সেই রাত্রিতেই দীপা বুঝতে পারলেন, “তাঁর এবার কপাল পুড়েছে । স্বামীর তৈরী বাড়িতে আর ঠাঁই নেই । বাকী জীবনযাপন বৃদ্ধাশ্রমে ।“
কাশী আজকের যেটা বারাণসী, সেটা হিন্দু ধর্মের পবিত্র স্থান । বারাণসীর প্রধান দর্শনীয় স্থান কাশী-বিশ্বনাথ মন্দির । মন্দিরের দেবতা কালো পাথরের বিশ্বেশ্বর । এটি নাকি দ্বাদশ জ্যেতির্লিঙ্গের অন্যতম । বিশ্বনাথ মন্দিরের বিপরীতে অন্নপূর্ণা মন্দির । কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদীতে অন্নকূট উৎসব হয় । পাশেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত মদনমোহন মালব্য’র প্রতিষ্ঠা – বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় । শোনা যায় বারাণসী প্রাচীন ভারতের এক অন্যতম স্থান । গঙ্গার পশ্চিম তীরে বরুনা ও অসি নদীর মিলনস্থলে অতীতের কাশী আজকের বারাণসী ।
নতুন জায়গা কাশী-বারাণসী ।
অন্নপূর্ণা মন্দিরের অদূরে দীপাদের বৃদ্ধাশ্রম । সেখানে বয়স্কা বিধবা মহিলারাই থাকেন । তখন থেকেই পাশের ঘরের ডোনা দিদির সঙ্গে তাঁর উঠাবসা । তিনিই দীপাকে হাত ধরে কাশী-বিশ্বনাথ মন্দিরে নিয়ে গেছেন । দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যাবেলায় একসঙ্গে গঙ্গা আরতি দেখা । অবসর সময়ে সুখ-দুঃখের আলাপ-আলোচনা । বৃদ্ধাশ্রমের নিরামিশ খাওয়া দাওয়ার অবস্থা তথৈ-ব-চ । খাওয়ার ধরন দেখে মাঝে মধ্যেই দীপার অনাহারে রাত কাটে । শেষ বয়সে তাঁকে এইরকম দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে তাঁর কল্পনার অতীত । অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে দীপা বিষণ্ণতায় ভরপুর !
এক বছরের নাম করে রেখে গেছে, দেখতে দেখতে পাঁচ বছর অতিবাহিত । এখনও পর্যন্ত মাকে খোঁজ নেওয়ার নাম নেই । ছেলেকে চিঠি লিখেও জবাব মেলেনি । মনে তাঁর বড় কষ্ট । পচাশি বছর বয়স । এখন শরীর ঠিকমত চলছে না । চোখের জ্যোতি কমে আসছে । মাঝে মাঝে রাত্রিবেলায় বুক ধরফর করে । গরমের সময় আরও কষ্ট । গুমোট গরমে হাঁসফাঁস । ছোট একখানি ঘরে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় । ডাক্তারবাবু বলেছেন, তাঁকে লোকজনের মধ্যে দিন কাটাতে । টেনশনফ্রী থাকতে । বাড়িতে যেতে পারলে, নাতির সঙ্গে খুনসুটি করতে পারলে তাঁর প্রাণে শান্তি মিলত ।
ডোনাদিদির গঙ্গা আরতিতে মন বসছে না । তাঁর মনটায় বেশ খচখচ । তাঁরা দুজনে প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলায় দশাশ্বমেধ ঘাটে আসেন । হাসি ঠাট্রা গল্প গুজব আরও কত কী হয় । দুজনের হরিহর আত্মা । ঘাটে গিয়ে বাদাম কিনে দুজনে ভাগ করে খান । দীপার ছেলে অংশুমান যেমন তার মাকে খোঁজ খবর একদম নেয় না, অন্যদিকে ডোনাদিদির ছেলে মায়ের খোঁজ খবর রাখে । তাঁর ছেলে থাকে কাশ্মীরে । মিলিটারিতে চাকরি । ছেল অবসর নিলেই ডোনাদিদিকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে যাবে ।
গঙ্গার ঘাটে দীপা না আসায় তাঁর মনটা বেসুর গাইছে । তবে কী তাঁর শরীর খারাপ !
গঙ্গা আরতির মাঝখানে ডোনাদিদি ঘাট থেকে ফিরে এসে দেখেন, দীপা হাতে ফটোগুলি নিয়ে খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছেন । তাঁর ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না । তিনি ভয়ে আঁতকে উঠলেন ।
আশ্রমের অন্যান্য সাথীরা আকুলভাবে ডাকছেন, “দীপা উঠো ।“
দীপা কোনো সাড়া দিচ্ছেন না । ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠানো হল । ডাক্তারবাবু এসে বললেন, “তাঁর পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে । তাঁর বাঁচার আশা কম । সত্ত্বর তাঁর ছেলেকে খবর দিন । ঔষধ দিয়েছি । ঘন্টা খানেক বাদে তিনি ঘুম থেকে উঠে পড়বেন । তখন আপনারা তাঁকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবেন । নতুবা আবার ঝিমিয়ে পড়তে পারেন । এবার আমি আসছি ।“
ডোনাদিদি রাত্রিতে তাঁর আত্মীয়কে দীপার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সত্ত্বর অংশুমানকে বারাণসীর বৃদ্ধাশ্রমে আসতে বললেন । অংশুমানের মায়ের অবস্থা ভীষণ খারাপ । তিনি এখন আর দিন গুণছেন না, ঘন্টা গুণছেন ।
একদিন পরে অংশুমান বারাণসীর বৃদ্ধাশ্রমে এসে পৌঁছালো ।
ছেলের আওয়াজ পেয়ে দীপা চোখ মেলে তাকালেন, “বাবা এসেছিস ! দাদুভাইকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে ।“ তারপর দীপার কথা বলা জড়িয়ে গেল । তিনি চোখ দুটি আর খুলতে পারলেন না । পরের দিন ভোরবেলায় অংশুমানের চোখের সামনে দীপা বিদায় নিলেন । চির শান্তিতে চলে গেলেন ।
—————-০—————–
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী, নদীয়া-৭৪১২৩৫, মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪