আজ ২২শে শ্রাবণ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এক আর্দ্র অপরাহ্নে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত রবি। মধ্যাহ্নের সূর্য অকস্মাৎ স্মৃয়মান। প্রখর সৌরকিরণ যেন বিনম্র। অস্তাচলগামী। এই একটা দিন, ঠিক এই একটা দিন যে দিনটার সাথে বঙ্গবাসীর রক্তের, ভারতবাসীর শিরার আর বিশ্ববাসীর হৃদয়ের সম্পর্ক জড়িত। এই একটা দিন, যে দিনের নান্দীপাঠ শুরু হয় ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’ গানটির মধ্য দিয়ে। গানটি যে কতটা প্রাসঙ্গিক, বুঝি। রবীন্দ্রনাথ যে ক্রান্তদর্শী কবি ছিলেন সেও সকলে প্রায় এক বাক্যে স্বীকার করবেন। উদিত সূর্যের দেশে এক ভারতীয় ক্রিড়াবিদের কাঞ্চনস্পর্শকথা লিখতে বসে এত রবি-কথা কেন? প্রশ্ন হল ‘রবি-কথা’ নয় কেন? এমনিতে প্রায় একশো তেত্রিশ কোটির দেশে সারাবছর মন প্রাণ যদি কেউ হরণ করে থাকে তো ক্রিকেট। ক্রিকেটের চোখ ধাঁধানো বর্ণময় আলোক ছটায় দেশের অন্যতম ক্রীড়াক্ষেত্রগুলির প্রতি দর্শক উদাসীন। ক্রিড়াবিদদের প্রতি অনাগ্রহী। রবীন্দ্রনাথ তো অসাম্য চাননি। তাঁর দেবতা মার্বেল পাথরে খোদাই করা মন্দিরে থাকেন না, থাকেন রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা চাষি, মজুরদের বুকে! তাঁর কৃপণের অশ্রু যেন কুলপ্লাবিতা গঙ্গা, সেই অশ্রুগঙ্গার তরঙ্গে তরঙ্গে ফেনাইত হতাশা, নিজেকে শূন্য করে অপরকে পূর্ণ করার কি তীব্র আর্তি!
জ্যোতিসর্বস্ব নন্দনক্ষেত্র থেকে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে। নয়ত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়ামঞ্চের আসরে এক একজন নীরজ এভাবেই থাপ্পড় মেরে যাবে। এই থাপ্পড়টা খুব দরকার ছিল। আমাদের শত অবহেলা, অনাদর, উপেক্ষার ওপর বিরাশিসিক্কার এই থাপ্পড়ের দাগ বোধহয় আর উঠবে না।
নীরজ চোপড়া। হরিয়ানার অখ্যাত (?) জ্যাভলিন থ্রোয়ার। আমজনতার সাথে পরিচিত হওয়ার আগে, এক নজরে দেখেনি মাত্র তেইশ বছরের ছেলেটির সাফল্যের নজির গুলি।
২০১৬, এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ‘রূপো’, ২০১৬ বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ‘সোনা’, ২০১৭ সাফ গেমসে ‘সোনা’, ২০১৭ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ‘সোনা’, ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসে ‘সোনা’, ২০১৮ এশিয়ান গেমসে ‘সোনা’, ২০২১ অলিম্পিক্সে ‘সোনা’। ‘টোকিও অলিম্পিক্স ২০২০’-র আগে যে ছেলেটা পাঁচ পাঁচটা সোনা জিতেছে তাকে নিয়ে দেশে কোনো মাতামাতি নেই! তাকে কাগজের শিরোনামে দেখা যায় না, তার নাম পাড়ার কেষ্টদা বিষ্টুদার চায়ের দোকানে শোনা যায়না, ট্রেন,বাস,টোটো, অটো কোনো জায়গায় তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, ভাবা যায়!
বছর তেইশের আত্মপ্রত্যয়ী ছেলেটি কিন্তু লক্ষ স্থির করে ফেলেছে। ‘টোকিও অলিম্পিক ২০২০’। হয় এসপার নয় ওসপার! নিজেকে প্রমোট করার এরচেয়ে ভালো মঞ্চ হয় না। ফাইনালের দৌড় শুরু করেছে নীরজ। টিভির পর্দায় অগণিত চোখ। নীরজ দৌড়াচ্ছে, উল্কার গতিতে। আজ সে তার বর্শায় বিদ্ধ করবেই সমস্ত উপেক্ষা,বঞ্চনা, অনাদর,অনাগ্রহ। আজ সে সেই দেশের গণ প্রতিনিধি হয়ে এসেছে, যে দেশে একটা সত্যি কথা বলার জন্য প্রতি মিনিটে একজন মানুষ মরে, আজ সে সেই দেশের গণ প্রতিনিধি হয়ে এসেছে যে দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ দিনে দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায়না, ভিন রাজ্যে কাজে গেলে ছেলে বাবার কাছে ফেরে না, বাবা মায়ের কাছে ফেরে না, আজ সে সেই হতভাগ্য দেশের গণপ্রতিনিধি হয়ে এসেছে, যে দেশে সব আছে, শুধু শিক্ষা নেই, কারিগর নেই, জহুরি নেই, যোগ্যতা যেখানে অঙ্কমূল্যে বিচার্য হয়! মেধা যার প্রহসন মাত্র সার! নীরজের জ্যাভলিন যেন এই ঘূণ ধরা দেশটার সমস্ত স্টিটেমের মূলে গিয়ে সজোরে আঘাত করেছে। যেন এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে গড়া ঐ উড়ন্ত জ্যাভলিন বলতে চায়, একটু সুযোগ পেলে, একটু সহযোগীতা পেলে, উপযুক্ত আহার আর প্রশিক্ষণ পেলে গ্রাম বাংলার অলিতে গলিতে আরও কত নীরজের জন্ম হতে পারত! হতে পারত একটা মেসি, কিংবা টেন্ডুলকর! স্বপ্নকে মরতে দিলে হবে না। চেতিয়ে রাখতে হবে। কঠোর অনুশীলন আর অধ্যাবসায়ই লক্ষপূরণের এক এবং একমাত্র শর্ত।
‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’। সত্যিই তো! তাঁকে ছাড়া কোনো সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাফল্য অভিনন্দিত হতে পারে না। প্রত্যেক সোনাঝরা প্রভাতে রবি ঠাকুরের আনন্দ উপস্থিতি। সকলের ঊর্ধ্বে আকাশ আলোরিত করে উড়ছে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা! ভিক্ট্রি-স্ট্যান্ডে সোনার পরশ মেখে দাঁড়িয়ে সোনার নীরজ। ঠোঁটে জনগণমন…! এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী-ই বা হতে পারে! একজন অ্যাথেলেটিকের সারা জীবনের স্বপ্ন অন্তত একবার অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয়! সেখানে নীরজ! অলিম্পিকে সোনাজয়ী সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয়! এ বিস্ময় আমরা লুকাব কি করে! ২০১১-র ২রা এপ্রিলের পর ৭ই আগস্ট ২০২১, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার চোখটা চিকচিক করছে আনন্দে। সূর্যোদয়ের দেশে এ কোন সূর্যোদয়! এ কোন আত্মশক্তিতে বলীয়ান তারুণ্যের অভ্যুদয়! তবে কি অভিশাপ ঘুচলো…।