জয় রাধে ! জয় জয় রাধে !
শ্রীরূপ গোস্বামীর বিদগ্ধ মাধবের ঘটনা—-তখন শ্রীরাধারাণীর পূর্বরাগ দশা চলছে। দেবী পৌর্ণমাসীর অভিলাষ হল রাধারাণীর প্রেমকে একবার পরীক্ষা করার। তাই তিনি বললেন, “ওহে রাধে ! শোনো ! এই যে তুমি মনে মনে শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হবার বাসনা করছো, স্বপ্ন দেখছো (!)—তোমার এই বাসনা কোনদিনই চরিতার্থ হবে না। স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয় কোনমতেই। কারণ, তিনি তো মহা ঐশ্বর্যময়ী শ্রীকমলার হৃদয়লালিত ধন ! শ্রীলক্ষ্মীর সাধনার সম্পদ ! আর তুমি অতি সাধারণা। এক গোপিনী হয়ে কিনা সেই শ্রীকমলা-বাঞ্ছিত বস্তুকে নিজ বল্লভ বানাতে চাইছো ! এ তো অসম্ভব ,অবাস্তব ব্যাপার। তাই তাঁকে বরং ভুলে যাও । তাঁর প্রতি অনুরাগ ত্যাগ কর। এতেই তোমার মঙ্গল জানবে।”
দেবী পৌর্ণমাসীর কথাকে ব্রজে সকলেই খুব মান্যতা দেয়, সম্মান করে। তাই রাধারাণী বললেন, “হে দেবী, তোমার কথা তো সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বত্র শিরোধার্য । আমাকেও তাই তোমার কথা শুনতে হবে বৈকী ! তুমি যে বলছো কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ ত্যাগ করতে—আমি তাই করবো।”
পৌর্ণমাসী দেবী শুনে বললেন, “যাক বাঁচা গেল। ভালো হল।”
রাধারাণী বললেন তৎক্ষণাৎ, “না, না বাঁচা গেল না ! তোমার একটা আশীর্বাদের বিনিময়ে আমি এই অনুরাগ বর্জন করলাম।”
দেবী পৌর্ণমাসী শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “একটা আশীর্বাদের কি কথা (!) ,আমি তোমায় একশোটা আশীর্বাদ করছি। তুমি সতী-সাধ্বী রমণীকুলের শিরোমণি হও। সৌন্দর্য মাধুর্যের ধূর্য হও। সর্ব গুণে গুণান্বিতা হও। অতুলনীয় ঐশ্বর্যের অধিকারীণী হও। চিরতরে ধন্যা হয়ে শতায়ু হয়ে বেঁচে থাকো।”
রাধারাণী বললেন , “না, না তুমি তো তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী আশীর্বাদ দিয়ে চলেছ ! নিজের মর্জি মতোই যা মনে হয় বলে চলেছ ! আমার এতো আশীর্বাদের প্রয়োজন নেই। কেবল একটি আশীর্বাদই যথেষ্ট। পৌর্ণমাসী বললেন, “বেশ তো , কি চাও শুনি !”
তখন রাধারাণী বললেন ,আমায় তুমি এই আশীর্বাদ দাও যেন এখনই এই মুহূর্তেই মরে যাই আমি ! ” পৌর্ণমাসী বললেন, “বা রে ! এ আবার কেমন আশীর্বাদ! মরার আশীর্বাদ কেউ চায় নাকি ! এ তো অভিশাপ দেওয়া হয়ে যাবে। লোকে তো আমায় নিন্দা করবে এই আশীর্বাদ দিলে !”
রাধারাণী বলে চলেছেন– “হ্যাঁ ,আমি এক্ষুনি মরে যেতে চাই আর মরে গিয়ে ভৃঙ্গীর জন্ম প্রাপ্ত হতে চাই। এই আমায় আশীর্বাদ কর।”
পৌর্ণমাসী দেবী মনে মনে হাসছেন আর শ্রীরাধার প্রেমের রঙ্গ দেখছেন; অবাক হয়ে বললেন— “কেন , কী হবে ভৃঙ্গীর জন্ম প্রাপ্ত হয়ে, শুনি?
শ্রীরাধা বললেন, “যখন শ্যামসুন্দর গোচারণ করে ফেরেন তখন গোপসখারা বনফুল তুলে মালা গেঁথে তাঁকে যে মালা পড়িয়ে দেয় সেই মালা তাঁর কণ্ঠে দোদুল্যমান থাকে । আর তিনি তো তাঁর সখাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে ফেরেন, তখন তাঁর মুখসুবাস সেই মালায় লেগে মিশে যায় । আমি ভৃঙ্গী হয়ে সেই মালায় বসে তাঁর সেই মুখসুবাস আস্বাদন করব।শ্রীকৃষ্ণের দেহে আটটি কমল থাকে। দুটি হস্তকমল, দুটি পদকমল, দুটি নেত্রকমল, একটি নাভিকমল ও একটি বদনকমল । কেবল মালার সৌরভ বা মধুর আকর্ষণে তো ভৃঙ্গ- ভৃঙ্গীরা আসে না । শ্যামসুন্দরের ওই আটটি কমলের সৌরভাদি মধুরিমা আস্বাদন করতে তাদের আগমন হয়। এই মনুষ্য দেহ দ্বারা যদি শ্যামসুন্দরকে ভালবাসতে না পারি, তাঁকে অনুরাগপূর্ণ অন্তরে আলিঙ্গন না করতে পারি, তাঁর সেবায় যদি না লাগে সর্বাঙ্গ আমার , তবে এ দেহ থেকে কি লাভ ! তার থেকে বরং মরে যাই। মরে গিয়ে ভৃঙ্গীদেহ গ্রহণ করি। ক্ষণকালের জন্য হলেও তো ভৃঙ্গী হয়ে শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য আস্বাদন করতে পারবো ! এ কারণে তুমি ভৃঙ্গী হবার আশীর্বাদ প্রদান কর আমায়।”
দেবী পৌর্ণমাসী মুগ্ধ হয়ে গেলেন শ্রীরাধার অন্তরে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমানুরাগ উপলব্ধি করে । তিনি বেশ অনুভব করলেন এই পূর্বরাগের প্রেম যেমন তেমন প্রেম নয়, সাক্ষাৎ মহাভাবময়ীর প্রেম !
————-রাধে রাধে ।
সকল রাধাদাস্য-ভাবের ভক্তদের শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম এই অধমা ভজনহীনা রাধাবিনোদিনী দাসীর।
(রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক)