আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস, সপ্তদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
594

বিয়ের পাকা কথা । সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না, আস্বাদযুক্ত রান্নার রকমারি অয়োজন হবেই । দেরাদুন রাইস । ভেটকি মাছের ফিসফ্রাই । নিরামিশ মুগের ডাল । কাতলা মাছের কালিয়া । ট্যাংরা মাছের ঝাল । কষা মাংস । চাটনি ও পাঁপড় । সঙ্গে টক দই, বর্ধমান থেকে আনা সীতাভোগ এবং রাজভোগ ।
সৈকত আর খেতে পারছে না । বারে বারে ইমলির দিকে তাকিয়ে বললো, “আন্টি, আমি আর খেতে পারছি না ।“
দীপালির মামা সৈকতের উদ্দেশে বললেন, “তা বললে হবে না ভায়া । তুমি হচ্ছ এই বাড়ির ভাবী জামাই । তার উপর হাল্কা বয়স । তোমাদের বয়সটা হচ্ছে খাওয়ার বয়স । সুতরাং “খেতে পারছি না” স্লোগান বন্ধ রেখে মুখ বুজে খাও তো বাছা । আমরা তোমার সঙ্গে বসে আছি । তোমার খাওয়া শেষ হলে তবেই আমরা খাওয়া থেকে উঠবো ।“
খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রাম । বটব্যালবাবু দীপালির মামাকে বললেন,”আপনি এখানে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ । আপনি আমাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলে তবে আমি উঠতে পারি ।
সে কী মাস্টার মশাই । আপনি শিক্ষিত বিদ্বজ্জন । সমাজের গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত মানুষ । আপনাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া আমার শোভা পায় না । বরং আপনার সান্নিধ্য পেয়ে আমি ভীষণ খুশী ।
দীপালির মামা বললেন, “রৌদ্রের প্রখর তাপ । বেলা পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে আমরাও রওনা দেবো ।“
ইমলি বিনয়ভাবে দীপালির মামাকে বললো, “আজ আমাদের বাড়ি বেড়ান । আগামীকাল ফিরবেন ।“
থাকা সম্ভব হবে না । কেননা আগামীকাল আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে । সেখানে ডাক্তার দেখানোর দিন ধার্য করা আছে । ডাক্তারবাবু মাসে একদিন আসেন । সুতরাং আমরা সন্ধ্যার আগে মালডাঙা ফিরতে চাই । সবে কুটুম হলেন । এরপর অনেকবার বেড়াতে আসবো । তখন আপনারা বিরক্ত হয়ে উঠবেন ।
“কী যে বলেন । আপনারা আমাদের একান্ত আপনজন । যখন খুশী বেড়াতে আসবেন । বেড়াতে এলে বরং আমরা খুব খুশী হবো ।“ ইমলি দীপালির মামাকে কথাগুলো বললো ।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল ।
সৈকত বাড়ির রং করতে গিয়ে নাজেহাল । বাড়ি রং করতে গিয়ে তার টার্গেট ফেল । বাড়িটা রিপেয়ার করতে গিয়ে অনেক ভাঙাচোরা হয়েছে । তারপর আধুনিক পদ্ধতিতে ঘরের রং নির্বাচন । প্রত্যেক ঘরের আলাদা আলাদা রং । ফলে বাড়িটা সুন্দরভাবে সাজিয়েছে । ছেলের পছন্দতেই দীপালি খুশী । সৈকত নিজের মতো করে বাড়ি ঘর রিপেয়ার ও রং করলো । বাড়ির রং দেখে ছেলে ও মা ভীষণ আহ্লাদিত ।
রং হয়ে যাওয়ার পর সৈকত ঘরের ভিতরের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে মনোযোগ দিলো । আগেকারদিনের খাট পাল্টে সেই জায়গায় সেগুন কাঠের বক্স খাট ঘরে তুললো । আরও জিনিস যেমন ড্রেসিং টেবিল, আলনা, গোদরেজের আলমারী, সেগুন কাঠের বসার সোফা এবং দুখানি চেয়ার, ডাইনিং টেবিল ইত্যাদি আসবাবপত্র কেনার জন্য ঘরের শোভা বাড়লো ।
সৈকতের সাথে দীপালি ঘরের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে সুন্দরভাবে তাদের ঘর বাড়ি সাজালো । বাইরে থেকে বাড়িটার জৌলুশ চোখে পড়ার মতো । প্রতিবেশীরা সৈকতের বিয়ের খবরে উচ্ছ্‌সিত । গাঁয়ে দুজন পাশ করা ডাক্তার আসছে । এটা গাঁয়ের মানুষের কাছে স্বস্তির খবর । কেননা মালডাঙা গ্রামে বাইরের ডাক্তারবাবুরা চেম্বার করছেন । রাত্রিতে গাঁয়ের মানুষের শরীর খারাপ হলে ভাল ডাক্তার নেই । হাতুড়ে ডাক্তার একজন আছেন, তিনি ঝুঁকি নিতে নারাজ । গ্রামের মানুষ রাত্রিবেলায় অসুখ-বিসুখে খুব অসহায়তাবোধ করেন । সেই গাঁয়ে দুজন পাশ করা ডাক্তার । প্রতিবেশীরা সৈকতকে অনেক আগে বলে রেখেছেন, গাঁয়ে চেম্বার খুলতেই হবে । কিন্তু এখন পাশ করা ডাক্তারের সাথে বিয়ে হয়েছে শুনে তাঁদের দাবি, গাঁয়ে নার্সিং হোম চাই ।
সৈকত যদিও গাঁয়ের মানুষকে নার্সিং হোম খোলার বিষয়ে কথা দেয়নি, কিন্তু তাঁদের নিরাশও করেনি । গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে কিছু করার ব্যাপারটা সৈকতকে খুব ভাবায় । মালডাঙার মানুষ ঘরের ধানের ভাত খায়, অভাব নেই বললেই চলে । কিন্তু শিক্ষা দীক্ষায় তাঁরা অনেক পিছিয়ে । যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ ! বাসিন্দারা বাসের উপর নির্ভরশীল । গ্রামটির উন্নয়নের নিরিখে সৈকতকে খুব ভাবায় । অথচ গ্রাম উন্নয়নের নিরিখে তার চিন্তাভাবনা বড় বড় । তবুও গ্রাম উন্নয়নের ভাবনাটা সৈকত তার অন্তরে জিইয়ে রাখতে উদ্গ্রীব । যদি কোনোদিন সুযোগ ঘটে তখন তার ভাবনাটার বাস্তবায়ন ঘটাবে ।
এদিকে বাড়ি ঘর সারানো বা রং করার ইতাসের ইচ্ছা নেই । বলা ভাল বাড়ির কাজ করা এই মুহূর্তে তার সামর্থের বাইরে । মেশিন রানিং করতে অনেক টাকা ঋণ হয়েছিল । সেগুলো এখনও শোধ হয়নি । তার উপর মেয়ের বিয়ে । বাড়ির লোনের মাসিক কিস্তির টাকা শোধ করতে গিয়ে ইমলি হাতে বেতনের টাকা খুব কম পায় । বেতনের টাকায় আসানের পড়াশুনা । ফলে ইমলির পক্ষে টাকা জমানো সম্ভব হয়নি । তবুও একমাত্র মেয়ের বিয়ে, তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই । সৈকতের মতো জামাই পেয়ে তারা খুব খুশী । ইতাস আরও আহ্লাদিত, কারণ ছেলের পরিবারের হালহকিকৎ অনেক আগে থেকেই তার জানা । “দীপালির ছেলে সৈকত” জানার পর ইতাস নিশ্চিন্ত তার মেয়েটার যোগ্য জায়গায় বিয়ে হচ্ছে ।
ইতাসের হৃদয়ে আর একটা অতিরিক্ত শান্তি, কেননা মেয়েটা বিয়ে দেওয়ার সময় বাবা-মা সঙ্গে থাকছেন । বাবা-মাকে খুঁজে পেয়ে ইতাসের জীবনে দুশ্চিন্তার অবসান । তাঁদের শেষ বয়সে ইতাস ও ইমলি পাশে থাকতে পেরে তারা খুশীতে ভরপুর । তেমনি ইতাসের বাবা-মা দুজনে তাঁদের ছেলে, বৌমা ও নাতনীকে খুঁজে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত । দেশ ভাগের নির্মম করুণ পরিণতির শিকারের ক্ষত সহজেই শুকাবার নয় । ক্ষতটা যেমনি ইতাসের বাবা মায়ের জীবনে কষ্টজনক ছিল তেমনি ইমলিরা কীভাবে বাঁচবে, এই প্রশ্নটাও তাদের জীবনে কঠিন ছিল । জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাতের, চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে তারা আজ কুসুমগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা । তাদের কষ্টকর জীবনে এখন অনেক স্বস্তি । একমাত্র মেয়ের বিয়ে মহাধুমধামে দেওয়ার জন্য ইতাস ও ইমলি প্রস্তুত ।
বিয়ের দিন আসন্ন ।
দুই বাড়ির প্রস্তুতি তুঙ্গে । কুসুমগ্রামের মানুষ তাজ্জব । সেদিন লোকটা সব হারিয়ে ভিক্ষুকের ন্যায় ব্যাঙ্কের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় রাত কাটিয়েছে, আজ তাদের ঝা চকচকে বিশাল বাড়ি । সেই বাড়িতেই মেয়ের বিয়ে । মেয়ে আবার পাশ করা ডাক্তার । বিয়ে হচ্ছে পাশ করা ডাক্তারের সাথে । বিয়েতে কুসুমগ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নিমন্ত্রিত । কুসুমগ্রামের মানুষ যারা তাদের বাঁচার করুণ ও কষ্টকর সংগ্রাম কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরা বিস্ময়ে হতবাক ! স্বামী স্ত্রী দুজনে প্রচুর পরিশ্রম করার জন্য আজ তাদের ঘুরে দাঁড়ানো । এত বড় গ্রামে ওপার বাংলা থেকে বিতাড়িত এক ঘর মাত্র মানুষ । তারা নিঃস্ব অবস্থা থেকে যেভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলো সেটা এককথায় সাংঘাতিক । পরিশ্রমের এইরূপ উদাহরণ খুব বিরল !
তারপর …………?
তারপর দীপালি ইতাসকে ফোন করলো, “এখন কথা বলা যাবে ?”
যাবে, তবে আমাকে একটু আড়ালে যেতে হবে ।
আবার আড়ালে কেন ? আপনি আমার বেয়াই মশাই । আজ সবার সামনে কথা বলুন । কিছু দরকারি কথা আছে ।
আমি জানি তোমার কোনো দরকারি কথা নেই । তুমি ঝামেলা পাকাচ্ছো ?
না মশাই । আমি আপনার ভাল চাই ।
এবার ভাল কী চান, জানালে বাধিত থাকিব ।
কোনো ভাল কথা নেই । রবিবার সন্ধ্যায় বিয়ের আসরে দেখা হচ্ছে ।
“এটা কোন ধরনের ভদ্রতা ?” ইতাস বিস্ময়ে বললো ।
আমি যাচ্ছি সেটা মেয়ের বাবাকে আগাম জানিয়ে রাখলাম ।
বেশ করেছো । সেদিন সবাইকে নিয়ে খুব সাবধানে এসো । লগ্ন যেহেতু সন্ধ্যার দিকে সেহেতু আগে আগে রওনা দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত ।
যথা আজ্ঞা, বেয়াই মশাই । এবার ফোন রাখছি ।
রাখুন । শুভ রাত্রি ।
বিয়ের দিন প্রচুর বৃষ্টি । সকলের মুখে এক কথা, এটা পুষ্প বৃষ্টি । শুভ লক্ষণ । ব্যবস্থাপনা ভাল থাকায় নির্বিঘ্নে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হল । দুটো পরিবার খুশী । ইতাসের বাবা মায়ের চোখে জল । তাঁরা বারংবার কেঁদে কেঁদে বললেন, “আগের জন্মের পুণ্যির বলে আমরা দিদুর বিয়েটা দেখতে পারলাম । আমাদের আশীর্বাদ রইলো, নাতনী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক ।“
মহাধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ !
ইতাস এখন ফ্রী । ফ্রী থাকলে হবে ? মনের ভিতরে আসানের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । তাদের একমাত্র মেয়ে আসান । বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ায় ঘরটা বড্ড খালি খালি । ইমলিও কেমন যেন মনমরা । মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়ার পর নিত্যকার উচ্ছাস ইমলির আচরণে নেই । রান্না আর অফিস নিয়ে ব্যস্ত । ইতাসের বাবা মা প্রচণ্ডভাবে নাতনীর অভাববোধ করছেন । আসান চলে যাওয়ার পর ইমলিই বরং বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে । কিন্তু অফিসে গেলে বাড়িটা নিঝুম, নিস্তব্ধ । শুধুমাত্র আইসক্রিম কলের ঘ্যানঘ্যানানি আওয়াজ !
তারপর ইতাসের বাবা ইমলি ও ইতাসের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ঈশ্বর আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন । সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্যভাবে বর্ণনীয়, সেটা আমাদের পুরো পরিবারের মিলন । তাই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসাবে অষ্টম প্রহর নাম যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চাই । নামকীর্তনের মাধ্যমেই হবে আমাদের শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন । তবে এই অনুষ্ঠানটি হবে মিলন মেলার মতো । ঐ বাংলার লোকজনদের বিশেষভাবে ডাকা হবে ।“
বাবার ইচ্ছা ইতাসের কাছে আদেশের ন্যায় । সদ্য মেয়ের বিয়েতে অনেক খরচা হওয়া সত্বেও ইতাস পিছপা হল না । মাঘী পূর্ণিমার দিনটি অষ্টম প্রহরের পক্ষে খুব পুণ্যের । আসান ও সৈকতকে ডাকল ইতাস । সবাই মিলে জোর আলোচনায় । ঠিক হল পাঁচটি গানের দল আনা হবে । গানের দল সংগ্রহের ব্যাপারে গাঁয়ের ত্রিনাথবাবুর সাহায্য নেওয়া হবে । কেননা ত্রিনাথবাবুর বাড়ি প্রতি বছর শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে কীর্তন গানের আসর বসে । তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে নাম কীর্তনের দল এনে অনুষ্ঠান করেন ।
মাঘী পূর্ণিমার আগের দিন ভোর থেকে নাম কীর্তন শুরু হবে এবং চলবে সারাদিন ও সারারাত্রি এবং শেষ হবে মাঘী পূর্ণিমার ভোরে । তারপর নগর কীর্তন । নগর কীর্তন শেষে ভোগ আরতি । তারপর প্রসাদ বিতরণ । প্রসাদ হবে খিচুড়ি । আর আগে-পরে অন্যান্যদিন নিরামিষ আহার । এবার নিমন্ত্রণের পালা । সৈকত দায়িত্ব নিলো, নিজেদের স্বজাতির মানুষকে খুঁজে বের করে তাঁদের নিমন্ত্রণ করার । তবে এলাকাটা কাটোয়া, বেথুয়াডহরী, বনগাঁ ও বাঁকুড়ার দামোদরের চর । সৈকত জানতে পেরেছে, বাঁকুড়া জেলার রন্ডিয়া ব্রিজের আশেপাশে এমনকি পখন্না গ্রামের আশেপাশে প্রচুর ওপার বাংলার মানুষের আশ্রয় । বেথুয়াডহরীর কয়েকটা গ্রাম তৈরী হয়েছে ওপার বাংলার মানুষদের নিয়ে । যেমন পাটিকাবাড়ী, ইঞ্জিনপুর, সাহাপাড়া, ক্ষিদিরপুর, বীরপুর, খালপাড়, ইত্যাদি । বনগাঁ চত্বরে বনগাঁ ছাড়াও গোপালনগর, চাঁদপাড়া, ইত্যাদি । কাটোয়ায় নিমন্ত্রণ করার দায়িত্ব ইতাসের । সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো খিচুড়ি ভোগে গোবিন্দ ভোগের চাল ব্যবহার করার । ডালের ক্ষেত্রে সোনা মুগ প্রাধান্য, সঙ্গে অন্যান্য উন্নত মানের ডাল । নানান সবজি দিয়ে তরকারি । খাওয়ার শেষে মিষ্টি হিসাবে থাকবে বোদে ।
গানের দলের এবং বাইরের অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ত্রিপল টাঙিয়ে করা হবে । যেহেতু সময়টা শীতকাল, বর্ষা বাদলের সুযোগ নেই । সুতরাং ত্রিপল টাঙিয়ে ঘর বানিয়ে থাকার বন্দোবস্ত যথার্থ সিদ্ধান্ত । সব কিছু পাকা কথাবার্তা । সময় হাতে কম । সুতরাং শীঘ্রই কাজে নেমে পড়াটা সমীচীন ।
দীপালি রান্না ও পরিবেশনের দায়িত্ব নিলো । দীপালির মামার দেশ থেকে রাধুঁনী আসছে । পরিবেশনের জন্যে মালডাঙার কয়েকজন মানুষকে ঠিক করলো দীপালি । তারা স্বামী স্ত্রী মিলে কাজ করতে ইচ্ছুক । সমস্ত ব্যবস্থা পাকা ।
মাঘী পূর্ণিমার আগের দিন ভোরে শুরু হল নাম কীর্তন । প্রথমেই বেথুয়াডহরীর “অষ্টসখী সম্প্রদায়” । ঘুম থেকে উঠে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন অতিথি শ্রোতা হিসাবে বসে গেছেন । গ্রামের অনেক দূর পর্যন্ত মাইকের চোঙ । নাম কীর্তন চলছেঃ-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে ।
ভোর বেলায় নাম কীর্তন । সুতরাং ভীষণ শ্রুতিমধুর ।
ইতাসের বাবা শ্রোতাদের দলের সর্বাগ্রে । গানের আসরের ঠিক পাশে । গানের আসর সুন্দরভাবে সাজানো । মঞ্চের চারিদিকে কৃষ্ণের ফটো টাঙানো । পাশেই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি । ঠাকুরের মন্দিরটা ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছে । ইতাসের বাবা মা মনোযোগ দিয়ে গান শুনছেন । ইতাসের মনে আছে, ঐ বাংলায় তাদের গ্রামের নাম কীর্তনের সময় তার বাবা অবশ্যই যেতেন । মনোযোগ দিয়ে গান শুনতেন । কৃষ্ণনাম শ্রবণ করে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে তিনি মাঝে মাঝেই মূর্ছা যেতেন । এমনই ইতাসের বাবার কৃষ্ণ ভক্তি ।
বেলা দুটোর সময় প্রচুর মানুষের সমাগম । সেই সময় শান্তিনিকেতনের “মহাপ্রভু সম্প্রদায়” নাম কীর্তনে মত্ত । কীর্তনের সাথে সাথে উপস্থিত মহিলাদের মুহুর্মুহু উলুধ্বনি, শঙ্খ ধ্বনি । বয়স্ক মানুষেরা দুহাত তুলে হরি ধ্বনি দিচ্ছেন । ইতাসের বাবা গানের আসরে উঠে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলে বললেন, “সবাই প্রাণ খুলে বলুন কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে । কৃষ্ণনাম কেবলম ।“ তারপর কীর্তন মাঝে ইতাসের বাবার গড়াগড়ি । কৃষ্ণ নামে তখন তিনি বিভোর ।
সন্ধ্যাবেলায় প্রচুর ভক্তের আগমন । কুসুমগ্রাম ছাড়াও মন্তেশ্বর, সাতগাছিয়া, এমনকি বলাগড় থেকেও ভক্তরা এসেছেন । ইমলি ও সৈকত অতিথিদের আপ্যায়ন সামলাচ্ছে । কীর্তন শোনার পর প্রত্যেককে না খাইয়ে ছাড়ছে না । রান্নার কাজ সমানে চলছে । চায়ের কেটলি ও বিস্কুটের থালা নিয়ে দুজন মহিলা ভক্ত রাউন্ড দিচ্ছেন । আয়োজনের ত্রুটি নেই । আসান ঠাকুরের মন্দির ও গানের দল সামলাচ্ছে । গানের দলের গায়কদের গলায় ফুলের মালা ঠিকমতো দেওয়া, ধুনুচি জ্বালানো, প্রদীপের প্রজ্বলন, এইসব দিকে তার শ্যেন দৃষ্টি । আসানের জীবনে কীর্তন গান শোনার অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম ।
কৃষ্ণের নামকীর্তন শ্রবণে কুসুমগ্রামের মানুষ ধন্য । গ্রামবাসী ইতাসদের উদ্যোগকে ভূয়সী প্রশংসা করলেন । যত রাত্রি হচ্ছে, ভক্তের সমাগম কমতে থাকছে । রাত্রি দুটোর সময় আসরে জনা কয়েক ভক্ত ঘুমে ঢলে পড়ছেন । কিন্তু কীর্তনের আসর বন্ধ রাখা যাবে না । তাই কীর্তন সমানতালে চলছে । শ্রোতা কম থাকার জন্য ইতাসদের বাড়ির সবাই কীর্তনের আসরে বসে নাম গান শুনছে । ইতাসের বাবা মা কীর্তনের আসরে শুয়ে পড়লেন । তাঁরা আর জেগে থাকতে পারছেন না । রাত্রি তিনটে । আসরে শ্রোতা নেই বললেই চলে । মানুষের অসুবিধার কথা ভেবে মাইকের চোঙ বন্ধ । কীর্তন চলছে স্লো গতিতে । ইমলির চোখে ঝিমুনি । সারাদিন খাটাখাটুনি । ক্লান্ত শরীর । একমাত্র সৈকত ও আসান চোখ মেলে তাকিয়ে কীর্তন শ্রবণ করছে । চতুর্দিকে বিজলী বাতির আলো । কিন্তু ভক্তহীন কীর্তনের ফাঁকা আসর । গানের দল ঢিলেঢালাভাবে কীর্তন চালিয়ে যাচ্ছেন । ভোর পর্যন্ত কীর্তন বন্ধ রাখা যাবে না । সারাদিন ক্লান্তির কারণে ইতাস ও ইমলি, দুজনেই কীর্তনের আসরে ঘুমিয়ে পড়লো ।
তারপর রাত্রির শেষ প্রহরে কীর্তনের ফাঁকা আসরে জনৈক বুড়ো ও বুড়ির লাঠি ভর দিয়ে কীর্তনের আসরে প্রবেশ । সৈকতকে দেখেই বুড়ি বললেন, “বাবা, প্রসাদ পাওয়া যাবে ? আমাদের খুব খিদে । তোমাদের এখানে কীর্তনের কথা শুনে অনেকদূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি এক মুঠো খাবারের আশায় । একটু প্রসাদ খাওয়ালে আমরা দুটি প্রাণী ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচতাম । দুদিন না খাওয়া । ভিক্ষাও সেরকম জোটেনি । যেটুকু জুটেছিল তাতে ভাত খাওয়া সম্ভব হয়নি । বাছা ! একটু প্রসাদ দাও ।“
আসান বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে দেখে তার দাদু ঠাম্মির কথা মনে পড়ে গেল । তাঁরা এইরূপ ভিখারী বেশে ছিন্নমূল হয়ে ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েছিলেন । তাই সময় নষ্ট না করে ঝটপট রান্না ঘরে ঢুকলো । ভাত ও ডাল ছাড়া অন্য কোনো তরকারি নেই । ভাত ও ডাল গরম করে সেই সঙ্গে বেগুন ভেজে তাঁদের কলা পাতায় খেতে দিলো । বুড়ো বুড়ি পেট ভরে খেলেন । আসানের মাথায় হাত বুলিয়ে বুড়ি বললেন, “সৌভাগ্যবান হও মা ।“
তারপর গানের আসরে বসলেন । তাঁদের ক্লান্ত শরীর । কীর্তন গান শুনে দুজনের চোখে জল । গায়কেরা আবেগে বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে আলিঙ্গন করলেন । তখন ভোরের আলো চারিদিকে ফুটে উঠেছে । বাইরে থেকে আসা অতিথিরা ত্রিপলের ভিতর থেকে বেরিয়ে গানে আসরে ধীরে ধীরে এসে বসছেন । আর কিছুক্ষণের মধ্যে নাম গানের পরিসমাপ্তি ঘটবে । অষ্টম প্রহর শেষ হবে । ভোর পাঁচটা । সকাল ছটায় আসর ভাঙ্গবে । ইমলি ও ইতাস তখনও ঘুমোচ্ছে । বুড়ো বুড়ি আসরের এক কোনে বসে গান শুনছেন । আসান তাঁদের বলল, “আপনারা মনে করলে গানের আসরেই ঘুমিয়ে নিতে পারেন ।“
বুড়ো আসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কীর্তন শেষ হোক । তারপর বিশ্রামের কথা ভাববো । অনেকদিন পর কৃষ্ণনাম শোনার সৌভাগ্য হল ।“ বলেই বুড়ো বুড়ি দুজনেই ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করলেন ।
ভোরে পুনরায় কীর্তন জমে উঠলো । ইতাস ও ইমলির ঘুম ভেঙ্গে গেছে । তারা দাঁড়িয়ে কীর্তন করতে লাগলো । আর মাত্র পনের মিনিট বাকী । উপস্থিত সব শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে কীর্তনে মাতোয়ারা । ইমলি লক্ষ করলো, এক কোনে বসে থাকা দুজন বয়স্ক মানুষ উঠে দাঁড়াচ্ছেন না । অথচ তাঁদের চেহারার গঠনাকৃতি তার খুব চেনা মনে হচ্ছে । ইমলি চাইছে, কীর্তনের শেষ মুহূর্তে সব ভক্ত উঠে দাঁড়িয়ে কীর্তনে যোগ দিক । ইমলি ইতাসের কানে কানে বলল, “দ্যাখো তো, বৃদ্ধ বৃদ্ধা উঠে দাঁড়াচ্ছেন না কেন ?”
ইতাস খানিকটা বিরক্ত মুখে বলল, “বয়স্ক মানুষদের ছেড়ে দাও না ! দাঁড়িয়ে কীর্তন করতে তাঁদের অসুবিধা হতে পারে ।“
“তুমি বলতে না পারলে আমিই যাচ্ছি । তোমার সব ব্যাপারেই গড়িমসি । কুড়েমি আচরণ । সবাই দাঁড়িয়ে কীর্তন করছেন, সুতরাং তাঁরাও দাঁড়িয়ে কীর্তন করলে আসরটা মনে হবে বৃন্দাবন ধাম ।“ বলেই ইমলি গুটিগুটি পায়ে বৃদ্ধ বৃদ্ধার কাছে পৌঁছালো ।
ইমলির দুই চোখ বেয়ে অশ্রুধারা । সে কাদের দেখছে ? তাঁরা যে ইমলির বাবা মা । কীর্তনের মধ্যে ভক্তরা তখন দু-বাহু তুলে “হরি বল/ কৃষ্ণ কৃষ্ণ” করছেন । সেই “হরি বল” আওয়াজের মাঝে ইমলির কান্নার চিৎকার, “বাবা মা, তোমরা অবশেষে দেখা দিলে ।“
বুড় বুড়ি করুণ দৃষ্টিতে ইমলির দিকে তাকিয়ে ?
তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে কে কাঁদছে ? চিনতে না পেরে বৃদ্ধ ইমলিকে দুহাত দিয়ে তুলে দাঁড় করালো । তারপর ইমলিকে দেখে তাঁদের শুরু হল কান্না ! তাঁদের হারানো সাত রাজার ধন একমাত্র মেয়ে ইমলি । ইমলির মা বাবার কান্না থামানো বিষম দায় !
অষ্টম প্রহর শেষ হওয়ায় কীর্তন গানের তখন পরিসমাপ্তি ।
বাবা, মা ও মেয়ের অভূতপূর্ব মিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সমস্ত ভক্তদের চোখে জল । মিলন দৃশ্য দেখে ভক্তদের মাঝে তখন মুহুর্মুহু কৃষ্ণের ধ্বনি ।
ইমলি তার শ্বশুরকে ডেকে বলল, “আপনার পরামর্শমতো কৃষ্ণের নাম যজ্ঞ করার জন্য আমি আমার বাবা ও মাকে ফিরে পেলাম । স্বয়ং কৃষ্ণ ভক্তবৎসল । ভক্তের প্রতি স্নেহশীল । আমাদের মতো ভক্তের ডাকে তিনি সদয় হয়েছেন । স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বাবা মাকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন ।
ইতাসদের পরিবার এখন খুশীর আনন্দে বিহ্বল ।
——————–০————————
( সমাপ্ত )