বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, “দরিদ্রতা হল মানুষের ন্যুনতম জীবনযাত্রা মানের উন্নীত হওয়ার অক্ষমতা ।“ আমাদের দেশে দারিদ্র্যোর ব্যাপ্তি ও গভীরতা ভয়াবহ । জানা গেছে, জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে । সুতরাং আমাদের দেশের জনসংখ্যার নিরিখে দরিদ্রতার ব্যাখা অন্যরূপ । যেমন স্বল্প আয়, দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা যাকে বলে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্য ক্রয় করার অক্ষমতা, জনসংখ্যার চাপ বলা ভাল জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান দামস্তর ও মুদ্রাস্ফীতি, কৃষি উন্নয়নে ঘাটতি, আয় ও সম্পদের অসম বন্টন, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা, অপর্যাপ্ত সরকারি ভর্তুকি, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, দরিদ্রতার অন্যতম কারণ । তা ছাড়া পরিকল্পনা রূপায়ণের ব্যাপারে ত্রুটি বিচ্যুতি, ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা দেশের দরিদ্রতারও কারণ । দেখা যাচ্ছে দারিদ্রোর কারণ বহুবিধ । এখানে স্পষ্ট, উল্লিখিত কারণের মধ্যে যেমন আছে অর্থনৈতিক তেমনি আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক । সামাজিক ন্যায় বিচারের দৃষ্টকোন থেকে সরকারের প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য হল দারিদ্র্য দূরীকরণ । এই বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, দরিদ্রতা দূরীকরণে শুধুমাত্র সরকারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সমাজের সুশীল নাগরিকদের ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে ।
এবার আসছি গ্রামের অভাবী মানুষের হালহকিকতের দিকে । প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি নির্ভর । ৬৯% মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল । গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সরাসরি চাষে নিযুক্ত থেকে জীবিকানির্বাহ করেন । আবার অনেক মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত আনুষঙ্গিক কাজকর্মের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করে থাকেন । গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জমি নেই । কারও কিছু জমি থাকলেও সব জমিতে আবাদ হয় না । আবার অন্যদিকে কিছু জমিতে সারা বছর আবাদ হয় না । অভাবী হওয়ার আরও কারণ, সারা বছর সমানভাবে কাজ জোটে না । বাড়ির লোক রোগে পঙ্গু । খেটে খাওয়ার ক্ষমতা নেই । বাঁচার তাগিদে খেটে খাওয়ার জন্য যাদের যেতে হয় অনেক দূরে, সেই ক্ষেত্রে বাড়ির মহিলারাই ঘর সামলায় । তা ছাড়া চিরাচরিত পেশার সাথে যারা যুক্ত তাদেরও রোজদিন কাজ জোটে না, যার জন্য তাদের অনেকে নিত্য খাবারের যোগাড় করতে পারে না । অভাবী মানুষদের মধ্যে রোগবালাই লেগেই আছে । অসুখে ভাল চিকিৎসা করাতে পারে না । ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারে না । ফলে অল্প বয়সেই বাচ্চাদের কাজে পাঠাতে হয় । শীতের রাতে গরম কাপড় জোটে না । পয়সার অভাবে সময়মতো চাষ আবাদ করতে পারে না । বাড়িতে শৌচাগার নেই, মেয়েদের স্নানের কোনো আলাদা বন্দোবস্ত নেই । প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না । অভাবের কথার শেষ নেই । গ্রামের মানুষের দৈনদশা দূর করতে চাই সরকারি ও বেসরকারি সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনা ও তার নিঁখুত বাস্তবায়ন । তাতে যদি কিছুটা সুরাহা হয় ।
দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি কথা । দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলেও দরিদ্রতা দূর করা যায়নি । দেখা গেছে, দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারি উদ্যোগগুলি ছিল ইতিবাচক যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের গণবণ্টন ব্যবস্থা, দামের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, শ্রমিকদের জন্য ন্যুনতম মজুরি আইন প্রবর্তন, ঋণ সংস্কার ইত্যাদি । আমরা জানি, আমাদের দেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু হয় ১৯৫১ সালে । পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যেই ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন । দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা মাথায় রেখে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কিছু কিছু নীতি গৃহীত হয় । চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তৈরী হয়েছিল ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন সংস্থা (SFDA) এবং প্রান্তিক কৃষি ও কৃষি শ্রমিক সংস্থা (MFAL) । মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে মানুষের উন্নয়ন । সরকার ও পরিকল্পনা কমিশন যৌথভাবে চেয়েছিল অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের মাধ্যমে জনগনের মাথাপিছু আয় বাড়ানো । ফলে দারিদ্র্য দূরিকরণ সহজ হবে । কিন্তু পরিকল্পনায় বিভিন্ন কর্মসূচী নেওয়া সত্বেও দারিদ্র্য কমার লক্ষণ খুব কম । তখন পরিকল্পনা কমিশন “গরবী হঠাও” অভিযান চালু করে । সেইজন্য ন্যুনতম প্রয়োজন প্রকল্প গ্রহণ করে, যার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, ইত্যাদি । তারপর দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য যেসব উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী সরকারি উদ্যোগে নিয়েছিল নীচে উল্লেখ করা হল –
সুসংহত গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচী (IRDP)
জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান কর্মসূচী (NREP)
গ্রামীণ ভূমিহীন কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা কর্মসূচী (RLEGP)
শহরের শিক্ষিত যুবকদের জন্য স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রকল্প (SEEUY)
শহরের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান কর্মসূচী (SEPUP)
জহর রোজগার যোজনা (JRY)
নেহরু রোজগার যোজনা (NRY)
প্রধান মন্ত্রীর রোজগার যোজনা (PMRY)
কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প (EAS)
গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর্মসূচী (REGP)
স্বর্ণজয়ন্তী শহরী রোজগার যোজনা (SJRY)
স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা (SJSRY)
ইন্দিরা আবাস যোজনা (IAY)
প্রধানমন্ত্রীর গ্রামোদয় যোজনা (PMGY)
অন্তোদয় অন্ন যোজনা (AAY)
প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা (PMGSY)
জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প (NREGS)
মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প (MGNREGS)
এতসব সত্বেও দারিদ্য দূরীকরণ সম্ভব হয়নি ।
আমরা যদি বিশদে ভেবে দেখি, যেকোনো জাতির নিরিখে বিকাশ ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রথম তথা পূর্বশর্ত হল সমাজের সকল শ্রেণীর সমান তালে ক্ষমতায়ন । সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমান সুযোগ সুনিশ্চিত করা এবং সকলে যাতে সুফল পান সেদিকে লক্ষ্য রাখা । ক্ষমতায়নের নিরিখে আমরা মহিলাদের ক্ষমতায়নকে অস্বীকার করতে পারি না । যদিও এক্ষেত্রে সরকারি বন্দোবস্ত রয়েছে যেমন সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা, প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনা । আবার তপশীলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর জাতির ক্ষমতায়নের দিকটাও উল্লেখযোগ্য । সেখানেও সরকারি দৃষ্টিভঙ্গী না দিলে প্রাথমিক শিক্ষা, জীবিকানির্বাহের সুযোগ, আর্থিক বিকাশের সুযোগ ঘটবে না । সর্বোপরি জনগনের আর্থিক বিকাশের কথা ভেবে কিছু প্রকল্প তৈরী হয়েছে যেমন মুদ্রা ঋণ, ঝুঁকি মূলধন তহবিল প্রকল্প, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া, ইত্যাদি । এসবের মধ্যেও মানুষের আর্থিক দিক কতটা সুসংহত হচ্ছে সেটা ভাববার বিষয় ?
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই এখন সর্বাত্মক বিকাশের প্রশ্নে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টিকে প্রধান শর্ত হিসাবে দেখছে । কেননা প্রতিটি নাগরিক যদি তার উপার্জনকে আর্থিক সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করার মতো অবস্থায় থাকে তা হলে সেই সম্পদ ভবিষ্যতে উপার্জনের উৎস হয়ে উঠতে পারে । তাতে সারা দেশের আর্থিক বিকাশের গতি আসতে পারে । অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে সাথে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক ও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ।
দেশে চালু হয়েছে জাতীয় তপশীলি জাতি অর্থ ও বিকাশ নিগম ১৯৮৯ সালে, জাতীয় তপশীলি উপজাতি অর্থ ও বিকাশ নিগম ২০০১ সালে । তা ছাড়া রয়েছে জাতীয় সাফাই কর্মচারী অর্থ ও বিকাশ নিগম, জাতীয় অনগ্রসর শ্রেণী অর্থ ও বিকাশ নিগম, জাতীয় সংখ্যালঘু অর্থ ও বিকাশ নিগম, জাতীয় দিব্যাঙ্গ (ভিন্নভাবে সক্ষম) অর্থ ও বিকাশ নিগম, রাষ্টীয় মহিলা কোষ, ইত্যাদি সংস্থা । সরকারি উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য সমাজের দুর্বলতর শ্রেণীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া যাতে সর্বাঙ্গীণ আর্থিক বিকাশ ঘটে । দেশের প্রান্তিক এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে উদ্যোগ সংক্রান্ত দক্ষতার বিকাশ ঘটলে তাদের মধ্যে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটাটাই স্বাভাবিক । ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে ।
আমরা যদি গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার দিকে তাকাই, সেখানেও দেখতে পাই সাধারণ গরীব মানুষ উপার্জনের নিরিখে বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত । কৃষিক্ষেত্রে ধান কাটা, পাট কাটা, ইত্যাদি চাষবাস ছাড়াও মানুষ দুগ্ধ উৎপাদনে মনোনিবেশ করছে । ছাগল, শূকর প্রতিপালন করছে । মাছের চাষে তাদের খুব তোড়জোড় । উদ্যানপালন ইদানীং খুব জনপ্রিয় । বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র বানাচ্ছে । বই বাঁধাই একটা ভাল পেশা । এইভাবে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বন হওয়ার দিকে তাদের প্রয়াস অবিরত ।
সুতরাং পরিশেষে বলা যায়, দারিদ্র্য হঠাতে গেলে কাজ সৃষ্টির প্রতি নজর সর্বাগ্রে । তা ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশও অবশ্যাম্ভাবী । কেননা শিক্ষা দারিদ্র্য দূরীকরণে শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার । বর্তমান সময়টা হচ্ছে প্রযুক্তির যুগ । পুঁজি ও প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের উপার্জনের পথ সুগম করতে পারে । আর একটি কথা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া সমভাবে প্রয়োজন । তা ছাড়া দেখা গেছে ক্ষুদ্র অর্থায়নেও (যেটাকে বলে মাইক্রোফাইনান্স) মানুষের উপার্জনে সহায়তা হচ্ছে । আবার এখানে উল্লেখ করছি, সরকার ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দারিদ্র্য দূরীকরণের মহৌষধ । (তথ্যসূত্রঃ তথ্য সংগৃহীত ও যোজনা-৮/১৮)
—————-০—————